ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

সব শিক্ষকই প্রিয়

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৭, ৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সব শিক্ষকই প্রিয়

|| শাহ মতিন টিপু ||

একটা কৌতুক এ রকম: শিক্ষক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সামনে যদি দু’টো জিনিস রাখা হয়- ‘টাকা’ আর ‘বই’ তুমি কোনটা নেবে? ছাত্র বলল ‘টাকা’। শিক্ষক বললেন, তুমি খুব বোকা। আমি হলে ‘বই’ নিতাম। কারণ, জ্ঞাণ আহরণের জন্য উত্তম হচ্ছে ‘বই’। ছাত্র তাৎক্ষণিক জবাব দিল ‘ঐ তো স্যার, যার যেটার অভাব’।

ছাত্রদের মানসিকতা বোঝার জন্য এক নতুন শিক্ষক ক্লাসে ঢুকেই বললেন, যারা নিজেকে নির্বোধ মনে করো তারা উঠে দাঁড়াও। অনেকক্ষণ পর দেখা গেলো যে শুধু একজন ছাত্র উঠে দাঁড়াল। শিক্ষক বললেন, তাহলে তুমি নিজেকে নির্বোধ মনে করো ?  ছাত্র বলল, না স্যার। আসলে আপনি একা দাঁড়িয়ে আছেন, এটা ভালো দেখায় না । তাই আমিও...। আরেকটি কৌতুক এমন- শিক্ষক ছাত্রকে বললেন, আমি তোকে ভালবাসি বলেই মাঝে মাঝে মারি। ছাত্রটি জবাবে বলল, স্যার, আমিও আপনাকে খুব ভালবাসি কিন্তু ছাত্র বলে ভালবাসা প্রকাশ করতে পারি না । শিক্ষকদের সঙ্গে এমন অনেক অদ্ভুত আচরণ ছাত্ররা করে থাকে। অনেক সময় শিক্ষক ছাত্রদের দ্বারা নিগ্রহের শিকারও হন, তারপরও তিনি আজীবন চেষ্টায় থাকেন কীভাবে ছাত্রটিকে সত্যিকারের মানুষরূপে গড়ে তোলা যায়। এই হচ্ছেন একজন শিক্ষক। আর শিক্ষকরা এমন হন বলেই একসময় ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষকে পরিণত হন।

শিক্ষাদানের মহান ব্রত থাকে বলেই ধৈর্যচ্যুত না হওয়াই শিক্ষকদের ধর্ম। শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষক নিজের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদের দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন। শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রিয় হবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি যা শেখান তার সবই ছাত্র’র জীবন গঠনের জন্য। এ কারণে প্রতিটি ছাত্রই বড় হতে হতে তার শিক্ষককে প্রিয়জনরূপে ভাবতে শেখে। একেকজন ছাত্র যতটা বড় হয়, ততই সে বুঝতে পারে শিক্ষক তার কতো বড় বন্ধু। শিক্ষক গৃহের হোক বা স্কুলের হোক কেউই কিন্তু কম শ্রদ্ধার নন। আমার মতে, ‘বিশেষ প্রিয়’ শিক্ষক হয় না, হওয়া উচিতও না। কারণ একজন ছাত্রের জীবনে যে ক’জন শিক্ষকই আসে, সবাই তার প্রিয়। তবে বিশেষ কোন আচরণ, ঘটনা বা ব্যাক্তি স্বভাবের কারণে কোনো কোনো শিক্ষক ছাত্রদের মনে বিশেষ কোনো দাগ কেটে থাকেন। যা শিক্ষকটিকে সময়ে-অসময়ে ওই ছাত্রের মনে পড়িয়ে দেয়।

আমার বাল্যকালে ক্লাশে একজন শিক্ষক ছিলেন, যার কিছু আচরণ জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে এখনো মনে পড়ছে। তিনি ক্লাশে প্রায়ই একটা স্থানীয় প্রবচন বলতেন, যা এই বয়সে এসে এতো ব্যস্ত জীবনে এখনো মনে স্পষ্ট জেগে আছে। তিনি পড়াশুনায় অমনোযোগী দেখলেই বলতেন ‘যখন পড়িবে চঙ্গার মই, হাজি-কুটা যাইবে কই’। শ্লোকটির ভাবার্থ হচ্ছে- যখন মারধর শুরু হবে তখন আর এসব ফাঁকিজুকি থাকবে না। তারপরই তিনি বলতেন, ‘তোদের এখন মাইরের দরকার’। আজ সেই শামসুদ্দিন স্যারের কথা মনে পড়ছে। তিনি এখন জীবিত আছেন কি না জানি না। সে সময়ই বৃদ্ধ ছিলেন, আজ এতো বছর পরে বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু স্যারের প্রবচন আজো আমার মনে বেঁচে আছে। এমন অনেক টুকরো টুকরো ঘটনা আছে মনের রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যা কখনো কখনো মনে পড়ে।

আরেকজন শিক্ষক একবার আমাদের একই ক্লাশের চারজনকে লাইব্রেরিতে ডেকে নিয়ে জোড় বেত দিয়ে জবর মেরেছিলেন। অবশ্য বিনা অপরাধে নয়। ছাত্রাবাসে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আমরা তাস খেলেছিলাম। ঘটনাটা যেভাবে হোক ওই শিক্ষকের কানে পৌঁছে। ফলশ্রুতিতেই জোটে জোড় বেতের মার। তবে মারার ধরনে মনে হচ্ছিল, কোনো কারণে তিনি আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই সুযোগ পেয়ে কাজে লাগালেন। যে বিচার করার কথা ছিল প্রধান শিক্ষকের, সেটা আগ বাড়িয়ে তিনি করেছিলেন। মারধরের পরও বিষয়টিকে টিসি দেওয়ার মতো পর্যায়ে নিয়ে যান। পরে যেভাবেই হোক অভিভাবকের কানে পৌঁছানোর আগেই ম্যানেজ করে নিয়েছিলাম। এজন্য আমাদের প্রায় দু’মাইল দূরে প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে গিয়ে চারজনকেই তার পা ধরতে হয়েছিল। তার পূর্ণ আশ্বাস নিয়ে তারপর ওই বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিলাম। আসলে কেবল যে ক্লাশে তা নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানে আমাদের এ চারজন নানা কারণেই ছিলাম আলোচিত। ডানপিটে ছিলাম আমরা। ওই ঘটনার পর আমরা ওই শিক্ষকদের অনেক প্রিয় ছাত্রে পরিণত হয়ে উঠেছিলাম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক সমস্যা সমাধানে আমাদের ডাক পড়তো। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টাও করতাম। আজ সে শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক দু’জনই প্রয়াত। মনে পড়ে আবদুল মান্নান, ধীরেণচন্দ্র দাস, মাওলানা সাদেক, ইদ্রিস আলী, তৈয়বুর রহমান, আবদুল মালেক, বরকত উল্লাহ, ফাজিল আহমেদ, মাওলানা নুরুল ইসলাম, শাহ মো. এমরান, আবদুল কাইয়ুম, আবদুস সাত্তার, আবু তাহের, মুজিবর রহমানসহ অনেক শিক্ষকের কথা। আবার অনেকের চেহারা মনে ভাসে কিন্তু নাম মনে আসে না। অথচ এরা জীবন গড়ার বিশেষ সময়ে প্রিয় শিক্ষকে পরিণত হয়েছিলেন। তাদেরকে আজো সশ্রদ্ধ সালাম।

আসলে শৈশবে একজন ছাত্রের জীবনে যে শিক্ষকরা আসেন, তারা ছাত্রদের মনে বেশি স্মরণযোগ্য হয়ে থাকেন। কারণ মানুষ হওয়ার প্রকৃত পাঠ তো তখন থেকেই শুরু। শৈশবে যতো শিক্ষক পেয়েছি অনেকের নামই এখন আর হুট করে মনে পড়ে না। অথচ কতো শতো টুকরো স্মৃতিতে জড়িয়ে আছেন তারা। মক্তব, প্রাথমিক, মাধ্যমিকেই দুষ্টুমির সময়। কলেজ জীবনে তেমন দুষ্টুমি করিনি। সিলেবাসের বাইরের লেখাজোখা অর্থাৎ সাহিত্য চর্চায় ওই সময়েই আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। এ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও প্রিয় হয়ে ওঠে ডাকঘর। ডাকে সপ্তাহজুড়েই আদানপ্রদান থাকতো। পাঠাতাম লেখা, পেতাম লিটল ম্যাগ সাহিত্য পত্রিকা। এজন্যও পরিবার থেকে স্যারদের কাছে নালিশ যেতো। আমি নাকি লেখাপড়া ছেড়ে এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এ কারণে চলতো স্যারদের কড়াকড়ি। কোনো কোনো স্যার হয়ে উঠতেন অসহ্য। আজ বুঝতে পারি, এসব স্যাররা জীবনের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। জীবনে যেটুকু আজ অর্জন তা তাদের ওই টুকরো টুকরো শাসনের জন্যই। আবার জীবনে যেটুকু বঞ্চিত হয়েছি, তা তাদেরকে ফাঁকি দিয়েছি বলেই। এজন্যই হয়তোবা প্রচলিত আছে যে, শিক্ষকদের ফাঁকি দেওয়া মানে নিজের জীবনকেই ফাঁকি দেওয়া।

মনে পড়ে পাঠ্য বইয়ে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ এর ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামে একটি কবিতা ছিল। যার প্রথম কয়েকটি চরণ : বাদশাহ আলমগীর/কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।/একদা প্রভাতে গিয়া দেখেন বাদশাহ/শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া/ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে/পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,/ শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি/ধুয়ে মুছে সব করিতেছেন সাফ সঞ্চারি আঙ্গুলি।’ পুরো কবিতাটিই গল্পের মতো। এরপরের ঘটনাক্রম এ রকম- বাদশাহ শিক্ষককে ডাকালেন। শিক্ষক ভাবলেন বাদশাহ হয়তো ছেলেকে দিয়ে পানি ঢালায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারপরও সাহস সঞ্চয় করে বাদশাহর মুখোমুখি হলেন। কিন্তু বাদশাহর উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। বাদশাহ বললেন, আমার ছেলেতো কিছুই শিখেনি, শিখেছে শুধু বেয়াদবি। সে কেবল পানি ঢালল, কেন নিজ হাতে আপনার পা ধুয়ে দিল না। বাদশাহর বক্তব্যে সেদিন শিক্ষক আরো উচ্ছ্বসিত হলেন। কবিতাটি শৈশবে আমার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। তাই শিক্ষকদের সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখতাম। মেনে চলতাম।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়