ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

টেক্সাসান জীবন থেকে : ৮ম পর্ব

দিলরুবা আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৪, ৬ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টেক্সাসান জীবন থেকে : ৮ম পর্ব

দিলরুবা আহমেদ : আমার খুবই কান্না পেতে লাগল। আমি যতটা আগ্রহ আর হৃদয় দিয়ে ঘটনার আয়োজন করেছি মনে হলো ব্যাপারটা সে রকম হলো না।

 

অনেকটা দায়সারা গোছেরই হলো যেন ভিক্ষুকদের পক্ষ থেকে। যেন আমাকে উদ্ধার করে গেলেন তারা।

 

আমার শ্বশুর বললেন, ভবিষ্যতে এতিমখানায় খাবার পাঠিয়ে দিও। বাসায় ডেকো না। শ্রেণি  বৈষম্যটা খুব বেশি চোখে পড়ে এভাবে ডাকাডাকিতে। আমি বললাম, তাই করবো।

 

এখানে টেক্সাসে ডাকাডাকির কোনো স্কোপ নেই। কাউকে ভিক্ষুক ভেবে ডেকে দরজার বাইরে মাটিতে বসিয়ে খেতে দেবো এমনটা সম্ভব নয়। তবে ভদ্রগোছের একটা শব্দ আছে হোমলেস। মাঝে মধ্যে রাস্তার আশপাশে সাইনবোর্ড হাতে এদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সাইনবোর্ডে লেখা থাকে হোমলেস, সাহায্য দরকার। আমার অফিসে যাওয়ার পথে একটা ব্রিজের নিচে জটলা বেধে থাকতে দেখি ওরকম কজনকে।

 

দেখলেই দূর থেকে আমি জানালাটা তুলে দেই। উষ্কখুষ্ক চুল। ময়লা জামা-কাপড়ে ওরা প্রায়ই আমার নিষ্ঠুরতা দেখে। কিছু বলে না। ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়ালেও কাছে আসে না।

 

এ দেশে হোমলেস কুকুর-বিড়ালেরও শেলটারখানা আছে। আর ওরা তো মানুষ। এদের জন্য সরকারি দায়িত্ব আরো বেশি। প্রায় টিভিতে অনুরোধ করা হয়, শেলটারে এদের ফিরে যেতে। ঝড়, বৃষ্টি, তুফানে কষ্ট না পেতে। বাস পাঠিয়ে এদের খুঁজে খুঁজে আনার পায়তারাও দেখা যায়। শেলটারে সব ফ্রি। শর্ত শুধু নিজের বিছানা নিজে সাজাতে হবে। নিজের প্লেট নিজে পরিস্কার করতে হবে এবং পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করা চলবে না। তারপরও দেখা যায় অনেকেই পথে ঘুরছে।

 

ইদানিং কেন এরা পথকেই পছন্দ করছে, প্রেফার করে তা নিয়ে সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা চলছে। এদের পথপ্রীতি আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। এতে জিন তথা জেনেটিক প্রভাব কতটুকু তাও ব্যাখ্যার চেষ্টা চলছে।

 

অনেক ড্রাগ আসক্ত ও ভিক্ষুক স্টাইলে এসে বলে, গাড়ির তেল শেষ হয়ে গেছে। পথে আটকা পড়েছে। তেলের জন্য পয়সা দিতে পারা যাবে কি না। ওই কাজটা করে অবশ্য পথঘাটে। বাসায় এসে হানা দেয় না। খুবই কমন ব্যাপারটা। ওরা একই রকমভাবে বারে বারে প্রায় সব সময়ই একই জায়গাতেই টাকা খুঁজতে আসে একই কারণ দেখিয়ে। নতুন কোনো কারণ কেন খুঁজে বের করে না বলার জন্য এটা নিয়েও নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সহসা মনোবিজ্ঞানের গবেষণার খাতা খুলে বসবে।

 

একবার মলের ফুড কোর্টে খাচ্ছি আমি আর আমার মেয়ে। খুব ভদ্রগোছের এক লোক নীরবে টেবিলে টেবিলে সুন্দর পুঁথিতে চারধার বাধা একটা করে লিফলেট রেখে গেল। পড়ে দেখলাম সে বোবা। পরিবারের অন্নসংস্থানের জন্য আর্থিক সাহায্য চায়। খেতে বসেছি যখন, তখন আরেকজন খাদ্যের জন্যই পয়সার আবদার ধরেছে। ভালোই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় এতে পাওয়া যাচ্ছে।

 

অনেকেই দেবে ভেবেছিলাম। দেখলাম, না, দুনিয়াটা অনেক কঠিন। দুই মিনিটের মাথায় নিরব কবি নিজেই কাগজগুলো তুলে নিয়ে অন্যদিকের টেবিলের দিকে চলে গেল। কোনো রকম দ্বিতীয় প্রচেষ্টা বা তরিকা দেখা গেল না মন গলানোর জন্য। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ফকির বোধহয় একেই বলে।

 

গাড়ির ওয়াইপারের ভেতরও একদিন দেখলাম কে যেন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিয়ে সাহায্য চেয়ে লিফলেট গুঁজে দিয়ে গেছে। আমার ঢাকাবাসী এক আত্মীয়া তাই শুনে বললেন, বাপরে আমেরিকান ফকিরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও থাকে! সম্প্রতি এক মহিলা আবার ছেলেতে ফিরে যেতে চাচ্ছে অপারেশনের মাধ্যমে, যেটা করে সে প্রথমবার মেয়ে হয়েছিল, ছেলে জীবন পরিত্যাগ করে।

 

সে ইন্টারনেটে আর্থিক সাহায্য চেয়েছে। কে যেন তাকে পুরো টাকাটাই দান করেছে যাতে সে আবার ছেলে হয়ে যেতে পারে। হয়েছেও। তারপর টিভিতে এসে কতক্ষণ ছেলে-মেয়ে উভয় সেক্সেই নিজের নিরন্তন অসন্তোষের বয়ান গাইল। উভয় অবস্থায় দোটানায় দোদুল্যমান ফকির।

 

অতএব দান-খয়রাত চলছে বিভিন্ন ফর্মে, পরিপ্রেক্ষিতে। মান্ধাতার আমলের আমার চিরচেনা ভিক্ষুক টেক্সাসে নেই বলে যে দান বন্ধ তা কিন্তু নয়।

 

স্যালভেশন আর্মির দান বক্সগুলো দেখলেই বোঝা যায় কি পরিমাণ বাক্স বোঝাই করা দানবীর রয়েছে ইউএসএ জুড়ে।

 

ফিরছিলাম সে ব্রিজের নিচে দিয়ে। বেখেয়ালে জানালা খোলা। এক হোমলেস দ্রুত এগিয়ে এলো কাছে। কি কুক্ষণে যে জানালা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম।

 

একটা চিৎকার তাকে এতকাছে দেখা মাত্রই উঠে আসছিল। সে এসে বলল, তোমার সেল ফোনটা দাও তো, একটা জরুরি কল করবো।

কি আবদার!

আমি দ্রুত মিথ্যা বললাম, নেই। একে সেল ফোন দেবো! পাগল আমি? এবার বলে, তোমার গাড়ির ভেতর তো দেখছি ব্লুটুথ আছে। নাম্বার দিচ্ছি লাইন দাও।

এ যেন মামার বাড়ি তার। মামাতো বোনের দেখা পেয়েছে অনেককাল পর।

 

গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের ওপরই ব্লুটুথের সুইচ। সে নিজেই এবার হাত ঢোকালো গাড়িতে যখন, ব্লুটুথ অন করতে আর চিৎকারটা ধরে রাখা গেল না।

 

আর তখনই সবুজ বাতি। এক্সেলেটরে চাপ। ছুটে বেরিয়ে গেলাম। আর ওদিকে মিস্টার হোমলেস আমার চিৎকার শুনে নিজেও চিৎকার করতে লাগল আর বলতে লাগল- ‘কল ৯১১’। সম্ভবত অবচেতনভাবেই পাগলাটার মুখ থেকে পুলিশ ডাকার কথা ফসকে বের হয়ে এসেছিল। হয়তোবা ভড়কে গিয়েছিল আমার চিৎকারে। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা বুঝি একেই বলে।

 

আর ব্লুটুথের কমপিউটার কম না, সঙ্গে সঙ্গে ৯১১ শব্দটা ক্যাচ করে সংযোগ দিয়ে দিল যেহেতু সে সুইচ অন করেই দিয়েছিল। নার্ভাস আমি পুলিশকে যতই বলি আমি ঠিক আছি, ওরা হয় বুঝল না বা বিশ্বাস করল না। সাইরেনসহ ছুটে এসে চারদিক থেকে আমাকে পথেই আটকালো। গাড়ির নেভিগেশন সিস্টেম বা সেল ফোনের কারণে এরা সহজেই আমাকে লোকেট করতে পেরেছিল। পুলিশকে আদ্যোপান্ত ঘটনাটাও জানাতে হলো।

এরপর আরো বহুদিন ওই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করেছি কিন্তু ওদের ওই দলটাকে আর দেখিনি।

 

দিন যায়। কি হলো ওদের জানি না। ওরাই সরে গেছে না পুলিশ ওদের ভাগিয়েছে তাও জানতে পারিনি। তারপরও হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠে ওদের খোঁজে এদিক-ওদিক তাকাই ওই পথে আসতে-যেতে। আমার পিচ্চিটাও বিপুল উৎসাহে পথে আসা-যাওয়ায় ওদের খোঁজে। তার মায়ের সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়েছে যারা তাদের যেন তার হাত থেকেও নিস্তার নেই।

 

হঠাৎ অনেকদিন পর অন্য জায়গায় আরেকটা ব্রিজের নিচে ওই ধরনের কিছু লোক দেখেই আমার বাচ্চাটা চেচিয়ে বলতে লাগল, আই হ্যাভ হোয়াইট টুথ, নেয় নেনা নেয়। প্রথম প্রথম স্কুল যাওয়ার নতিজা।

 

সে পেছনে কার সিটে বসা। এখানে মাইনরদের ড্রাইভিং সিটের পাশে বসানোর নিয়ম নেই। আমি যতই বলি চুপ চুপ সে ততই চেচায়-  নেয় নেনা

 

নে, আই হ্যাভ হোয়াইট টুথ। নিজের দাতগুলোও দেখাচ্ছে। ওই পক্ষও কম নয়। তারাও দাত দেখাচ্ছে। প্রতিযোগিতা যেন। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, ইউর মাম হ্যাভ ব্লুটুথ। চমকে চেয়ে দেখি, আই রে রে, আমার সেই ঐতিহাসিক বিখ্যাত প্রখ্যাত ফুপাত ভাই-ই। হাসছে। আমাকে বলল, হাই।

 

মাথা খারাপ, তাকে বলল হাই। কিন্তু বাতি সবুজ হচ্ছে না। লালে ভাগতে পারছি না। ফিরে চাইলাম। তার হাতে ধরা সাইন বোর্ডটার দিকে চোখ পড়ল। হোমলেস। গৃহহীন। ছিল পথ, তা থেকেও একদিন বিতাড়িত করেছি। হঠাৎ মমতাবশে জিজ্ঞেস করে বসলাম, হাউ আর ইউ?

 

সঙ্গে সঙ্গে সেই পাগল চিৎকার করে তিনটা ডিগবাজি খেয়ে দূরে চলে গেল। মাগো কি ভয়ংকর এক উলুর ধ্বনি দিল। বুঝলাম আমাদের এশীয় মমতায় ওরা অভ্যস্ত নয়। অথবা ওদের আমেরিকান কায়দায় সুখ বা বিস্ময়ের প্রকাশ বুঝতে আমি অক্ষম। যে মমতার দার কিছুটা খুলে ছিল ভয়ে আপনা থেকেই দ্রুত তা বন্ধ হয়ে গেল আমারও এক প্রচণ্ড চিৎকারের মধ্যদিয়ে। আমিও যে আপন মনে চেচিয়ে উঠেছিলাম বুঝতে পারিনি প্রথমে, পর মুহূর্তেই বাতিটা সবুজ হতেই আমিও ওখান থেকে চলে আসলাম।

 

চলবে..

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ অক্টোবর ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়