ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পৌলী নদীর ভাঙন : হুমকিতে টাঙ্গাইল শহররক্ষা বাঁধ-ঘরবাড়ি

শাহরিয়ার সিফাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ৮ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পৌলী নদীর ভাঙন : হুমকিতে টাঙ্গাইল শহররক্ষা বাঁধ-ঘরবাড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক, টাঙ্গাইল : সবেমাত্র বানের পানি আসতে শুরু করেছে পৌলী নদীতে। এরই মধ্যে টাঙ্গাইলের পৌলী নদীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।

ইতোমধ্যে নদীর বাম তীরে ৬০০ মিটার ও ডান তীরে ৮০০ মিটার এলাকা এবং ৮-১০টি বাড়ি নদীতে চলে গেছে। ডান তীরের ভাঙন টাঙ্গাইল শহররক্ষা বাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সূত্র মতে, ২০০০ সালে ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ টাঙ্গাইল শহররক্ষা বাঁধটি তৈরি করা হয়। যা ছিলিমপুর-করটিয়া বাঁধ নামে পরিচিত।

দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় হুমকির মুখে রয়েছে টাঙ্গাইল শহর রক্ষার এই বাঁধ। বিশেষ করে বাঁধের পূর্বাংশ পুংলি ব্রিজ থেকে মহেলা, আগবেথর, পাছবেথর, শালিনা, বার্থা হয়ে করটিয়া পর্যন্ত বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে।

এছাড়া বাঁধের পুরো অংশটি ভেঙে গেলে টাঙ্গাইল শহর, গালা, ঘারিন্দা, করটিয়া ইউনিয়নসহ বাসাইল উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বাড়িঘর, ফসলি জমি, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ-মাদরাসা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

এছাড়াও ঢালান শিবপুর ঘাট থেকে যুগনি পর্যন্ত প্রধান স্লুইসগেট এলাকাসহ শিবপুর ও শ্যামার ঘাট এলাকায় বাঁধের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। একইভাবে প্রতিনিয়ত শহর রক্ষা এই বাঁধের বিভিন্ন অংশে যানবাহন চলাচলের কারণে দেবে গেছে। গত বছর বন্যার সময় রামদেবপুর এলাকার বাসিন্দারা নিজ উদ্যোগে মাটি ফেলে কোনোরকমে বাঁধের রামদেবপুর অংশটিকে রক্ষা করেছিল।

স্থানীয়রা জানান, বেশ কিছুদিন ধরে পৌলী নদীতে বর্ষার পানি এসেছে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে নদীর দুই তীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পৌলী নদীর বাম তীরে কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভা ও সহদেবপুর ইউনিয়ন এবং ডান তীরে সদর উপজেলার গালা ও ঘারিন্দা ইউনিয়নের আওতায়। নদীর বাম তীরে (উত্তরাংশে) অর্থাৎ এলেঙ্গা পৌরসভার অংশে ভাঙনের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। গত এক সপ্তাহের ভাঙনে এলেঙ্গা পৌরসভার ফটিকজানী ও মহেলা গ্রামের ৬০০ মিটার এলাকার আবাদি জমি এবং মহেলা গ্রামের সেকান্দর আলী ও তার ভাইদের ৮-১০টি বাড়ি নদীর গর্ভে চলে গেছে। নদীর ভাঙন চারান-লক্ষীবাসা বিল উপ-প্রকল্পের বাঁধের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।

বাঁধটি রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাঁধের পাশেই মহেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মহেলা মাদ্রাসা, মহেলা ঈদগাহ মাঠ ও গোরস্থান। চারান-লক্ষীবাসা বিল উপ-প্রকল্পের বাঁধটি ভেঙে গেলে কালিহাতী উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ঘরবাড়ি-ফসলি জমি, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা প্লাবিত হয়ে অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হবে। পৌলী নদীর ডান তীরে রেলব্রিজ সংলগ্ন এলাকাটিও এলেঙ্গা পৌরসভার মহেলা আদর্শ গ্রাম (গুচ্ছগ্রাম) এবং টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের পাছবেথইর, আগবেথইর ও শালিনা গ্রামের অংশেও ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮০০ মিটার এলাকা ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে বর্তমানে কম্পার্টমেন্টালাইজেশন পাইলট প্রকল্পের বাঁধ (টাঙ্গাইল শহররক্ষা বাঁধ) ছুঁই ছুঁই করছে। এ বাঁধটি ভাঙনের শিকার হলে টাঙ্গাইল শহর, গালা, ঘারিন্দা, করটিয়া ইউনিয়ন সহ বাসাইল উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বাড়িঘর, ফসলি জমি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার ফটিকজানী গ্রামের বেলায়েত হোসেন, মহেলা গ্রামের মামুনুর রশিদ, আলতাফ মিয়াসহ অনেকেই জানান, শুকনো মৌসুমে নদীর তলদেশে বাংলা ড্রেজার বসিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করায় এখন নদী তীরের নিচের অংশ ধসে ভেঙে পড়ছে। নদীতে পানি আসার সময়ই পরিস্থিতি বিবেচনায় টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তিনি ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও কোনো কার্যকারিতা দেখা যায়নি। ফলে নদীর তীর ভাঙতে ভাঙতে আবাদি জমি গিলে চারান-লক্ষীবাসা বিল উপ-প্রকল্পের বাঁধ কামান্না রাস্তার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। বাঁধটি ভাঙনের শিকার হলে উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ৬টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হবে।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের পাছবেথইর গ্রামের আমীর আলী, বুজরত আলী, আব্দুল বারেকসহ অনেকেই জানান, নদীতে বাংলা ড্রেজার বসিয়ে অবাধে দিনরাত বালু উত্তোলন করায় এখন নদী তীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েকদিনের ভাঙনে নদী তীর বর্তমানে টাঙ্গাইল শহর রক্ষা বাঁধের খুব কাছে এসেছে। এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে টাঙ্গাইলের পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

ভাঙনের খবর পেয়ে গত ১৯ জুন মঙ্গলবার বিকেলে পৌলী নদী এলাকা পরিদর্শন করেন টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন। এ সময় তার সাথে ছিলেন, টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায়, টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাজাহান সিরাজ প্রমুখ।

এ সময় স্থানীয়দের দাবির মুখে কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দ ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। সে লক্ষ্যে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জেলার পৌলী নদী ভাঙন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বুধবার (২০ জুন) একটি পত্র পাঠিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে এলেঙ্গা পৌরসভার কাউন্সিলর শুকুমার ঘোষ ও আব্দুল বারেক জানান, পৌলী নদীতে প্রতিবছর বর্ষায়ই দুই তীরে ভাঙন দেখা দেয়। এ বিষয়ে তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এ বছর বর্ষার শুরুতেই নদীর বাম তীরে ফটিকজানী গ্রাম ও মহেলা গ্রামের বিশাল এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাজাহান সিরাজ জানান, তিনি ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন। শহর রক্ষায় ৪৭ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। তবে এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় ভাঙন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভাঙনকবলিত গ্রামগুলোর মধ্যে মহেলা, পাছবেথর, রানাগাছা, বার্থা অন্যতম। এসব এলাকায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। তখন এসব এলাকায় ভাঙন থাকবে না। আর এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদিত হলে ভাঙনরোধে কাজ করা হবে।

তিনি আরো জানান, বর্তমানে তাদের কাছে কোনো বাজেট নেই। বাজেট না পেলে শুধু শুষ্ক কেন কোনো মৌসুমেই কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জানান, তিনি ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। পৌলী নদীর ভাঙন প্রতিরোধে দুই স্তরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমানে জরুরি প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও শুকনো মৌসুমে স্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা। নদী ভাঙনে টাঙ্গাইল শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেলে টাঙ্গাইল শহরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা মারাত্মক দুর্যোগের সম্মুখীন হবে।

তিনি জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রী মহোদয়ের পিএসের সাথে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।



রাইজিংবিডি/টাঙ্গাইল/৮ জুলাই ২০১৮/শাহরিয়ার সিফাত/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়