ঢাকা     শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৮ ১৪৩১

আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আমাদের মানুষ হতে দেয় না

রুহুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৯ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আমাদের মানুষ হতে দেয় না

রুহুল আমিন : মানুষ হয়ে জন্মেছিলাম। সাধের মানবজীবন। মাঝে মাঝে মনে হয়, আসলেই কি মানুষ হয়ে জন্মেছি? নাকি প্রাণী জীবন নিয়ে জন্মেছি। এখন প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার একটা প্রক্রিয়ায় আছি। তবে এই প্রক্রিয়াকে ইদানীংকালে খুব স্টুপিড মনে হয়।

 

পৃথিবীর আলো-বাতাস খেয়ে অনেক বছর কাটিয়েছি। ২৬-২৭ বছর কম না। প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার যেন আমার নিরন্তর চেষ্টা। কিন্তু কূল-কিনারা পাচ্ছি না। আচ্ছা সত্যি কী প্রাণী জীবন নিয়ে জন্মেছি? আর এখন প্রাণী থেকে মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি? এমনটা হওয়ার কথা নয়। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সেরা জীব নাকি আমরা। তাহলে প্রাণী জীবন হবে কেন? আসলে মানুষ জন্মই আমার। মানুষ হতে হলে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

 

যাপিত জীবনের নানা আয়োজনে আমরা মগ্ন থাকি। আর এই মগ্নতায় আমরা কখনো কখনো, কেউ কেউ মানুষ পরিচয়ের চেয়ে পেশাগত পরিচয়, বংশগত পরিচয়সহ আরো নানা পরিচয়ে বড় হয়ে উঠি। তখনই মনে হয় মানুষ কোনো বিশেষ পরিচয় না। এই হরেক রকমের পরিচয়ের পাশবিকতা আবার খুব ভয়াবহ। কখনো কখনো এই পরিচয়ের তীব্রতা এমন হয় যে, মানুষ পরিচয়টা তখন তার কাছে নিতান্তই একটা সরল পরিচয় হয়ে যায়। আমার কাছে মনে হয় ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে মানুষ নামক ওই প্রাণধারীগুলো প্রাণী হয়ে ওঠে। কিংবা মানুষ হওয়ার জন্য যতটুকু আলোর দরকার হয় ততটুকু আলোকিত হয় না সেসব প্রাণী। শিক্ষার আলোর কথা বলছি। প্রকৃতপক্ষে সুশিক্ষিত ব্যক্তির মানুষ ছাড়া আর কোনো পরিচয় কখনো বড় হয়ে ওঠে না।

 

মানুষ ব্যতীত অন্য পরিচয়গুলো কি জরুরি? আমি মনে করি না। কিন্তু আমিও এই প্রক্রিয়ার বাইরের কেউ না। ছোটবেলা থেকে অনেক পরিচয় নিয়ে বড় হয়েছি। স্কুলজীবন থেকে শুরু। প্রথমে ‍ওমুকের ছেলে, ওমুকের ভাতিজা। এগুলো স্বাভাবিক। এই পরিচয়গুলো মানুষ প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই তৈরি করে। কিন্তু এই পরিচয়গুলো দিয়েই শুরু হয় মানুষ পরিচয় ব্যতীত অন্য পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠার ধারা। এরপর ধীরে ধীরে মানুষ ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ আরো অনেক পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে। আর এসব পরিচয় একসময় মানুষ পরিচয়কে আড়াল করে। ছাত্রাবস্থায় এই পরিচয়ের ধারণা নিজেদের ভেতর একধরনের আমিত্ব তৈরি করে, যা অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা, গুরুত্বপূর্ণ আর বড় করে ভাবতে প্রেষণা দেয়। যা মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই তৈরি হয় শ্রেণির। শ্রেণি সৃষ্টি হলেই শঙ্কা থাকে শ্রেণিবৈষম্য তৈরির। আর মানবসমাজে শ্রেণিবৈষম্যের কারণে সৃষ্ট সমস্যার মুখোমুখি আমাদের সকলের কমবেশি পড়তে হয়। পৃথিবীর শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরোনো ক্যাচাল এবং প্যাঁচাল। পেশার ভিত্তিতে মানুষের বিভিন্ন পরিচয় তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা আক্ষরিক অর্থেই পরিচয় হিসেবে থাকা উচিত। কিন্তু এই পরিচয় যদি মানুষ পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে তখনই তা বিপত্তি বাধায়।

 

আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সরকারও মানুষ পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তির পেশাগত পরিচয়কে বড় করে দেখে বোধ হয়। আমাদের সরকারি দল ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর রয়েছে নিজস্ব পরিচয়পত্র, যা নিজেদের লোক বলে জাহির করে। আর এর মধ্য দিয়ে তারা অন্য সাধারণ নাগরিক থেকে নিজেদের আলাদা, গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক হিসেবে ভাবতে পারে। বিভিন্ন সুযোগ-‍সুবিধা নিতে তাদের এই পরিচয়পত্র সহায়তা করে। প্রকৃতপক্ষে কোথায় পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা নেই? গাড়ির নম্বরপ্লেট থেকে শুরু করে সব জায়গায় এই ব্যবস্থা আছে।

মানুষ পরিচয়ের চেয়ে পেশাগত পরিচয় যে বড় উঠছে তার জ্বলন্ত একটি উদাহরণ মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষককে পেটাল এক ‍ট্রাফিক পুলিশ। মিডিয়াতে ফলাও করে তা প্রচার এবং প্রকাশ করা হলো। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে গেল এবং শেষ পর্যন্ত ওই পুলিশকে শাস্তি দেওয়া হলো। এই শাস্তি পাওয়াতে আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমি ততটুকু খুশি হতে পারছি না। কারণ দেশে প্রায় প্রতিদিন সাধারণ নাগরিক পুলিশের দ্বারা মার খাচ্ছে। এর একটার বিচারও হয় না। কাউকে আন্দোলন দূরে থাক কথাও বলতে শুনি না এইসব নিয়ে। কিন্তু একজন শিক্ষককে মারার কারণে পুলিশের শাস্তি পেতে হলো। তার মানে কী সাধারণ মানুষ মার খেতেই পারে? একটি ঘটনার বিচার চেয়ে অন্য হাজারো ঘটনার বিচারকে আমরা কি নাকচ করলাম না এই ঘটনার মধ্য দিয়ে? এভাবেই তৈরি হয় শ্রেণি এবং শ্রেণিবৈষম্য।

 

মানুষ পরিচয়টাই আমাদের প্রকৃত এবং শেষ পরিচয় হওয়া দরকার। এর চেয়ে বড় কোনো পরিচয় আমাদের থাকা বা হওয়া উচিত নয় বলে আমি মনে করি।

 

লেখাটা শেষ করব একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করেছি। সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ থেকে অনার্স। কাজ করছি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে। পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদকের নাম ও আমার ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইয়ের একই নাম। তো ওনি দেখা হলেই বলতেন, তোমার নিউজ পোর্টালটি একদিন নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছি। খুব গর্ব করে ওনি তা বলতেন আমার সঙ্গে দেখা হলে। ‍ওই ভাই আবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করেন। তো ওনার কাছে বোধ হয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কোনো প্রতিষ্ঠানই না চাকরি করার জন্য। অথবা নিউজ পোর্টাল এটা কোনো ব্যাপারই না। সত্যি সেদিন তাকে পরিচয়ের সংকীর্ণতায় ভোগা একজন ব্যক্তি মনে হয়েছে। কারণ, তিনি টেলিভিশনে চাকরি করেন বলেই বোধ হয় এত সহজে বলতে পেরেছেন কথাটা।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মে ২০১৫/রুহুল/সাইফুল/এএন

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়