ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

চিতলমারী থেকে রিও অলিম্পিকে

আমিনুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৩, ২৬ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চিতলমারী থেকে রিও অলিম্পিকে

রিও অলিম্পিকে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নিতে যাওয়া দেশসেরা দৌড়বিদ মেজবাহ আহমেদ

আমিনুল ইসলাম : প্রত্যেক মানুষের জীবনে ‘প্রথম’ সবকিছুই অন্যরকম। জীবনের ‘প্রথম’ জিনিসগুলো রক্ত কণিকায় জোয়ার আনে। চোখের কোণায় জমে থাকা লবণাক্ত জলের কণাকে গতিশীল করে।

জলের ধারা হয়ে কপোল ভিজিয়ে দেয়। স্মৃতির মণিকোঠায় স্বমহিমায় ভাস্মর হয়ে থাকে ‘প্রথম’ সবকিছু। জীবনের আর দশটি ঘটনার চেয়ে এই ঘটনার আলাদা গুরুত্ব পায়। থাকে আলাদা আবেদন।

 

আসন্ন রিও অলিম্পিকে অংশ নিতে যাওয়াটা দেশের দ্রুতমানব মেজবাহ আহমেদের কাছেও তেমন কিছু। অনিশ্চয়তার দোলাচল থেকে শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়তার স্বারক ওয়াইল্ড কার্ড পেয়েছেন। মাঝপথে থেমে যাওয়া অ্যাথলেট মায়ের ও কখনো অলিম্পিকে খেলতে না পারা কোচের বহুদিনের লালিত স্বপ্নকে ব্যাটন বানিয়ে ১ আগস্ট ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে উড়াল দিবেন তিনি।

 

বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে ‘গ্রেটেস্ট শোন অন আর্থ’ খ্যাত অলিম্পিক গেমসে যাওয়া মেজবাহ আহমেদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির জেষ্ঠ্য সহ-সম্পাদক আমিনুল ইসলাম। মেজবাহর স্বপ্ন, আশা, প্রত্যাশা আর লক্ষ্য উঠে এসেছে সেখানে। সেগুলোই রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকার আকারে তুলে ধরা হল :

 

প্রশ্ন : ক্রিকেটার কিংবা ফুটবলার না হয়ে দৌঁড়বিদ হলেন কেন?
মেজবাহ : আমি আসলে পারিবারিকভাবেই অ্যাথলেট। আমাদের পরিবারের সবাই খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। আমার মাও একজন অ্যাথলেট ছিলেন। তার ইভেন্ট ছিল ১০০ মিটার ও দীর্ঘ লম্ফ। আমার মা হয়তো অনেক দূরে যেতে পারেননি খেলাধুলায়। মাঝপথেই ছেড়ে দিতে হয়েছে। আম্মুর ইচ্ছা ছিল আমি যেটা পূরণ করতে পারিনি সেটা আমার ছেলেকে কিংবা মেয়েকে দিয়ে পূরণ করতে পারি। মূলত মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্যই অ্যাথলেটিকসে আসা।

 

প্রশ্ন : আপনার শুরুটা কিভাবে?
মেজবাহ : আমি যখন বাগেরহাটে স্কুল লেভেলে পড়াশুনা করতাম তখন থেকেই বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নিতাম। ভালো করতাম। এমনকী ঢাকায় এসেও ভালো করতাম। তখন আমার স্কুলের স্যারেরা বললেন তোমার ভালোর জন্য বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া উচিত। তুমি আমাদের স্কুলে থাকলে হয়তো আমাদের স্কুলের সুনাম হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হল তোমার ক্যারিয়ার। তারপর আমি বিকেএসপিতে ভর্তি হই। সেখানে কাফি স্যারের তত্ত্বাবধানে অনুশীলন করি। উনি আমাকে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেন। আমার এতদূর আসার পেছনে কাফি স্যারের অবদান অপরিসীম। তার সহচর্য ছাড়া আমার পক্ষে এতদূর আসা সম্ভব হত না।

 

 

প্রশ্ন : এবারই আপনার প্রথম অলিম্পিক। অনুভূতিটা কেমন?
মেজবাহ : আসলে অনুভূতিটা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। কতোটা খুশি বা কতোটা আনন্দ লাগছে। আমি আসলে সবার স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছি। আমার কোচ কখনো অলিম্পিকে খেলতে পারেননি। তার ইচ্ছা ছিল আমার একজন ছাত্র অলিম্পিকে খেলুক। তার স্বপ্নটা পূরণ হচ্ছে। মায়েরও ইচ্ছা ছিল আমার ছেলে অলিম্পিকে খেলুক। তার স্বপ্নও পূরণ হচ্ছে। আমার অলিম্পিকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে যেখানে সবার স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাচ্ছে, সেটার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

 

প্রশ্ন : অনিশ্চয়তার মধ্য থেকে ওয়াইল্ড কার্ড পেয়েছিলেন। অপেক্ষার এই সময়টা কিভাবে কেটেছে?
মেজবাহ : আসলে একটা সময় তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সবাই বলাবলি করছিল এবার অ্যাথলেটিকস থেকে কেউ যেতে পারবে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সুযোগ পেয়েছি। আসলে এটা সম্ভব হয়েছে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম চেঙ্গিস স্যারের জন্য। তিনি কর্তৃপক্ষকে মেইল করে বলেছিলেন আমার ফেডারেশনের কেউ অলিম্পিকে অংশ নিতে পারবে না কেন? সমস্যা কোথায়? তখন তারা জানায় যে আপনার ফেডারেশন থেকে অ্যাথলেট অংশ নিতে পারবে। পরে অলিম্পিক ফেডারেশন থেকে ওয়াইল্ড কার্ড পাঠায়। আমি মনে করি ইব্রাহিম চেঙ্গিস স্যারের কারণেই আমরা প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে যেতে পারছি।

 

প্রশ্ন : অলিম্পিকে আপনার লক্ষ্য কী?
মেজবাহ : অলিম্পিকে আমার লক্ষ্য নিজের সেরা টাইমিংটা করা। এখন আমার সেরা টাইমিং ১০.৭৫। আমি এটাকে ছাড়িয়ে যেতে চাই।

 

প্রশ্ন : স্প্রিন্টারে আপনার আদর্শ কে?
মেজবাহ : এক কথায়, উসাইন বোল্ট।

 

প্রশ্ন : এর আগেও অনেক দেশে খেলেছেন আপনি। তার মধ্যে স্বরণীয় কোনো ঘটনা যদি বলতেন।
মেজবাহ : ২০১৩ সালে রাশিয়ায় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে উসাইন বোল্টকে সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়। আমি মনে করি সেটাই আমার স্বরণীয় ঘটনা। একই মাঠে আমি ও উসাইন বোল্ট খেলেছিলাম। আমার সব থেকে ভালো লাগছে উসাইন বোল্টের ফিনিশিং। একজন অ্যাথলেট এতো সুন্দর ফিনিশিং কিভাবে দেয়! সেটা ভেবে আমি এখনো বিস্মিত হই। ৯৫ মিটার পর্যন্ত তারা সমান-সমান। শেষ পাঁচ মিটারের মধ্যে সবাইকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে যাওয়াটা অসাধারণ কিছু। আমি টাচ লাইনের পাশে বসে তার ফিনিশিংটা দেখেছিলাম। সেটা এখনো আমার চোখে ভাসে। এখনো আমি সেটা ভেবে মুগ্ধ হই।

 

 

প্রশ্ন : দেশের বাইরে আপনার সেরা সাফল্য কোনটা?
মেজবাহ : দেশের বাইরে আমার সেরা সাফল্যে ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায়। সেখানে আমি সেরা আটে উঠেছিলাম। ওখানে আমি ট্রিপল জাম্বে সেরা টাইমিং করি। আর সবশেষ সাফ গেমসে সেরা টাইমিং করি।

 

প্রশ্ন : দেশের বাইরে গেলে কাকে বেশি মিস করেন?
মেজবাহ : বাবা-মাকে মিস করি। ভাই-বোনদের মিস করি। যদিও এর আগেও বিদেশে গিয়েছি আমি। কিংবা ছোটবেলা থেকেই আমি বাইরে। তারপরও কেন জানি বাইরে গেলে মাকে বেশি মনে পড়ে।

 

প্রশ্ন : যারা চায় আমাদের দেশ থেকেও একজন উসাইন বোল্ট হোক। তাদের উদ্দেশ্য আপনার কী বলার আছে?
মেজবাহ : আসলে সবার চাওয়া পূরণ করতে আমি চেষ্টা করব। তার পাশাপাশি ফেডারেশন যদি আমাকে সাহায্য করে। বা অলিম্পিক ফেডারেশন সহায়তা করে। ভালো একটি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। তাহলে আমি হয়তো আমার নিজের চাওয়া পূরণ করার পাশাপাশি সবার চাওয়াটাও এক সময় পূরণ করতে পারব।

 

প্রশ্ন : আপনি দেশসেরা দৌঁড়বিদ। মুস্তাফিজ দেশসেরা বোলার। বিষয়টা কিভাবে দেখেন?
মেজবাহ : এই বিষয়টা ভেবে আমি নিজেও অবাক হই। আসলে ভালো ভালো অ্যাথলেট বলেন, ভালো ভালো খেলোয়াড় কিংবা ক্রিকেটার বলেন- সব আমাদের খুলনা অঞ্চল থেকে উঠে আসছে। মুস্তাফিজ খুব ভালো একজন বোলার। আমি দেশের চারবারের দ্রুতমানব। আমাদের ওই অঞ্চলে কেমন জানি আলাদা একটা স্পোর্টসের ছোঁয়া আছে। এখান থেকে শুধু অ্যাথলেটিকস না, অন্যান্য খেলোয়াড়রাও উঠে আসছে। অঞ্চল ভিত্তিকভাবে খুলনা বিভাগের ছেলে-মেয়েরা খুব ভালো করতেছে। দেশের দ্রুতমানবী শিরিন, সেও কিন্তু ওই অঞ্চলের!

রাইজিংবিডিকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মেজবাহ : আপনাকেও ধন্যবাদ। পাশাপাশি দেশের সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুলাই ২০১৬/আমিনুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়