ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

টেক্সাসান জীবন থেকে : ১২তম পর্ব

দিলরুবা আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৯, ৮ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টেক্সাসান জীবন থেকে : ১২তম পর্ব

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

দিলরুবা আহমেদ : মশী ভাই আমাকে দেখলে প্রায়ই বলেন, ভাবী আমি হচ্ছি একশ ভাগ হালাল মানুষ। ভালো কথা। খুবই ভালো কথা। তবে আমি উনাকে কখনোই জিজ্ঞেস করি না, কীভাবে বা কেন বলছেন? কী কারণে বলছেন? কীভাবে জানলেন বা কী দিয়ে মাপলেন, তাও জানতে চাই না।

শুধু বলি, ওকে, খুব ভালো কথা। এতে সম্ভবত উনি খুবই মনে কষ্ট পান। কারণ এর ফলে উনি বাদ বাকি গল্পটুকু আর বলতে পারেন না। বুঝতে পারি কিছু একটা গল্প উনার আছে বলার যা উনি সুযোগের অভাবে উগরাতে পারছেন না। তবে না বলার কষ্ট নিয়ে উনি দূরেও সরে যান না। বরং আশেপাশেই থাকেন। বিভিন্ন দাওয়াতে দেখা হয়ে যায়। একদিন আল্লাহর রহমতে সুযোগটা উনি হাতেনাতেই পেয়ে গেলেন। এক দাওয়াতে এক্কেবারে আসরের মাঝখানে বসে সবাইকে জানান দিলেন উনার মতন একশ ভাগ হালাল মানুষ জগৎ সংসারে বিরল। সবাই অবাক। অবাক হবার ভঙ্গিতে সবাই উনার দিকে চেয়ে থাকল। উনি মানুষটাই কিছু না কিছু কাণ্ডকারখানা প্রায় প্রায়ই করেন। কেন যে করেন তা উনিই জানেন।

যেমন একবার বিশ্বশান্তির জন্য বিশ্ব নেতাদের চিঠি লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আরেকবার উনার কাজের জায়গায় কিছুক্ষণ পর পর গেয়ে উঠতেন জাতীয় সংগীত এবং সহকর্মীদের বাধ্য করতেন হয়তোবা উনার নিজেরই অজান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে যতক্ষণ পর্যন্ত না উনার গান থেমেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ধমাধম তবলা বাজান। তবলার প্রতি বারিতেই যেন নতুন নতুন প্রজেক্ট উনার মাথায় ঘুরতে শুরু করে, পপ আপ হয়। যেহেতু বিগত বিশ বছর ধরে একটানা প্রবাসী বা আমেরিকায় বন্দি হয়ে আছেন, ইনলিগাল বলে দেশে যেতে পারছেন না। তাই উনার মাথায় গণ্ডগোল হচ্ছে, এরকম ভাব করে সবাই উনার সবকিছু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। না হলে পাল্লায় পড়ে এতদিনে আমাদের সবারও মাথা পা যা আছে সব গোল হয়ে যেত। পাগোল, মাথাগোল, গোলমাল, এই আর কি, পাগল হয়ে যেতাম। যাই হোক তবে আমি অবাক হলাম না উনার ঘোষণায় কারণ আমি আগেই জেনেছি।

তবে অবাক হলাম উনার উত্তরে বা যে কারণ বলছেন তাতে, এত ঘটা করে আয়োজন করে আসরের মধ্যমনি হয়ে দাঁড়িয়ে যে ঘোষণা দিলেন তার দ্বিতীয় লাইনটিই হচ্ছে অতি সংক্ষিপ্ত, ছোট, বললেন, উনি হালাল সাবান ব্যবহার করেন তাই উনি হালাল। আচ্ছা পাগল তো! ‘আহ্ মরণ’ বলে উঠল যেন কোনো এক ভাবী। কে যেন পেছনে নিল খিল করে হেসে উঠে বলল, ওহ্ নো। এবং হা হা, হি হি। বোঝাই যাচ্ছে যারপর নাই গোছের অবাক হয়েও অবশ্য কেউ বসে নাই। মশী ভাই মানেই তো এমন কিছু এমন ভাব অনেকেরই। এক ভাই হেসে হেসে ওনাকে জিজ্ঞেস করেই বসলেন, তাহলে তো আপনার ওই  সাবান মেখে গোসল করালে হালাল হয়ে যাবে, খাওয়া যাবে, কি বলেন? বলেই ভদ্রলোক নিজেই পরক্ষণে বলে উঠলেন নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ।

উনার সঙ্গে সঙ্গে মশী ভাইও হাসি দিয়ে বলছেন নাউজুবিল্লাহ। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল ওনাকে আরেকটু ঘাটালে হয়তো জানা যাবে ইতিমধ্যেই দুই তিনটা সাপ ব্যাঙকে গোসল দিয়ে বাসায় শুইয়ে রেখে এসেছেন। কিন্তু উনাকে পারতপক্ষে আমি কিছু জিজ্ঞেস করি না। টেক্সাসবাসী হবার পর থেকেই উনাকে দেখছি। মতিচ্ছন্ন এক ভাবুক মানুষ। কিন্তু ওনার বউ সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজেই বললেন, ও তো হালাল তাহলে ওকে  খেয়ে ফেলা যাবে কচকচ করে। বোঝাই যাচ্ছে মহিলার মন চাইছে কামড়ে ছিড়ে ফেলতে এই লোককে। বললেনও চোখ বড় বড় করে, আস্ত মানুষের রোস্ট।

মশী ভাই বউয়ের নিষ্ঠুরতায় এদিক ওদিক চাইছেন সাহায্যের জন্য, কে করে সাহায্য! মিঞা বিবির মাঝে কে যাবে। একজন উল্টো বললেন, ভাবী গ্রীলে উল্টাতে অসুবিধা হলে আমাকে ডেকেন। আই উইল হেল্প।

ভাবী উঠে চলে যাচ্ছিলেন কিন্তু ওনার এ কথায় হেসে দিলেন। বললেন, ওর কারণে আমি জ্যান্ত ভাজা ভাজা হচ্ছি। ইদানীং সবকিছুতে হালাল খোঁজে। থাকে আমেরিকায় অথচ খোঁজে  সারাক্ষণ হালাল, হালাল সবকিছুতে পাবে নাকি! যায় না কেন চলে সৌদিতে। মনে হলো এবার উনি কেঁদেও ফেলতে পারেন।  কিন্তু মশী ভাই জিজ্ঞেস করে উঠলেন, এক আসরে একসাথেই পর পর রাগ হাসি কান্না সব দেখানো কি জয়েজ, হালাল, কে বলতে পারেন। যে বলতে পারেন তাকে আমি একটা হালাল ভিটামিন দেব।

ইদানীং টিভিতে এই হালাল ভিটামিনের বিজ্ঞাপনটা আমিও দেখেছি। আমিও পেতে চাই ওটা। অন্য ভিটামিনের সাথে এর পার্থক্যটা কী জানি না। মশী ভাইকেই কি জিজ্ঞেস করবো। নাহ্ থাক। উনি আবার দেখা যাবে আমাকে এক সমুদ্র ভাবনা মধ্যে ফেলে দিয়েছেন বিভিন্ন মতবাদ দিয়ে। তবে এটা ঠিক আমারা প্রবাসী হলেও হারাম হালাল নিয়ে আমাদের প্রচুর চিন্তা। প্রচুর সময় ও শ্রম আমরা দেই হালাল খাবারটা খেতে। এটা আমাদের শিক্ষায় আর বেড়ে উঠার একটা অংশ হিসাবেই আমাদের সাথে এতদূর চলে এসেছে।

আমার খুব মনে আছে আমার তখন শিশুকাল। ওই সময়ে আমাদের বাসায় ৩/৪ টা মুরগি একসঙ্গে দলবেধে মারা গেল। মা বললেন, এগুলো আর আমরা খেতে পারবো না, হারাম। পাশের বাসায় অন্য ধর্মের একটা পরিবার ছিল, আমাদের বাবুর্চির বুদ্ধিতে ওদের বাসায় পাঠানো হলো। আমাদের বাবুর্চি ছিল আবার নিরামিষভোজী, সেও খাবে না ওই মুরগি। যাই হোক আমার মা ওগুলো দান করে বাঁচলেন। আমি অবশ্য একটু পরেই দোতলার জানালা থেকে দেখলাম সবকটা মুরগিই বাবুর্চি ময়লার ড্রামে ফেলে দিচ্ছেন। হয় তারা নেয়নি বা বাবুর্চি যায়নি ওই বাসা পর্যন্ত।

সে যাই হোক ছোট বেলাতেই বুঝে গেলাম খানা-খাদ্য নিয়ে ধর্ম ভেদে আমাদের বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। বেঁচে থাকা আরো ৭/৮টি মুরগিরও ভাগ্য নির্ধারণ হলো, আম্মা বাবুর্চিকে হুকুম দিলেন এখনই একজন মৌলভী ডেকে এনে সবকটাকে জ্যান্ত জবাই করতে। যে দাওয়াতের উপলক্ষে কেনা তা আসতে যদিও আরো দুতিনটা দিন দেরি আছে তারপরও এগুলো জিন্দা রাখা ঠিক না। সঙ্গী হারা হয়ে যে কোনো সময় ওদের হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। বাবুর্চি হিন্দু, সে জবাই করলে হবে না। মা মহিলা উনি জবাই করবেন না। বাবা অফিসে। অন্যকোনো পুরুষ মানুষ নেই। আমি আর আমার ছোট বোন গালে হাত দিয়ে বসে বসে দেখলাম এক হুজুরকে আনা হয়েছে। উনি আল্লাহু আকবর এবং হয়তোবা আরো কিছু দোয়া-দরুদ পরে মুরগিগুলো একের পর এক জবাই করছেন। আম্মা আমাদের দুবোনকে শিখালেন, আমরা আল্লাহর নামে জবাই করা পশুই একমাত্র খাই, ওটা হালাল। যেগুলো খেতে পারি তার নাম শেখালেন এবং অবশ্যই ওগুলো যেন আল্লাহর নামে জবাই হয় তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিলেন। হিন্দু বাবুর্চি যার নামটা ভুলে গেছি সে বলল, একটা কাক ধরে আল্লাহর নামে জবাই করলে তো আপনারা খাবেন না, তাই না বেগম সাহেব?

বেগম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তওবা তওবা বলতে লাগলেন। হুজুর তো নাউজুবিল্লাহ বলে এমনভাবে বাবুর্চির দিকে তাকালেন যেন মনে হলো হাতের ছুরি দিয়ে বাবুচিকেই এবার উনি জবাই করবেন। আমার সেই শিশুকাল পার হয়ে গেছে বহুকাল আগে। এখন চলছে আমার মেয়ের শিশুকাল। আমার মেয়েটি বড় হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সংস্কৃতিতে, পরিবেশে। তাই আমি আমার মায়ের থেকেও চারগুণ বেশি সচেতন এবং সতর্ক। কোনোভাবেই মেয়েটিকে ভিন্ন কালচারে যেতে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশি  সংস্কৃতি এবং মুসলমানের ধর্মীয় বিধি-নিষেধ পাকাপোক্তভাবে গেঁথে দেওয়ার গুরু দায়িত্বটি এখন আমার হাতে। আমিও ওকে শেখাতে চেষ্টা করি আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলো। কি খেতে পারবে কি পারবে না তার ওপরও সে প্রায়ই আমার থেকে লেকচার শোনে। তার নানীকেও বিভিন্ন সময়ে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করি। এখানে তো বাইরের সব ধরনের খাবারেই চর্বি থাকে। ও জানে কোনো অবস্থাতেই পোর্ক খাওয়া চলবে না। অ্যালকোহল সম্পর্ক বলার জন্য সে একটু বেশি রকমের ছোট। চার বছর বয়সে সে আমেরিকাতে ঢুকেছে এবং প্রথমদিনের  প্ল্যান ভ্রমণকালীন খাবারের মেনু বাছাই করা থেকেই নো পোর্ক বলতে শুরু করেছে। সে বারগার থেকে সবকিছুতেই যেমন ক্যান্ডি, চিপস, ম্যাশমেলন ইত্যাদি যাই খাবে আগে ইনগ্রীডেন্ট পড়ে নেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সে জানে মুরগি, গরু, খাসি খাওয়া যাবে কিন্তু কিভাবে এনসিউর করবে ওটা হালাল কি না? আমরাই ধোকা খাই আর ও তো শিশু। কিন্ডারগার্টেনে প্রথমদিন ক্লাস করে আসতেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম আজ কি টিফিন খেলে। যদিও স্কুলের মেনুতে আমরা লিখে দিয়েছি নো পোর্ক তারপরেও রেগুলার খবর নেই কি কি খাচ্ছে সে স্কুল ক্যাফে থেকে। এখনকার স্কুলগুলোতে ভালো ভালো টিফিন সাপ্লাই করা হয়। নো-ফ্যাট খাবারের প্রতি ইদানীং খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে এতে করে ভবিষ্যৎ জেনারেশনকে ওবিসিটি থেকে রক্ষা করা যাবে।

আমার টার্গেট হচ্ছে হারাম কিছু না আবার খেয়ে ফেলে। বারগার খেলে মেয়েকে বলেছি চিজ বারগার খেতে। মাংসের না। সে একদিন এসে বলল, মা আমি আজকে চিকেন বারগার খেয়েছি। সারছে। ওই চিকেন তো আল্লাহর নামে অবশ্যই জবাই হয়নি। আমি কিছু বলার আগেই সে বলল, আমি আল্লাহু আকবার বলে বাইট করেছি। আমি হা করে আমার কিন্ডারগার্টেনের মেয়ের দিকে চেয়ে থাকলাম। এখানকার কিছু ভাবীরা বললেন, বাসার জন্য যখন তারা কেনেন অবশ্যই হালাল দেখেই কেনেন কিন্তু রেস্টুরেন্টে, ফাস্টফুডের দোকানে চিকেন খাওয়ার সময় হারাম কি না ভাবেন না। তাহলে বাইরের খাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। যেমন, বাইরে বিফকেও তেমন খায় না। আমিও না। মুরগিকে পাখি ভেবে খেলে কোনো অসুবিধা নেই এমন অদ্ভুত মতামতও দিলেন অনেকে এবং এতে আস্থা রাখতেও বললেন। না হলে পুরোপুরি সবজিখাদক হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাও কি সম্ভবপর হবে কি না সন্দেহ আছে কারণ চিনি আর লবণের হারাম হালাল নিয়েও আজকাল বিতর্ক দেখা যাচ্ছে।

চিনি-লবণ রিফাইন করার সময় একপর্যায়ে হাড্ডি মেশাতে হয়, ওই হাড্ডিটা শুয়োরের হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আজকাল কিছু চিনির ওপর হালাল চিনি লেখা থাকে। হালাল লবণ এখনো আমার চোখে পড়েনি। আমার স্বামীকে আমাদের ভাবীদের হালাল-হারামের সমস্যার কথা বলতেই উনি বললেন, এক কাজ করো না, তোমরা সবাই ফল খেয়ে থাকো না। ফলাহারি। কি অদ্ভুত মানুষ। সমাধান না দিয়ে আরো সমস্যায় ফেলে দিলেন, বললেন, শোন যে বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছ সেখানে শুয়োরের দীর্ঘশ্বাসও পড়ছে, ভেবে দেখো শ্বাস নেবে না দম বন্ধ করে বসে থাকবে। আমার ছোটবেলার এক বান্ধবী পারুল অক্সফোর্ডে মেডিক্যাল সায়েন্সের ওপর বড় একটা ডিগ্রি করার সুযোগ পেল। আমি এক সময় স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে অক্সফোর্ডে পড়বো, পারুল শুনতো। সে বরাবরই ধার্মিক। স্কুলেও সে স্কার্ফ মাথায় দিয়ে ঘুরে বেড়াতো। সে যখন ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পেল আমি তখন অস্ট্রেলিয়াতে। সে তার অসাধারণ স্বপ্ন পূরণের সুযোগটার সুখবরটা আমাকে জানানোর জন্য আকাশ-বাতাস তোলপাড় করে বহু বছর পরে আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে অস্ট্রেলিয়াতে রিং করল। আমার প্রথমেই মনে হলো ও অতটা ধার্মিক ছিল বলেই আল্লাহ ওকে অক্সফোর্ডে পাঠালেন, আমাকে না। পারলে ফোনেই টেনে ওর স্কার্ফটা খুলে নিয়ে আমার মাথায় পরি। তবে ওকে জানাতে ভুললাম না, শোন, ইংল্যান্ডে মাংস খাবি কেমন করে। কতটা সত্যিই হালাল সন্দেহ থেকেই যায়।

সে নির্বিকারভাবে বলল, দুই বছর সবজি আর মাছ খেয়ে থাকলেই তো চলে। বুঝলাম পাক্কা মুসলমান। আল্লাহতায়ালা এজন্যই এদের ওপর রহমত করেন। সেদিন ওর ফোন রেখে দিয়েও অনেকক্ষণ আমি গম্ভীর হয়ে বসে ছিলাম। আমার অক্সফোর্ডতো গেলই, পরকালও কতটা গেল বুঝতে পারলাম না। কল ব্যাক করলাম। পারুল শুনে হাসতে লাগল।  সান্ত্বনা দিল। বলল, আল্লাহ কাকে কেন মাফ করবেন আমরা জানি না, সফরের সময় তো রোজাই মাফ। তুই অস্ট্রেলিয়াতে সফরে আছিস, অতএব হারাম-হালালের মাফ পেতেও পারিস।

ম্যাকডোনালাস, কেএফসির নাম শুনে শুনে বড় হয়েছি। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে চোখে দেখেছি। প্রথম প্রথম ধুমায়ে যে কামড় বসাতাম ম্যাক চিকেন আর ক্যান্টাকি ফ্রাইড চিকেনে পরে নিজের অজান্তেই খচ খচ এসে গেল। যদিও সব সময়ই শুধু মুরগির আইটেমগুলোই অর্ডার করতাম, তারপরও, ওই হারাম-হালালের চিন্তা ভিড় করতে লাগল যে মনে। এখন আমেরিকাতে তো সফরে নেই, বসতি। অতএব কী করি। এখানে যদিও প্রচুর মুসলিম হালাল মাংসের দোকান আছে তবে কতটুকু হালাল তা নিয়েও সন্দহে আছে। তারপরও ওইগুলো থেকেই কিনছি। কিন্তু চায়নিজ খেতে গেলে বা থাই অথবা আমেরিকান রেস্টুরেন্টে গেলে অবশ্যই একটু ধাধায় থাকতে হয়। সিফুডের দোকানগুলোই নিরাপদ বলা চলে বলে ভাবলাম কিন্তু তাতেও একজন ভাঙানি দিলেন, কিসের তেলে ভাজে কে জানে, চিংড়ি হোক আর তেলাপিয়া, ভাজতে তো হবে। ও আল্লাহ এবার যাই কই? পিৎজা খেয়ে যে জান বাঁচাবো তারও উপায় নেই। পিৎজা হার্টে কর্মরত এক ভাবী জানালেন একই ছুরি দিয়েই পোর্ক পিৎজাও কাটা হয়। অতএব চিজ বা সবজি পিৎজায় পোর্কের ছোঁয়া লেগেই যায়। একবার ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলাম, ছোটবেলায়, জ্যাঠাতো বোনের বাসায়। দুলাভাই ক্রমাগত বলতে লাগলেন, এখানকার সব মুরগি-গরু যে খাবে তারই গা চুলকাবে। উনি শালীর সঙ্গে দুষ্টামি করেই গেলেন আর আমি শালী বেচারার একসময় সত্যি সত্যিই মনে হতে লাগল, আরে গা চুলকাচ্ছে কেন? গরু-মুরগি সবকিছুতেই গন্ধ লাগতে লাগল, চামড়া চামড়া গন্ধ। যে কোনো খাবার দেখলেই বমির ভাব হতে শুরু করলো। দেশে ফিরে বড় শান্তির একটা নিঃশ্বাস নিলাম।

এবার আমেরিকা আসার সময়ও আবার বলতে লাগলেন সব গরু, মুরগি খাওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না। কুকুর কেউ  খায়? তারপরও উনি বলেই চলেছেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার পথে ব্যাংকক ছিলাম পাঁচদিন। আমার ভাই তখন অ্যাবাক ভার্সিটির ছাত্র। সে আমাদের অনেক মজার মজার খানা খাওয়াল, প্রচণ্ড ঝাল এবং নারিকেল তেলে রান্না অনেক রকম খাবার। একসময় সেগুলো হালাল কি না জিজ্ঞাসা করায় সে অবাক হয়ে বলল, এখানে যে তোমাকে সাপ, ব্যাঙ, অক্টোপাস না খেতে দিয়ে মুরগি দিচ্ছি সেই তো ঢের। বলল চায়নায় একবার বানরের মগজ তাকে প্রায় খাইয়ে দিচ্ছিল। সেরকম কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা যে চলছে না সেই-তো অনেক। বুঝলাম বিশ্বজুড়ে মানুষ বহুকিছুর খাদক।

তবে এখানে এই আমেরিকাতেই আমি কিছু পরিবারকে চিনি যারা বিশুদ্ধ ও কঠিন নিষ্ঠাবান ধার্মিক। এমন কি মাটিতে বসে খায়। টেবিল চেয়ার ব্যবহার করেন না। সবার বাসাতে অবশ্যই ওনারা দাওয়াত খেতে যান না। সবাইকে দাওয়াত  করেন না। একবার এলেন কজন আমার বাসায়। আমি নতুন এসেছি এই মহাদেশে আমাকে হেদায়েত করতে পারলে বা আমি ওনাদের মতো অতটা পরিবর্তিত হলে ওনাদেরও অনেক সওয়াব হবে। আমার রান্নার খুবই প্রশংসা করলেন কিন্তু সবজি ও মাছ দিয়েই খেলেন। মাংস খেলেন না, কারণ ওনারা নিজের হাতে জবাই করেই মুরগি আনেন ফার্ম থেকে। দোকানের থেকে আনা মাংসের হালালের বিশুদ্ধতা নিয়ে ওনারা সন্দিহান। তাই মাংস খাবেন না।

যাই হোক, ওই পরিবারগুলোর একটি আবার আমাদের দাওয়াত দিল। তবে মেয়েরা আগে খেয়ে চলে যাবে তারপরে ছেলেরা আসবে। আমার স্বামী শুনে বললেন, ওদের বাসার সামনে কি কোনো সিগনাল বাতি আছে লাল-সবুজ? না হলে বুঝব  কেমন করে আমরা এখন বিপদমুক্ত, গো এহেড। খেতে যাও। আমি সেল ফোনটা তুলে দেখালাম, ইশারা পাবে। ওই বাসায় খেতে বসলাম মাটিতে। ফ্লোরে চেপ্টা হয়ে বসে অনেককাল পরে খেলাম। খুব ছোটবেলায় দাদার মৃত্যুর পর মিসকিন ভোজে বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে চাটাই বা মাদুর বিছিয়ে এরকম বসেছিলাম। আমেরিকাতে এসে এতো বছর পরে কার্পেটের ওপর চাদর বিছিয়ে বসে খাওয়া, আমার ভালই লাগছিল। আমার সঙ্গে অন্য যে কজন আছেন সবাই হিজাব পরা, গৃহকর্ত্রী ছাড়া। অন্যদের মুখ আমি দেখতে পেলাম না। এদেরই একজন একবার বলেছিলেন বিধর্মীদের সামনে ওরা মুখের পর্দা সরায় না, সে মেয়ে হলেও না। ছেলে তো বহু দূরের কথা। আমার খুব বলতে ইচ্ছা হলো, হ্যালো, আমি তো মুসলমান আমার সামনে মুখ খুলো। কে কোন ভাবী কিছুই বুঝতে পারছি না। কাকে কি নামে ডাকবো তাও না। নিজেকেই অপাঙক্তেয় মনে হতে লাগল। সমগ্র আসরে আমিই একমাত্র অড ম্যান আউট, সরি অড ওমেন আউট। যাই হোক, আমার জানা খুবই জরুরি যে মাংস আমরা কিনি বাংলাদেশি গ্রোসারি শপ থেকে তা কতটুকু হালাল।

আমার বাসার কাছেই ১৮৩ হাইওয়ের পাশে পরপর তিনটি বাংলাদেশি গ্রোসারি শপ আছে। মাংস কেনার নাম করে আমি প্রশ্নাবলি নিয়ে হাজির হলাম। প্রথম দোকান থেকে বলা হলো, কিছু আছে মেশিনের হালাল। মেশিনে পশু জবাই হতে থাকে, ক্যাসেটে দোয়া চলতে থাকে। কিছু হাতে জবাই করা হালাল। ওইগুলোর ওপর কোহিনুর সিল মারা আছে দামও একটু বেশি। আমেরিকান চেইন স্টোরগুলোতেও এখন এই হালাল মাংসের সাপ্লাই দেওয়া হয়। তারপর হাত নেড়ে বলল, সবই হালাল, হালাল বলে বিক্রি করছি গুনা হলে আমাদের হবে আপনাদের কি? নেবেন আর খাবেন, এই তো বুঝি। ভালো কথা। পরের দোকানে গেলাম। পাত্তাই দিল না কর্মচারী। মালিকরা থাকলে পাত্তা পাওয়া যায়। ভাবখানা ইচ্ছে হলে নেন, না হলে বিদায় হন। এতো কথা কিসের। যেহেতু কর্মচারী বাংলাদেশি সে বাংলাদেশ থেকেও উদাহরণ দিল। বলল, ঢাকার বাজারগুলোতে যে ঝুপড়ির পাশ থেকে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো মুরগি জবাই করে পরিষ্কার করে আনে তারা কি মৌলভী যে শুদ্ধভাবে জবাই করছে? বুঝলাম নিজেদের দোষ তো ধরতে দেবেই না, বরং অন্যের দিকে আঙ্গুল তুলবে। ভালোই রাজনীতি জানে কর্মচারীরা।

তৃতীয় দোকানে ভাবীকে (মালিকের বউ) পেলাম। খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, খালি আমাদের দোকানে এসে হালাল খোঁজা কেন, আমেরিকান দোকানগুলোতে যেন কেউ যায় না, দুহাত ঘোমটা দিয়েও তো সবাইকে ঘুরতে দেখি না, শুধু আমার দোকানে এলেই হালাল খোঁজেন কেন? আমার মেয়েটি ওনার বিরক্ত মুখ দেখে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বলল, মা মাংস নিয়ে নাও না, বিসমিল্লাহ বলে বাইট দিয়ে দেবো। আমি হাসলাম, ও তো শিশু, বুঝবে কেমন করে সবকিছু অতো সহজ না। তবে আমাকে অবাক করে ভাবীই আমার মেয়েকে বললেন, ‘জীবন এক গভীর পরীক্ষার সাগর-রে মা’, বলে উনি নিজেই উদাসীন হলেন।

এরই মধ্যে হঠাৎ মশীভাই কোত্থেকে যেন ছুটে এলেন। সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই ওনাকে দেখা যায় এবং সবখানেই বাচ্চাদের তিনি প্রচুর দেশভিত্তিক প্রশ্ন করেন। আজ বাংলাদেশি গ্রোসারি শপে দেখা মিলল। আর তাকে দেখা মাত্রই আমার পিচ্চিটা বলল, মা বলতে আজ ভুলোনা যেন তুমি আমাকে ফক্স গ্রিল করে খাওয়াওনি। মশী ভাই প্রায়ই আমাদের জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা কি বাচ্চাগুলোকে আস্ত আস্ত শিয়াল বেটে খাইয়েছিলেন না কি, না হলে এগুলোর এত বুদ্ধি কেন? তাই আমার মেয়ের আগ বাড়িয়ে সাবধানতা। কিন্তু মশী ভাই আজ বেখবর। যেন অন্য ভুবনে আছেন। বললেন, আতর কিনছি, এবার থেকে পারফিউমের বদলে আতর মাখবো। আমিও বললাম, জী, ভালো আইডিয়া। আমাদেরও একশ ভাগ হালাল ভাই ডাকতে সুবিধা হবে। উনি এবার বিষণ্ণ মুখে চেয়ে থেকে বললেন, আসলে কি জানেন ভাবী আমি তো এ দেশের জন্য হারাম। কারণ আমি ইললিগাল। আপ্রাণ চেষ্টা করছি আল্লাহতায়ালাকে খুশী করতে, যাতে করে উনি আমার জন্য কোনো একটা পথ খুলে দেন। বলে উনি আরো বিষণ্ণ মুখেই দরজার দিকে এগোলেন। আমার নিজেরও মনটা খারাপ হয়ে গেল।

আসলে মানুষ সবসময়ই খোঁজে তার নিজের অস্তিত্বকে, মনে মনে আপন মনে কিংবা প্রকাশ্যে। নিজেকে খোঁজতে গেলে অনির্বচনীয়ভাবে চলে আসে বা এসে যায় অবিশ্বাস্য সুন্দর  স্রষ্টাকে খোঁজার আর পাওয়ার বাসনা। আর খোঁজার পথে পথও হয়ে যায় বিভিন্ন, বিবিধ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৭/দিলরুবা/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়