ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

টেক্সাসান জীবন থেকে : ১০ম পর্ব

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৭, ২৪ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 টেক্সাসান জীবন থেকে : ১০ম পর্ব

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

দিলরুবা আহমেদ :  আপা হঠাৎ আঙুল তুলে ওই মহিলাটিকে দেখালেন। আপা হয়তো বলতে চাচ্ছিলেন সেই নাটের গুরু। কিন্তু পুলিশ বুঝল না।

 

বলল সবাই তো দেখছি দাঁড়িয়ে রয়েছে, কে মারা গেছে তাহলে। আমি এক যটকায় আপার হাত সরালাম জান বাঁচানোর তাগিদে। এবার আমার কথা বলার সুযোগ হলো।

 

বললাম, একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সরি। কারণটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলাম। ওইদিকে আপা একটু পর পরেই হাত তুলে ওই মহিলাটিকে দেখাচ্ছেন। মহিলাটিও অসহায়ের মতো মুখোভঙ্গি করে পেছনের দিকে কাউকে দেখাচ্ছেন। ওনার পেছনে যে কেউই দাঁড়ানো নেই সেটা বোধহয় ওনার জানাই নেই। চোখ বন্ধ করে যে কারোর দিকে আঙুল তোলাই স্বভাব মনে হয়, যেন সে ছাড়া সবাই দোষী।

 

ভদ্র মহিলাটি যে পুলিশ দেখে ভয় পেয়েছে ভালোই তা বোঝা যাচ্ছে। পুলিশ আমার কথা শুনছে আর অবাক হয়ে ওদের দুজনার হাত চালাচালি দেখছে। শেষে বলল, তুমি শিওর তো এখানকার আর কাউকে সাইকিয়াট্রিকের কাছে নেয়ার দরকার নেই? থাকলে সবাইকে এক ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যেতে পারি। আগের জনকেও তো সেখানে নিতে হবে। মহিলাটি সঙ্গে সঙ্গে আপার দিকে চেয়ে বলল, আপনার ছেলে পাগল হয়ে গেছে? এবার সে ইংরেজি বুঝল কেমন করে? দরকার মতো বুঝে দরকার মতো বুঝে না! আমি অবাক হয়ে মহিলাটিকে দেখলাম।

 

দুলাভাই বললেন, আমি ঠাণ্ডা হওয়ায় একটু নিঃশ্বাস নিতে যাচ্ছি। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আমিই পাগল হয়ে যাবো। পুলিশগুলোকে বলল, আপনারা যাকে যাকে খুশি ধরে নিয়ে যান, আমার কোনো আপত্তি নেই। দুলাভাই লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে বের হয়ে গেলেন। ওনার পেছন পেছন পুরুষ সমাজও। দুলাভাইয়ে সঙ্গে তারাও কিছুক্ষণ হাঁটবে। পুরো ঘটনাটা কারো কাছেই পরিষ্কার না এখনো। প্রচুর সান্ত্বনার বাণী নিয়ে অনেকক্ষণ ধরেই সবাই অপেক্ষা করছে কিন্তু ঘটনা না জেনে কিভাবে কোনটা বর্ষাবে? পুলিশও বিদায় হলো। সবাই যেতেই আপা মহিলাটির দিকে চেয়ে বললেন, রিনি তুমি এবার যাও তো। অনেক নাটক করেছো। বাসায় গিয়ে ঠাণ্ডা শরবত খাও গে। আপা ঘরে ঢুকে মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে পড়লেন। মহিলাটিও যার নাম এই মাত্র জানলাম রিনি, তিনিও ঘরে ঢুকতে উদ্যত হতেই আপা বললেন, ঢুকবে না। যাও বাসায় যাও। তুমি থাকলে আমার মাথা ঠাণ্ডা হবে না।

 

আমিও দরজা থেকেই বিদায় হবো কিনা ভাবছি। কিন্তু আপা ডেকে বললেন, এক গ্লাস পানি দাও আর দরজাটা শক্ত করে ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও। বারান্দাতে আরো কিছু বাঙালি ভাবী দাঁড়ানো ছিল তারা নিজেরাই অবস্থা বুঝে ঝরে যাচ্ছে। চাইনিজ দুটো অবশ্য নট নড়ন-চড়ন। অন্য দেশি পাবলিক তাই ভদ্রতা করে বললাম Thank you, bye now.

 

আপা চেচিয়ে বললেন, Thank you. বল যে গেলি তোরা।  আমি দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলাম। পানি ঢালতে ঢালতেই শুনলাম আপা কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন, এই বাঙালি সমাজে আজ থেকে উনি মুখ দেখাবেন কিভাবে ইত্যাদি বলছেন।

 

বলছেন, ছেলে তার বন্ধুকে দুষ্টামি করে বলেছে সে আজ রাতেই আত্মহত্যা করবে। আমেরিকান বন্ধু। বোঝেনি। দুষ্টামিকে সত্যি ভেবেছে। পুলিশকেও জানিয়েছে বন্ধুর জান বাঁচানোর জন্য। সে থাকে অন্য স্টেট-এ, নিজে ছুটে আসতে না পারলেও পুলিশকে ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝখান দিয়ে সবাই এখন ফেসেছে। আমি গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে তার কথা শুনে যেতে লাগলাম। আমার মনেও প্রশ্ন অনেক। কিন্তু তাকে একটিও জিজ্ঞাসা করার সাহস নেই। তিনি নিজেই বলে যেতে লাগলেন, কাল থেকে দেখবে না কতো গল্প চালু হয়েছে আমার ছেলেকে নিয়ে।

 

সাধারণ একটা রসিকতা নিয়ে কি দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। পুলিশ এসে তাকে একবার এভাবে উল্টে দেখে আরেকবার ওইভাবে। শেষে হাজতে না হসপিটালে নিয়ে গেল। আবার বলে গেল আগামী কিছুদিনও দরকার পড়লে পর পর কয়েকবার সাইকিয়াট্রিকের কাছে যেতে হবে। মানে আছে এসবের কোনো? আমিও মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম বা সান্ত্বনা দিলাম, না কোনোই মানে নেই এসবের। আমরা যা খুশি করবো, ইচ্ছা হলে বাঁচবো, ইচ্ছা হলে মরবো, তাতে কার কি? My life is my life.. আমার কথাতে অবশ্য আপা ভ্রু-কুচকে তাকানোর অবকাশ পেলেন না কারণ উনি তখন হু হু করে কান্নায় ব্যস্ত।

 

আমার কথা হয়তো উনার কানেও গেল না। ছেলে ফিরে না আসা পর্যন্ত উনি কাঁদতেই থাকবেন। এক সময় আমিও উঠলাম। পাড়াটা নীরব হয়ে গেছে। চুপচাপ। রাত পুরোপুরি গভীর হয়ে গেছে। সিঁড়ির নিচে একা দুলাভাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সিগারেট টানছেন। ছেলের অপেক্ষায়। হাঁটা শেষ করে কখন যেন ফিরে এসে অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখে দুলাভাই বললেন, আচ্ছা কন তো আমার ছেলে দোষটা কি করলো? বললাম বলতে ভুল বলেছে, ওর বলা উচিত ছিল সুইসাইড খাবো। খাবো বললেই ঘটনাটা বদলে যেতো। উনি অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন কয়েকটা মুহূর্ত কথাটা বোঝার জন্য তারপরে হাসতে লাগলেন। আমি আর ওনার হাসাতে যোগ না দিয়ে আমার বাসার দিকে হাটা দিলাম। একটু এগুতেই আমার বাসার সিঁড়ি। একবার পেছন ফিরে চাইলাম। নিঃসঙ্গ একা দাঁড়ানো এক বাবা, উপরে জানি মাও আছেন অপেক্ষায়। My life  শুধু কি My life is my life এর পেছনে দুজন মানুষ সবসময় আছেন। কী সুখে কী দুঃখে।

 

আমার সিঁড়ির ধাপে দেখলাম নিহা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আজ রাতে সে আমাদের বাসায় থাকবে। নিহা আমার বান্ধবী। আজ থেকে বহু বছর আগে এক যুবক ওকে বলেছিল তুমি ভালো না বাসলে আমি মরে যাবো। সুইসাইড করবো। এরপর নিহা অযথাই ভালবাসতে গিয়েছিল তাকে। আমার ধারণা নিহা সম্ভবত ভুল শুনেছিল। ওই ছেলে বলেছিল সুইসাইড খাবো। সেই ভালোবাসার ছেলে না হলে আজ কেমন করে চলে গেছে বহু দূরে। নিহাও চলে এসেছে আরো দূরে কোথাও। কেউ কারো জন্যই সুইসাইড করেনি। এতোই কি সহজ মরা! এ দেশে তো আরো কঠিন।

 

শবেবরাত ও হ্যালোউইন-২০০১

লাইজু আজ রোজা রেখেছে, শবেবরাতের রোজা।

 

চন্দনা ভাবী এসে তাই শুনে বেশ অবাক হলেন। আপনারা শবেবরাত করেন? মানে? এখানে কেউ করে না তো, তাই। ডালাসে কেউ শবেবরাত করে না। নাহ! সউদি আরবেও তো করে না ভাবী। তাই? জানি না তো! এখন এখানকার বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই শবেবরাত করে না। চন্দ্রনা ভাবী কথাটা বলেই এমন সর্বজ্ঞ ধরনের ভঙ্গিমা করলেন যেন এর উপরে আর কোনো কথা থাকতে নেই। তারপর যেমন হঠাৎ এসেছিলেন, হড়বড় করে যা বলার বলে চলে গেলেন। কিন্তু লাইজুর মনটা খারাপ হয়ে গেল এবং খারাপ হয়েই থাকলো। সেই কবে ছোটবেলা থেকে শবেবরাত করে এসেছে। আজ এ আবার কি শুনলো। ৩০ বছর বয়সে তাকে আজ নতুন করে শিখত হবে, অনেক কিছু! দাদিমা বলতেন, আজ বরাত লেখা হবে। কপাল ভরে যাবে নতুন লেখায়। সারা বছর কেমন যাবে তার খাতা তৈরি হবে। এই দিনে তারা ছয় বোনই নতুন জামাকাপড় পরতো। তাতে সারা বছর নতুন নতুন জামাকাপড় পরার সৌভাগ্য পাবে এ রকমই ভাবতো। মজার খাবার তৈরি হতো। খেতোও গপাগপ। বছরময় মজার খাবারের কথা কপালে লেখা হবে ভেবে নিজেরাই বেশ খুশির ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। সেই শিশুকাল এখন আর নেই। তবে বিশ্বাসটুকু রয়ে গেছে। লাইজু প্রায়ই বাবাকে দেখতো, খাবারের শেষ লোকমাটা এ রাতে মুখে দিতেন না। প্লেটে রেখে দিতেন।

 

তাই তাদেরও করতে বলতেন। এই লোকমাটা আগামী বছর খাবেন তিনি। ফলে, এক বছরের সুনিশ্চিত হায়াত পাওয়া গেল। অলরেডি বরাদ্দ লোকমা ভাবা হচ্ছে এটাকে এবং এটা না শেষ করে উপরে তো নেয়া যাবে না। এগুলো হচ্ছে দাদিমার বুদ্ধি এবং যুক্তি। বাবাকে তিনি এমনই অভ্যস্ত করেছেন এই মতবাদে যে, বাবা যুক্তিতর্কে না গিয়ে কাজটা করে যাচ্ছেন ছোট থেকে। তাদেরও করতে বলছেন। যদিও বাবা জানেন না মেয়েদের মধ্যেই এ নিয়ে বহু মতভেদ রয়েছে। যার যার নিজস্ব মতবাদ, মতামত রয়েছে। যেমন মেহেরান, সবার ছোট সে। তার বক্তব্য হচ্ছে, হিন্দু ধর্মের শতপুত্র চাওয়ার মধা দিয়ে যে শতায়ু নিশ্চিত করা হয়েছিল স্বামীর, সে রকম একটা ভাবনা থেকে দাদিমা মনগড়া বিষয়টি তৈরি করেছেন। মেহেরান প্রায়ই ঘোষণা দিতো, গ্রামে গেলেই দাদিমার সঙ্গে তার বোঝাপড়া আছে। ধার করা বুদ্ধি বা বুদ্ধি চুরির দায়ে দাদিমাকে সে অভিযুক্ত করবে। হলো কই? পারলো কই? কত শীত, বর্ষা এলো গেল, দাদিমা এলেন, গেলেন। গ্রামেও যাওয়া হলো, ফেরা হলো, মেহেরানের আর দাদিমাকে জব্দ করা হয়ে ওঠেনি। দাদিমার বিশ্বাসটাই এমন দৃঢ় এবং প্রবল, এ প্রসঙ্গে কথা তুললে, তর্কের অবতারণা হলেই, তিনি নাউজুবিল্লা বলতে বলতে পাগল হয়ে যান। যদি শুনতেন, আজকের চন্দনা ভাবীর বলে যাওয়া কথা,  খোদাই জানেন তিনি কি করতেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেই আত্মহত্যা করতেন। এই দূষিত বাতাসে শ্বাস নিতেও রাজি হতেন না। বড় আপা বিশ্বাসে মিলায় স্বর্গ এ মতবাদে অজন্ম বিশ্বাসী একজন মানুষ। তার মতে, অযথা বাবা, দাদিমার সঙ্গে তর্ক করা ঠিক না। যে যা বিশ্বাস করে আনন্দ পায় করুক। তা তার বিশ্বাস, ক্ষতি কি? অবশ্যই বড় আপা সব সময়ই সব পরিবারের সব বড় মেয়েদের মতোই সদাসর্বদা দাদী-বাবাভক্ত একজন নিরীহ টাইপের সাদাসিধা মানুষ। তাই, ওনার কথা বাদ। লাউজু সব সময়ই ভেবেছে বাবাকে বলবে, বাবা তোমার এই শেষ লোকমাটা গত বছরই তোমার কপালে লেখা হয়নি। তাই এ বছর খেতে পারছো না। কথাটা অবশ্য কখনই তার আর বলা হয়ে ওঠেনি। একবার লাইজুর পঞ্চম বোন চিনু বলল, বাবা, খেয়েই দেখো না। অন এক্সপেরিমেন্ট, দেখো কি হয়। বাঁচো না মরো? বাবা অত্যন্ত বিমর্ষ চোখে চেয়ে থেকেছিলেন তার মেয়ের দিকে, তার বাঁচা-মরা নিয়ে প্রহসন, কি ভয়াবহ! সেই সপ্তাহটা না গড়াতেই জানা গেল চিনুর ভয়াবহ ডায়াবেটিস।

 

ভাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। মাত্র ১৬ বছরের চিনুর শর্করা পরিহারের ক্ষেত্রে প্রথমেই বাদ পড়ল ভাত। দাদীমা খবরটা শুনেই বিলাপ করে চিৎকার শুরু করলেন এবং চিনু যে অবিশ্বাসের ফল হাতেনাতে পেয়েছে এ কথা বলে কাঁদতে কাঁদতে সুদূর গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আছড়ে পড়লেন। লাইজুর বয়স তখন ১৮ বছর। বোনদের মধ্যে তার স্থান চতুর্থ। সে ঠিক করল তখনই, আর কোনো কথা নেই। গুরুজনেরা যে যা বলছেন, চোখ বন্ধ করে সে করে যাবে। আজও বাবা তার একটা করে লোকমা রেখে উঠে যান। লাইজুও তা করবে। এও জানে, আজ ওরা ছয় বোনই যে যেখানে আছে সেখান থেকেই আল্লাহর দরবারে বাবার দীর্ঘায়ুর জন্য মোনাজাত করবে, আসছে বছরেও বাবা যেন একটা করে লোকমা রেখে উঠে যেতে পারেন। এতদূরে ডালাসে বসেও সে জানে, পরিষ্কার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ঢাকার বাসার শবেবরাতের আয়োজন। আগরবাতির সৌরভ, বাগানে জ্বালানো বাতিগুলো। ভিক্ষুকের লাইন। চালের রুটির ভাপা গন্ধ যেন থেকে থেকে এসে ছুয়ে যাচ্ছে তাকে। সে কি চমৎকার সেই সন্ধ্যা ও রাত এবং রাত জাগা সময়গুলো। বাবা-মা নিশ্চয়ই আজ রাতভর জাগবেন, নামাজ পড়বেন। এখনই তো রাত ওখানে।

 

তারা নিশ্চয়ই এখন সেজদায় বা মোনাজাতে অথবা অন্য কিছু করছেন। ইশ! যদি জানা যেতো, দেখা যেতো কি হচ্ছে ওখানে? লাইজু মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। এ বারান্দাটা ডালাসে। ধানমন্ডিতে না। সামনে খোলা মাঠ। যেন তেপান্তরের মাঠ। তারপরে বহুতল রাস্তা হাইওয়ে, এক তলা দুই তলা, তিন তলা রাস্তা। কোনটার ওপর কোনটা, কোনটা কোনদিকে গেছে খুব সুক্ষ্মভাবে দেখতে হয়। দূর থেকে বোঝা যায় না। পাঁচ তলা, চার তলা বাড়ির মতো তলাওয়ালা রাস্তা। এ রাস্তাগুলো দেখলেই তার মনে পড়ে যায়, পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি গানটা। বাতাসটা আজ বেশ ঠাণ্ডা। প্রায় তিনটা বেজে গেছে। ঢাকায় রাতের তিনটা। গভীর রাত। একবার এক শবেবরাত রাতের তিনটায় সে ছিল চট্টগ্রামে। নানার বাড়িতে। ছোট খালার সঙ্গে ঘুরছিল বাগানে, ঘুরে ঘুরে দোয়া পড়ছিল। সে বহু বছর আগের কথা। বাগানের এক পাশে বিশাল কাছারির মতো ঘরটাতে নানা সাহেব রাতভর জেগে পড়তেন শবেবরাতের নামাজ।

 

আগরবাতির সে কি তীব্র সুগন্ধ! আজকার এ গন্ধও যেন আর আগরবাতিতে থাকে না। নানু ছিলেন শোবার ঘরে। কিন্তু বাগানটা লাগোয়া হওয়াতে শোনা যাচ্ছিল গুনগুনিয়ে তার কোরআন তেলাওয়াত করা, সে কি সুমধুর শব্দ তরঙ্গ। সেদিন এ রকম মনে হয়নি, অথচ আজ এতকাল পরে মনে হচ্ছে অসাধারণ এক আভিজাত্য ছিল সেই রাতের হালকা বাতাসে। সেই ঝিরঝিরে বাতাসে খালার সঙ্গে মেতেছিল এক অ্যাডভেঞ্চারে। বহুদিন আগে শোনা এক গল্প বা ঘটনার সত্যতা পরীক্ষায় মগ্ন ছিল। যখন ক্লাস টুর ছাত্রী তখন স্কুলের টিচার শুনিয়েছিলেন এক অবাক করা সত্য গল্প বা কল্প-কাহিনী। শবেবরাতের রাতে ম্যাডামের বাবা রাস্তায় হাটছিলেন অনেক রাতে।

 

গ্রাম অঞ্চল। কোন গ্রাম লাইজুর আজ তা আর মনে নেই। ম্যাডামের নামও না। শুধু মনে আছে সেই ম্যাডাম হলুদ শাড়ি পরতেন খুব। এতকালো একজন মানুষ। অথচ হলুদ শাড়িতে কি অপূর্ব লাগতো। সেই ম্যাডামের বাবা শবেবরাতের রাতে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখলেন সব কয়টা গাছ দুধারে সেজদায় অবনত। ভদ্রলোক দৌড়ে বাড়ি এসে ফিট হয়ে গেলেন। ম্যাডামের মা ছিলেন খুব পরহেজগার। তিনি ঘটনা শুনে দৌড়ে নামাজে দাড়িয়ে গেলেন পরে শুধু বললেন, এ রাতে সবাই আল্লাহর দরবারে সেজদা দেয়। গাছের সঙ্গে তুমিও সেজদায় গেলে না কেন! বেহেশত পেতে কোনো অসুবিধা হতো না। ম্যাডামের সেই ঘটনা আজো মনে আছে লাইজুর।

 

ছোটবেলার ঘটনাগুলো এতো কেন মনে থাকে! রেখাপাত করা বিষয়গুলো তো বোধহয় জীবনভর বয়ে নেয়ার সামগ্রী। ‘স্মৃতির ভারে আক্রান্ত’ শব্দটা বা পংক্তিটা বোধহয় এ জন্যই তৈরি হয়েছে। ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে রাতে খালার সঙ্গে, অনেকক্ষণ, বহুক্ষণ। প্রায় রাতভর জেগে নজর রেখেছে গাছগুলোর দিকে, চোখে ছিল আকাক্সক্ষা, মনে ছিল লোভ, অলৌকিক কোনো দৃশ্য দেখার বাসনা। পরেও বহু বছর বিভিন্ন সময়ে জানালা দিয়ে উকি মেরেছে বহুবার গাছেরা কি করছে দেখতে এবং কখনোই অসম্ভব কোনো কিছুই দেখা হয়নি। দেখার মতন চোখ-ই হয়তো স্রষ্টা দেননি তাকে। ছোটখালা বহুবার দুষ্টুমি করেছেন তার সঙ্গে এই বলে, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, দেখ তবে চক্ষু মুদিয়া। বসে আছে ডালাসে। অথচ চক্ষু মুদিলেই দেখতে পাচ্ছে চট্টগ্রাম। সেই কবেকার কথা, সেই ঘটনা, ঘটনা সকল ছুটে ছুটে আসছে যেন। লাইজু মনে মনে আওড়ালো, এ যেন আমার অবাধ স্বাধীনতা, ভিসা লাগে না, পাসপোর্ট লাগে না, যখন যেভাবে খুশি মনের দুয়ার খোলো। সোদা মাটির গন্ধ, তারাবাতির ঝিলিক, নানার বিড়বিড়িয়ে দোয়া পড়ার আওয়াজ, নানুর কোরআন তেলাওয়াত সবই যেন ছুয়ে যায় লাইজুকে।

 

মাথার উপর সে রাতের আকাশও মনে পড়ে। চাদ ছিল। চারপাশের নারিকেল গাছের ফাকে উকিঝুকি মারা ওই নীলাভ এক মায়াভরা চাদের আলোর নিচে সে আর ছোটখালা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সব এখন ফেলে আসা অতীত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এতো কি দেখছো? সাজিদ যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে, শুমুনও সঙ্গে আছে। মেয়েকে নিয়ে সে একটু শপিংয়ে গিয়েছিল। দুই রুমের অ্যাপার্টমেন্ট। এদিক থেকে সেদিকে ঘাড় ফেরাতেই সীমানা শেষ। সময় পেলেই অবশ্য সাজিদ ওদের নিয়ে বেড়াতে বের হয়। চলো, চলো, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। কোথায়? মলে, আরভিং মলে আজকে হ্যালোউইন- এর ক্যান্ডি দেয়া হবে। তোমরা নিয়ে আসতে। আমি রোজা রেখেছি না। একটু পরেই ইফতারির সময় হবে। আমরা মল পর্যন্ত যাইনি। Sack and Save (স্যাক অ্যান্ড সেইভ) পর্যন্ত গেলাম। তোমাকে ছাড়া চকলেট কুড়াতে আমাদের ভালো লাগবে না। আহা রে! কি ভালোবাসা। আরভিং মলের একটু আগেই স্যাক অ্যান্ড সেইভ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর জাতীয় বিশাল গোডাউন সদৃশ দোকান। সব কিছুই পাওয়া যায়। তরকারি, মাছ থেকে পাউডার সব। এ দোকানে জিনিসপত্রের দাম কম। স্যাক-এ বা পলিথিন জিনিসপত্র নিজেকেই ভরতে হয়। এ জন্য দাম কম। সেভ করা যায়। তাই নাম Sack and Save । আমরা রোজা রেখে এসব হ্যালোউইন উৎসবে যেতে ইচ্ছে করছে না। ফান হিসেবে নাও। এটাতে নাকি খুব মজা হয়। শুমুন তো কখনো দেখেনি। প্রায় চার মাস আমেরিকাতে আসা হয়েছে। লক্ষ্য বসতি স্থাপন। শুমুন স্কুলও শুরু করেছে। কিন্ডারগার্টেন। স্কুলে শুমুনদের হ্যালোউইন সম্পর্কে অনেক গল্প করা হয়েছে। ধারণা দেয়া হয়েছে। সেও উদগ্রীব। উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। অক্টোবর মাস আসতে না আসতেই যেভাবে চারদিকে সাজানোর ধুম পড়ে গেছে, বাচ্চাকাচ্চারা পাগল না হয়ে কি করবে। প্রতিবছর ৩১ অক্টোবর এদের হ্যালোউইন হয়। মৃত আমেরিকানরা নাকি ভূত হয়ে ফিরে আসবে দেখা দিতে জিন্দাদের। শুমুন স্কুল থেকে তা শুনে এসে জিজ্ঞাসা করলো, মা, যদি ডেড পারসনরা ভূত হয়েই আসে তাহলে চিনবে কিভাবে কার কে এসেছে? লাইজু বলেছিল মনে হয় সঙ্গে ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকবে। এই আইডি তো এখানকার যজ্ঞের ধন, মরে গেলেও কেউ এটা হারাবে না।

 

শুমুন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল, তারপরে বললো, মাম! ওয়াট আর ইউ সেইং। সে যাই হোক। সব আমেরিকানদের বাসার সামনেই কমলা রঙয়ের পামকিন যা দেখতে বাংলাদেশের মিষ্টি কুমড়ার মতো তা দিয়ে সাজানো হয়ে গেছে। অনেকে ভূতপ্রেত বানিয়েও সাজিয়ে রেখেছে। লাইটিং তো আছেই। সেদিন ম্যাকডোনাল্ডস- এ খেতে গেলে বাচ্চাদের Kids Meal-এ হ্যালোউইনের ক্যান্ডি সংগ্রহের জন্য দিল একটা ঝুড়ি। ঝুড়িটা দেখতে পুরোপুরি একটা মিষ্টি কুমড়া। শুমুন সেই ঝুড়ি হাতে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে চেয়ে আছে মায়ের দিকে। মায়ের রাজি হওয়াটা বিশেষভাবে দরকারি বিষয়। লাইজুর মোটেও ইচ্ছা করছে না মেয়েকে নিরাশ করতে, অথচ বাইরে ইফতারি করারও ইচ্ছে নেই আবার শবেবরাত সম্পর্কিত নতুন জ্ঞানে তার মনটা খুবই বিষণ্ন।

 

চলো, চলো মলে কিছু খেয়ে ইফতারি করে নেবে। সাজিদের আগ্রহেরও সীমা নেই। অতএব, চলিতেছি। নিজেই নিজেকে বললো। বলে তৈরি হয়ে নিল। আরভিং শপিং মল, দোকান রয়েছে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটা, প্রতিটিতেই ক্যান্ডি দেয়া হচ্ছে। দরজায় দাড়ানো সুন্দরী সেলস গার্লরা বহু ধরনের ক্যান্ডি দিচ্ছে। বাচ্চারা ছুটছে এই দোকান থেকে আরেক দোকানে। শুমুনও তা করছে। কোনো কোনো দোকানের সামনে লম্বা লাইনও তৈরি হয়ে গেছে। অনেক মানুষের ভিড় আবাল-বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই। বাংলাদেশি একজনের একটা দোকান রয়েছে এই মলে। ওরা অবশ্য ক্যান্ডি বিলাচ্ছে না। সম্ভবত ধর্মীয় কারণে।

 

সেলস গার্ল চুপচাপ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও বাঙালি সেই মেয়ের পরনে রয়েছে শার্ট-প্যান্ট। বাঙালিত্ব বর্জন করলেও ধর্মীয় অনুশাসন না। ধর্ম মানুষের এক ধরনের সুনিবিড় জন্মগত বন্ধন, সহজে মানুষ এটি পরিহার করতে পারে না, পালনের ক্ষেত্রে যতোই বা ছেলেমি থাকুক না কেন। বাচ্চারা সবাই বহুভাবে সেজে এসেছে। ভূত সাজার প্রবণতাই বেশি। বহু রকমের ভূত। শুমুনই শুধু নরমাল ড্রেসে এসেছে। ফ্রক পরা শুমুন হাসছে, মজা করছে, দৌড়াচ্ছে। অনেকে তাকে বলছে Trick or treat: এটি হ্যালোউইনের বিশেষ শব্দাবলি। শুমুন এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। বলতে পারছে না উত্তরে কিছু। শুমুনের চার মাসের অভিজ্ঞতার আমেরিকা থেকে সে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না বা জবাব দিতে সংকোচ করছে।

 

তবে চারদিক থেকে যেভাবে সবাই জানতে চাইছে ট্রিক না ট্রিট, সহসাই শুমুনও একটা কিছু উত্তর দিতে শুরু করবে। বাচ্চাদের শেখার ক্ষমতা খুবই ভালো। আমেরিকার সব কিছুই শুমুন শিখে নিতে পারবে। কিন্তু সে আর পারবে না। তার ছক তৈরি হয়ে গেছে। শুমুনের ঝুড়িটা প্রায় কানায় কানায় ভরে উঠেছে। শুমুন খুব চিন্তিত, বাকি দোকানগুলোর ক্যান্ডি সে কোথায় ভরবে। পপর্কন-এর বাক্স সেজে কয়েকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাছে গেলেই পপর্কন বিলাচ্ছে। কয়েকজন বিশাল পায়ের ওপর দাঁড়ানো ভূত সেজেছে। লম্বা পা ফেলে হেঁটে বেড়াচ্ছে। অনেকের দাত দুটো আলো হয়ে জ্বলছে। মুখের দুইপাশ দিয়ে রক্তও বের হয়ে আছে, এই মাত্র হালুম-হলুম করে যেন কিছু মানুষ খেয়ে এসেছে রাক্ষসের দল। যেমন খুশি তেমন ভূত সাজার উৎসব যেন আজ। মলে লাইজুর দেখা হয়ে গেল চন্দনাভাবী আর ভাইয়ের সঙ্গে। মহিলা তাকে দেখেই এমন ভাব করলো যেন আপনার রোজাগিরি কোথায় গেল! লাইজু পাত্তা দিল না। এমন গায়েপড়া স্বভাবের মানুষ খুবই কম হয়। ভাই জানালেন, প্রতি বছর ভিড় আরো চারগুণ বেশি হ। এ বছর টেররিস্টের ভয়ে লোকজনের আগমন কম। ভূতের ছন্দবেশে কে কে ঘুরে বেড়াবে বলা তো যায় না। মাত্র তো সেপ্টেম্বর ইলাভেন গেল। ওরা বিদায় নিতেই সাজিদ হেসে লাইজুকে বলল, জন্ম থেকে মারামারি, হরতাল, বোমা, এসব দেখে দেখে-এদের মতো ভয় আমরা পাই না। কি বলো? আচ্ছা তাই? তোমার সামনে কেউ বোমা নিয়ে দাঁড়ানো থাকলে বুঝতাম কি বীর পুরুষ। কপালে লেখা থাকলে হতে কতক্ষণ? আজ রাতে লেখা হতেও পারে। এখন আর কপালে ওসব কিছু লেখা হবে না। ধর্মঘট শুরু হয়ে গেছে। মানে? এখন শুনছি নতুন কথা, শবেবরাত আমাদের ধর্মেই নাকি নেই। তাহলে রোজা রেখেছো কেন? কথাটা বলেই সাজিদ হাসতে থাকে। লাইজু বিরক্ত হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে দেখে তাড়াতাড়ি বলল, ধর্মবিষয়ক আমার জ্ঞান সীমিত। সহসাই এ ব্যাপারে পড়াশোনা করে নেবো। তবে তোমার মন যদি বলে পালন করতে, করো। এতকাল দাদা-দাদী সবাই করে এলেন। রাত জেগে নামাজ পড়লে এমন কি আর অসুবিধা। শুমুনের কাছ থেকে ক্যান্ডি চেয়ে নিয়ে সাজিদ খেতে লাগল। আল্লাহ কপালে রেখেছে বলেই তো এতো মজার ক্যান্ডি খেতে পাচ্ছি, কি বলো? কথাটা বলে সাজিদ এদিক-সেদিক চেয়ে হাসল। সাজিদের হাসি এতো সুন্দর। পৃথিবীর সব কিছুই সে সুন্দরভাবে দেখতে পারে। এতো সুন্দরভাবে দেখার চোখ সবার হয় না। আমার রোজা ভাঙার সময় হয়ে এলো। শব্দ হবে নাকি। মানে? কিছু ভাঙলে তো শব্দ হয়। এটা সাউন্ড প্রুফ। সাজিদ হাসলো। সেই সুন্দর হাসি।

 

চলো ফুড কোর্টে বারগার খেয়ে আজ রোজা ভাঙবে তুমি। শুমু কি খাবে? শুমু মুখস্থ বিদ্যার মতো সঙ্গে সঙ্গে বললো, ম্যাকডোনাল্ডস। গুড, আর তুমি? আমি বারগার খেয়ে রোজা ভাঙবো না। ইফতারি সঙ্গে নিয়েই এসেছি। বারগার হালাল নয়। এ আবার কি থিওরি? খুব সহজ। বারগার-এর ভেতরে যে মাংসটা থাকে সেটা হালাল না। চিকেন বারগার খাও। চিকেনটা আল্লাহর নামে জবাই হয়নি। ও খোদা, এতো কিছু! ভেবি সিমপল হিসাব। অন্য সময় খাও যে? অন্য সময় রোজা রাখি না যে। উচিত অবশ্য কখনোই না খাওয়া। গুড, গুড, ভেরি গুড। কিপ ইট আপ। লাইজু বুঝতে পারছে সাজিদ তার সাথে দুষ্টামি করছে, তারপরও বলল, থ্যাংক ইউ। ওই উচু জায়গাটা দেখছো? দেখেছি।

 

ফোয়ারার চারধারে বেদির মতো? ওখানে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে হবে ইফতারি শেষে। এটাও গুড আইডিয়া। এবং অবশ্যই বোঝার চেষ্টা করছি না তুমি আমার সঙ্গে কতটুকু ফাজলামো করছো। ওয়ান্ডারফুল। লাইজু ইফতারি বের করতে করতে বেদির ওপর গিয়ে বসল। একবার ফিরে চাইল, সাজিদের দিকে। দুই হাত পকেটে ঢোকানো। এদিক-সেদিক চেয়ে বিভিন্ন ধরনের ভূত দেখছে। কি চমৎকার একজন মানুষ। স্রষ্টা কি অসাধারণ একজন মানুষ সৃষ্টি করেছেন তার জন্য। লাইজু মনে মনে হাজারো শোকর করে খোদার দরবারে।

 

সাজিদ বলল, তুমি এই সার্কেলটার ওপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়বে! দেখো উল্টে আবার পানিতে পড়ে যেও না। শুমুন খিল খিল করে হেসে উঠল। বলল, মাম, পানিতে দেখেছো অনেক কয়েন আছে। ওইগুলো উইশ করে ফেলা হয়েছে। লাইজু চেয়ে দেখল। তাই তো! ফোয়ারার পানিতে প্রচুর পয়সা। কোথেকে তুমি জানলে ওইগুলো উইশ করে ফেলা হয়েছে? মেয়ের হয়ে সাজিদই উত্তর দিল, বাহ! তারও তো একটা সার্কল আছে, স্কুলে যাচ্ছে। নতুন বন্ধু হচ্ছে, শুনছে ওদের কারো থেকে। শুমুন হাত বাড়িয়ে বলল, আমাকে একটা কয়েন দাও, আমিও ফেলব। লাইজু সঙ্গে সঙ্গে ধমকালো, এসব আমরা করি না। সাজিদ অবাক হয়ে বললো, লাজু, এটাকে সিরিয়াসলি নেয়ার কি আছে? এতে আমরা তোমারা আবার কি? ফেলতে চাচ্ছে ফেলুক, বাচ্চা মানুষই তো। সাজিদ একটা কয়েন বের করে মেয়েকে দিল। মুখে বলল, ফেলো ফেলো। এক গাদা উইশ করে পানিতে ছুড়ে মারো। সাজিদ হাসছিল। লাইজু চুপ করে থাকে। বলা হয় না, তার শুধু ভয় করে। কেন জানে না। কিসের ভয় তাও বোঝে না। শুধুই ভয়। মনে হয় নতুন কোনো এক মহাদেশে এ তার একা পথচলা। সাজিদের দিকে চেয়ে লাইজু বলল, শোন, তোমাকে আজান দিতে হবে। না হলে পুরোপুরি রোজা মনে হচ্ছে না। রোজা খুলবো, অথচ আজান শুনবো না এ কেমন কথা! সাজিদ বোধহয় এবার একটু ঘাবড়ালো, এ রকম পাবলিক প্লেসে? আজান কি গোপন জায়গায় দেয়া হয় নাকি? তাই তো? কিন্তু তোমার আজকে হয়েছে কি? আমার কিছু হয়নি। ওই যে চন্দনা ভাবীরা এদিকেই আবার আসছেন ঘুরে। তুমি ওদের শুনিয়ে আজান দাও। দাও। কোনো খারাপ কাজ তো করতে বলছি না। এতো অবাক হচ্ছো কেন? মোয়াজ্জিমের ছেলে হয়ে এখন আজান দিতেও লজ্জা পাচ্ছো নাকি? লাজুর দিকে চেয়ে সাজিদ কি যেন কি ভাবলো কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর সোজা ফোয়ারার বাধানো বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবর বলে আজান দিতে শুরু করল। চমকে চারদিকের ভূতগুলো তাকাল। অনেকে দূরে সরে গেল। আশ্চর্য! ওইগুলো কি সত্যিকারের ভূত নাকি? সরে পড়ছে যে! লাইজু তীক্ষ্ম চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকল। সহসাই চারপাশটা ফাঁকাই লাগছে তার। নাকি মনের ভুল! যাই হোক। ইফতারি করতে বসল। ব্যাগে ভেতরেই ছিল পানি আর কুকি। বাংলাদেশের বিস্কিট এখানে এসে সেজেছে কুকি। তাই মুখে দিয়ে রোজা ভেঙে নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেল। চন্দনা ভাবীদের প্রতিক্রিয়া দেখতেও সে ফিরে তাকাল না। নিজের অবিচলতায় নিজেরই তার বড় ভালো লাগছে। তবে আশেপাশের লোকজন যে বেশ বিচলিত তা সে অনুভব করতে পারছে। ভাবখানা, এ আবার কি হচ্ছে? কোনো নতুন ধরনের সিগনাল লেন? টেররিস্ট অ্যাকশনের পূর্বক্ষণ! নাকি ফান? নাইন/ইলেভেনের এর ধাক্কা মাত্র লেগেছে সবাই সব কিছুতেই এলার্ট। লাইজু অবশ্য ভাবছিল অন্য কথা। শত মানুষের বিস্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে সে নামাজ পড়ছে, নামাজ হবে তো? ধর্মের এতো পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ সে জানে না। যেদিন প্রথম ডালাসে এসে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে উঠল, বুঝতে পারছিল না কোন দিকে ফিরে নামাজ পড়বে।

 

সাজিদ বলেছিল, পৃথিবীটা গোল, কাবাঘরের অভিমুখী তুমি যে কোনোভাবেই হবে। শুধু ডাকতে হবে অন্তর দিয়ে। কি সুন্দরই না কথা বলে সাজিদ! সাদা-কালো, লাল-নীল ভূত সাজা প্রচুর মানুষের ভিড়ের মাঝখান থেকে লাইজু সেজদায় গিয়ে পরম করুণাময়কে স্মরণ করতে চাইলো অন্তর দিয়ে। চারদিকের উপস্থিতি এক সময় সে ভুলে গেল। মনে হতে লাগল, বহুবছর আগে নানার বাড়িতে শবেবরাতের রাতে দেখা সেই চাদের আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সে আল্লাহতাআলাকে ডাকছে অসীম ভক্তি সহকারে। কোথাও কেউ নেই। চারপাশে তার ঘুরে বেড়াচ্ছে নানুর কোরআন তেলাওয়াত, নানার দোয়া দরুদের ধ্বনি।

 

হঠাৎ দেখল মোনাজাতে তার দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কেন? জানে না লাইজু। নতুন এই প্রবাস জীবনের সূচনাতে ক্ষণে ক্ষণেই উঠছে ভরে তার দুচোখ পানিতে। প্রতিদিনই অনাগত দিনের দিকে ভীরু চাহনি। প্রতি মুহূর্তেই প্রচুর না জানার সাথে দেখাদেখি চোখাচোখি। তেমনি দেখা হ্যালোইন। তেমনি জানে না, তাই থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছে ২০০১ এ শবেবরাত ও হ্যালোইন কেন একই দিনে এসেছিল ডালাসে!!!

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ নভেম্বর ২০১৬/দিলরুবা/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়