বোস কেবিনের সেই আড্ডা আজও আছে
হোসাইন মোহাম্মদ সাগর : ছোট্ট ঘরের মধ্যে তিনটে টেবিল পাতা। প্রতিটিতে চারটে করে চেয়ার। দুটো ছেলে এসে বসলো মাঝের সারিতে। চোখে-মুখে প্রবল উত্তেজনা। গায়ের টি-শার্ট আর পরনের প্যন্টটা বৃষ্টিতে ভেজা। টেবিলের সাথে ডান হাতের আঙুল ঠুকতে ঠুকতে হঠাৎ করেই একটা চাপড় বসালো টেবিলে। হাঁক ছেড়ে বললো- ‘গোপীদা, দু’কাপ চা!’
বাকি দু’টেবিলের সকলের নজর ততক্ষণে ছেলেটার দিকে গিয়ে পড়েছে। মুখে তার কথার তুবড়ি ফুটছে, ‘আর দুটো গোল যদি দিতে পারতাম, তবে শান্তিটা আরো বেশি লাগতো, বুঝলি!’ সদ্য খেলে আসা ফুটবলের আলাপ করছিলো ছেলে দুটো। সাথে এসে যোগ দিলো আরো দুটো ছেলে। গোপীদা ততক্ষণে চা দিয়ে দিয়েছে টেবিলে। কাপ থেকে পিরিচে চা ঢেলে চুমুক দিতে দিতে বাকি দুটো টেবিল থেকেও এগিয়ে গেল আরো কয়েকজন। শুরু হলো তুমুল আড্ডা। বোস কেবিনের চায়ের আড্ডা।
বাঙালি আড্ডা দিতে ভালোবাসে- কী পুরুষ, কী নারী! নগরজীবনে অফিসের কাজের ফাঁকে সহকর্মীর সঙ্গে লাঞ্চ ব্রেকে যেমন গল্প জমে, তেমনি এই গল্পই আড্ডা নামে শিল্পরূপ পায় কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিক, খেলোয়াড়, কলেজ-ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের মধ্যে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেন আড্ডার ম্যারাথন চলে সে সময়। আড্ডা আরো জমে ওঠে যখন তাতে যোগ হয় এক কাপ চা বা হালকা নাশতা। আর আড্ডা জমানোর সেই কাজটিই দীর্ঘদিন করে আসছে ‘বোস কেবিন’।
নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের এই বিখ্যাত বোস কেবিন। এলাকার আড্ডাবাজেরা যে যেখানেই থাকুক না কেন, নির্দিষ্ট সময়ে তারা ঠিক এখানে এসে মেতে ওঠে জম্পেশ আড্ডায়। শুধু কি এলাকার লোকজন, এই বোস কেবিনে চা খেতে আসেন নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকার মানুষও।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এমনকি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বোস কেবিনের অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো অনেক নেতা এই বোস কেবিনের চা-পান করেছেন। কবি, সাহিত্যিকের পদধূলিও পড়েছে সেখানে। কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক সেখানে গিয়েছিলেন বলে জানালেন বোস কেবিনের ম্যানেজার রতন বোস।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ। এই জেলার ১ ও ২ নাম্বার রেলগেটের মাঝামাঝি ফলপট্টির কাছাকাছি রেললাইনের পাশেই অবস্থিত বোস কেবিন। একটি টংঘরের মধ্য দিয়ে বোস কেবিনের যাত্রা শুরু হয় ১৯২১ সালে। প্রতিষ্ঠাতা নৃপেনচন্দ্র বসু। তবে তিনি এলাকায় ‘ভুলুবাবু’ নামে অধিক পরিচিত। তার আদি নিবাস বিক্রমপুরের ষোলঘরে। জীবিকার সন্ধানে ২০ বছর বয়সে ঢাকা আসেন তিনি। শুরুতে তেমন কোনো কাজ না পেয়ে একটি ছোট টংঘরে কড়া লিকারের চা, লাঠি বিস্কুট ও বাটার বিস্কুট নিয়ে বিক্রি করতে বসেন তিনি। সে সময়ই সমাদৃত হয় তার কড়া লিকারের রং-চা। ধীরে ধীরে দোকানটি জনপ্রিয় হতে থাকে। এক সময় দোকানের কলেবর বাড়তে থাকে, নাম হয়- নিউ বোস কেবিন।
শীতলক্ষ্যা পাড়ের হাট-বাজারের দরুন এখানে জনমানুষের পদচারণা সে সময় থেকেই অত্যাধিক। এছাড়া মাঝি-মল্লার ও ব্যবসায়ীদের মুখে মুখে এই বোস কেবিনের জল খাবার আর চায়ের সুখ্যাতি ছড়াতে থাকলে তা অমলিন হয়ে রয়েছে আজ অবধি। তাইতো এখনো সারাদিনে প্রায় হাজার কাপ চা বানাতে হয় এই বোস কেবিনের প্রায় ৩০ বছরের চায়ের কারিগর মতি বোসকে। তার সঙ্গে এখানকার সকাল এবং বিকেলের নাস্তা তো এ অঞ্চলের মানুষের জন্য অমৃত। সব মিলিয়ে শুধু আড্ডা নয়, বরং খাবারের জন্যও বিখ্যাত বোস কেবিন।
ভুলুবাবুর নাতি তারকচন্দ্র বসু বলেন, ‘১৯৩৭ সালে একবার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। সেসময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে দাদা ভুলুবাবু কড়া ও হালকা লিকারের দুই কেটলি চা বানিয়ে ছুটলেন নেতাজির জন্য। সেই চা খেয়ে তখন খুবই খুশি হয়েছিলেন নেতাজি, আশীর্বাদও করেছিলেন। এরপর বিভিন্ন সুযোগ পেলেও শুধু ওই একটি কথা মনে রেখেই দাদা এই ব্যবসা চালিয়ে যান।’
কথা হয় বোস কেবিনে ৪৫ বছর ধরে কর্মরত গোপিনাথ বোসের (গোপীদা) সঙ্গে। গ্রাহকদের চা বিতরণ ও টেবিল পরিষ্কারের ফাঁকে ফাঁকে নানা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে বোস কেবিনে ওয়েটার হিসেবে কাজ শুরু করেছি। ৬ টাকা রোজের বেতন এখন ৩০০ টাকা হয়ে গেছে। আর এই রেস্তোরাঁর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা মানুষের স্মৃতিকথা।
কথা হয় স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি আজিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক সময় দু’আনা কাপে চা খেতাম এখানে বন্ধুদের নিয়ে। দেশের কত নামকরা মানুষ আসতেন এখানে। এখনো আসেন। তবে বর্তমানে সব ধরণের মানুষের আগমনে ইতিহাসের সাথে এটা যেন কেমন বেমানান। এখন শুধু খাবারের হোটেল হয়ে গেছে যেন এটা।’
তবে বোস কেবিনের বর্তমান মালিক তারকচন্দ্র বসু বলেন, খুব দ্রুত মান উন্নয়নের কাজ হবে। কেবিনে আনা হবে আভিজাত্যের ছাপ। পাশাপাশি ২০২১ সালে বোস কেবিনের ১০০ বছর পূর্তি হবে। সে উপলক্ষ্যে ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন বোস কেবিনকে জাতীয়ভাবে উপস্থাপনের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।
তবে যে বোস কেবিন নিয়ে এতো মাতামাতি, তার নাম বোস কেবিন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তারকচন্দ্র বসু বলেন, আমাদের পারিবারিক টাইটেল বা পদবি হলো ‘বোস’। সে জন্যই এটা বোস কেবিন। বোস কেবিনের উল্লেখযোগ্য আইটেম হলো কড়া লিকারের রং চা। দুপুরের দুই ঘণ্টা বাদে এখানে চা পাওয়া যায় সারাদিন। বোস কেবিন প্রতিদিন সকাল সাতটায় শুরু হয়ে খোলা থাকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। আর শুরু থেকে আজ অবধি এই নিয়মেই চলছে ঐতিহ্যের রংমাখা বোস কেবিন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম