ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

টেক্সাসান জীবন থেকে : ৭ম পর্ব

দিলরুবা আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২২, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টেক্সাসান জীবন থেকে : ৭ম পর্ব

দিলরুবা আহমেদ : দেশে দেশে অনেক দেশ ঘুরে, বহুভাবে বহুজনকে বিবিধ লেবাসে দেখাও হলো যেন এই সুবাদে। অসংখ্যবার একই ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন দেশে।

 

তবে দেশ ভেদে ভিন্ন মাত্রায় যেন ঘটছে  ঘটনাগুলো। কিছু চাইবার আর দেওয়ার রীতিও  তাই যেন বিবিধ।

 

মানত করে ফকিরকে পয়সা দেওয়ার রেওয়াজ আছে আমাদের দেশে। রেওয়াজটার চর্চা বাড়তে বাড়তে এক সময় তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। প্রায়ই বিপদে-আপদে মনে হয়, ইস! দুটো পয়সা যদি ফকিরকে দেওয়া যেতো! এটা এক ধরনের শর্টকাট পথে বিপদ মুক্তির প্রার্থনা। জ্বর হলো, গহনা হারালো, রাস্তায় পিছলে পড়ে পা ভাঙলো, তো দুটো পয়সা ফকিরকে দিতে ইচ্ছা জাগে মনে।

 

কিন্তু আমি এখন যেখানে থাকি, টেক্সাসের ডালাসে। সেখানে চিরচেনা আদলে ফকির পাবো কোথায়! মাগো দুটো পয়সা দেন বলে কেউ দরজায় ধাক্কা দেয় না যখন-তখন। মাঝে মধ্যে অচেনা কেউ বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের কাগজ বা কুপন দরজার ক্লিপে ঝুলিয়ে দিয়ে যায়। সেটাই প্রাইভেসিতে উৎপাত মনে হয়। আমার অজান্তে আমার দরজা পর্যন্ত চলে আসা, ব্যাপারটা এখন আর গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।

 

লেটার বক্স পর্যন্ত যা খুশি রেখে যেতে পারো, কিন্তু দরজা পর্যন্ত চলে আসাটা পছন্দনীয় নয়। অথচ ঢাকায় থাকতে এক সময় সকাল-বিকাল দরজায় ধাক্কা পড়তো, মাগো কয়টা পয়সা দেন, তিনদিন না খাইয়া আছি, বলে বসেও থাকতো, কেও কেও। কিন্তু গতবার যখন দেশে গেলাম এবং ভাবলাম কিছু ফকির খাওয়ানো উচিত তখন দেখা গেল ফকিরের প্রাদুর্ভাব।

 

আমার বাপের বাড়ি শশুরবাড়ি দুটোই ধানমন্ডি লেকের এপার-ওপার। লেকের মাঝ দিয়ে যে পারাপারের সেতুটা আছে ওটা দিয়ে বাপের বাড়ি শশুরবাড়ি করি, অবরোধ হরতাল কিছুই আমাকে আটকে রাখতে পারে না। তবে অসুবিধাটা হলো যে, বৃহত্তম ঢাকার ওপর দিয়ে নিত্যদিন আমাকে চলাচল করতে হয় না, তাই আমি ধরেই নিয়েছিলাম এখনো প্রচুর ফকির অবশিষ্ট আছে সর্বত্র। কিন্তু যখন দাওয়াত দিতে গেলাম তখনই বুঝলাম ব্যাপারটা ঠিক নয়। ফকির খুঁজে পাওয়াটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। হয়তো বা তারা আমার চলাচলের সীমানার বাইরে অবস্থান করছে। যত্রতত্র তাদের দেখতে পেলাম না। তারা হয়তোবা কোথাও দলবদ্ধ অবস্থায় আছে, কবরস্থানে, মসজিদে বা অন্য কোথাও।

 

অবশেষে আমি একজন ভিক্ষুকের দেখা পেলাম ধানমন্ডি মসজিদের পাশে। অধীর আগ্রহে তাকে দাওয়াত দিলাম এবং দায়িত্বও। অতজন ভিক্ষুক নিয়ে অমুক দিন আমার বাসায় আসবেন। প্রথমেই জানতে চাইলো, কুকুর আছে কি না? বসার ব্যবস্থা কোথায় হবে? খাওয়া শেষে পান সুপারি থাকবে কি না, আসা-যাওয়ার জন্য বখশিস দেওয়া হবে কি না, ইত্যাদি।

 

আমি প্রশ্নগুলো শুনে যারপরনাই গোছের অবাক হলাম তবে এক ধরনের প্রফেশনালিজমের গন্ধ পেলাম। আমার ড্রাইভারও দাঁড়িয়ে শুনছিল, পরে বলল, শখ করে কি কেউ আর ভিক্ষা করে, এটা একটা পেশা, ব্যবসা।

 

আমার আম্মাকেও বললাম। আম্মা আমার কথাকে নাদান মার্কা কথা ধরে নিয়ে মনোযোগ না দিয়ে সোজা দরকারি ও জরুরি কথায় গেলেন। বললেন, ওদের তো টাইম বেধে দেওয়ার কথা, দেয়নি?

 

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, সময় তো আমার দেওয়ার কথা, ওরা দেবে কেন?

 

আম্মা বললেন, এখন ওরাই দেয়। কারণ ওদের অনেক দাওয়াত থাকে একইদিনে। কোনটার পর কোনটা সেভাবে সাজিয়ে ঠিক টাইম দেয়।

 

বুঝলাম, এ জন্য ফোন নাম্বার নিয়েছে। আমি বাসার নাম্বার দিতে ইতস্তত করছিলাম দেখে আমাদের ড্রাইভার তার মোবাইল ফোন নাম্বার দিয়েছে। আমি তো ড্রাইভারেরই মোবাইল ফোন দেখে অবাক হচ্ছিলাম। সে আমাকে আরো অবাক করে বলল, হানিফেরই তো মোবাইল আছে।

 

হানিফ আমাদের কাজের ছেলে। তাকে অবশ্য কাজের ছেলে বলাটা ঠিক হচ্ছে না, চাকর শব্দটা তো গুলি মেরে উড়িয়ে দেওয়া উচিত, হয়েছেও তাই। এখন বলতে হবে, বেল বয়। আমি ঢাকায় নামামাত্রই সে আমার হাতে একটা ‘বেল’ (ঘণ্টি) ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, এটা বাজালেই আমি এসে দাঁড়াব। রুমে রুমে তাকে ধরার জন্য সুইচের ব্যবস্থা হয়েছে। টিপ দেওয়া মাত্রই সে এসে হাজির হবে। মনে হলো আমিই ফকির। কোনো ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই। জ্ঞানহারা আসল ফকির।

 

পরদিন ফোনে খবর দিল কবে কতজন আসবে। সন্তাহখানেক পরের একটা দিন দিল। তার আগে সব বুকড। ২টা থেকে ৩টার মধ্যে আয়োজন শেষ করতে হবে। আমার এখান থেকে অন্য জাযগায় যেতে হবে খেতে। এক পেটে এতো খাবে কি করে? আম্মা বললেন, না খেলে নিয়ে যাবে। ভালোই সমাধান। অ্যানারেক্সিয়া আজকাল আমেরিকার অন্যতম আলোচ্য বিষয়।

 

ইটিং ডিস অর্ডার। না খেতে খেতে না খাওয়াতেই অভ্যাস গজিয়ে যায়। তিনজন আমেরিকান মডেল সম্প্রতি শুকাতে শুকাতে শেষে মিশে গেছে, মানে মারা গেছে। আক্ষরিক অর্থেই অনাহারে মারা গেছে। ব্যাপারটা দুঃখজনক এবং ভালোই তোলপাড় তুলেছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। টিভিতে এক মডেলকে দেখাল তার উচ্চতা পাঁচফিট ছয় ইঞ্চি, ওজন মাত্র ৮৮ পাউন্ড। উপস্থাপকের ভাবখানা- এরও মৃত্যু সন্নিকটে। যদিও সে মেয়ে জোরাল কণ্ঠে নিজেকে অত্যন্ত স্বাস্থ্যবতি দাবি করে গেল। প্যারিসের ফ্যাশন শোগুলোতে এখন নাকি মডেলদের সর্বনিম্ন ওজন বেধে দেওয়া হচ্ছে।

 

যা হোক, সে রকম হাড় জিরজিরে কোনো ফকির অবশ্য দেখা গেল না দাওয়াতিদের মধ্যে তবে ঠিক ২টা বাজতেই মেহমানরা হাজির। অসাধারণ সময়জ্ঞান।

 

আমাদের রাঁধুনি ফরমায়েস অনুযায়ী রেধেছে। সে খুবই মন দিয়ে রেধেছে। বলেছে বারে বারে, রান্না ভালো না হলে তারা খাবে না। অনুষ্ঠান বর্জন-বয়কট হতে পারে। আরেক দিন তাহলে আয়োজন করতে হবে।

 

রাঁধুনি তার নিজের পক্ষ থেকেও একটা আইটেম তৈরি করেছে। সে দীর্ঘদিন এ পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারও এক ধরনের আধিপত্য তৈরি হয়ে গেছে। আমরা পরবাসীরা দেশে হাজিরা দিলেই সেও গ্রাম ছেড়ে ওই কটা দিনের জন্য আমাদের সেবায় ওখানে হাজির থাকেন। রিকু আমাকে বলল, চার আনা সওয়াব সেও চায়, তাই একটা তরকারি তার। আমার সওয়াবে ভাগ বসাল। আমি নিমরাজি। কাকে বলব, শাশুড়ি-ননাসরা কেউ পাশে নেই। শাশুড়ি পৃথিবী ছেড়েছেন। ননাসরা দেশের বাইরে থাকেন।

 

বাসায় আছেন শশুর। ওনাকে বললে তো অবাক হয়ে বলবেন, আরে গ্রামের এ মহিলা রিকু বেগম তো অসাধারণ লেডি! কি পিতামাতা ভক্ত। তাদের জন্য ফকির খাওয়াচ্ছে। দেখা যাবে উনি চার আনার জায়গায় আট আনা সাওয়াবই ওই মেয়েকে দিয়ে দিতে বলবেন।

 

আমার মা শুনেই বললেন, আগেই বলেছিলাম আমার বাসায় ফকির খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো। যাই হোক, আম্মা বললেন, এখন ওদের পান-সুপারি আর পারহেড বখশিস দিতে যেন না ভুলি। তা হলে ভবিষ্যতে ওরা আর আমাদের দাওয়াত নেবে না। ওদের মাঝে প্রচার যদি হয়, এ বাড়ির লোকজন সুবিধার নয়, তবে আমাদেরই অসুবিধা, পূণ্য কামাইয়ের পথ বন্ধ।

 

আমাদের ড্রাইভার এসে বলল, ৪টার সময় যে দাওয়াতে ওরা যাবে ওখানে চা খাবে, তাই এখানে কোক দিলে কেমন হয়? ওরা জানে আপনি বিদেশ থেকে এসেছেন।

 

আমি খুবই গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম। রসিকতা করছে নাকি এরা সবাই আমার সঙ্গে।
আবার এসে বলল, ভাবী তিনজন প্লেট আনেনি। আমরা পেপার প্লেট দেবো ভেবেছিল। ওরা জেনেছে আপনি বিদেশে থাকেন তো তাই ভেবেছে ঐ রকম।

 

আমাদের রাঁধুনি রিফু বলে দিয়েছে, তার প্লেট সে দেবে না। হানিফও না। ড্রাইভার তো নাই-ই। এখন ডিনার সেটের প্লেট বের করবে কি না জানতে চাইছে।

 

আরেকটা সমস্যা ফকিরদের প্লেট এরা কেউ ধোবেও না। ওদেরই ধুয়ে দিয়ে যেতে হবে। ভাগ্যিস আমার কাছে কিছু পেপার প্লেট ছিল। দিয়ে বাঁচলাম।

 

অবশেষে এক পর্যায়ে খাওয়ার পর্ব শেষ হলো। হাত তুলে মোনাজাত করা হলো। রিকুও তার বাবা-মায়ের নাম দিল ওদের, দোয়া করার জন্য, যেহেতু একটা আইটেম তার। মনে মনে খুবই মিস করলাম আমার শাশুড়িকে। উনি থাকলে এক ধাতানি দিয়ে আমার চার আনা সওয়াব নেওয়া বন্ধ করতেন।

 

আমার জা (ভাসুরের বউ) এলেন ওনার বাসা থেকে অনুষ্ঠানের একদম শেষ পর্যায়ে। উনি শুনে হাসলেন শুধু। বললেন না কিছু। উনি আমার থেকেও বেশি বেচারা।

 

আমার কন্যাটি শুধু বিপুল উৎসাহে ওপর-নিচে দৌড়াদৌড়ি করে সব দেখল। সে বড় হচ্ছে ইউএসএতে। অতএব আমাদের সব আয়োজনই নতুন তার কাছে। সবশেষে বলল, ডোন্ট ইউ থিঙ্ক মাম, ওদের ফ্লোরে বসে খাওয়ানোটা টু ইনডিসেন্ট। এর টোবা টোবা গাল দুটো গেলে দিলে কেমন হয়। টু ইনডিসেন্ট ফলাচ্ছে। আমার স্বামী সবাই চলে যেতে বলল, ওরা তোমাকে ওদের সঙ্গে বসে খেতে ডাকেনি? আমি তো ভাবলাম সে দাবিও আসবে। ও হাসতে লাগল।

 

চলবে...

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়