ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ফুলদী নদী কি ওদের ক্ষমা করবে?

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৯, ২৮ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফুলদী নদী কি ওদের ক্ষমা করবে?

জাফর সোহেল: কিছু ঘটনা আমাদের সমাজে ঘটে, তবে ঘটনার বিবরণ শুনে মনে হয়- এ বুঝি আমাদের সমাজের কোনো ঘটনা নয়। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষ কী করে এমন কাজ করে? গত বছরের আগস্টে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর হত্যাকাণ্ড আর নির্যাতনের ছবি দেখে এই প্রশ্ন মনে জেগেছিল। প্রশ্ন জেগেছিল টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসের ভেতরে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করে রূপাকে জঙ্গলে ফেলে দেয়ার পরও। প্রশ্ন জেগেছিল রাজীবের খণ্ডিত হাত রাজপথে পড়ে থাকতে দেখে। আবার এখন মনে প্রশ্ন জেগেছে, পায়েলকে বাস থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যার ঘটনা শোনার পর।

সত্যি, মানুষ কী করে এমন কাজ করে? বনের পশুও স্বগোত্রীয় কারো প্রতি এমন নির্দয় আচরণ করে না। ২১ জুলাই রাতে হানিফ পরিবহনের যে শ্রমিকেরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পায়েলকে আহত অবস্থায় মুন্সিগঞ্জের ফুলদী নদীতে ফেলে দিল, তারা কোন প্রকারের মানুষ? নাকি আমরা যেমন কথার ছলে বলি ‘সে একটা অমানুষ’- তেমনি এই শ্রমিকেরা সত্যিকারের অমানুষ? আমরা কি পরিবহন শ্রমিকদের মাঝে সত্যি সত্যি কিছু অমানুষের ছবি দেখছি?
পত্রিকার খবর বলছে, এই সময়ে চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা ছিল না সাইদুর রহমান পায়েলের। বড় ভাইয়ের সন্তান হওয়ার খবরে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ভাতিজির নামও দিয়েছিলেন-মাহানুর রহমান। শনিবার রাতে হানিফ পরিবহনের বাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন তিনি। ঢাকার খুব কাছে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার ভাটের চরে এসে প্রস্রাব করার জন্য নামেন গাড়ি থেকে। পরে গাড়িতে ওঠার সময় দরজায় ধাক্কা লেগে আহত হন তিনি। অজ্ঞানও হয়ে পড়েন। রক্তাক্ত পায়েলকে হাসপাতালে পাঠানো দরকার, কিন্তু বাসের সুপারভাইজার চালক ও সহকারী তখন আর মানুষ থাকেন না, তাদের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা অমানুষটা টুপ করে বেরিয়ে আসে-সেই অমানুষ বলে, ‘আরে কীসের হাসপাতাল, এত ভেজালের মধ্যে কে যাবে, এটাকে ফেলে দাও’! কোথায় ফেলব? কেন এই যে পাশেই তো নদী- এখানেই ফেলে দাও! ব্যস, সিদ্ধান্ত হয়ে গেল! আহত রক্তাক্ত পায়েল পড়ে গেল ফুলদী নদীতে। ফুলদী, আহা কী সুন্দর একটি নাম- এখানেই কি না এমন অসুন্দর ঘটনা ঘটে গেল মানুষেরই কারণে। ফুলদী কি মানুষকে আর ভালোবাসা জানাতে পারবে? সে কি ওই মানুষগুলোকে অভিশাপ দেবে না?

পায়েলের মা কোহিনূর বেগম বলছেন, ‘হাসিমুখেই আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল ও। গাড়িতে উঠেই ফোন দিয়ে বলেছিল, মা, টেনশন কোরো না, ভোরে পৌঁছেই ফোন দেব। সেই ভোর কোহিনূরের জীবনে এসেছে, তবে তা ছেলের ফোন কল নিয়ে নয়, ছেলের চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ নিয়ে! দুদিন পর যখন ছেলের লাশ ভেসে ওঠে ফুলদী নদীতে তখন কোহিনূর বেগমের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠেছিল? জানি না, কিন্তু এটি লিখতে গিয়ে আমাদের দূরের মানুষদেরও বুকের ভেতরটায় যে মোচড় লাগে তা থেকে বুঝতে পারি তাঁর ভেতরে কী ঘটেছে, কী ঘটছে, কী ঘটতে পারে। শোক সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এই মমতাময়ী মাকে আল্লাহ কতখানি দিয়েছেন জানি না। তবে চাই তিনি যেন শক্তি পান ছেলের স্মৃতি নিযে বাকি জীবনটা ঠিকঠাক কাটাতে পারেন।

প্রশ্ন হলো, মানুষের সমাজে বাস করেও যারা অমানুষ হয়ে যাচ্ছে, যারা এমন অগণিত মাকে শোকে ভাসাচ্ছে তাদের মানুষ করার উদ্যোগ কই সমাজে? আমাদের গায়ে কাঁটা ফুটলে আমরা তা যে কোনো উপায়ে ফেলে দিই; সমাজের গায়ে হুল হয়ে ফোটা বিষাক্ত এসব কাঁটা কে সরাবে? পরিবহন খাতে নৈরাজ্য যে সমাজের গায়ে একটা বিষফোঁড়ার মতো হয়ে দেখা দিচ্ছে, তা তো আর নতুন কথা নয়। কথা হলো, এর প্রতিকারে যা করা দরকার তা কি করা হচ্ছে? পায়েল আর রূপারা তো একেবারে পারিষ্কার হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার নামেও প্রতিদিন বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার কই?

রাজীব হত্যার পর দেশের মন্ত্রী এমপি এমনকি সরকার প্রধানও বলেছেন আমাদের যাত্রীদের আরও সতর্ক হতে হবে! হায়রে সময়, আমরা আর কত সতর্ক হব? কবিতার সেই নাদের আলীর ভাষায়- আমাদের পরিবহনের চালক আর সহকারীরা যতদিন অমানুষ থেকে মানুষ না হবে ততো দিন? নৌমন্ত্রী হয়ত বলবেন, যতদিন তারা গরু ছাগল ছেড়ে রাস্তায় মানুষ দেখা না শিখবে ততদিনই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে! আর শ্রমিকরা আমাদের সবাইকে কলা দেখিয়ে গলা মিলিয়ে কোরাস গাইবে ‘আমরা করব জয়, মানুষের প্রাণ করব ক্ষয়’-এই তো? যখন তখন পরিবহন ধর্মঘট ডেকে এই শ্রমিকেরা মানুষকে জিম্মি করে মজা করে, তখন আমাদের প্রশাসন, আমাদের সরকার তামাশা দেখে। পরিচালক তারেক মাসুদকে সড়কে চাপা দিয়ে হত্যার ঘটনায় বাস চালকের শাস্তি ঘোষণা করে এদেশের আদালত আর শ্রমিকেরা অদৃশ্য শক্তির ইশারায় আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রাস্তায় নেমে আসে। যে দেশের শ্রমিক এমন আশকারা পায়, যাদের পেছনে সারাক্ষণ সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন একজন মন্ত্রী, যাদের আরও আরও মন্ত্রী এমপি কিংবা আরও উঁচু পর্যায়ের সমর্থন আছে, তারা কী করে মানুষ হবে? আমাদেরকে কিছু করতে হলে প্রথমে এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে। যতদিন এই প্রশ্নের কোনো সুরাহা না হবে, যতদিন হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত না হবে  ততদিন এদেশের পরিবহন শ্রমিকদের মানুষরূপে দেখার আশা আমাদের ছেড়ে দিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়