ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হায়! লাঠি : লাঠির সেকাল-একাল

কাজী জাহিদুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫২, ১০ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হায়! লাঠি : লাঠির সেকাল-একাল

বাঁয়ে মনিরুজ্জামানের আঁকা কৃষক বিদ্রোহ, ডানে সমরজিৎ রায় চৌধুরীর আঁকা নীল বিদ্রোহ

 

|| কাজী জাহিদুল হক ||

থিব্‌সের স্ফিংক্‌স নামক রাক্ষস রাজা ইডিপাসকে একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছিলেন। ইডিপাস ধাঁধাটির সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হলে ক্ষুব্ধ হয়ে স্ফিংক্‌স পর্বত থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান। আপন বৈশিষ্ট্যের জন্যেই ধাঁধাটি এখানো সর্বত্র প্রচলিত। ধাঁধাটি হলো- সকালবেলা চার পায়ে হাঁটে, দুপুরবেলা দু’পায়ে হাঁটে এবং বিকেলবেলা তিন পায়ে হাঁটে- সে কোন প্রাণী? বলাবাহুল্য সর্বদেশে সর্বকালেই এর উত্তর হলো ‘মানুষ’। আর বিকেলবেলার তিন পায়ের তৃতীয় পা হচ্ছে লাঠি।
লাঠি দেখেন নি বা লাঠি চেনেন না আমাদের সমাজে এমন মানুষ নেই বললেই চলে। দেখতে এমন আহামরি কিছু নয়, তবু এর তেজে জগৎ কাঁপে, ভয়ে গুটিয়ে থাকে। এক সময় বাঙালি বাবুদের বিলাসী জীবনের ছবিতে লাঠির একটি বিশেষ ভূমিকা ছিলো। শুধু বাবুদের বিলাসী জীবনেই নয়, সৃষ্টির আদিতে পৃথিবীর নানা প্রান্তের সব শ্রেণির মানুষের জীবনেই লাঠির ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। আদিম মানুষ আত্মরক্ষাসহ নানা প্রয়োজনে লাঠিকে সঙ্গী করে নিয়েছিল। এ থেকে লাঠির প্রাচীনত্ব এবং গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। লাঠি একসময় আমাদের জীবন ও ঐতিহ্যের অংশ ছিলো। সে-সবের পরিচয় মেলে আমাদের সাহিত্য এবং ইতিহাসের নানা গ্রন্থে। বর্তমানে লাঠির ভূমিকা কিছুটা ম্রিয়মান হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়:

‘হায়! লাঠি! তোমার দিন গিয়াছে। তুমি ছার বাঁশের বংশ বটে, কিন্তু শিক্ষিত হস্তে পড়িলে তুমি না পারিতে, এমন কার্য নাই। তুমি কত তরবারি দুই টুকরা করিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ, কত ঢাল খাঁড়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিয়াছ। হায়! বন্দুক আর সঙ্গীন তোমার প্রহারে যোদ্ধার হাত হইতে খসিয়া পড়িয়াছে। যোদ্ধা ভাঙ্গা হাত লইয়া পালাইয়াছে। লাঠি! তুমি বাংলার আব্রু পরদা রাখিতে, মান রাখিতে, ধান রাখিতে, জন রাখিতে, সবার মন রাখিতে। মুসলমান তোমার ভয়ে ত্রস্ত ছিল, ডাকাইত তোমার জ্বালায় ব্যস্ত ছিল, নীলকর তোমার ভয়ে নিরস্ত ছিল।’
[দেবী চৌধুরাণী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]

গৌরাবার্থে লাঠির দিন হয়তো আগের মতো আর নেই। তবে সমাজে এর প্রভাব এবং প্রয়োজন এখনও ফুরিয়ে যায় নি। লাঠি আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ, জীবনের অংশ। এই নিবন্ধে লাঠির ইতিহাস, ঐতিহ্য, ব্যবহার ইত্যাদি খুঁজে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।

ইসলামী উপাখ্যানে কয়েকজন নবির হাতে একটি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন লাঠির উপস্থিতি মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যায়। আমরা জানি লাঠির আরবি নাম ‘আষা’। পবিত্র কোরান শরীফের কয়েকটি সুরায় আষা-র মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘কোরানসূত্র’ গ্রন্থে নিন্মরূপ বিবরণ পাওয়া যায়:
১.  তারপর মুসা তার লাঠি ছুড়ে ফেলল আর সাথে সাথে সেটি এক সাক্ষাৎ অজগর সাপ হয়ে গেল। (সুরা আরাফ, বাক্য- ১০৮)
২.  তারপর মুসার কাছে প্রত্যাদেশ পাঠালাম, ‘তোমার লাঠি দিয়ে সাগরে বাড়ি মার।’ তখন তা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বড়ো পাহাড়ের মতো হয়ে গেল। আর অপর দলটিকে আমি সেখানে পৌঁছে দিলাম, আর মুসা ও তার সঙ্গীদের আমি উদ্ধার করলাম। (সুরা শোয়ারা, বাক্য ৬৭-৬৮)

সতেরো শতকের বিখ্যাত কবি সৈয়দ সুলতানের ‘নবীবংশ’ কাব্যের একটি কাহিনিতে ইসলামের কয়েকজন নবির আষা তথা লাঠি ব্যবহারের এবং সেই লাঠির অলৌকিক ক্ষমতার বর্ণনা পাওয়া যায়:
‘প্রথম মানব হযরত আদমকে আল্লাহ স্বর্গে বাস করার সময় চারটি জিনিস দিয়েছিলেন- সেগুলির অন্যতম ছিলো বেহেশতের বৃক্ষের ডাল দিয়ে তৈরি একটি লাঠি বা আষা। আদম-পত্নী বিবি হাওয়ার বন্ধু ছিল একটি ময়ূর ও একটি সাপিনী। সাপিনী স্বর্গের বহির্দেশ থেকে উদরে করে শয়তানকে বেহেশতে নিয়ে এসেছিল। শয়তানকে উদরে স্থান দেয়ার কারণে তখন থেকে সাপের বিষ জন্মায়। শয়তানের কুপরামর্শে আদম নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করলে তাঁর হাত থেকে আষা খসে পড়ে। পরবর্তীকালে আরো দুই পয়গম্বর হয়ে সেটা পৌঁছে যায় হযরত মুসার কাছে। মুসা আষা দিয়ে অজগর সংহার করেন। প্রভুর ইচ্ছায় সেটা সর্পরূপ ধারণ করে ফেরাউনের সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেছে; এবং শেষপর্যন্ত আষার সাহায্যেই মুসা নবী নীল নদকে দুই ভাগ করে ইসরাইল সম্প্রদায়কে নিরাপদে অপর পাড়ে নিয়ে গেছেন। নীল নদের তীরে দণ্ডায়মান মুসার প্রতি জীব্রাইলের পরামর্শ:

                জীব্রাইল পাঠাইলা মুসার যে পাশে
                সাক্ষাতে আসিয়া কহে বহুল আসোয়াস।
                মারহ ‘আষা’র বাড়ি এহি সাগরেরে
                বোল পন্থ করি দিতে তুক্ষ্মি যাইবারে।
                তা শুনিয়া আষা হাতে লৈলা পয়গম্বরে
                মারিলা আষার বাড়ি সেই সাগরের।
                সাগরে চিক্কার ছাড়ি কান্দিতে লাগিল।
                অতি উচ্চস্বরে ডাক বহুল ছাড়িল॥
                শুনি মুসা পয়গম্বরে আষা হাতে করি
                মারিলেক সাগরের সে আষার বাড়ি।’

আরেক নবি হযরত ইউসুফ (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে একটি ‘আষা’ পেয়েছিলেন বলে কবি শাহ মুহম্মদ সগীর ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যে উল্লেখ করেছেন।

                ‘নির্মল স্বরূপ আষা বিধির নির্মিত
                হেন আষা ইছুফক দিলেন্ত বিদিত।’

‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র চাঁদ সওদাগরের হাতে সব সময় একটি লাঠি থাকতো। সেই লাঠিতে দেবী মনসার বড় ভয়। দেবীর ইচ্ছা যে, সওদাগর তাঁর পূজা করুক; কিন্তু লাঠির ভয়ে দেবী সওদাগরের কাছে আসতে সাহস করে না। একবার নাগালে আসায়, চাঁদ লাঠির আঘাতে দেবীর কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত সওদাগর পূজা করতে বাধ্য হলেও তার হাতে লাঠি থাকা অবস্থায় পূজার ফুল গ্রহণ করার জন্য মর্তে অবতরণ করতে দেবী রাজি হন নি। দেবীর আতঙ্কের কারণ বুঝতে পেরে চাঁদ লাঠি দূরে ফেলে দিলে দেবী পূজা গ্রহণ করেন ও আশীর্বাদ জানান।

লোকবিশ্বাস আছে কামিনি গাছের লাঠি হাতে থাকলে যেমন সাপ কাছে ঘেঁষে না, তেমনি হেঁতালের লাঠিকে সাপ ভয় পায়। তাই সাঁতালি পর্বতের উপরে পুত্র পুত্রবধূর জন্য লোহার বাসরঘর বানিয়েও চাঁদ সওদাগরের স্বস্তি ছিলো না। কালসর্পের হাত থেকে পুত্রের জীবন রক্ষা করতে তিনি নিজে হেঁতালের লাঠি নিয়ে লোহার ঘরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।   

 

আলোকচিত্র : মোহাম্মদ আসাদ


এক সময় জমিদারদের হাতের লাঠি যথেষ্ট সম্ভ্রম জাগাতো। জমিদার আর লাঠির একটি অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক ছিলো। সে লাঠিও ছিলো দর্শনীয়। লাঠির হাতল সোনা বা রুপা দিয়ে বাঁধানো থাকতো। লাঠির গায়ে থাকতো নানা রকম নকশা। কম দামের লাঠির মাথা পিতল দিয়ে বাঁধানো হতো। আমাদের চলচ্চিত্র, পুরনো দিনের পত্রপত্রিকা বা বইতে এখনো জমিদারদের এ-চিত্র দেখা যায়। জমিদাররা আভিজাত্য প্রকাশে যেমন হাতে লাঠি রাখতেন, তেমনি লাঠি খেলাকে গুরুত্ব দিতেন। হাঙ্গামা রোখার জন্য তারা প্রশিক্ষিত লাঠিয়াল নিয়ে লেঠেল বাহিনী গড়ে তুলতেন। শুধু জমিদারের লেঠেল বাহিনীই নয়, গ্রামের সাধারণ কৃষকও ক্ষেতের ফসল রক্ষায়, জমির ন্যায্য অধিকার রক্ষায় সহজে পিছু হটেনি। ওই লাঠি নিয়েই তারা জমিদারের লেঠেলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কবি জসীমউদ্‌দীনের ‘নক্সী-কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থে দেখি, গজনাচরের ধানের জমি দখলকে কেন্দ্র করে লাঠি ঘুরিয়ে রূপাই কীভাবে জমিদারের লেঠেলদের ঘায়েল করে তার ছবি।
কবির এ-কাহিনির নায়ক রূপাই। রূপাই শুধু কালো রং ও কিশোর মূর্তি দিয়েই সেই গ্রামটি মুগ্ধ করে নি। রূপাইয়ের যেসব গুণের জন্য গ্রামবাসী মুগ্ধ, সেসবের মধ্যে তার লাঠি চালনার পারদর্শিতাও রয়েছে। কবির ভাষায়- ‘আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী’। রূপাই চাষার ছেলে কিন্তু বাঙালি সন্তান। তার প্রাণের প্রেম ও হাতের লাঠি উভয়ই অতুলনীয়। তার হাতে বাঁশের বাঁশি ও বাঁশের লাঠি দুই-ই অনিবার্য। কবির ভাষায়:

              ‘ও রূপা তুই করিস্ কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে?
              বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা-চরের খামার ভূয়ে।’
              ‘কি বলিলা বছির মামু?’ উঠল রূপাই হাঁক ছাড়িয়া,
              আগুনভরা দু চোখ হতে গোলা বারুদ যায় উড়িয়া।
              ...
              ‘আলী! আলী! আলী!! আলী!!!’ রূপার যেন কণ্ঠ ফাটি,
              ইস্‌রাফিলের শিঙা বাজে, কাঁপ্‌ছে আকাশ কাঁপ্‌ছে মাটি।
              তারি সুলে সব লেঠেলে লাঠির পারে হান্‌ল লাঠি
              তাল ঠুকিয়া ফুটল রূপাই, ছুটল পাছে হাজার লাঠি,
              ‘আলী-আলী- হজরৎ আলী’ কণ্ঠ তাহার যায় যে ফাটি।’’

লাঠি ঘুরিয়ে জমিদারের লোককে জখম করার পর রূপাই ফেরার হলো। তা থেকে গড়ে উঠলো করুণ বিষাদময় এই কাব্যগাথা।

জমিদারি প্রথা চালু হওয়ার পূর্বেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক নামকরা লাঠিয়াল ছিলেন। তাঁদের কথা বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রমোহন রায় লিখিত ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে রাম মালিক নামে তেমনি একনজর বীর লাঠিয়ালের উল্লেখ আছে। রাম মালিক বিক্রমপুরের রঘুরামপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। রঘুরাম ছিলেন বিক্রমপুর অঞ্চলের স্বাধীন নরপতি। রঘুরাম কবেই বিস্মৃত হয়েছেন, কিন্তু রাম পালের বলশালী নৈপুণ্যের কথা জনপ্রবাদের ন্যায় লোকের মুখে মুখে ফেরে।

                ‘রাম মালিকের লাঠি।
                রঘু রায়ের মাটী॥
                উঠলে লাঠির ডাক।
                দৌড়ে পালায় বাঘ॥
                গুলি ফিরে ঝাঁকে।
                রামের লাঠির পাকে॥
                মালিক ধরে লাঠি।
                যম রযন সে খাঁটি॥’

সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: ‘‘প্রাচীন বঙ্গে লাঠিই আত্মরক্ষা বা আত্মপীড়নের প্রধান সম্বল ছিল। এখন যেমন লাঠি ‘ছড়িত্ব প্রাপ্ত হইয়া শৃগাল-কুক্কুরভীত বাবুবর্গের হস্তের শোভা বর্ধন করে এবং কুকুর ডাকিলেই সে ননীর হস্তগুলি হইতে খসিয়া পড়ে’ পূর্ব্বে সেরূপ ছিল না। তখন ইহার বলে গৃহস্তের মানমর্যাদা ও ধনধান্য রক্ষিত হইত। দেশ ও সমাজ উভয়েরই শাসন ভার লাঠির উপর ন্যস্ত ছিল।’’
এই গ্রন্থে তিনি সেসময়ের লাঠি-শাস্ত্রে পারদর্শী অনেক সর্দারের বীরত্বের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। তখন জমিদারসহ অবস্থাপন্ন লোকের গৃহে বেতনভুক্ত পালোয়ান থাকতো। শিশু-কিশোররা তাদের কাছে কুস্তি ও লাঠিখেলা শিখতো।

রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন আটাশ বছর, তখন তিনি ঠাকুর বাড়ির পূর্ববঙ্গের জমিদারির কাজ দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন পূর্ববঙ্গে ছিলেন। জমিদারির লেঠেল বাহিনীর খবর তাঁর জানা ছিলো। এই বাহিনীর একজন মেছের সর্দার। তিনি নিজে অসাধারণ লাঠি খেলতেন, অনেক লাঠিয়াল তৈরি করেছিলেন। এই মেছের সর্দার রবীন্দ্রনাথকে দেখে মুগ্ধ হলেন এবং রবীন্দ্রনাথের পাহারায় সবসময় থাকার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। রবীন্দ্রনাথ এতে রাজি হলেন এবং বললেন, ‘তোমাকে গ্রামের ছেলেদের লাঠি খেলা শেখাতে হবে। আমি তোমায় একদল শিক্ষার্থী দেবো। আমার সদর ও মফস্বল কাছারিতে যতো বরকন্দাজ হালসানা আছে সবাইকে ভালো করে লাঠি চালনা তুমি শিখিয়ে দেবে। আমি চাই একদল শক্তিমান সেবক আর সাহসী গ্রামবাসী। যারা এই বিদ্যা শিখে ভুল পথে গিয়ে ডাকাতি করে শক্তি নষ্ট করছে, তাদেরও আমি ফিরিয়ে আনতে চাই। তোমরা সবাই গ্রামগুলোকে সাহসী শক্তিমান করে তোলো।’ [শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ- শচীন্দ্রনাথ অধিকারী]

যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই লেঠেল বাহিনী টিকে থাকে লাঠিখেলার দল হিসেবে। লাঠিখেলার মধ্যে  শরীরচর্চা, বিনোদন ও আত্মরক্ষামূলক কলাকৌশল আছে। এই খেলা শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী ‘বাংলার মুখ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: ‘গ্রামে পৌষসংক্রান্তি এবং মহরমের সময় লাঠিখেলা হতো। অনেক সময় প্রতিযোগিতামূলক খেলাও হতো, তাতে বিজয়ী দল পেত পুরস্কার। গ্রামে কিছু অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে ও মেয়ের বিয়েতেও লাঠিয়াল আনা হতো। বিয়ের নওশার সঙ্গে বর্ষার দিনে নৌকায় এবং শুকনার দিনে নওশার পালকির আগে আগে তারা ডাকের গান- মানে ডাক ভাঙতে ভাঙতে আসতো। পথের পাশের লোকেরা জিজ্ঞাসা করতো, কোথাকার নওশা গো? বিয়ে কোন গেরামে গো? এতে সবাই জানতো অমুক গ্রামের অমুকের সঙ্গে অমুক গ্রামের অমুকের শাদী হচ্ছে। লাঠিয়ালদের বিয়ে বাড়ির সাজানো গেটের সামনে এসে ডাকের ছড়া যেন বেড়ে যেতো। এদিকে কন্যা পক্ষের লাঠিয়ালগণও প্রতিউত্তর দিতো। যেন এক কৃত্রিম যুদ্ধই লেগে যেতো।’

কুষ্টিয়ার সুপরিচিত ওস্তাদ ভাই সিরাজুল হক চৌধুরী রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্নগ্রন্থ থেকে আমরা আবহমান বাংলার লাঠির কসরত, তার কৌশল, আর্ট এবং ইতিহাস সম্বন্ধে বহু তথ্য পাই। তাঁর লিখিত ‘জীবনের বাঁকে বাঁকে’ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি তার নিজের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। তিনি জানান- লাঠিখেলায়ও আছে নানা পরিভাষা- এই যেমন জোর, নিম, ঘাড়ী, বগলী, মোড়া, ঘুর্ণি, কাঁধপিট্, চাঁদমোড়া, পদচক্র, চিৎচক্র, ষড়ভঙ্গ, ত্রিভঙ্গ প্রভৃতি। আছে নানা মুদ্রা- পালট, দুঃশাসন, মার, চক্র, হুল, উজো, নাচ, সালাম ইতাদি। তিনি আবৃত্তি করতেন-

               ‘মুসা নবীর হাতের লাঠি হয়ে কালের সর্প
               মুহূর্তে ধ্বংস করে ফেরাউনের দর্প॥’   

জানতে পারি লাঠির সেই বোল- ‘ঝাউর গিজার গিজ ঘিনিতা- এক ধামা চাল একটা পটল’। জানতে পারি তার আবহমান শিক্ষা এবং কসরত প্রক্রিয়ার কথা। জানতে পারি গুরুসদয় দত্ত এই লাঠিয়ালদের সুশৃঙ্খল শিক্ষাকে ব্রতচারীদের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে কি বিপুল সাড়া জাগিয়েছিলেন। লাঠির ঐতিহ্য থেকে নেয়া সেই সব ছাত্রজীবনের স্মৃতি-

                ‘সব চলে আয় খেলি
                বীর নৃত্যের কেলি॥
                মনের ভয় আর ভাবনা
                নিয়ে দূরে ফেলি ॥’

আদিম মানুষ যখন ক্রমে-ক্রমে সমাজবন্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক বন্ধন। এই সামাজিক বন্ধন অটুট রাখার জন্য তারা বিভিন্নভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে নানা ধরনের চুক্তি করেছে। এই চুক্তিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইনরূপে। আইনের বরখেলাফের জন্য বিধান হয়েছে দণ্ডের। অপরাধীকে দণ্ড প্রদানের প্রক্রিয়ারূপে মানুষের প্রথম পছন্দ ছিলো বেত্রদণ্ড। ঠিক কবে থেকে বেত্রদণ্ডের উদ্ভব- সভ্যতার ইতিহাসে তার কোনো তারিখ পাওয়া যাবে না। বিধানটা এতোই প্রাগৈতিহাসিক। তবে, বর্তমান থেকে পিছু সরে গেলে ইতিহাসের পাতায় এর সন তারিখ পাওয়া না-গেলেও বিভিন্ন নজির পাওয়া যাবে। ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখ আছে এই বেত্রদণ্ডের। প্রাচীন হিব্রু এবং মিশরীয় সমাজে অপরাধের তারতম্য অনুসারে সর্বোচ্চ চল্লিশ ঘা পর্যন্ত বেত বা চাবুক মারার বিধান ছিলো। এই বেতের ঘা পড়তো তখন অপরাধীর মুখের ওপর, শরীরে অন্যত্র নয়। হিব্রু সমাজের বিধান অনুসারে যীশুখ্রিষ্টকে ঊনচল্লিশ ঘা বেত খেতে হয়েছিলো ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে।

 

কাইয়ুম চৌধুরী : উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, অ্যাক্রিলিক অন ক্যানভাস


প্রাচীন রোমান সমাজেও বেত্রদণ্ড ছিলো অত্যন্ত জনপ্রিয় দণ্ড মাধ্যম। ভিন্ন-ভিন্ন অপরাধে ভিন্ন-ভিন্ন বেত বা চাবুকের ঘা খেতে হতো অপরাধীদের। লঘু অপরাধের জন্য ছিলো ‘ফেরুলা’ নামের চামড়ার চাবুক। এগুলো মারা হতো ছিঁচকে চুরির জন্য। যৌন অপরাধের জন্য প্রয়োগ করা হতো ‘স্কুটিকা’ নামে সরু ডালের আঘাত। সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক চাবুকের নাম ছিলো ‘ফ্ল্যাজেলাম’। ফ্ল্যাজেলামের আঘাত নির্ধারিত ছিলো দাসদাসীদের জন্য।

বেত্রদণ্ডের খোলামেলা প্রয়োগের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে মধ্যযুগের ইতিহাসে। ইংল্যান্ডে এই দণ্ড মাধ্যম ছিলো অত্যন্ত ব্যাপক। ১৫৩০ সালে, রাজা অষ্টম হেনরীর রাজত্বকালে বেত্রদণ্ডের প্রথা বর্বরতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। কতো ঘা বেত মারা হবে এ-ব্যাপারে তখন ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম ছিলো না।
গ্রাম বাংলায় এই কয়েক বছর আগ পর্যন্ত বাড়িতে এবং স্কুলে শাসন ও শাস্তি প্রদানে লাঠি-ছড়ি-বেতের ব্যবহার যথেষ্ট ছিলো। আমাদের শিশুসাহিত্যে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, সিনেমায় লাঠির উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো।
বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে লেখক প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালার কথায় বলেছেন: ‘বেত ছাড়া পাঠশালায় শিক্ষা দানের বিশেষ উপকরণ বাহুল্য ছিলো না। তবে এই বেতের উপর অভিভাবকদেরও বিশ্বাস গুরুমহাশয়ের অপেক্ষা কিছু কম নয়। তাই তাঁহারা গুরুমহাশয়কেও বলিয়া দিয়াছেন, ছেলেদের শুধু পা খোঁড়া এবং চোখ কানা না হয়, এইটুকুমাত্র নজর রাখিয়া তিনি যতো ইচ্ছা বেত চালাইতে পারেন।’
ঈশপের নীতিকথার গল্পেও নানা জায়গায় লাঠির উল্লেখ আছে। এছাড়াও বাংলা প্রবাদ-প্রবচনে, ধাঁধা, মন্ত্রসহ নানা জায়গায় লাঠির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। লাঠি চালানোর মন্ত্রও আছে।

            ‘ধররাম লাঠি, কইবায় খাঁটি।
            কিয়ানো পাইলাম লাঠি?
            না অইলে বুড়া বেটার
            লাঠি আথো লওয়া আসার।
            লাঠি গুন্‌গুন্‌, লাঠি গুন্‌গুন্‌ লাঠি নিলো চোরে।
           এমন মাইর পুত নাই লাঠি রাখতো পারে।
           অনিল পর্বতোর বাঁশ,
           করিল দেয় বৈশাখ মাস।
           আগা কাটি, গুঁড়া কাটি,
           মাঝখানদি বানাইছি লাঠি।
           লাঠি আমার বড়ো ভাই,
           মাঝ গাঙ্গো ঠাঁই পাই।
           আত্তি মারি, ঘোড়া মারি,
           জমাদারতে খাড়া করি।
           মজাইলো গুয়া, তেজাইলো পান,
           শুনছরি রে বেটাইন লাঠির বয়ান॥’

লোকবিশ্বাস মারামারি করার সময় মন্ত্র পড়ে লাঠি চালনা দ্বারা শত্রুপক্ষকে সহজেই পরাজিত করা যায়। যেদিন মানুষ লাঠি দিয়ে আত্মরক্ষা শিখেছে, সেদিন থেকে তাকে নানাভাবে ব্যবহারের কলাকৌশল রপ্ত করেছে। পর্যায়ক্রমে এর উচ্চতা, ব্যাস এবং কিসের তৈরি হলে ভালো হয় তাও ভেবেছে। লাঠি তৈরি হয় শাল-সেগুনের মতো দামি কাঠ, বাঁশ, বেত, বিভিন্ন গাছের সরু ডাল ইত্যাদি দিয়ে। কখনো কখনো সুপারি গাছের কাণ্ড বা শক্ত অন্য কোনো গাছের কাণ্ড দিয়ে লাঠি বানানো হয়। এখন অবশ্য বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়েও লাঠি তৈরি হচ্ছে। তবে বাঙালি ব্যাপক অর্থে লাঠি বললে যে চিত্র কল্পনা করে তা হচ্ছে বাঁশের তৈরি লাঠি। লাঠি তৈরির জন্য বিশেষ ধরনের বাঁশের প্রয়োজন হয়। দাঙ্গা-হাঙ্গামার কাজে যে লাঠি ব্যবহৃত হয় তা তৈরির জন্য প্রয়োজন ঘন গিটযুক্ত পাকা সরু বাঁশ। এই লাঠি লম্বায় আড়াই থেকে তিন হাত হয়ে থাকে। লাঠি খেলার কাজে ব্যবহৃত লাঠি লাঠিয়ালের উচ্চতার সমান লম্বা হয়। এই লাঠির রয়েছে নানা রূপ এবং নানা আকৃতি। কার্য ভেদে নানা আকৃতির লাঠি ব্যবহৃত হয়। ক্ষেত্র বিশেষ এদের নামও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন হালচাষের সময় কৃষক যে লাঠি ব্যবহার করে তার নাম ‘নড়ি’। বৃদ্ধ বয়সে যে লাঠিতে ভর দিয়ে মানুষ চলাফেরা করে তা ‘ছড়ি’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। আবার পুলিশ কিন্তু এখনো ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার নীতি থেকে খুব একটা সরে এসেছে বলে মনে হয় না। আর স্কুলে আমাদের প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ যে দণ্ডটি দিয়ে আমাদের শায়েস্তা করতে পছন্দ করতেন সেটি যা দিয়েই তৈরি হোক না কেন ‘বেত’ নামেই তার খ্যাতি। ব্যবহার ভেদে নাম যাই হোক না কেন একটা সময় পর্যন্ত লাঠি ব্যবহারকারী বা তাদের অধিনস্থরা নিজেরা তৈরি করতেন। আর দশটা ব্যবহার্য সামগ্রীর মতো লাঠিও এখন বিক্রয় পণ্যের মর্যাদা অর্জন করেছে। লাঠি এখন বিদেশ থেকে আমদানিও করা হয়। পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর জন্য রিতিমত দরপত্র আহ্বান করে লাঠি ক্রয় করা হয়। দরপত্রে শর্ত থাকে লাঠি লম্বায় তিন ফুট এবং দেশি-বিদেশি সোজা মোটা বেতের তৈরি হতে হবে।

আবার লাঠি যোগে তৈরি হয়েছে নানা শব্দ। সেগুলো আমাদের সমাজে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন লাঠালাঠি, লাঠিগাঠ, লাঠি চিকিৎসা, লাঠিপেটা, লাঠিবাজি, লাঠি ভাঁজা, লাঠিয়াল, লাঠিয়ালি, লাঠিসোটা, লেঠেল ইত্যাদি। আদিম মানুষ যদিও আত্মরক্ষার জন্য প্রথম লাঠি ব্যবহার করেছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে শাসকগোষ্ঠী তাদের অন্যায় শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য এই লাঠি ব্যবহার করেছে। যে কারণে আজও ‘লেঠেল’ কথাটা ভালো অর্থে ব্যবহৃত হয় না। লেঠেল কথাটা শুনলে মনে হয় জমিদারের খাস লোক, অত্যাচারী। ঢালাওভাবে লাঠির দুর্নাম করলেও এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, তিতুমীরের বাঁশের লাঠি ইংরেজদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এছাড়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, নাচোল বিদ্রোহসহ বাঙালির বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে লাঠি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

 


তথ্যসূত্র:
আশরাফ সিদ্দিকী,  বাংলার মুখ, ঢাকা, ২০০০
ওয়াকিল আহমদ, বাংলা লোকসাহিত্য : মন্ত্র, ঢাকা, ১৯৯৫
জসীমউদ্‌দীন, নক্সী-কাঁথার মাঠ, ঢাকা : শেখ মনিরুদ্দীন এ- কোং, ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ
শামসুজ্জামান খান (সম্পাদক), বাংলাদেশের লোকঐতিহ্য ১ম খণ্ড, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০০৬
শ্রীরাজেন্দ্রলাল আচার্য্য বি-এ, বাঙ্গালীর বল, কলিকাতা, ১৩২৮
সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোহর-খুলনার ইতিহাস, খুলনা: রূপান্তর। পুনর্মুদ্রণ, ২০০১
সামীয়ুল ইসলাম, বাংরাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯২

প্রবন্ধ
ইব্রাহিম খালিদ, বার্ধক্য, রোববার, ২২শে জুলাই ১৯৭৯
ইব্রাহিম খালিদ, বেত্রদণ্ডের ইতিহাস ও পাকিস্তান, রোববার, ২৩শে ডিসেম্বর ১৯৭৯


 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়