ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সুধাময় চিঠির ডাকঘর || পিয়াস মজিদ

পিয়াস মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ৭ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুধাময় চিঠির ডাকঘর || পিয়াস মজিদ

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

আজ সকালের আমন্ত্রণে আমি যে রাতের কাছে গেলাম তার নাম রবীন্দ্রনাথ। কারণ দেড়শ বছর আগের ২৫ বৈশাখের এক জাতক আমার পৃথিবীকে এমন অভিজ্ঞান দান করেছে যে, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। হ্যাঁ, শিমুলপুরের বিনয় মজুমদার যেমন বলেন, রবীন্দ্র-জন্মের পর পৃথিবী আর পৃথিবী নেই। পৃথিবী এরপর থেকে রবীন্দ্রগ্রহ। এ কথাকে উন্মাদ-প্রলাপ বলে মনে হলেও দেখি আমার দেখার চোখটা পাল্টে দিয়েছেন জোড়াসাঁকোর এই ঠাকুর। তার দিগ্বিদিক প্রভায় আমার ভেতরকার ঢেউগুলোও ভাঙছে দু’ধারে, নিরূপায়।

কালরাত্রি, নাগিণী নিঃশ্বাস, ঝড়ো হাওয়া পেরিয়ে-মাড়িয়ে স্বপ্নভঙ্গ থেকে পৌঁছবো হয়তো বোধে। হয়তো বা পৌঁছবো না কোথাও। তাতেও খেদ নেই। পথ চাওয়াতেই যে আনন্দ।
অধ্যাপককবলিত রবীন্দ্রনাথ আমার কেউ নন। চারদিকে মঞ্চ আলো হয়। মূঢ়ের তালি পড়ে। বলে পক্ককেশ ভক্তবৃন্দ, ‘মহামহিম রবীন্দ্রনাথ, তাকে অতিক্রমের সাধ্য কারও নাই।’ অথচ অতিক্রমণের আনন্দগান তো তাঁরই। পথে চলে যেতে যেতে এমনকী নিজেকেই ছাড়িয়ে যেতে হবে।
আর জানি না তো পথের শেষ কোথায়!
এবং স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত সুরে সুরে জানিয়ে গেলেন দিনপঞ্জিতে ২৫ তারিখটা আছে বলেই এমন তুমুল খর-বৈশাখ আসলে আনন্দ-বসন্তের বিশ্বস্ত বার্তাবাহক। ফাল্গুন-চৈত্রও এ বিশেষ বসন্তের কাছে তুচ্ছ।


এই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে যখন বিষয় ঠিক করতে পারছি না তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমার মতো নেহায়েত বৃক্ষ-মূর্খকে গাছ চেনাতে গিয়ে কবি দ্রাবিড় সৈকত বললেন, ‘অ্যালামুন্ডা নাম পাল্টে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটা ফুলের নাম দিয়েছেন- অলকানন্দা। কী সুন্দর ভাবুন তো দেখি।’ হ্যাঁ ভাবছি আমি। রবীন্দ্রনাথ তো আসলে সুন্দরতার চেতনা। এ চেতনা গজদন্ত মিনারে বসত করে না। আত্মবোধের দুয়ার খুলে দেয়। আর এভাবেই তো আমার চেতনার রঙে পান্না হয়ে যায় সবুজ।
জনান্তিকে একজন হঠাৎ বলে উঠলো ‘‘আইয়ুব বাচ্চুর ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি, তুমি সুযোগ পাইলে বন্ধু বাসিও...’ গানটির ভাবনাবীজ যে রবীন্দ্রনাথ থেকে নেয়া তা থেকেই তো বোঝা যায় ঠাকুরকে ব্যান্ডওয়ালারও অস্বীকার করতে পারছে না।’’ এই কথা শুনতে শুনতে ভাবছি ব্রিটিশ-ভারতের সুরেশচন্দ্র সমাজপতি থেকে শুরু করে পাক জমানার খাজা শাহাবুদ্দিন পর্যন্ত কত রাজা-উজির, খাজা-গজা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড়াল। কিন্তু সার্থকভাবে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। নইলে বলাকার কবি কী করে লিখেন পুনশ্চ? এককালের ভক্তিবাদী কবি কেমন করে মাছের কানকো আর কাঁঠালের ভুঁতিকেও করে তোলেন কবিতার সামগ্রী? নিজের নির্মিত ছন্দের ঘরবাড়ি ভেঙে কী করে বেরিয়ে আসেন টানাগদ্যের বারান্দায়? শেষের কবিতায় পাত্র-পাত্রীর সংলাপের মধ্য দিয়ে নিজেকেই হাস্যাস্পদ করে তোলা কী নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার শৈল্পিক সাহস নয়?

সঞ্জয় ঘোষ চলতিপথে বললেন, ‘বাংলায় রবীন্দ্রনাথ একটা নতুন শব্দ যোগ করেছেন- আসমানদারি।’ হ্যাঁ, আমরা কেজো মানুষেরা রবীন্দ্রজীবনীর অত্যাবশ্যক অংশ-জ্ঞানে পাঠ করি পূর্ববঙ্গে তাঁর খণ্ডকালীন জমিদারির কথা; কিন্তু তিনি যে চিরকালের এক অসামান্য আসমানদার- সে কথা কি মনে রাখি!
আসমানদার বলেই তো এই আকাশে মুক্তি খুঁজেন আলোয় আলোয়। ধুলায় ধুলায়। ঘাসে ঘাসে।
আমাদের সান্ধ্যভ্রমণের আরেক সদস্য বিক্রমাদিত্য বাবু রবীন্দ্রসংগীতের একটা কলি গলায় সাধতে সাধতে বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তো সবই ভেবে গেছেন। তাঁকে অতিক্রম করা অসম্ভব।’ এমন কথার পিঠে কথা যোগ করতে তো রবীন্দ্রনাথেরই শরণ নিতে হয়। যে রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু গেয়ে গেছেন অতিক্রমণের আনন্দগান। রবীন্দ্রবিশ্ব মানে তো স্থানুতার বিপরীতে ক্রমচলিষ্ণুতার প্রণোদনা। ক্রমাগত নিজেকেও ছাপিয়ে যাওয়া।


আমার রবীন্দ্রনাথ দেবতার সাক্ষাৎ-শত্রু। রক্তমাংসের মানুষমাত্র। আমার রবীন্দ্রনাথ সোনার ঠাকুর ফেলে সন্ধান করে মনের মানুষের। আমার রবীন্দ্রনাথ শুধু কাননে কাননে পরিব্রাজন করে বেড়ায় না বরং আইনস্টাইনের সাথেও সংলাপে বসে। ভাবে কী করে বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়। বৈশ্য-শাসিত সময়ে ধরিত্রী-রথের রশি টানতে আমার রবীন্দ্রনাথ কামনা করে মহাশূদ্রের উত্থান। এমনি করে নিম্নবর্গের মেহনতি মানুষের মিছিলে যেমন অনুভব করি রবীন্দ্রনাথকে তেমনি ইরাকে-আফগানে, কিউবা-কোরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের ময়দানেও দেখি রবীন্দ্রনাথ, তোমাকে। তুমি সেই কবে দিব্যদ্রষ্টার মতো বলেছিলে, ‘সাম্রাজ্যের নীতি হচ্ছে অজগর সাপের নীতি, যা পায় তা-ই গিলে খায়।’
দুনিয়ার দিকে দিকে পাষাণপুরীর দানব দেখে সবাই যখন বালিতে মুখ গুঁজে তখন আমার রবীন্দ্রনাথ মারের সাগর পাড়ি দিতে বলে। হৃদয়-মাঝে অভয় বাজার দীক্ষা দেয় সে।


রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ আসে আমার কাছে, প্রতিদিন আসে। সামনের পাথর বিছানো পথে নামতে আমি ভয় পাচ্ছি দেখে আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন ‘তবে তুই-ই হ আজকের একলা চলার অভীক।’ আমি রবীন্দ্রনাথের কথায় পথে নামি। আমার আর একা লাগে না। কারণ রবীন্দ্রনাথের সূত্রে অনন্ত পৃথিবীও হাঁটছে আমার সঙ্গে।
চিঠি আসে রোজ।
ফেসবুক-টুইটার-স্কাইপি-গুগল প্লাস-হোয়াটস-আপ-ভাইবার-ইয়াহু-জিমেইলের ফাঁসে বন্দি ২০১৫-এর অমল নামক এই আমার কাছে কতশত জানা-অজানা মানুষের চিঠি আসে। চাইলেও আসে। না-চাইলেও আসে। কিন্তু সুধার চিঠি এখনও আসেনি। না আসলেও ক্ষতি নেই।
এই অমল-জীবনে রবীন্দ্রনাথই আমাকে এখন বোধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন যে সুধাময় চিঠির প্রতীক্ষা আছে বলেই সমস্ত ধ্বংস-মৃত্যু-রক্ত উজিয়ে আমাদের জীবনটা এত সুন্দর। এত মনোহর।


রবীন্দ্রনাথ নামের ডাকঘর কখনও বন্ধ হয় না। আমার জন্য তা রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। দুঃখের তিমির শেষে সে বয়ে আনে সোনালি সকালের বার্তা। বিদ্যমান ধাতব পরিস্থিতিতে সে বইয়ে দেয় অলকানন্দা জলের প্রস্রবণ। নিকষ অন্ধকারে সে ফুটে থাকে গন্ধরাজ হয়ে। যুদ্ধের দিগ্বিদিক দামামা থামাতে মুহূর্তেই সে রূপ নেয় শান্তি-পারাবারে।
তিক্ত-রুক্ষ-খরখরে জীবনে একরত্তি প্রাণদায়ী সুধার সন্ধান পেতে রবীন্দ্রনাথ নামক ডাকঘরে যাই। যেতেই থাকি।
সুধাময় চিঠির সন্ধান পেতে আমার কাছে আর তো কোন বিকল্প নেই।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মে ২০১৫/তাপস রায়
 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়