ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কবিগান : প্রাচীন লোকসংগীতের অনন্য ধারা

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৫, ২৮ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কবিগান : প্রাচীন লোকসংগীতের অনন্য ধারা

কবিগানের আসর। ছবি: সংগৃহীত

শিহাব শাহরিয়ার : বাংলার প্রাচীন লোকসংগীতের একটি অনন্য বা বিশিষ্ট ধারার নাম ‘কবিগান’। এই গান যারা পরিবেশন করেন, তাদের বলা হয় ‘কবিয়াল’।  কবিয়ালরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই গান পরিবেশন করে বলে একে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক গানও বলা হয়। প্রতিযোগিতায় যে দুই দল থাকে, সেই দলের দলপতি হলেন ‘কবিয়াল’ আর যারা কবিয়ালের সহযোগী বা কবিতা ও গান পরিবেশনে সহায়তা করেন তাদের বলা হয় ‘দোহার’। অনেক সময় কবিয়ালদেরকে ‘সরকার’ বলা হয়। এই দোহারদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ‘ঢুলি’। দোহারদের কাজ হলো কবিয়ালের কথা বা কবিতা ও গান পুনরাবৃত্তি করা। বিশিষ্ট গবেষক ও পণ্ডিত যতীন সরকার বলেছেন: ‘‘গান ও কবিতার যে যুগ্ম সৃষ্টি কবিয়ালদের, তারই প্রচলিত নাম ‘কবিগান’। কবিগান শুধু গান আর কবিতাই নয়, কবিগান বিতর্কও। এই বিতর্কমূলকতার জন্যই কবিগানের নামান্তর ‘কবি লড়াই’।’’ পৃথিবীর বহুজাতির প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে পাণ্ডিত্যের অধিকারী অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ বাংলার কবিগান নিয়ে এরকম মন্তব্য করেছেন, ‘এই গানে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য আছে। অন্য কোনো জাতির মধ্যে এরূপ গান দেখা যায় না।’

কবিয়ালকে কবি হতে হয়, কারণ তিনি তাৎক্ষণিক মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তা সঙ্গে সঙ্গেই সুরারোপ করে গেয়ে থাকেন। কবিগান সব সময়ই শুরু হয় বন্দনা বা গুরুদেবের গীত দিয়ে। এই বন্দনা করা হয় সরস্বতী, গনেশ ও সাধারণ শ্রোতা এবং জনতার উদ্দেশ্যে। এরপর গাওয়া হয় রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান, যাকে আগমনী গানও বলা হয়ে থাকে। পরের গানগুলোর বিষয় হলো: সখী সংবাদ, বিরহ, লহর, ডাক, মালসি, কবির টপ্পা, পাঁচালি, ধুয়া, জোটের পাল্লা ও খেউর। এসব গানের পদক্রম হলো এমন: ধরন, পাড়ন, ফুকার, মিশ, মুখ, প্যাঁচ, খোচ, অন্তরা, পরচিতান ও ছুটি। ডাক গান বন্দনামূলক ও লঘুসংগীত। সবশেষে শুরু হয় মূল পর্ব; যা কবিয়ালদের লড়াই। এখানেই কবিয়াল মুখে মুখে তাৎক্ষণিক কথা ও সুরের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন এবং উত্তর-প্রতিত্তোরের মাধ্যমে চলে কবিলড়াই।

এই কথা ও কবিতার বিষয় সম্পর্কে গবেষক যতীন সরকার বলেছেন, ‘পৌরাণিক কাহিনী ও চরিত্রের সঙ্গে গ্রাম-বাংলার জনগণের যে আত্মিক সংযোগ, তা থেকেই উৎসারিত কবিয়ালদের কবিতার বিষয়বস্তু। পরবর্তীকালে তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহ’। যেহেতু কবিয়ালরা তাদের ভাবনা তাৎক্ষণিক পদ বা কবিতা রচনা করে সুরের মাধ্যমে গানাকারে পরিবেশন করেন, সেকারণে কবিয়ালরা একদিকে স্বভাব কবিত্বের অধিকারী; পাশাপাশি তাদের হতে হয় শাস্ত্র-পৌরাণিক ঐতিহ্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্বসম্পন্ন, লোকমনস্তত্ত্বের রসগ্রাহী বোদ্ধা ও তাদেরকে জানতে হয় সমাজের খুঁটিনাটি বিষয়। এখানে কবিয়ালরা সচেতন, কারণ তারা বিষয় পরিবেশন করেন সময়োপযোগী করে। ফলে লিখিত সাহিত্যের মতই মৌখিক এই কবিগান জনমনে প্রভাব বিস্তার করে এবং একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

সংগীত বিষয়ক গবেষক ও পণ্ডিতরা মনে করেন, আঠারো শতকে কবিগানের উদ্ভব ঘটে। ড. সুশীল কুমার দে মনে করেন, ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীতেও কবিগানের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কবিয়ালদের প্রকৃত বিকাশকাল ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে’। বলা হয়েছে, উনিশ দশকের গোড়ার দিকে কবিগান সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক তাৎপর্য অর্জন করে। গোঁজলা গুঁইকে বলা হয় কবিগানের আদি-পুরুষ। অধ্যাপক যতীন সরকার বলেছেন, ‘অষ্টাদশ শতকের কবিয়াল গোঁজলা গুঁই থেকে বিশ শতকের রমেশ শীল পর্যন্ত কবিগানের যে ধারা, তার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, বাংলার কবিগান এই দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় পৌরাণিক ধূসর কল্পজগৎ থেকে নেমে এসেছে সামাজিক বাস্তবের কঠিন মাটিতে’। মূলত নতুন করে ওঠা বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের বিনোদনের চাহিদা পূরণে কবিগান বিশেষ ভূমিকা পালন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বাংলায় প্রাচীন কাব্যসাহিত্য এবং আধুনিক কাব্যসাহিত্যের মাঝখানে কবিয়ালদের গান। ইহা এক নূতন সামগ্রী এবং অধিকাংশ নূতন পদার্থের ন্যায় ইহার পরমায়ু অতিশয় অল্প। একদিন হঠাৎ গোধূলির সময়ে যেমন পতঙ্গ আকাশ ছাইয়া যায়, মধ্যাহ্নের আলোকেও তাহাদিগকে দেখা যায় না এবং অন্ধকার ঘনীভূত হইবার পূর্বেই তাহারা অদৃশ্য হইয়া যায়-এই কবিগানও সেইরূপ একসময় বঙ্গ সাহিত্যের স্বল্পক্ষণস্থায়ী গোধূলি-আকাশে অকস্মাৎ দেখা দিয়েছিল, তৎপূর্বেও তাহাদের কোন পরিচয় ছিল না, এখনও তাহাদের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না’।

যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত অর্থাৎ প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভগ্নদূত এবং আধুনিক যুগের অগ্রদূত হিসেবে যিনি খ্যাত, তার সাহিত্য-যাত্রা শুরু হয়েছিল কবিয়াল হিসেবে। কবিগানের খ্যাতিমান কবিয়াল বা শিল্পীরা হলেন হরু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী, রাম বসু, ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, তারকচন্দ্র সরকার, হরিচরণ আচার্য, রমেশ শীল, রাজেন্দ্রনাথ সরকার, বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী, গুমানী দেওয়ান প্রমুখ। এখানে কবিয়াল ভোলা ময়রার রচিত একটি গান উপস্থাপন করা হলো :

ময়মনসিংহের মুগ ভাল, খুলনার ভালো কই।

ঢাকার ভালো পাতাক্ষীর, বাঁকুড়ার ভালো দই ॥

কৃষ্ণনগরের ময়রা ভালো, মালদহের ভালো আম।

উলোর ভালো বাঁদর পুরুষ, মুর্শিদাবাদের জাম ॥

রংপুরের শ্বশুর ভালো, রাজশাহীর জামাই।

নোয়াখালির নৌকা ভালো, চট্টগ্রামের ধাই ॥

দিনাজপুরের কায়েত ভালো, হাবড়ার ভালো শুঁড়ি।

পাবনা জেলার বৈষ্ণব ভালো, ফরিদপুরের মুড়ি ॥

বর্ধমানের চাষী ভালো, চব্বিশ পরগনার গোপ।

গুপ্তিপাড়ার মেয়ে ভালো, শীঘ্র-বংশলোপ ॥

হুগলির ভালো কোটাল লেঠেল, বীরভূমের ভালো বোল।

ঢাকের বাদ্য থামলেই ভালো, হরি হরি বল ॥

কবিগান উল্লিখিত সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নব্য মধ্যবিত্তদের বিনোদনের বিষয় হলেও, এই কবিগান যারা পরিবেশন করতো অর্থাৎ কবিয়াল ও দোহাররা ছিল নিম্নবর্গের মানুষ। ফলে তারা সমাজের খুঁটিনাটি, ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিল। কবিগান লোকজীবনের নানা উপাদান ও লোকসংগীতের নানা মাধ্যমের সমন্বয় বা সংমিশ্রণে একটি বিশেষ ধারার গান হওয়ায়; সমাজের নিম্নশ্রেণিভুক্ত এই কবিয়ালরা, এই গানকে সহজেই বিনোদনের প্লাটফর্মে নিয়ে জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন।

কবিগান হারিয়ে গেছে। যেহেতু কবিগান মুখে মুখে গীত হতো, লিখে রাখার প্রচলন ছিল না, সেকারণে এই গান সংরক্ষিত হয়নি। তবে কবি ঈশ্বরগুপ্ত ১৮৫৪ সাল থেকে কবিগান সংগ্রহ শুরু করেন এবং কিছু কিছু গান তিনি তার সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় প্রকাশও করেছেন। পরবর্তীতে অনেক পণ্ডিত ও গবেষক কবিগান সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছেন, প্রকাশ করেছেন এবং কবিয়ালদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়