ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শিক্ষায় দুর্নীতি রোধে দুদকের যত সুপারিশ

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০২, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিক্ষায় দুর্নীতি রোধে দুদকের যত সুপারিশ

এম এ রহমান মাসুম : প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির উৎস বন্ধে বিষয়ভিত্তিক বেশকিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিমের বিশ্বাস, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে।

বুধবার দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এসব সুপারিশ মন্ত্রিপরিষদের সচিব বরাবর পাঠানো হয়েছে। দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য রাইজিংবিডিকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

দুদকের সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিনের সই করা চিঠিতে অনুসন্ধানকালে পাওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদের সচিব বরাবর পাঠানো হয়েছে।

পাঁচ পাতার চিঠিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলির সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। যেখানে কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতি প্রতিরোধে গৃহীত সুপারিশসমূহের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

দুদক জানায়, কমিশনের প্রতিবেদনে দুর্নীতির উৎস, দুদকের আইনি ম্যান্ডেট এবং এসকল দুর্নীতি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করে দুদকের বিশেষ টিমের সদস্যরা। ওই প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট/গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ বিভিন্ন প্রকারে দুর্নীতির উৎস এবং তা বন্ধের জন্য ৩৯টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম।

মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সুপারিশগুলো হলো-

প্রশ্নপত্র ফাঁস:
পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস দুর্নীতির নতুন সংযোজন। কতিপয় ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা এ ধরনের অপরাধে সংশ্লিষ্ট।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য উৎস :
শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি এবং পরীক্ষাকেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্র। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণের প্রতিটি স্থানেই দায়িত্বে আছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। অর্থের বিনিময়ে সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক প্রশ্নপত্র ফাঁস অপরাধমূলক অসদাচরণ, যা দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। এ জাতীয় দুর্নীতি দমনের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম বলে মনে করে সংস্থাটি।

প্রশ্নপত্র ফাঁসে সুপারিশগুলো হলো:
প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে মেধাবী, সৎ এবং মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক বাছাই করে নিয়োগের ব্যবস্থা করা।

প্রতিটি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে ইংরেজি অনুবাদের জন্য একজন অনুবাদক নিয়োগ করা।

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণে যারা থাকবেন তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা নিতে হবে। যাতে উল্লেখ থাকবে যে, তাদের সন্তান কিংবা পোষ্য সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন না অর্থাৎ স্বার্থের দ্বন্দ্ব যেন না থাকে। এই অঙ্গীকারনামা যাচাইপূর্বক তাদেরকে মনোনয়ন দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত মডারেটরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর নজরদারিতে রাখা।

বিশেষ লক সংবলিত বক্সের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রতিটি ট্রেজারিতে প্রশ্নপত্র পাঠাতে হবে। ডাবল লক সংবলিত এই তালা জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে খোলা হবে এবং একই পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রশ্নপ্রত্র উপজেলা পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো যেতে পারে।

পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় সর্বোচ্চ দুটির বেশি পরীক্ষাকেন্দ্র রাখা সমীচীন হবে না। পরীক্ষা কেন্দ্রসমূহ উপজেলা শহরেই থাকা বাঞ্ছনীয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে যেসব অপরাধীদের গ্রপ্তার করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইনে মামলা করাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করা যেতে পারে।

কোচিং এবং নোট-গাইড বাণিজ্য :
শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পাঠদান না করা, কোচিং  মালিক ও কিছু শিক্ষকের অবৈধভাবে স্বল্প সময়ে সম্পদ অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষা কার্যক্রমের মনিটরিংয়ের অভাব এবং অভিভাবকদের অসচেতনতা  ইত্যাদি দুর্নীতির মূল উৎস। এক্ষেত্রে দুদক মনে করে, যেসব শিক্ষক একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন বহাল থেকে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনৈতিক অর্থ উপার্জন করছেন তাদের বিরুদ্ধে অনুপার্জিত আয়ের অভিযোগ সৃষ্টি হয়। সাধারণত এ জাতীয় অনৈতিক অর্থ আয়ে কোনো প্রকার ভ্যাট বা ট্যাক্স দেওয়া হয় না। যা অনুপার্জিত আয় হিসেবে পরিগণিত হয়।

এ জাতীয় অপরাধ প্রতিরোধে দুদকের সুপারিশ হলো:
শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিতকল্পে মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা মনিটরিং কমিটি গঠন করা।

সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির নীতিমালা অনুসারে বদলি নিশ্চিত করার পাশাপাশি অবস্থাতেই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের সংযুক্তির মাধ্যমে প্রশাসনিক কোনো পদে বা ঢাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদায়ন করা উচিত নয়।

গ্রামীণ বিদ্যালয়ে শিক্ষকস্বল্পতা, বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিত শিক্ষকের স্বল্পতা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

প্রশ্নপত্র আমূল সংস্কার করা প্রয়োজন: যেমন পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী প্রশ্নপত্র সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া। প্রশ্ন হতে পারে বর্ণনামূলক, সৃজনশীল এবং বিশ্লেষণধর্মী।

সরকার প্রণীত কোচিং নীতিমালার বাইরে যেসব শিক্ষক কোচিং করাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

কোচিং সেন্টার বন্ধ করা প্রয়োজন। এসব কোচিং সেন্টারের মালিক বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন তাদের বিষয়গুলো দুদক খতিয়ে দেখবে।

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সকল নোট-গাইড প্রকাশনা সংস্থায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন এবং শিক্ষক, অভিভাবক ও স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির মধ্যে নিয়মিত মাসিক সভার আয়োজন করা যেতে পারে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি:
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন:  স্কুল, কলেজ মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক বা প্রিন্সিপাল, সহকারী প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ, জাল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে এমপিওভুক্তিকরণ, বোর্ড পরীক্ষার সময় ফরম পূরণে কোচিং ফি, হোস্টেল-ভবন সংস্কার, শিক্ষাসামগ্রী ক্রয়, উন্নয়নসহ বিভিন্ন মনগড়া খাত সৃষ্টি করে অর্থ আদায়, নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের বোর্ড পরীক্ষায় সুযোগ দানের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, অনুরূপভাবে ভর্তির সময় বিভিন্ন খাত দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়। ল্যাবরেটরি ফি, মডেল টেস্টের ফি’র নামে অর্থ আত্মসাৎ ইত্যাদিকে দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এসব কার্যক্রমের সঙ্গে যারা যুক্ত রয়েছেন তাদের অধিকাংশই সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ নিয়ে থাকেন। তাদের যেকোনো প্রকার আর্থিক দুর্নীতির বিষয়সমূহ দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। ইতোমধ্যে এ বছর জাল রেজুলেশন এবং জাল সার্টিফিকেট ব্যবহার করে এমপিওভুক্ত হয়েছেন এমন বেশকিছু শিক্ষক এবং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক কয়েকটি মামলা দায়ের করেছে।

এ জাতীয় অপরাধ প্রতিরোধে সুপারিশগুলো হলো:
জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে মন্ত্রণলায়ের অধিযাচন অনুসারে প্রচলিত সকল নিয়ম অনুসরণ করে প্রতি বছর নিয়োগের ব্যবস্থা করা। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএসসির আদলে কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।

বর্তমানে এমপিওভুক্তি বিকেন্দ্রীকরণের কারণে দুর্নীতি কিছুটা কমলেও জাল সার্টিফিকেট, জাল রেজুলেশন, এমনকি প্রযুক্তি জালিয়াতির একাধিক ঘটনা দুদক তদন্ত করছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর এসব কাজে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এর পাশাপাশি নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন নীতিমালা অনুসরণ করে নিয়মিত বদলির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের নীতিমালা অনুসারে কর্মকর্তারা একটানা তিন বছরের বেশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থায় থাকতে পারবেন না।  নতুন স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নীতিমালার যথাযথ অনুসরণ প্রয়োজন।

শিক্ষকদের পেনশন প্রাপ্তিতে দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে তাদের আবেদনের সাথে সাথেই তাদেরকে পেনশন প্রাপ্তির দিন-ক্ষণ জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ। কোনো অবস্থাতেই সিরিয়াল ভঙ্গ করা বাঞ্ছনীয় নয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) দুর্নীতি
প্রতি বছর ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার গৌরব এবং কৃতিত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের। এ মহৎ কাজের পেছনে যদি ন্যূনতম দুর্নীতি বা অনিয়ম হয় তা মানুষকে ব্যথিত করে। তাই এনসিটিবির কার্যক্রম হতে হবে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন। পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের টেন্ডার প্রক্রিয়া, বিভিন্ন কমিটি গঠন, পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি কতিপয় প্রকাশকদের কাছে অননুমোদিতভাবে সরবরাহ, অবৈধ কোচিং বাণিজ্য প্রসারের জন্য বইয়ে তথ্য সংক্ষিপ্তকরণ ও স্বনামে-বেনামে টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি দুর্নীতি।

এ জাতীয় অপরাধ প্রতিরোধে সুপারিশগুলো হলো:
টেন্ডার প্রক্রিয়া দুর্নীতির একটি বড় উৎস। এনসিটিবির সব টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়া অনুসরণ করা প্রয়োজন। কোনো কর্মকর্তা যদি নামে বা বেনামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে দরপত্র অংশগ্রহণ করেন তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকের মান নিয়ন্ত্রণে তদারকি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক কমিটি, শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি ও টেকনিক্যাল কমিটিতে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে।

শিক্ষাক্রম ও পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।

বইয়ের পাণ্ডুলিপি যখন এনসিটিবি প্রেসে পাঠানো হয়। ঠিক একই সময়ে এনসিটিবির অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তা পৌঁছে যায় নোট-গাইড প্রকাশকদের কাছে। এ বিষয়ে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয় কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

পাঠ্যপুস্তকে তথ্য চরমভাবে সংকুচিত করা হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন শ্রেণির গণিত বইয়ে উদাহরণমালার অধিকাংশ সমস্যারই সমাধান নেই। সাধারণত শিক্ষার্থীরা উদাহরণমালা অনুসরণ করেই অনুশীলনীর সমস্যার সমাধান করে থাকে। কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষেই শিক্ষকের সর্বোচ্চ সাহায্য/কোচিং/নোট-গাইড ছাড়া বর্তমান পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে পাঠ অনুধাবন সম্ভব নয়। পাঠ্যবই পাঠ করে তা অনুধাবনের পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় শিক্ষার্থীর কোচিং এবং নোট-গাইডের ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাই এ প্রেক্ষাপটে সকল পাঠ্যবইয়ে সমাধানসহ নমুনা প্রশ্ন সংযোজন করা প্রয়োজন।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের দুর্নীতি:
অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রাক্কলন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি যেমন: টেন্ডারের তথ্য ফাঁস, নেগোসিয়েশনের নামে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সাপোর্টিং বা এজেন্ট ঠিকাদার নিয়োগ, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, টেন্ডারের শর্তানুসারে কাজ বুঝে না নেওয়া, মেরামত বা সংস্কার কাজের নামে ভুয়া বিল ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক বেনামে অথবা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ পরিচালনা করা দুর্নীতির উৎস হিসেবে পরিগণিত।

এক্ষেত্রে দুদকের সুপারিশ :
ই-টেন্ডারিং এর মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ।

নির্মাণ কাজ মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় শিক্ষক, সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নাগরিক কমিটি গঠন করা।

যেসব কর্মকর্তা নামে-বেনামে ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের তালিকা তৈরি করে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যেতে পারে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব দূর করার জন্যে এবং জাতীয় শুদ্ধাচারের কৌশল হিসেবে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তাদের আত্মীয়-স্বজন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িত আছে কি না তার সুস্পষ্ট অঙ্গীকারনামা নেওয়া।

নির্মাণ কাজে মন্ত্রণালয় মনিটরিং টুলস যেমন: পরিদর্শন, অডিটিং, রিপোর্টিং ইত্যাদি প্রয়োগ করতে পারে। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় দুদকের সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারে। কাজ চলমান অবস্থায় নির্মাণ কাজ মনিটরিং করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

মেরামত কাজের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো মেরামত বা সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানপ্রধানের প্রত্যয়নপত্র ছাড়া বিল পরিশোধ করা যাবে না।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ মনিটরিং যেমন: পরিদর্শন, অডিটিং ও রিপোর্টিং কার্যকর করা।

মনিটরিংয়ের নামে কোনো প্রকার হয়রানি কিংবা উপঢৌকন গ্রহণের সংস্কৃতি কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা বা তার ইউনিট মনিটরিং কার্যক্রম সমন্বয় করতে পারেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম:
শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার পলিসিসহ সকল কার্যক্রম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরিচালনা করছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোন পথে পরিচালিত হবে তার নিয়ন্ত্রক শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বছরের শুরুতেই মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া, নারী শিক্ষা প্রসারে যুগান্তকারী কিছু কর্মসূচিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই মন্ত্রণালয়ের ঈর্ষণীয় সাফল্য থাকলেও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং বাণিজ্যের প্রসার, নোট-গাইডের ব্যাপক প্রচলন, শিক্ষক বদলি ও পদায়নসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নেতিবাচক আলোচনায় মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ।

এ প্রেক্ষাপটে দুদকের সুপারিশ:
বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় নির্দেশমালা ২০১৪ অনুসরণ করে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কার্য সম্পাদন নিষ্পত্তিকরণ।

সচিবালয় নির্দেশমালা অনুসারে অর্পিত ক্ষমতানুসারে নথি নিষ্পত্তি না করে এবং অনাহুতভাবে নথি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে বিষয় নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ঘটানো হয়। এভাবে বিষয় নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ঘটিয়ে দুর্নীতির পথ সৃষ্টি করা হয়। এসব কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানপ্রধান গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-১০ পর্যন্ত পদসমূহ ছাড়া অন্যান্য পদের বদলি ও পদায়ন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও বিভাগীয় কার্যালয়ের ওপর অর্পণ করা। তবে এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের বদলি ও পদায়ন নীতিমালার আলোকে এসব কার্যক্রম মনিটরিং করা।

বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহার বন্ধে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত প্রকল্পসমূহের বিভিন্ন ক্রয়, গাড়ি ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ, প্রশিক্ষণের নামে অর্থ ব্যয়ে অনিয়মের যেসব অভিযোগ রয়েছে তা দূরীকরণের উদ্যোগ প্রয়োজন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা অথবা তার ইউনিটের মাধ্যমে বিভিন্ন মনিটরিং টুলস যেমন: পরিদর্শন, অডিটিং, রিপোর্টিং ইত্যাদি প্রয়োগ করে এসব ক্ষেত্রে এ জাতীয় অনিয়ম দূর করা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুসারে সনদপত্রের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং শিক্ষাসংক্রান্ত সকল কার্যক্রম বন্ধ করা।

এ বিষয়ে দুদক সচিব ড. শামসুল আরেফিন রাইজিংবিডিকে বলেন, আগামী প্রজন্মকে দুর্নীতির কবল থেকে রক্ষা করতেই দুদক শিক্ষার দুর্নীতি নিয়ে কাজ করেছে। আমরা চাই, আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন দুর্নীতির বলয়ের বাইরে থাকে।

শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানিক টিমের প্রধান ও দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল এসব সুপারিশ তৈরি করে। টিমের অপর সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৭/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়