ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

পাহাড়ি ঝিরিতে গরম পানি

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাহাড়ি ঝিরিতে গরম পানি

আজকের পথ বেশ লম্বা। আমরা ভোরেই রওনা দিলাম। পথটা যেমন লম্বা তেমনি বিপজ্জনক। আমাদের গাইড জয় মাল্লা আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন- পথে বেশ কয়েকটি জায়গায় ল্যান্ড স্লাইড জোন আছে। যার মধ্যে দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ল্যান্ড স্লাইড এলাকায় কোনো অবস্থাতেই দাঁড়ানো যাবে না। যত দ্রুত সম্ভব সেই বিপজ্জনক এলাকা পার হয়ে যেতে হবে। আমরা অবশ্য বেশ ভালোভাবেই সেই এলাকা পার হয়ে গেলাম। শুনলাম গত বছর একসঙ্গে ১৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন এই পথে পাহাড় ধ্বসে। যত এগিয়ে চলছি প্রকৃতির রূপ ততই বৈচিত্র্যময়। দিনের শুরুতেই অনেকগুলো ঝরনা দেখা হয়ে গেছে। কম করে হলেও প্রায় ১০-১৫ টি ঝরনা দেখেছি।

একটা সময় আমরা চলে এলাম বিখ্যাত তাতোপানি। নুর ভাই এর কথা আগেই বলেছিলো। তখন বিশ্বাস হয়নি। পাহাড়ের ভেতর থেকে গরম পানি আসে! সেই তাতোপানির কাছে এখন দাঁড়িয় আছি। সবার আগে আমি তাতোপানিতে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। পানি অনেক গরম। পানি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। নেপালি ভাষায় তাতোপানি মানে গরম পানি। এটি মূলত গরম পানির একটি ছোট ধারা। আমি শুধু অবাকই হলাম না, অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে!
 



আজ দোভানে দুপুরের খাবারের বিরতি দেয়া হবে। তাই দেরি না করে পুনরায় পথ চলতে শুরু করলাম। বুড়িগন্ধকীর পাড় ধরে হেঁটে চলছি। সাস্পেনশন ব্রিজ দিয়ে কখনো এপাড় আবার কখনো ওপাড়। পাহাড়ের ঢালে সরু রাস্তায় বারবার খচ্চরের দলকে জায়গা করে দিতে হচ্ছে। পাহাড় ঝরনা আর বুড়িগন্ধাকীকে সঙ্গী করে চলে এলাম দোভানে। আজকের লাঞ্চ এখানেই। পাহাড়ে ঘেরা সবুজের মাঝে একটি লজে আমরা লাঞ্চ করার জন্য ঢুকলাম। কিন্তু এখানে খাবারে চিকেন পাওয়া যাবে না। তাই আলুভর্তা আর ডিমভাজি দিয়ে খাবার খেতে হবে। মুহিত ভাই আর বিথী লেগে গেলো রান্নার কাজে। আমরা নরম রোদে শরীর গরম করছি। মুহিত ভাইয়ের আলু ভর্তা আর বিথীর ডিম ভাজির সঙ্গে গরম ভাত, পাপড় ভাজা, আর ডাল দিয়ে খেতে বসে গেলাম। মুহিত ভাই ক্ষেত থেকে কাঁচামরিচ তুলে আনলেন। পথ্য যাই হোক খেলাম আমরা গলা পর্যন্ত।  খাবার শেষে আবার পথ চলা শুরু। আমরা আস্তে আস্তে যে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে অধিক উচ্চতার দিকে যাচ্ছি তা বেশ বুঝতে পারছি। কিছুদূর হাঁটার পর একটি লম্বা ল্যান্ড স্লাইড জায়গা পার হচ্ছি। এটা বেশ বিপজ্জনক। মনে হলো আজ সকালেই ল্যান্ড স্লাইড হয়েছে। ঝুরঝুরে আলগা মাটি ও পাথর এখনো তাদের ধ্বংসযজ্ঞের কথা জাহির করছে আমাদের কাছে। উপর থেকে আলগা পাথরের টুকরা গড়িয়ে পড়ছে আমাদের পাশ ঘেঁষেই। এই জায়গাটি পার হতে আমাদের প্রায় আধ ঘণ্টার বেশি সময় লাগলো।
 


কঠিন এক খাড়া চড়াই পার হয়ে ইয়ারু বাজারে যাত্রা বিরতি দিলাম। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নেমে এলাম আবার সেই বুড়িগন্ধকীর পাড়ে। মুহিত ভাই জানালেন নদীর এই স্থানটা গতিপথ পরিবর্তন করেছে। এখানেই চোখে পড়লো নেপালের একমাত্র ক্লিপ ব্রিজ। খাঁড়া পাহাড়ের দেয়ালের গায়ে ক্লিপের সাহায্যে আটকানো কাঠামো দ্বারা তৈরি এই ব্রিজ। দেখতেও বেশ দৃষ্টিনন্দন। পার হয়ে জগতের পথে হেঁটে চলছি। জগত এখনো প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টার দূরত্বে। শেষ মুহূর্তগুলোয় জিজ্ঞাসা ছিল আর কত দূর জগত? ঠিক সন্ধ্যার মুখে আমরা এসে পৌঁছালাম বড় এ জনপদে। এখানে জনবসতিও অনেক, হোটেল, লজ মিলিয়ে বেশ বড় জায়গা। এখানেই মানাসলু কনজার্ভেশন এলাকার চেকপোস্ট। শীতও অনেক বেড়ে গেছে। যতই উপরের দিকে যাচ্ছি ততই শীত বেড়েই চলেছে। তাই আমরা কেউ গোসলের ঝামেলায় যাইনি। জগতের অলিগলি বেশ সরু। তবে ভীষণ পরিষ্কার। ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করছে। আমরা যে লজে উঠেছি সেটা বেশ নতুন ও গোছানো। সন্ধ্যায় একটি বড় তাঁবুর ভিতরে আমাদের খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই হাত-মুখ ধুয়ে সন্ধ্যার পরে আমরা ডাইনিং টেন্টে চলে আসি। এখানে রাতের খাবার খেয়ে এবং কিছু সময় আড্ডা দিয়ে আমরা রুমে চলে এলাম। 
 


আজকের উদ্দেশ্যে ড্যাং। সকালের নাস্তা করে বেরিয়ে পরলাম। জগত থেকে বেরিয়ে প্রথমেই চোখে পড়লো মাইক্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট। এই সব দুর্গম অঞ্চলের বিদ্যুতের উৎস এটি। খরস্রোতা নদী ও ঝরনার পানির স্রোত কাজে লাগিয়ে এই পাওয়ার প্ল্যান্ট চালানো হয়। এখান থেকেই চোখে পরতে শুরু করলো ন্যাড়া পাথরের পাহাড়। বুড়িগন্ধাকীর নদী খাত ঘেঁষে পাহাড়ের কঠিন পাথর কেটে কেটে বানানো হয়েছে সরু রাস্তা। রাস্তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করছে মানুষ, মালবাহী পশুর দল। তবে পথগুলো দিয়ে চলার সময় ভয়ে গা শিউরে ওঠে। সিদ্ধিরবাসে এসে আমরা চা বিরতি দিলাম। এটা নেপাল ও তিব্বতের সীমান্ত এলাকা। তাই এই অঞ্চল থেকেই চোখে পড়লো তিব্বতি বংশোদ্ভূত লোকজন। উপরের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি তিব্বতি জনগোষ্ঠীর আধিক্য বেড়েই চলেছে। জনপদের বাড়িতে বাড়িতে ওড়া পাঁচ রঙের প্রার্থনা পতাকা দেখেই বুঝতে পারছি। হলুদ, লাল, নীল, সবুজ ও সাদা এই পাঁচটি রং। প্রত্যেকটা রঙের  আলাদা আলাদা অর্থ আছে। হলুদ হলো অগ্নি দেবতা, লাল সূর্য দেবতা, নীল আকাশ দেবতা, সবুজ প্রকৃতি দেবতা ও সাদা হলো জল দেবতা। নিচের দিকে যেমন গুরঙ জনগোষ্ঠী, তেমনি উপরের দিকে তিব্বতি। এই গুরঙ ও তিব্বতিদের মধ্যে জীবনাচরণের বেশ পার্থক্য রয়েছে। যেমন তিব্বতিরা ইয়াক, খচ্চরের মতো পশু পালনের উপর নির্ভরশীল। গুরঙরা কৃষিকাজ আর হোটেল ব্যবসার উপর নির্ভরশীল। (চলবে)

ছবি: কাজী বিপ্লব




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়