ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বৈশাখের পঙ্‌ক্তিমালা

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৈশাখের পঙ্‌ক্তিমালা

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

জ্বলে ওঠে যেন আগুনের শিখা || আল মাহমুদ

ছুটছি ত্বরিৎ প্রবাহের মত যেন কালবৈশাখী-

ঝড়ের বেগে শরীরে লেগে কি যে অনুভূতি!

হাওয়ার গতি আমাকে ডেকে বলছে-যাচ্ছি

                  পরিসমাপ্তি।

 

যাচ্ছি কোথায়? কে জানে কোথায়?

                দুরন্ত বেগে।

 

বলছি, ‘আমি তো, আজও আছি জেগে।

তোমার পাশেই, নরম ঘাসেই,

                 শুয়ে দেখি তারা

                 যেন ফুটন্ত তারার পাহারা।

 

আর যাবে কে কে? নামগুলো লিখে

দাও আমাকে। আমি চেয়ে দেখি,

কিছু কথা লিখি, আমার বক্ষে।

পাশেই রয়েছে আমার দেহের একটি তালিকা

যেন জ্বলে ওঠে আগুনের শিখা।

আমার চারিপাশ; কারা যেন হাসে

বলে- ওহে যুবা, দারুণ প্রতিভা!

মেলাও ছন্দে গন্ধে-আনন্দে

আমার নামটি। শেষ হোক খেলা

                          

আমাদের বেলা ওই ডুবে যায়।

ঠেলা খেয়ে বেলা যদি ডুবে যায়-

যাক না এখন

স্থির করো মন

ভাবো- যৌবন, এমনি ক্ষণিক সময়ের খেলা

খেলছি আমরা; আমি আর তুমি-

                 মাতৃভূমি।

 

তারপরে কিছু নেই আর বাকী

অনন্ত আকাশে উড়ে গেছে পাখি

যত ডাকি আয়, আয় বিহঙ্গ

বক্ষে আমার নাচে তরঙ্গ

            আমি নিঃসঙ্গ।


কালবৈশাখী || অসীম সাহা

বহুকাল বিশীর্ণ পাতার আড়ালে, অন্ধকারে প্রকৃতির ডানার ভেতরে

যে-দিগন্তবিস্তৃত থাবা ওৎ পেতে আছে-তার অপস্রিয়মাণতার জন্যে

এবার জেগে উঠেছে সিংহের কেশর-ফোলানো উদ্ধত গ্রীবার মতো

রুদ্র বৈশাখ-সময়ের চঞ্চল ডানা এসে আকাশের বুক থেকে

ছুড়ে দিচ্ছে পৌরুষের রক্তাক্ত স্রোতের মতো বজ্র ও বিদ্যুৎ।

তার মানে একটু একটু করে জেগে উঠছে জীবন-সংগোপন

ইচ্ছেগুলো নিবিষ্ট কাকের মতো বসে থেকে অবশেষে বিদীর্ণ চিৎকারে

চুরমার করে দিচ্ছে অসীম আকাশ-কখনো সে হয়ে উঠছে বিরহিণী,

কখনো রুদ্রমূর্তি-কখনো স্বপ্নের টানে জেগে ওঠা ভয়াল প্রকৃতি।


বাতাসের প্রবল চিৎকারে ক্রমাগত কেঁপে উঠছে স্বর্গের দেবতা

নদীর ঢেউয়ের তালে নগ্ননৃত্যে দুলে উঠছে মাতাল তরণী

আর মর্মঘাতী আক্রোশে মুহূর্তে মুহূর্তে শুধু পুড়ে যাচ্ছে

প্রাচীনের অগ্নিশিখা-কামনায় কম্পমান দুরন্ত আঁখি।

প্রান্তরে লুটিয়ে পড়ছে ঝরাপাতা, উড়ে যাচ্ছে চৈত্রের মেঘ

ডাকছে নতুন ভোর, দিগ্বিদিক ছিন্ন করে ডেকে উঠছে পাখি

নদীর ঢেউয়ের মতো ক্লান্তিহীন ভেসে যাচ্ছে প্রবল আবেগ

প্রাচীনের মেঘ ফুঁড়ে ধেয়ে আসছে আরো এক কালবৈশাখী।


বাসুদেবের মেলা || মুস্তাফিজ শফি

বাসুদেবের মেলায় কেনা

সেই পাখিটি আজো আমায়

 কানে কানে একলা ডাকে,

 আজো আমার উথাল পাতাল

 মনটা ছুটে দূর নীলিমায়

 হারিয়ে যাওয়া মোহন বাঁকে।

 

 মেলায় যাবো, মেলায় যাবো

 হোসেন আলীর পিঠে চড়ে

 বাসুদেবের মেলায় যাবো,

 রঙিন ঘুড়ি সুতোর নাটাই

 বাঁশের বাঁশি কিনে আবার

 মন ছুটাবো, মন ছুটাবো।

 

 এবার গেলে নয়নতারা

 তোমার নামে একটি কড়ি

 ইচ্ছে করে আনবো কিনে,

 তোমার বাড়ির পথের বাঁকে

 আবার আমি হারিয়ে যাবো

 হারিয়ে যাবো উদাস দিনে।


পূর্ণিমায় নক্ষত্রযাত্রা || মারুফ রায়হান

সম্মোহিত দুটি উড়ুক্কু নরনারী জোছনার ঢেউ সরিয়ে সরিয়ে

চলেছে এক নক্ষত্রযাত্রায় শিহরণ-জাগানো গন্তব্যে

পাখি-পাখিনীরও এমন সঙ্গম দ্যাখেনি পৃথিবীর সমুদ্রসৈকত

তাদের নগ্নতা থেকে বিচ্ছুরিত পরম বিদ্যুতে

          পুলকিত ঘুমঘুম মেঘের ঘুঘু, দারুণ দ্রাঘিমা

 

বৈশাখের তূণে সঞ্চিত কত না জাদু

যা জানেনি চিরযাযাবর, ভূমিলগ্ন স্বপ্নের সাম্পান

পূর্ণিমার আলো পড়ে নি এমন আঁধার প্রাঙ্গণ হতে

হতবিহ্বল একটি কণ্ঠ আমাকে কবিতা শোনায়:

বিরান হতেছে মাঠ, রুয়ে দেবে আকাক্সক্ষা কে আর

প্রতীক্ষায় পদ্মানদী, মাঝি নেই নিঃসঙ্গ খেয়ার

নিঃশর্ত প্রেরণা কবে দিয়েছিল বৈশাখী জোছনা

রাত ভোর হলে ফের করেছিল সমাধি রচনা


অপার্থিব রূপোলি দুধের ভেতর যে-মরমী সুর আছে

সন্ন্যাসব্রতের হাতছানি দ্যায় তা সুখী গৃহীকেও

কত বৃক্ষ উদভ্রান্ত হলো বৈশাখী পূর্ণিমা রাতে

সাপ ও সাপিনী ভুলে গেল ফণার ব্যাকরণ

মৃত্যুস্বাদ পেতে মরিয়া হলো দূরগামী তিমি

শুধু কবির হৃদয়ে তার সমূহ সংগ্রহ


স্তব্ধ চরাচর ফুঁড়ে বর্ষবরণের সহসা উচ্ছ্বাস

উৎসব-উন্মুখ রাত্রি সানন্দে আবৃত্তি করে:

চৈত্রের চতুর ও চিত্রল রাত্রি পেরিয়ে

বৈশাখ এলে অবশেষে

ও মাধবী ও কণকচূড়া- শুভ নববর্ষ

ধলেশ্বরীর বুকে প্রজাপতির মতো উড়ুক্কু রঙিন

স্বপ্নডানা নিয়ে একগুচ্ছ পাল, হরিয়াল- শুভ নববর্ষ


মধ্যরাতে বিরহী আরোহী হলো আরাধ্য আলোর

প্রকৃতি তখন আবরণহীন, নগ্নতাই নান্দনিক

লজ্জিত হলো নারী, খুলে ফেললো নৈশ সেমিজ

মুহূর্তে জ্বলে উঠল যুগল পূর্ণিমা, অন্ধ হলো চাঁদ

আর তক্ষুনি ভূপাতিত হলো সেই উড়ন্ত যুগল

যারা জোছনায় ছিল সন্তরণশীল, নগ্নতায় পুণ্যবান

পুনর্বার পূর্ণিমা জেগে ওঠার আগে

তারা বুঝি যাবে ঘোর অজ্ঞাত শীতনিদ্রায়


পঞ্চানন ঘোষ: ঘোল বিক্রেতা || ওবায়েদ আকাশ

ভোর হতে না হতেই কুমার নদের কম্পমান সাঁকো পাড়ি দিয়ে

পঞ্চানন ঘোষ ঘোল নিয়ে আসেন- ‘ঘোল, হেই ঘোল’ বলে-

কিংবা আমিই ছুটে যাই দুরু দুরু বুকে- বাঁশের সাঁকো হেঁটে

 

আমি যখন গ্লাস ভরে ঘোল দিতে বলি, ভেসে ওঠা ছানার দিকে

চোখ চলে যায়, আর পঞ্চানন যখন একবার আমার দিকে একবার

ঘোলের দিকে তাকিয়ে ঘোল দিতে যায়

ঘোলের পাত্রের নিচে অথৈ জলে বন্যা বয়ে যায়...

 

আমি তাকে বলি, এত জল কোথা থেকে আসে?

পঞ্চানন বলে, ছোট্টবেলায় সাঁতার কাটতাম আরো গভীর জলে

 

আমি পঞ্চাননের মুখের দিকে বিস্ময়ভরে তাকাতেই

তার চোখের মণিতে দু’চার বছর দু’তিনজন শিশুসন্তানের মুখ

ভেসে উঠতে দেখি। দেখি তারা সাঁতার কাটছে

আরো অথৈ জলে

 

আমি পঞ্চাননকে বলি, তোমার পাত্র থেকে জল ছেঁকে

আরেক গ্লাস ঘোল ঢেলে দাও

পঞ্চানন ঘোলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে আমার দিকে

জলবিহীন ঘোল তুলে দেয়

আমি কী মজা কী মজা বলে চুকচুক করে ঘোল চেটে খাই আর

 

পঞ্চাননের চোখ থেকে শিশুসন্তানেরা

ঝুরঝুর করে মাটিতে পড়ে যায়

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়