ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আরবদের স্বর্ণযুগে অনুবাদযজ্ঞ

রশিদ আত্তার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ৮ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আরবদের স্বর্ণযুগে অনুবাদযজ্ঞ

|| রশিদ আত্তার ||

প্রাচীনকালে ইউরোপীয় দর্শনের চর্চা ছিল মূলত গ্রিক ভাষায়। এমনকি রোমানরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দখল নেয়ার পর, মূর্তিপূজার চর্চা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসার পরও দর্শনচর্চা গভীরভাবে হেলেনিয়া সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। রোমের অগ্রগণ্য চিন্তাবিদ, যেমন- সিসেরো ও সেনেকা গ্রিক সাহিত্যে ডুবে ছিলেন। সিসেরো তার দার্শনিক নায়কদের শ্রদ্ধা জানাতে এথেন্সেও গিয়েছিলেন। রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস তার বিখ্যাত রচনা ‘মেডিটেশন’ গ্রিক ভাষাতেই রচনা করেছিলেন। তবে এসময় গ্রিক দার্শনিকদের রচনা ল্যাটিন ভাষায় সহজলভ্য ছিল না। অল্প কিছু রচনাই কেবল ল্যাটিনে অনূদিত হয়েছিল। তবে অন্য কিছু এলাকায় অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে গ্রিকভাষী বাইজান্টাইনরা মূল ভাষাতেই অ্যারিস্টটল ও প্লেটো পড়তে পারতো। অন্যদিকে আরব দুনিয়ার দার্শনিকরা হেলেনিয় বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিভাণ্ডারে প্রবেশ করেছিলেন। দশম শতকের বাগদাদে আরবি ভাষায় গ্রিক সাহিত্যে মানুষের যে অভিগমন ছিল তা আজকের দিনের ইংরেজিভাষী পাঠকদের সঙ্গে তুলনীয়। এই সমৃদ্ধ পরিস্থিতির জন্য কৃতজ্ঞতা দিতে হবে আব্বাসীয় খিলাফতকে। আব্বাসীয় আমলে অষ্টম শতকের মধ্যভাগে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আরবি ভাষায় অনুবাদের এক স্বর্ণযুগের আরম্ভ হয়েছিল। স্বয়ং খলিফা, তার পরিবার এবং রাজণ্যবর্গ এই অনুবাদযজ্ঞে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বাগদাদের প্রতিষ্ঠাকাল ৭৬২ খ্রিস্টাব্দ। হারুন আর-রশিদ খলিফা হয়েছিলেন ৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে। এবং এই কিংবদন্তী খলিফার সময়কালেই বাগদাদ গ্রিক সাহিত্যের আরবি অনুবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞানকে ইসলামী দুনিয়ায় প্রবেশ করানো। এই অনুবাদ কর্ম করার অর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য তখন ইসলামী দুনিয়ার ভালোভাবেই ছিল। ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত সিরিয়ার খ্রিস্টানদের মধ্যে গ্রিকভাষা প্রচলিত ছিল। তাই মুসলিম নেতারা যখন গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা আরবিতে অনুবাদের সিদ্ধান্ত নেন তখন তারা শুরুতে নির্ভর করেন এই সিরিয় খ্রিস্টানদের ওপর। অনেক সময় গ্রিক রচনা প্রথমে সিরিয় ভাষায় অনুবাদ হয়ে তারপর আরবিতে অনূদিত হতো। কাজটা কঠিন ছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। অন্যদিকে শুরুর দিকে অনেক দার্শনিক ধারণার জন্য উপযুক্ত আরবি শব্দ ছিল না। আব্বাসীয় শাসকরা ঠিক কী কারণে গ্রিক সাহিত্য আরবিতে অনুবাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? কোনো সন্দেহ নেই গ্রিক বিজ্ঞানের বাস্তব প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করছিলেন বিশেষত প্রকৌশল ও চিকিৎসা শাস্ত্রে। কিন্তু এটা পুরো উত্তর নয়। কারণ, অনুবাদের তালিকায় ছিল অ্যারিস্টটলের ‘মেটাফিজিকস’ ও প্লোটিনাসের ‘এনিডস’ । গ্রিক-আরবি অনুবাদ পর্ব নিয়ে বিশেষজ্ঞ দিমিত্রি গুটাস মনে করেন, এই অনুবাদ কর্মের পেছনে কারণটি ছিল রাজনৈতিক। খলিফারা পারস্য ও বাইজানটিয়ান সংস্কৃতির বিপরীতে নিজেদের আরবি সংস্কৃতির প্রভাব গড়ে তুলতে চাইছিলেন। আব্বাসীয় শাসকরা দেখাতে চাইছিলেন যে, তারা গ্রিকভাষী বাইজানটিয়ানদের চেয়েও ভালোভাবে হেলেনিয় সংস্কৃতিকে বহন করতে সক্ষম।

অন্যদিকে নিজেদের ধর্মচর্চা বিকশিত করতে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা অনেক প্রয়োজনীয় উপাদান খুঁজে পেয়েছিলেন গ্রিক রচনায়। এই সম্ভবনাকে প্রথম দেখতে পেয়েছিলেন আল-কিন্দি, যিনি ইসলামি দুনিয়ার প্রথম আরবিভাষী দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। তার মৃত্যু হয়েছিল ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে। আল-কিন্দি দেখেছিলেন কীভাবে আরব খ্রিস্টানরা গ্রিক সাহিত্যকে আরবিতে অনুবাদ করছে। কিন্তু সমস্যা হলো অ্যারিস্টটলের ‘মেটাফিজিকস’ এর আরবি অনুবাদ ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না আবার প্লোটিনাসের রচনার অনুবাদে অনেক বহিরাগত শব্দ ঢুকে পড়েছিল। দার্শনিক রচনার অনুবাদ যে কোনো যুগেই কঠিন কাজ, এমনকি এখনও। ভাষা ও বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য না থাকলে যথার্থ অনুবাদ সম্ভব নয়। গ্রিক ও আরবি শব্দে- অর্থ, বিভিন্ন ধারণার অস্তিত্ব নিয়ে পার্থক্য ছিল। প্লোটিনাসের অনুবাদে যথেচ্ছা হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল আব্রাহামিয় একেশ্বরবাদী ধারণার সঙ্গে সাযুজ্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে।

এসবের সঙ্গে আল-কিন্দির কী সম্পর্ক? তিনি নিজে তেমন অনুবাদ করেননি এবং তিনি ভালো গ্রিকও জানতেন না। লিপিবদ্ধ তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায় তিনি প্লোটিনাসের আরবি অনুবাদ সম্পাদনা করেছিলেন। এবং এটা করতে গিয়ে তিনি নিজের অনেক ধারণাকেও সেখানে যুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্দি ও তার সহযোগীদের ধারণা ছিল যথার্থ অনুবাদ মানে ‘সত্য’কে তুলে ধরা, মূল রচনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকলেই হবে না। এখনো কিন্তু আল-কিন্দির গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে না! এবার তাহলে সেই অধ্যায়ে প্রবেশ করা যাক। কিন্দি কেবল গ্রিক রচনার অনুবাদের সম্পাদনা করেই থেমে থাকেননি। তার অনেক মৌলিক রচনা রয়েছে। এসব অনেক রচনাই তিনি চিঠি আকারে তার পৃষ্ঠপোষকদের লিখেছেন, যাদের মধ্যে আছেন স্বয়ং খলিফা। এসব চিঠিতে তিনি গ্রিক চিন্তার শক্তি ও গুরুত্ব সম্পর্কে প্রাপকদের অবহিত করেছেন। তিনি এটাও বলেছেন যে, গ্রিকদের চিন্তা ইসলামের দর্শন কাজে আসবে। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায় আল-কিন্দি যেন ছিলেন হেলেনিয় দর্শনের প্রচারক। তবে তিনি সেই প্রাচীন গ্রিক গুরুদের অন্ধ অনুকরণ করেননি। তিনি বরং গ্রিক ধারণাকে আরবে সমন্বয় করে নিয়েছিলেন নিজের সৃষ্টিশীলতার প্রয়োগ ঘটিয়ে। দিমিত্রি গুটাস মনে করেন, দার্শনিক রচনার অনুবাদ করতে গিয়ে কীভাবে দর্শন নিজেই বিকশিত হয় সেটা করে দেখিয়েছিলেন আল-কিন্দি।

গ্রিক সাহিত্য থেকে এবার অন্য দিগন্তে উঁকি দেয়া যাক। প্রথম দুই আব্বাসীয় খলিফার চাচা ইসা ইবনে আলীর অধীনে কাজ করতেন এক পারস্যবাসী, যার নাম আবু মুহাম্মদ ইবনে আল-মুকাফা। এই মুকাফা ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলিম। অনেকে তার ইসলাম ভক্তির বিষয়ে সন্দেহও প্রকাশ করেন।  এই আল-মুকাফা একটি পাহলভী (ফার্সির আদি রূপ) গ্রন্থ ‘কালিলাগ ওয়া-দিমাগ’ আরবিতে অনুবাদ করেন। এখানে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে যে, গ্রন্থটি মূলত বৌদ্ধ সাহিত্য। এই গ্রন্থ ভারত থেকে পারস্যে নিয়ে গিয়েছিলেন খ্রিস্টানরা। এরা ভারতে এসেছিলেন ওষুধ খুঁজতে, ফেরার সময় আলোচ্য গ্রন্থ এবং দাবা খেলা সঙ্গে নিয়ে যান। আল-মুকাফা আরবি অনুবাদটি ছিল ক্লাসিকাল আরবি ভাষা। সেই অনুবাদ অক্ষতভাবেই এখনো আরবে বিদ্যার্থীরা অধ্যয়ন করেন। প্রচলিত আছে ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্তের ‘সিদ্ধান্ত’ আরবিতে অনূদিত হয়েছিল ‘সিন্ধহিন্দ’ নামে । বলা হয় এই কর্মটি সম্পাদিত হয়েছিল আল-মনসুরের আমলে। হারুন আর-রশিদ এলুসিডের ‘ইলিমেন্টস’ এবং ক্লডিয়াস টলেমির ‘মিগল’ এর অনুবাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে আরবরা আরবি আনুবাদের মিগলের আগে আল যুক্ত করেছিল, শেষমেষ মিগল হয়ে যায় ‘আল-মেজিস্ট’। ইয়াকুবির ৮৯১ খ্রিস্টাব্দের রচনাতে আল-মেজিস্টের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইয়াকুবি লিখেছেন, আল-মেজিস্টের অর্থ ‘শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ’। আরবিতে গ্রন্থটি হলো ‘কিতাব আল-মাজিস্তি’। হারুন আর-রশিদ নির্দেশ দিলেও কিতাব আল-মাজিস্তির অনুবাদ তার মৃত্যুর পর সম্পন্ন হয়েছিল, অনুবাদ করেছিলেন আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ইবনে মাতার আল-হাসিব। তিনি ৮২৭ খ্রিস্টাব্দে এই অনুবাদ সম্পন্ন করেছিলেন। এলুসিডের ইলিমেন্টসের অনুবাদও তিনি করেছিলেন। তবে আরেকটি প্রচলিত উৎস মতে, ‘কিতাব আল-মাজিস্তি’র আরবি অনুবাদ করেছিলেন এক ইহুদী- সল ইবনে রাব্বান আত-তাবারি। বলা হয় তাবারি খলিফা হারুন আর-রশিদের দরবারে হাজির হয়ে তার জন্য এই অনুবাদ সম্পন্ন করেছিলেন। এই তাবারি ছিলেন মারের অধিবাসী এবং পাণ্ডিত্যের জন্য খ্যাতিমান। এখানে উল্লেখ্য গ্রিক বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত অনেক টার্মের আরবি প্রতিশব্দ ছিল না। তাই শুরুর দিকে অনুবাদের সময় কেবল গ্রিক টার্মগুলোর জন্য লিপির রূপান্তর করা হতো। কিন্তু তারপর নিখুঁতভাবে জ্ঞান আর্জনের জন্য কৃত আরবি অনুবাদগুলো সম্পাদনা শুরু হয়। এবং মূল বিষয়ে গ্রিক টীকাভাষ্যগুলোও অনুবাদ শুরু হয়।

হারুন আর-রশিদের উদ্যোগে আরবি ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় নবযুগের সূচনা হয়েছিল। এতে অনেক অভিজাতরাও পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। এদের মধ্যে সবাই যে বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এমনটা করেছিলেন তা নয়, বরং অনেকটা মুখ রক্ষার্থে এ উদ্যোগে শামিল হয়েছিলেন। তবে দরবারের বাইরে এই বিজ্ঞানচর্চা তেমন প্রভাব রাখতে পারেনি কারণ আরবের সাধারণ মুসলিমরা মূলত ধর্মীয় গ্রন্থ নিয়েই মাথা ঘামাতো। হারুন আর-রশিদের মৃত্যু হয় ৮০৮ খ্রিস্টাব্দে। এরপর সাম্রাজ্য তার দুই পুত্রের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। আল-আমিন ও আল-মামুন দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। রাজত্ব দখলেও সে যুদ্ধে আল-মামুন জয়ী হন। আল-মামুনের জ্ঞান চর্চা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ইতিহাসে তিনি খ্যাত। মারের হেলেনিয় সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার কারণে তিনি উদারতা অর্জন করেছিলেন। ধর্মীয় তর্কে তিনি স্বাধীনতা প্রয়োগ করতেন। এমনকি একবার এক সঙ্গী তাকে ‘অবিশ্বাসীদের শাহজাদা’ বলেও সম্বোধন করে বসেছিল। মামুনের মা ছিলেন পারসীয় এবং তিনি বিয়েও করেছিলেন পারস্যের কন্যা। এভাবে বাগদাদের মানুষের সহজাত গোঁড়ামি তাকে স্পর্শ করেনি। মামুন যুক্তিবাদী মুতাজিলা দর্শন দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। গ্রিক বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার আরব অনুবাদকদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট নামটি হচ্ছে হুনায়ান ইবনে ইশাক আল-আবাদি (মৃত্যু ৮৭৩/৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন হিরার অধিবাসী এবং এক খ্রিস্টান রসায়নবিদের সন্তান। হুনায়ানের জীবনের এক দারুণ ঘটনা জানা যায়। তরুণ বয়সে তিনি ইবনে মাসাওয়াহ-এর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে যান। কিন্তু তিনি তার শিক্ষককে এতো প্রশ্ন করতেন যে একদিন মাসাওয়াহ ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, “হিরার মানুষ ওষুধ সম্পর্কে এতো জেনে কী করবে? তুমি বরং রাস্তায় দাঁড়িয়ে টাকা বদলানোর ব্যবসা করো।”কাঁদতে কাঁদতে মাসাওয়াহয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে হুনায়ান গ্রিক শিখতে চলে যান। এবার বসরায় আরবি শেখেন। এরপর তিনি বাগদাদে জিবরাইলে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। এরপর তিনি খলিফা মামুনের দরবারে হাজির হন। মামুন তার জগদ্বিখ্যাত ‘দার আল-হিকমা’র দায়িত্ব হুনায়ানের হাতে অর্পণ করেন। এই ‘দার আল-হিকমা’য় গ্রিক বিজ্ঞান রচনা আরবি অনুবাদ সম্পাদিত হতো। হুনায়ানের তত্ত্বাবধানে গালেন, হিপ্পোক্রেটাস, টলেমি, এলুসিড, অ্যারিস্টটলসহ আরো গ্রিক মহারথীদের রচনা আরবিতে অনূদিত হতে শুরু করে। মাসাওয়াহ তার ভুল বুঝতে পেরে হুনায়ানের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগান। হুনায়ানের কাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার চিকিৎসাবিজ্ঞানের গ্রিক রচনাগুলোর অনুবাদ। যার মাধ্যমে আরবের বিদ্যার্থীরা এই জ্ঞানের ভাণ্ডারের সন্ধান পান।

৯০৮ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান পাদ্রী ইউসুফ আল-খুরি আর্কিমিডিসের কিছু কাজ অনুবাদ করেন। গালেনের ‘দে সিম্পলিসিবাস টেম্পারামেন্টিস এট ফ্যাকালটাটিবাস’ও তিনি অনুবাদ করেন। কাছাকাছি সময়ে আরেক খ্রিস্টান আরব কুস্তা ইবনে লুকা অনুবাদ করেন হিপসিক্লেস। এই অনুবাদ সম্পাদনা করেন আল-কিন্দি। লুকা অনুবাদের তালিকায় আরো ছিল-থিয়োডোসিয়াসের ‘এসফায়েরিকা’, হেরনের ‘মেকানিকস’, থিওফ্রাস্টাসের ‘মেটিওরা’ প্রভৃতি। আবু বিশর মাত্তা ইবনে ইউনুস (মৃত্যু ৯৪০ খ্রিস্টাব্দ) অনুবাদ করেছিলেন অ্যারিস্টটলের বিখ্যাত ‘পোয়েটিকা’ । এছাড়া, আরো অনেক অনুবাদক আরবের সেই স্বর্ণযুগে গ্রিক সাহিত্য আরবি ভাষায় অনুবাদ করছিলেন।

উনিশ শতকের শুরুর দিকে ফরাসি তরুণ জ্যাঁ শাপলিঁও প্রচীন মিশরের হায়ারোগ্লিফিক অনুবাদ করে দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিলেন। তবে শাপলিঁওর আটশ বছর আগে এক আরব অনুবাদক হায়ারোগ্লিফিকের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছিলেন। দশম শতকে ইরাকের ইবনে ওয়াহশিয়া আল-নাবাতি লিখেছিলেন ‘কিতাব শউক আল-মুস্তাহাম ফি মারিফাত রুমুজ আল-আকলাম’ (প্রচীন বর্ণমালা ও হায়ারোগ্লিফিকের ব্যাখ্যা)। অস্ট্রিয়ার পণ্ডিত জোসেফ হ্যামার ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়াহশিয়া কাজ ইংরেজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। মূলত সপ্তম শতকে মুসলিমরা মিশরে হাজির হওয়ার মাধ্যমে পিরামিড, হায়ারোগ্লিফিক নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। দ্বাদশ শতকের আরব ভূগোলবিদ মুহাম্মদ আল-ইদরিসি লিখেছেন আইয়ুব ইবনে মাসলামা নবম শতকে হায়ারোগ্লিফিকের রহস্য উন্মোচন করেছিলেন। আবারো ফিরতে হবে খলিফা মামুনের কাছে। মামুন ৮৩১ খ্রিস্টাব্দে মিশর সফর করেন। তখন মাসলামা খলিফাকে পিরামিড গাত্র ও কিছু এপিটাফের লেখা অনুবাদ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হায়ারোগ্লিফিক নিয়ে মাসলামার কাজগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তথ্যসূত্র :

‘হাউ গ্রিক সায়েন্স পাসড টু দি আরবস’, ডি লেসি ও’ লিয়ারি

‘আ লিটারেরি হিস্টরি অব দি আরবস’, আর. এ. নিকলসন




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়