রজনীগন্ধাপুর : সপ্তম পর্ব
হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজন রজনীগন্ধাপুরের পুব দিকটায় চলে এসেছে। এদিকটায় গাছপালা আরও ঘন, আরও বেশি। একেবারে নিবিড় বনভূমি। বড় বড় ঘাস লতাপাতা, বুনো ঝোঁপঝাড়। রীতিমতো জঙ্গল। পায়েচলা পথ আছে। কোথাও কোথাও ফাঁকা জমি সবুজ ঘাসে ছেঁয়ে আছে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে, ফাগুন হাওয়ায় বুনোফুলের গন্ধ। যেটুকু রোদ পড়েছে গাছপালার ফাঁক ফোকড় দিয়ে, খুবই মিষ্টি লাগছে সেটুকু। হাওয়ার চলাচল, পাখিদের ডাকাডাকি, এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়াল এসব যেন নির্জনতা আরও গাঢ় করে দিয়েছে। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝিপোকার ডাক।
জামি বলল, এবার ছেলের কাছে যাওয়ার সময় রুবানা কী বলে গেল জানো?
কী করে জানবো? তুমি বলোনি তো।
বলল, আমি ছমাস থাকবো না। এই ছমাস তুমি একদম স্বাধীন। অবশ্য তুমি সব সময়ই স্বাধীন। যা করার তা তো করছোই। তার পরও আমি থাকলে স্বাধীনতায় বিঘ্ন ঘটে। ভয় কম-বেশি থাকে। ছমাস আর ভয় নেই। থাকো নিজের মতো। সম্পূর্ণ স্বাধীন।
মিলিয়া কথা বলল না।
জামি বলল, শওকত ভাইর মতো করে ফেললেই পারতাম।
মিলিয়া চমকালো। শওকত ভাই কী করেছেন?
লিনা ভাবি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
বলো তো ব্যাপারটা। এতবড় ব্যবসায়ি, হঠাৎ দ্বিতীয় বিয়ে করলেন?
কোনও কোনও বড় ব্যবসায়ীর দ্বিতীয় স্ত্রী থাকে।
মিলিয়া হাসলো। শুধু বড় ব্যবসায়ীদের কেন, অনেকেরই থাকে।
জামিও হাসল। তা ঠিক।
শওকত ভাইয়ের ব্যাপারটা বলো। কেন প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হলো? আগের ঘরের বাচ্চাকাচ্চা...
এক মেয়ে আছে। বিয়ে হয়ে গেছে। আমেরিকায় থাকে। মেয়েকে বাড়ি, মেয়ের জামাইকে গ্যাস স্টেশান, গ্রোসারি শপ ইত্যাদি করে দিয়েছেন। খুবই ভালো আছে তারা।
আর ভদ্রমহিলা?
তিনি দেশেই থাকেন। মেয়ের কাছে গেলেও বেশিদিন থাকেন না। তার সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম আছে। কিঞ্চিত পাগল টাইপ। শুনেছি শওকত ভাইর জীবন তছনছ করে দিয়েছিলেন। মেয়ে খুব চেষ্টা করেছে সামাল দিতে। পারেনি। তবে মেয়ের সঙ্গে শওকত ভাইর সম্পর্ক খুবই ভালো। মেয়েই নাকি তাঁকে বলেছিল, মার সঙ্গে তুমি জীবন কাটাতে পারবে না বাবা। তুমি আর একটা বিয়ে করো।
আশ্চর্য ব্যাপার। মেয়েরা সাধারণত মায়েদের পক্ষে থাকে।
তা ঠিক। তবে এই মেয়ে বাবার কষ্টটা বুঝেছিল। আজকালকার মেয়ে। উচ্চশিক্ষিত। তার মানসিকতা তো আধুনিকই হবে। মাকে সে নিজেই সহ্য করতে পারতো না। মেয়েকে নানা রকমের টর্চার করতো মা। আমেরিকায় মেয়ের কাছে গেলে মেয়ে খুবই বিরক্ত হয়। তবে মাকে তো আর ফেলতে পারে না! প্রথমে চেষ্টা করে মা যেন তার ওখানে না যায়। গেলে চেষ্টা করে কত দ্রুত তাঁকে দেশে পাঠানো যায়। ভদ্রমহিলা অনেক সময় না জানিয়েই আমেরিকায়, মেয়ের কাছে গিয়ে ওঠে। ফ্লোরিডার ফোর্ট লটারডেল এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা গিয়ে ওঠে মেয়ের ওয়েস্ট পাম বিচের বাড়িতে।
তার মানে স্মার্ট মহিলা?
হ্যাঁ স্মার্টনেসের অভাব নেই। শওকত ভাইর সঙ্গে সংসার করার সময় কোটি কোটি টাকা জমিয়েছেন নিজের একাউন্টে। টাকার অভাব নেই। ইচ্ছে হল মেয়ের কাছে যাবেন, রওনা দিলেন।
শওকত ভাইর সঙ্গে যোগাযোগ নেই?
এখন বোধহয় আর নেই। ডিভোর্সের আগে খুবই ঝামেলা করছিলেন। মেয়ে মেয়েরজামাই শ্বশুর শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন, তাঁরা আর ভদ্রমহিলার ভাইবোনরা সামাল দিয়েছে।
আর ডিভোর্সের পর?
ধীরে ধীরে থেমে গেছেন। তবে শওকত ভাইর টাকা পয়সা গেছে বিস্তর।
ভদ্রমহিলাকে দিতে হয়েছে?
হ্যাঁ। ঝামেলা চুকাবার জন্য তাঁর যা ডিমান্ড ছিল শওকত ভাই দিয়ে দিয়েছেন। যত দ্রুত ঝামেলা মেটাতে পারেন সেই চেষ্টা করেছেন। তবে মেয়েটা শওকত ভাইর দারুণ। বাবাকে যতটা সম্ভব হেল্প করেছে।
এ রকম বাবা ভক্ত মেয়ে কমই দেখা যায়।
মেয়েরা বাবা ভক্ত হয়। কিন্তু এই ধরনের ক্রাইসিসে মায়ের পক্ষ নেয়।
লিনা ভাবীর সঙ্গে সম্পর্কটা হল কীভাবে?
সেটা আরেক গল্প।
বলো না, শুনি।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই শুনবে, না কোথাও বসবে?
এখানে বসার জায়গা কোথায়?
কী আশ্চর্য! যে কোনও জায়গায়ই তো বসা যায়! ঝোঁপের ধারে। গাছের ছায়ায়। বসার জায়গার অভাব নেই।
তা ঠিক।
যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে মিলিয়া বলল, এই, এখানে সাপ নেই তো?
জামি নির্বিকার গলায় বলল, নিশ্চয় আছে।
ভয়ে দুহাতে জামির একটা হাত ধরল মিলিয়া। দাঁড়িয়ে গেল। কী বলছো তুমি? সাপ আছে?
জামি হাসল। এ রকম জায়গায় সাপ থাকবে না? সাপেরা এ রকম ঝোঁপজঙ্গল, নির্জন নিরাপদ জায়গাই পছন্দ করে। এখানে তাদের খাবারেরও কোনও অভাব নেই। ইঁদুর, ব্যাঙ, গিরিগিটি ব্যাপক পরিমাণে আছে। কোনও কোনও সাপ আছে ছোট ছোট সাপ খায়। সেই সাপেরও অভাব থাকার কথা না।
কেন আমাকে ভয় ধরাচ্ছো?
ভয় না, আমি সত্য কথা বলছি। এই রকম পরিবেশে সাপ থাকবেই। আমার ধারণা বেজিও আছে।
বেজি থাকবেই। ওই জিনিস ঢাকা শহরেই দেখা যায়। পুরনো শ্যাওলা ধরা বাড়ি, ভাঙাচোরা দালান কোঠায় পুরান ঢাকায় বেজি আমি দেখেছি।
তা আমিও দেখেছি। তবে বেজি থাকার একটা সুবিধা আছে।
জানি। বেজি থাকলে সাপ সহজে সামনে আসে না। চিরশত্রু। একজন আরেকজনের মুখোমুখি হলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। এজন্যই ‘সাপে নেউলে’ কথাটা তৈরি হয়েছে।
একটু থামলো মিলিয়া। জামির হাত ধরে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল দাঁড়িয়েই আছে। নড়ছে না, এগোচ্ছে না।
কী হলো?
আমার ভয় করছে!
সাপের ভয়?
হ্যাঁ।
ভয় পেয়ো না।
তুমিই ভয়টা ধরিয়েছো।
সেই আমিই ভয় ভাঙাচ্ছি।
তার মানে বলতে চাইছো সাপ এখানে নেই। তুমি মজা করার জন্য বলেছো?
না তা বলছি না।
তাহলে?
সাপ অবশ্যই আছে। আর ডাঙায় থাকা বেশির ভাগ সাপই বিষাক্ত। ছোবল দিলে খবর আছে। শওকত ভাইর কেয়ারটেকার কদমের বউকে সাপে কেটেছিল।
তারপর, তারপর?
দেখতেই পেয়েছো, বেঁচে আছে। মারা যায়নি। তবে সঙ্গে সঙ্গে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার ফলে বেঁচেছে।
ঘটনাটা বলো। এইসব ঘটনা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। (চলবে)
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন