ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ধর্ষণ ও চিকিৎসকের পাঁচালি

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ধর্ষণ ও চিকিৎসকের পাঁচালি

জাফর সোহেল: খুব আশা করেছিলাম, ২০১৭ সালের বাংলাদেশের ছবি কিছুটা হলেও রং পাল্টাবে ২০১৮ সালে এসে। খুন-ধর্ষণ, গুম-অপহরণের সংখ্যা কমে আসবে। কারণ, এসব বিষয়ে গত বছর যে অভিজ্ঞতা আমরা নিয়েছি, সেখান থেকে উত্তরণের আশ্বাস আমরা পেয়েছিলাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে। তারা সেই চেষ্টা হয়তো অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু আফসোস এই যে, বছর শুরু হয়েছে মাত্র দুই সপ্তাহ, এরই মধ্যে ১৫ মাসের শিশু ধর্ষণের খবর আমাদের পড়তে হয়েছে। আবার সমাজে উচ্চবিত্ত তো বটেই, উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির চরিত্র একজন চিকিৎসক দ্বারা তরুণীর সম্ভ্রম লুণ্ঠনের খবরও পড়তে হয়েছে। মনে হয়, এই চক্রাকার অপরাধবৃত্ত থেকে আমাদের বুঝি কোনো দিন রেহাই মিলবে না। এই সমাজের নৈতিক উন্নতি বোধহয় আর কখনও হবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ারে দিনে দিনে কি তবে হারিয়ে যাবে মনোজাগতিক উন্নয়ন?-প্রশ্নটি প্রকট হচ্ছে।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে সম্প্রতি শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী তরুণীর পিতা। ঘটনা শুনে প্রথমে আমাদের অনেকের বিশ্বাস হবে না, আমি জানি। তবে, আমরা তো সেই দেশে বাস করি, যেখানে চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণের শিকার হন। দিনাজপুরের ইয়াসমীনের কথা হয়তো আমরা এখনও ভুলে যাইনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং হাসপাতালে যে ঘটবে না তার নিশ্চয়তা ছিল না। এবার সেই আশঙ্কাও সত্যি হলো! দিনে দিনে মানুষ সভ্য হয়ে ওঠে। আমরাই সম্ভবত একমাত্র উল্টো পথের যাত্রী। আমরা যেন অসভ্যতার ক্ষেত্রে কীভাবে আরও উন্নতি করা যায় সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছি।

যাই হোক, উল্লেখিত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যিনি মামলা করেছেন তার বক্তব্য- তিনি অনেকটা নিরুপায় হয়ে থানায় গিয়েছেন। তার কন্যাকে চিকিৎসক ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাকে হুমকি দিয়েছেন ধর্ষণের ভিডিও ভাইরাল করে দেয়ার। গণমাধ্যমে সেই হুমকির ভাষাটা এসেছে এভাবে: ‘ভাইরাল করে দিলে কী করবে, তখন তো মুখ দেখাতে পারবে না!’ হায়রে নির্বোধ, ধর্ষণের সেই ভিডিও ভাইরাল হলে কেবল কি তরুণীর মান যাবে? তার সম্মানের কিছু হবে না?

 

তার মানে এই চিকিৎসক নিজেও সমাজের সামনে নগ্ন হতে রাজী! চরিত্রের কতখানি অধঃপতন হলে এমন চিন্তা করেন একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ? বিষয়টি পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে একটা কথা আমার মনে পড়ল। আচ্ছা, ধর্ষকদের ছবি ভাইরাল করে দেয়ার আলাদা উদ্যোগ নিলে কেমন হয়?  কিছুটা যেমন হয়েছিল বনানীর ধর্ষণ ঘটনায় আপন জুয়েলার্স পরিবারের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে কিছু পরিবার আছে যারা ধর্ষক স্বজনের জন্য কান্নাকাটি করে। তাকে সাজার হাত থেকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। কেন? অপরাধী নিজের লোক হলেও সে তো অপরাধীই। অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা যদি ভালো মানুষ করে, তাহলে সমাজে অপরাধ কী করে কমবে? 

গত সপ্তাহের আলোচিত এই মামলার পর থেকে ধর্ষণের আসামি সেই চিকিৎসক পলাতক আছেন। পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না, খুঁজে পাচ্ছে না গণমাধ্যমকর্মীরাও। তবে, একটি গণমাধ্যমে তার বক্তব্য এসেছে। তিনি বলেছেন, ‘সব সাজানো। তার কাছে চাঁদা দাবি করে না পেয়ে এই ঘটনা সাজিয়েছে মেয়েটির পরিবার।’

ভালো কথা, ঘটনা সাজানো। কিন্তু ডাক্তার সাহেব পলাতক কেন? কীসের ভয়? চাঁদাবাজির মামলা করছেন না কেন তিনি?

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নেয়া ভুক্তভোগী তরুণীর চিকিৎসাপত্রে স্পষ্ট লেখা আছে: ‘সেক্সুয়ালি অ্যাসল্ট’। অর্থাৎ যৌন নির্যাতন। বাংলাদেশের কোনো মানুষ বিশ্বাস করবে না একজন উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসককে ফাঁসাতে ধর্ষণের গল্প বলবে মফস্বলের কোনো তরুণী। ঘটনা যে এখানে কিছু একটা ঘটেছে তা পরিষ্কার। বিশেষ করে, তরুণীর মুখে বিশিষ্ট এই চিকিৎসকের যৌন লালসার শিকার হওয়ার প্রাথমিক যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে ঘটনার সব পরিক্রমা মিলে যায়, বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। তরুণী বলছেন, চর্ম ও যৌন রোগের এই চিকিৎসক প্রথম দিনই তাকে শরীরে মলম লাগিয়ে দেয়ার কথা বলে যৌন হয়রানি করেছেন। প্রতিবাদ করলে আরো বলেছেন, আমি তোমার ডাক্তার, অতএব আমি এসব জায়গায় হাত দেব!

লজ্জায় ঘটনা কাউকে জানায়নি সে। এখানেই তার ভুল। তাহলে হয়তো সেই তরুণীর জীবনে এত বড় দুঃসহ ঘটনা ঘটত না। কেননা দ্বিতীয় সাক্ষাতেই সে ধর্ষণের শিকার হয়। এ সময় চিৎকার করতে গেলে চিকিৎসক ওড়না দিয়ে তার মুখ বেঁধে ফেলে। এ যেন রুপার ধর্ষক সেই বাসের সহকারী। ঐ অশিক্ষিত সহকারীর সঙ্গে  এই শিক্ষিত চিকিৎসকের যেন কোনো পার্থক্য নেই!

বাংলাদেশেই কেবল নয়, পৃথিবীতেই চিকিৎসকদের অনেকে দেখেন ঈশ্বরের দৃষ্টিতে। রোগের ধকলে রোগী যখন আর উপায় দেখেন না, তখন চিকিৎসকের দুই হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, আমাকে বাঁচান ডাক্তার, আমি বাঁচতে চাই। প্রত্যেক ধর্মেই আছে, জন্ম-মৃত্যুর একমাত্র মালিক আল্লাহ বা ঈশ্বর। এরপরও সবাই চিকিৎসকের কাছেই বাঁচার আকুতি জানান। মফস্বলের মানুষদের কাছে ঢাকা মেডিকেল বা পিজির ডাক্তার মানেই বড় চিকিৎসক। মফস্বল শহরে যারা ডাক্তার দেখান তারা জানেন বিষয়টা। উপলব্ধিও করতে পারবেন ভালো। সেই হিসেবে ঐ তরুণীর মনে বড় আশা ছিল, যেহেতু তিনি বড় ডাক্তার, নিশ্চয়ই তার ভালো চিকিৎসা হবে। কিন্তু নীতি ও নৈতিকতায় সেই চিকিৎসক যে, সমাজের নিম্নশ্রেণির কিংবা অশিক্ষিত বর্বরদেরও হার মানাবে তা কী করে জানবে গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে? এই অজ্ঞতার কারণে তাকে শেষ পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হলো; আদালতের বিচারে চিকিৎসকের যদি শাস্তিও হয়, তরুণীর মনের ভেতরে চিকিৎসক সমাজের প্রতি যে বিরূপ-ভীতিকর মনোভাব তৈরি হলো তার প্রতিকার কী হবে? কিংবা এই ঘটনা শুনে, পত্রিকায় পড়ে আরো আরো যত তরুণীর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তার প্রতিকারই বা কী হবে? বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে রোগীর স্বজন এবং চিকিৎসকদের মধ্যে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, তাতে চিকিৎসক সমাজ যতই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। চিকিৎসক শুধু কেতাবি জ্ঞান নেবেন এমন নয়, তাকে সমাজের মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণের তালিমও নিতে হবে। যতটুকু জানি, এই ব্যবস্থা আছেও। কিন্তু কজন সেই শিক্ষাটা ঠিকঠাক নিচ্ছেন বা কতজন নিচ্ছেন না, বিষয়টি চিকিৎসক সমাজের নেতৃস্থানীয়দের খতিয়ে দেখতে হবে। কোনো একজন চিকিৎসক খারাপ কিছু করলে সে কারণে চিকিৎসক সমাজকে খারাপ বলার উপায় নেই। তা যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে, কিছু কিছু ঘটনা অবশ্যই বৃহত্তর পর্যায়ে প্রভাব ফেলে। সেই ঘটনাগুলো যেন না ঘটে সেদিকে নজর দেয়া উচিত। বাংলাদেশের মানুষ এখনো চিকিৎসকদের শ্রদ্ধা এবং সমীহ করে। সুতরাং শ্রদ্ধা পাওয়ার রীতি ধরে রাখার জন্য তাদেরকেই সচেতন হতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়