ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা

প্রকাশিত: ১০:২৭, ২৫ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা

মোস্তাফিজুর রহমান : মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকে। হাজার কষ্ট করে হলেও বেঁচে থাকতে চায়। কে এমন আছে যে নিজের মৃত্যু কামনা করে! শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে উগান্ডার ক্যান্সারে আক্রান্ত চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষরা।

গত বছর এপ্রিলে তাদের একমাত্র রেডিওথেরাপি মেশিনের বিমটা বিস্ফোরিত হয়েছে। উগান্ডার দরিদ্র, অসহায় ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না, সুস্থ হওয়ার সুযোগ নেই তাদের। টাকার অভাবে পাশের দেশ কেনিয়ায় গিয়ে রেডিওথেরাপি নিতে পারছে না তারা। স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চিকিৎসকরা ব্যথা কমানোর ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করছেন, যা যথেষ্ট নয়। তারা মরফিন সেবন করছে, যাতে করে ব্যথ্যাটা কম হয়।

জেমস ইসাবেরি ইসথার আপোলেটের ড্রাইভার। ইসাবেরি গাড়ি চালাচ্ছেন আর তিনি উগান্ডার মানুষের জীবন যাপন পরিদর্শন করছেন। ড্রাইভার তার সামনের কাচ দিয়ে হাসপাতাল, পাশের দোকান এবং প্রাইমারী স্কুল দেখছেন। ইসথার আপোলেট তাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। তারা এক রোগীকে দেখতে পেলেন। রোগীটা খুব অসুস্থ্য। জেমস বামে একটা শক্ত বাঁক নিয়েছেন ময়লাযুক্ত হাঁটার রাস্তা ধরে, যা ছোট হতে হতে লাল ইটের তৈরি দুটি ঘিঞ্জি বাড়ির দিকে এগিয়ে গেছে। পাশ থেকে একজন বললেন, এটাই সেই জায়গা।

মেঝের উপর একটা হলকা চাদর বিছানো অবস্থায় শুয়ে আছেন ৩২ বছর বয়সি হ্যারিয়েট নামুয়ী। সাত সন্তানের মা পেটের (এবডোমিনাল) ক্যানসারে কাতরাচ্ছেন। তার পেটে তরমুজের মতো একটা টিউমার, যেন পেট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তিনি প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। যদি এটাকে প্রথম অবস্থায় চিহ্নিত করা যেত, তাহলে এটা রেডিয়েশন থেরাপি দিয়ে ভালো হতো।

শুধু হেরিয়েট একা নন। কয়েক শত আরোগ্যযোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে একজন তিনি। গত এপ্রিল মাসে রেডিওথেরাপি মেশিনের বিস্ফোরণ হয়, যা পরিবর্তন করা হয়নি। তারা এতই গরিব যে পাশের দেশ নাইরোবি, কেনিয়াতে যেতে পারছেন না। হ্যারিয়েট এবং বাকি অসুস্থরা উগান্ডায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন।

গত বছর তার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তার সেবিকারা বিশ্বাস করেন যে তার এই তরমুজ সাইজের টিউমারটা ভালো হয়ে যেত এমনিতেই, রেডিওথেরাপির মেশিনের সাহায্যে।কিন্তু বিধির বাম, তাও নষ্ট হয়ে গেলেও এখনো পরিবর্তন করা হয়নি। তিনি তার নার্ভের ব্যথায় হাঁটতে পারেন না। কারণ পেটে অনেক বড় টিউমার আছে। কৃষিজীবী এই গৃহিনীর এখন সময় কাটে শক্ত বিছানায় ঘুমিয়ে। সেবিকারা দিনে ২০ জন করে রোগী দেখার জন্য আসেন। তারা বিনামূল্যে ব্যথা নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিকভাবে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন।

আমাদের এখনকার দ্বায়িত্ব ব্যথা নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষতস্থানটা পরিস্কার রাখা। যা আমরা করতে পারছি বলে জানাচ্ছেন সেবিকা ইসথার। সেবিকাকে কিছু টাকা কম দিয়ে ব্যথা কমানোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তিনি মারাত্মক ক্যানসারে আক্রান্ত এবং হস্পি জিঞ্জা হাসপাতালে গত অক্টোবর থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সাত মাস আগে উগান্ডার একমাত্র রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। ইসথার জিজ্ঞেস করেন, সরকার জানে কিনা যে কত মানুষ  কষ্ট ভোগ করছে। উত্তর আসে ‘হ্যা।’



কাসিটা নাবিয়ু (৫০) দুই বোতল মরফিন নিচ্ছেন আগ্রিম পর্যায়ে ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যথা কমানোর জন্য। উগান্ডার সরকারি হাসপাতালে মরফিনের খুব কম সংগ্রহ আছে। অন্য ওষুধও অপ্রতুল বলে জানান বুমানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডা. পাল কিবিরিয়া। তার ক্লিনিকে ২ হাজার রোগী নিবন্ধীত। তাদের জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারছেন না, ফলে তারা ক্যানসারে মারা যাচ্ছেন। সত্যি তাদের পাশের কোনো দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য যাওয়া দরকার। কিন্তু যেতে না পেরে তারা মারা যাচ্ছেন।

৪৫ বছর বয়সি কৃষক মুসা গ্যালি। গত বছর তার চোখের মেলানোমা ধরা পড়ে। কিন্তু সে কেবল একবারই কামপালার মুলাগা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়, থেরাপি মেশিন নষ্টের আগে। তিনি এখন মৃত্যুপথযাত্রী- বলছিলেন হস্পি জিঞ্জা হাসপাতালের অপারেশন ম্যানেজার সিলভা নাকামি।

মনিকা নাকাইমা উগান্ডায় নিজ বাড়িতে বসে কাঁদছেন। ৪৫ বছর বয়সি এই মায়ের প্রচন্ড পেলভিক ব্লিডিং, যার কারণে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। এটি ওভারিয়ান ক্যানসারের উপসর্গ। ছোট্ট কুড়ে ঘরে একাই থাকা এই নারীর পাশের দেশ কেনিয়াতে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া সামর্থ নেই। তিনি ভালো নেই- বলছিলেন ইসথার। তিনি এই নারীকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার কথা বললেন। হস্পি জিঞ্জা একটা অলাভজনক সংগঠন, যারা এসব দুস্থ অসহায় মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান, ব্যথা দুরীকরণ ব্যবস্থাপনা এবং সরাসরি কাউন্সিলিং সেবা প্রদান করছে ৪০০ জনেরও বেশি রোগীকে।

ফ্লোরেন্স নাবেটা তার মায়ের বাম স্তনের উপরের টিউমারে এন্টিবায়োটিক ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছেন। ক্রিস ওয়াক (৫০) গত সপ্তাহে মরফিন দেওয়ায় ব্যথা অনেকটা কমে গেছে। গত বছর তার ক্লোন ক্যানসার ধরা পড়েছে। তিনি ২১০ ডলার খরচে কোলোন্সকপি এবং ১১১ ডলারের সিটি স্ক্যান করতে অসমর্থ। কিন্তু ডাক্তার বলেছিলেন, এগুলো রেডিয়েশন থেরাপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এখন বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবার উপরই নির্ভর করছেন তিনি।

সুয়ালিনা নামিকোজ (১৪)। তার মায়ের ওষুধ সেবনের নির্দেশিকা পড়ছে। পরিবারের নবম সন্তান এই সুয়ালিনাই এখন তার মাকে দেখাশোনা করে। তার মা স্তনক্যানসারে মৃত্যুমুখী। এই বেদনাদায়ক ঘটনা বলছিলেন ইসথার। ৪১ বছর বয়সি মাদিনা নামিকোজ তার ১৪ বছরের মেয়ের কাছ থেকে মরফিন গ্রহণ করছেন এবং সুয়ালিনা নামিকোজ তার দেখভাল করেন মাঝে মাঝে।

সেবিকারা বিশ্বাস করেন, মাদিনাসহ বাকিরা রেডিয়েশনের ব্যবস্থা ভালো করা হলে সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তারা এতই গরিব যে চিকিৎসা করার মতো অর্থ নেই। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা তাদের প্রতিক্ষণের। নুদু মালিংগার স্ত্রী সেবিকার সঙ্গে কথা বলছিলেন।তখন তার স্বামী পাশের মেঝেতে শুয়ে ছিলেন। এতই গরম যে সব সময় ঘরে থাকতে হয়। ৬৮ বছর বয়সি এই কিডনি ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষটির পাতলা কাপড়ের উপর মেঝেতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটে।

বেট্রিক একোথ ( ২৩) খেতে পারেন না। বিছানার ওপর কাতরাচ্ছে তার বাবার বাসায়, উগাণ্ডার ম্যালেতে। তার গত মার্চ মাসে যকৃত ক্যানসার দেখা দিয়েছে, কিন্তু সে রেডিয়েশন থেরাপি গ্রহণ করতে পারছে না। উগান্ডার রেডিয়েশন থেরাপি যন্ত্র নষ্ট হওয়ার পর সেদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ৪০০ রোগীকে কেনিয়াতে চিকিৎসা করানোর জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার বাবা অপেক্ষায় আছেন কবে উগান্ডায় নতুন মেশিন আসে কিন্তু ততক্ষণে হয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে। সেবিকারা বলছেন, তিনি হয়তো তিন মাসেরও কম সময় বাঁচতে পারেন। এ তো  মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা।

(বিবিসি অবলম্বনে অনুবাদ মোস্তাফিজুর রহামান)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মার্চ ২০১৭/মোস্তাফিজ/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়