ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যুদ্ধে জড়াবে না ভারত-পাকিস্তান

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০২, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যুদ্ধে জড়াবে না ভারত-পাকিস্তান

জাফর সোহেল: জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতশাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি কনভয়ে  হামলা চালিয়ে ৪০ জনের বেশি সেনা সদস্যকে হত্যা করেছে। সংগঠনটি এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারপর থেকেই ভারতের নানা মহল থেকে দাবি উঠেছে, ওই হামলার কড়া জবাব দেয়া হোক।ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বলেছিলেন, ওই হামলা যারা করেছে, তারা বড় ভুল করেছে এবং এজন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হবে।

মঙ্গলবার ভোরে সেই চরম মূল্যের কিছুটা হামলাকারীদের বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করছে ভারত। তারা পাকিস্তানের অন্তত ৫০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে বালাকোট এলাকায় জঙ্গিবিমানের সাহায্যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছে। এতে ৩০০ জঙ্গি নিহত হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি আস্তানা একেবারে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। কথা হলো, ভারত আরও কী ধরনের কড়া জবাব দেবে এবং এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? এটি কি আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধ হতে পারে? হলে সেটি সর্বাত্মক যুদ্ধ হবে নাকি সীমিত বা লোকাল ওয়ার হবে? ইতিহাস বলে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক বা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়েছে তিনবার। এরপর থেকে কাশ্মির ইস্যুতে বিভিন্ন সময় তাদের মধ্যে স্বল্প মেয়াদে হামলা-পাল্টা হামলা হয়েছে। এগুলোকে ভারত যুদ্ধ বললেও পাকিস্তান ঠিক যুদ্ধ বলে না। তারপরও কারগিল ওয়ারকে সীমিত পর্যায়ের যুদ্ধ বা লিমিটেড ওয়ার বলা যায়।

ধারণা করা হয়, ভারত এবং পাকিস্তান এই সময় সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াবে না। কারণ তাদের উভয়ের হাতে পরমাণু বোমা রয়েছে। সর্বাত্মক যুদ্ধ মানে ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করা এবং শত্রুকে পরিপূর্ণভাবে পরাজিত করার প্রচেষ্টা। সে ধরনের যুদ্ধে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে শেষ করে দেয়ার পণ করে। তখন আর বেসামরিক-সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করা হয় না। নীতি নৈতিকতা, মানবাধিকার- এসব বিষয় শিকেয় তুলে রাখা হয়। যেমন ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ, ইরাক-কুয়েত উপসাগরীয় যুদ্ধ, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, আর্জেন্টিনা-ব্রিটেন ফকল্যান্ড যুদ্ধ প্রভৃতি। এ ধরনের যুদ্ধে হাতে থাকা সর্বপ্রকার শক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা জাপানের গায়ে মেরেছিল পরপর ২টি পরমাণু বোমা। যুদ্ধজয়ের নেশায় পেয়ে বসলে এখনো যে কেউ পরমাণু বোমা ব্যবহার করতেই পারে! ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধেও তা হতে পারে- তাই পারতপক্ষে ঐ পর্যায়ের যুদ্ধে কোনো পক্ষই যেতে চাইবে না।

কী হবে তা সময় বলে দেবে। আপাতত যা দেখা যাচ্ছে তা হলো, ৪০ জন সেনা নিহত হওয়ার পর ভারতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটা দামামা বেজে উঠেছে। ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, অন্তত ৪০ শতাংশ ভারতীয় এই মুহূর্তে যুদ্ধ চায়। তবে ভারতরাষ্ট্র নিজে এই মুহূর্তে যুদ্ধ চায় কি না- সেটাই হলো বড় প্রশ্ন। যদিও এরই মধ্যে মঙ্গলবার ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়ে ৩০০ জনকে হত্যার দাবি করেছে। এ দাবির সত্যতা এখনো শতভাগ নিরূপণ করা যায়নি। দাবির পুরোটাই প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান বলেছে, ভারতীয়রা ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে গেছে। রয়টার্স বলছে, ভারতীয় হামলায় মাত্র একজন সাধারণ নাগরিক আহত হয়েছে! বাকি হতাহতের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। প্রমাণ এখনো দেখাতে পারেনি ভারতও। তবে তাদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সফল স্ট্রাইকের বিবৃতি দেয়া হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি অস্বীকার করলেও পাকিস্তান নিজেদের আকাশ সীমা লঙ্ঘনের উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে বলে জানিয়েছে। তবে সে জবাব তারা এখনই দেবে বলেনি। তারা বলছে, উপযুক্ত সময়ে, উপযুক্তভাবে জবাব দেয়া হবে! এই বিবৃতি বেশ রহস্যজনক। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একই সঙ্গে পাকিস্তানের জনগণকে যেকোন পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতেও বলেছেন! এই আহবানও রহস্যের জন্ম দিয়েছে। যদি ভারতীয় হামলায় তাদের তেমন কোনো ক্ষতি না-ই হয়ে থাকে তাহলে জরুরি বৈঠক করে এ ধরনের বিবৃতি দেয়ার কী দরকার? তাহলে কি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি পুরোটা না হলেও আংশিক সত্যতা আছে বলে ধরে নেয়া যায়? ভারতীয় দাবির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তারা বলছে জইশ কমান্ডার ইউসুফ আজহারকে হত্যা করা হয়েছে, তার বাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান যদি এটা অস্বীকার করতে চায়, এখন তাদেরকে ইউসুফ আজহার যে জীবিত আছেন, যেকোন মাধ্যমে তার প্রমাণ পেশ করতে হবে। বলা হচ্ছে অন্তত ৫০ কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে পাকিস্তানের মূল ভূ-খণ্ড বালাকোটে অপরাশেন চালিয়েছে ভারত। এটা অনেক বড় ঘটনা। ভারত সরকার ইতোমধ্যে তাদের বিমানবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছে সফল অভিযানের জন্য।

পাকিস্তানের মাটিতে এ ধরনের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পরিচালনা করা নতুন নয়। কিছুদিন আগে আমেরিকান বিমানও তাদের ভূমিতে বোমা হামলা চালিয়ে চলে গেছে। পাকিস্তান কিছুই করতে পারেনি। মঙ্গলবারের ভারতীয় হামলার উপযুক্ত প্রতিরোধ সত্যিকার অর্থে পাকিস্তান করতে পারেনি বলেই মনে হচ্ছে। তারা হয়ত হামলার পর জেট বিমান পাঠিয়েছে। বিষয়টিকে ঠিক প্রতিরোধ বলা যায় না। প্রতিরোধ বলা যেত তখন, যখন পাকিস্তানিরা অন্তত একটা বা দুটো বিমান ভূপাতিত করতে পারত। যেকোন সময় আকাশ সীমা লঙ্ঘনের যথার্থ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পাকিস্তানের আছে কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে। আপনি পরে প্রতিশোধ নিবেন ঠিক আছে, কিন্তু আপনার ওপর হামলার প্রতিরোধ ব্যবস্থা কই? এখন প্রশ্ন হলো, ভারত কি এখানেই থামবে নাকি আরও কিছু করতে চাইবে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ৪০ জনের বদলে ৩০০ জন তো মোটামুটি সন্তোষজনক প্রতিশোধই!  আর পাকিস্তানই বা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে? এরই মধ্যে মঙ্গলবার রাতে খবর এসেছে,  পাক-ভারত সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তান মর্টার হামলা চালিয়েছে। এতে ভারতের ২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহতের খবর পাওয়া গেছে, আহত হয়েছে ৫ সেনা। আজ সকালে পাকিস্তান আরো দাবি জানিয়েছে তারা ভারতের দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। যদিও ভারত এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন কথা হলো- পাকিস্তান এমন ছোটখাটো কিছু হামলা করেই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রতিশোধ নেবে নাকি বড় ধরনের প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে?

যদি সত্যিকার অর্থে ৩০০ জইশ বাহিনী মারা পড়ে, তাহলে পাকিস্তানের তরফে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তারা এর চরম প্রতিশোধ যেমন নিতে পারে তেমনি আবার নাও নিতে পারে! যেহতু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনো ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়নি, মারা গেছে জঙ্গি, সেহেতু পাক আর্মি এ ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কেননা, পাকিস্তানে এই মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ জঙ্গিপণা রোধেও কাজ করছে সে দেশের সেনাবাহিনী। বিগত এক দশক ধরে গোটা পাকিস্তানে একের পর এক আত্মঘাতি হামলায় কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বোমা হামলা থেকে রেহাই মিলছিল না মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল শিক্ষার্থীদেরও। তাই ঐ বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণের একটা প্রচেষ্টা আছে ইমরান খানের সরকারের। আর আমরা সবাই এই তথ্য জানি যে, ইমরানের সরকারের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে সে দেশের সেনাবাহিনী। তাই এই সেনাবাহিনী জঙ্গি হত্যার প্রতিশোধ নিতে কতটা মরিয়া হবে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আবার অন্যদিক থেকে দেখলে ভারতীয় এই হামলার কঠিন জবাবই পাকিস্তান দেবে। কারণ, সীমান্ত এলাকায় ভারতের সঙ্গে সামরিক দ্বৈরথে সবসময় একটা বাড়তি শক্তি ও প্রেরণার উৎস এই জইশ-ই মোহাম্মদসহ বিভিন্ন উগ্রবাদি সংগঠন। বছরের পর বছর তাদের মদদ ও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান সরকার। সুতরাং এদের এতবড় ক্ষতির কোনো প্রতিকার হবে না, তা খোদ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অনেকেই মেনে নেবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে, এসমস্ত শিবিরে কেবল প্রাপ্তবয়স্ক এবং জঙ্গিরাই ছিল তা নয়, তাদের পরিবার- নারী-শিশুদেরও থাকার কথা। ভারতীয় দাবি সত্য হলে হামলায় নিহত হয়েছে নারী-শিশুসহ অনেক নিরপরাধ মানুষও। সুতরাং এখন পাকিস্তান কীভাবে কী করে এবং সত্যিকার অর্থে ভারতীয় হামলায় ৩০০ জঙ্গি মারা গেছে কি না- অনেকটা তার ওপর নির্ভর করছে বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে গড়াবে কিনা? নাকি হুমকি-ধামকি আর স্বল্পপরিসরের হামলা-পাল্টা হামলাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। যদি বাস্তবেই বেশি হতাহত হয়ে থাকে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও সরকার আক্রমণাত্মক হয় তবে পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকেই যাবে। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ সর্বাত্মক হবে নাকি সীমিত পর্যায়ে থাকবে সেটা হলো বিষয়। সাধারণভাবে যেকোন সামরিক সমীকরণে এই মুহূর্তে চূড়ান্ত যুদ্ধ করার মতো মানসিকতা ভারত-পাকিস্তান কোনো দেশেরই আছে বলে মনে হয় না। তারা বরং তাদের দেশের জনগণের কাছে হিরোইজম দেখানোর কিছু প্রচেষ্টা নিতে পারে সীমিত যুদ্ধের মাধ্যমে। যেমন ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছে। এতে ভারতের জনগণ খুশি হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমও উৎসাহী সংবাদ পরিবেশন করছে।

আরেকটা বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলো একেকটা এক্টর বা অভিনেতা হিসেবে এক ধরনের ভনিতায় অবতীর্ণ হয়। এজন্য তাকে সবসময় কিছু একটা অভিনয় করে যেতে হয়। কখনো নিষ্ক্রিয় থাকা যাবে না। একজন কিছু একটা করলে অপরজনকে এর প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়। যে রাষ্ট্রগুলো সবসময় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে থাকে তারা অনেক সময় ইচ্ছা না থাকলেও প্রতিপক্ষের যেকোন ঘটনার পাল্টা কিছু করে দেখাতে হয়। তবে পুস্তকীয় এই সমীকরণের বাইরে যদি যাই তাহলে দেখব, ভারতের পক্ষে এ ধরনের সাহসী বা দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির সরকারের জন্য দুটি ব্যাপার কাজ করেছে। এক, ভারতের মানুষের আবেগ অনুভূতির সুযোগ নিয়েছে তারা। দুই, সামনে জাতীয় নির্বাচনের আগে মোদি সরকার তার সাহস ও বীরত্ব জনগণের কাছে তুলে ধরেছে। ভোটের জন্য এর চেয়ে মারাত্মক অস্ত্র আর কিছুই পেত না নরেন্দ্র মোদির সরকার! হামলা চালানোয় মঙ্গলবারই হিন্দু শিবসেনা সংঘ মোদিকে বীর উপাধি দিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছে। এজন্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু থেকে পুলওমা হামলার জন্য একতরফাভাবে পাকিস্তানকে দোষারোপ করার সমালোচনাও করেছিলেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- মোদিকে এ ঘটনার ফায়দা তোলার সুযোগ না দেয়া! কিন্তু মোদি এরই মধ্যে ফায়দা নেয়া শুরু করেছেন। এই ফায়দা নেয়ার খেলায় এখন পাকিস্তান কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় তার ওপর নির্ভর করছে শেষ পর্যন্ত আরেকটা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা হয় কি না। সেরকম কিছু হলে কারগিল যুদ্ধের মতো সীমিত একটি যুদ্ধ কিছুদিনের জন্য হতে পারে। তবে বড় যুদ্ধ বা সর্বাত্মক যুদ্ধ বা ‘টোটাল ওয়ার’ হওয়ার আশঙ্কা আপাতদৃষ্টিতে নেই।

লেখক: সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়