ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

টেক্সাসান জীবন থেকে : ১৪তম পর্ব

দিলরুবা আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ২১ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টেক্সাসান জীবন থেকে : ১৪তম পর্ব

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

দিলরুবা আহমেদ : ছেলে খুশি তাতেই সে খুশি। রেবেকার খুশিতে আমিও খুশি হই। ব্রেন্ডা বয়সে জেইসনের থেকে বছর তিনেক বড় আবার হেভি মোটা।

তাই হয়তোবা প্রশ্নটা এসেছিল আমার মনের মাঝে, সবাই যখন খুশি আমার আর এত সাত-পাঁচ ভেবে কি লাভ।

ব্রেন্ডার মতো বেঢপ সাইজের একটা মেয়েকে আমারও ভালো লাগতে লাগল। জেইসনের মতো খুব সুন্দর লম্বা-চওড়া একটা ছেলের পাশে যতোই বেমানান লাগুক ব্রেন্ডাকে, তাদের মনের মিল সবকিছু মিলিয়ে নিল, মানিয়ে নিল। এখানে কিছুই যেন আসে যায় না। সবাই খুঁজছে সুখ। যেভাবে পার সুখী হও। পরিপূর্ণ সুখী হওয়ার নেশায় সবাই উতলা। যেভাবে থেকে সুখী হও তেমনই থাকো। যেখানে খুশি যেতে পারো চলে, ১৮ বছর যখন হয়েছে বয়স।

আমার শাশুড়ি ছিলেন এসব ভাবধারার একেবারেই বিপরীত। সবসময় বলেছেন, দেশে আছো, ভালো আছো। বিদেশে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আঁচল দিয়ে বেধে রাখার ছিল সে কি প্রবণতা। আমার ছেলে-মেয়েরা আমার কাছেই থাকবে-এই ছিল ভাবনা। রেবেকাকে একদিন তা বলতেই বলল, তাও কি সম্ভব? বেশ কিছু পূর্ণবয়স্ক মানুষ এক সঙ্গে থাকবে কিভাবে? আমাদের দেশের বৌয়েরা আলাদা হতে চায়। এ দেশের শাশুড়িরাই ভেবে পায় না পুত্রবধূ বা বড় হয়ে যাওয়া ছেলে-মেয়েরা সবাই একসঙ্গে থাকবে কিভাবে? সবারই প্রাইভেসি সচেতনতা বড় বেশি। সদ্য প্রসূত সন্তানকেও রাখা হয় পাশের ঘরে, আমাদের দৃষ্টিতে যা ফেলে রাখা। বৃদ্ধা মাতাকেও আশ্রয় খুঁজতে হয় ওল্ড হোম-এ।

রেবেকা বলে, আমার স্বামী আমাদের ফার্মের দেখাশোনা, কাজকর্ম করে, ওখানেই থাকে। তাই সে আমার মাকে দেখাশোনা করতে পারে। মা-ও এদিক-ওদিক দেখে রাখে। ধরো, আমার স্বামীও বাইরে কাজ করে, আমি রয়েছি এই অফিসে, তাহলে ৮০ বছরের এই বৃদ্ধাকে একা একটা বিশাল খামারবাড়িতে রাখা সম্ভব? না। অতএব ওল্ড হোম-ই ভালো। নিরাপদ। ওই বয়সী অনেক  লোকজন থাকে, বন্ধুত্ব হয়। গল্প চলে। যুক্তি ভালোই। কিন্তু আমার এশিয়ান মনমানসিকতায় ওল্ড হোম আইডিয়াটিই গ্রহণযোগ্য নয়। জঘন্য।

আমি সব ছেড়ে দেবো তবুও আমার বাবা-মাকে না। আমাদের দেশে ওসব নেই জেনে রেবেকা অবাক হয়। আমি মনে মনে ধন্য ধন্য করি। হাজার শোকর। চাইল্ড কেয়ার সেন্টার গজাচ্ছে শুনে বললো, তাহলে এক সময় ওল্ড হোম-ও হয়ে যাবে। স্বল্প কয়েকটা এদিক-ওদিক আছে এ খবর তাকে আর দিতে ইচ্ছে হলো না। সে বললো, তোমাদের দেশের মেয়েরা, মায়েরা ঘর থেকে বেরুচ্ছে, এর ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় এসব কিছুই এক সময় তোমাদের সমাজে জীবনযাত্রার অংশ হয়ে যাবে।

সে আশাবাদী, আমি শঙ্কিত। প্রায় রেবেকা গল্প করে তার ৮০ বছরের বৃদ্ধা মায়ের স্বামীর, যে সৎ পিতা তার, যিনি আর বেঁচে নেই। শোনা হয়নি তার নিজের বাবার কথা। একদিন জানতে চাইলাম, তোমার বাবা বেঁচে আছেন কি? কিছুদিন আগে হলে বলতাম আছেন বোধ হয়, এখন বলতে হচ্ছে বেঁচে নেই। প্রায় সাত বছর আগে মারা গেছেন। এমন বাকা-ত্যাড়া জবাবে আমি খুবই অবাক হয়ে চেয়ে থাকলাম রেবেকার মুখের দিকে। বিউটি কুইন হাসল, বলল, আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে তখনই আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাবার গোপন সম্পর্ক ছিল আরেক মহিলার সঙ্গে। সেও প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ল। মা-বাবাকে ডিভোর্স করে দিলেন। দেখনি কখনো। না। কি অসহায়ত্ব ওই দুচোখে। হঠাৎ করে যেন সে হয়ে গেল দুই বছর বা পাঁচ বছরের এক বালিকা। যখন আমার জেইসন জন্মালো চার্চের ফাদার বলল, সবাইকে ক্ষমা করে দিতে। দিলাম। বাবাকেও। তাকে ছেলেসহ আমার একটা ছবি পাঠালাম।

জোসেফ, যিনি আমার অদেখা বাবার বাবা, আমার না চেনা না দেখা দাদা তার নামের সঙ্গে মিল রেখে ছেলের নাম রাখলাম। ভেবেছিলাম বাবা আমার হয়তোবা একটিবার দেখা দিতে আসবে। বা দেখতে আসবে। বুড়ি অসহায় ভঙ্গিতে হাতটা উল্টে বলল, শুধু একটা চিঠি এসেছিল। উনিও নাকি আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এবার হাসতে লাগল রেবেকা। কেন, কি জন্য ক্ষমা তাও বুঝলাম না। শুধু মনে হয়েছিল মা ভালোই করেছে এই লোকের সঙ্গে জীবন কাটাইনি। এই লোকের ওপর যেন রেবেকার কোনো অধিকার নেই। বড়ই করুণ সেই মুখভঙ্গি। আমিই শুধু দেখেছি। রেবেকার সে মুখ মনে থাকবে আমার বহুকাল। হাসিমাখা মুখে এতো কষ্ট।

সে যে মারা গেছে তার স্বজনরা কেউ আমাদের জানায়নি। আমার শুনেছি সৎ ভাই আছে বাবার ওই সংসারে। ক্যালিফোর্নিয়ার কোথাও আছে তারা ছড়িয়ে। কেউ প্রয়োজন বোধ করেনি আমাদের দুই ভাইবোনকে খবর দিতে। অনেক পরে একদিন জানলাম। কিভাবে? জিনিওলজির ওয়েবসাইটে সার্চ করছিলাম, ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম, তখন হঠাৎ দেখলাম। সেটা কি? বংশধারা। ইন্টারনেটে গিয়ে  q  HYPERLINK "http://www.familysearch.org" www.familysearch.org গিয়ে সার্চ দাও। Ancestors বা পূর্বপুরুষদের নাম জানতে হবে শুধু। তার কথামতো আমি কম্পিউটারে সেই ওয়েবসাইটে সার্চ দিলাম, সেখানে চলছে শেকড় খোঁজার অনুসন্ধান, তৈরি হচ্ছে বংশলতা।

রেবেকা বলল, তোমাদের দেশের নাম চুজ করো, তোমাদের পারিবারিক বংশলতা পাবে। তাকে অবশ্য জানালাম না, এ যে এখনো সুদূরপরাহত ব্যাপার আমাদের দেশের জন্য। কিন্তু সে সার্চ দিয়ে দিল বাংলাদেশের নাম সিলেক্ট করে। এবং অবাক হলো। নেই কোনো কিছু? আমি নির্বিকারভাবে জানলাম, আমাদের লাগে না। জানি কে ছিল দাদা, প্রদাদা, কোথা আছে, সব। এখানেই থামলাম না। দেশের মান বাঁচাতে গিয়ে বুড়িকে দিলাম আরো আঘাত। আমাদের আপন-পর-সৎ থাকে না। সবাই আমরা এক সঙ্গেই থাকি। দুই হাত দূরে গেলেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যায়। নিখোঁজ বিজ্ঞাপনে দেশ ভরে যায়। পালানোর উপায় নেই। বলেই বুঝলাম ভুল করলাম। কি আর করবো। হেসে উঠলাম বোকার মতো হি হি করে।

সুন্দরী অবশ্য মন খারাপ করলো না। হাসল। তোমরা সৌভাগ্যবান। আমি তোমাদের কালচার পছন্দ করি। আমার অবশ্য মন খারাপ হয়ে গেল, শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। একেই বোধ হয় বলে শাখের করাত। স্কুল জীবনে আমরা বলতাম শখ সাহেবের করাত। শখ করেও শাক কাটলে শক খাবে।

রেবেকা অন্যমনস্কভাবে বলল, আগামী বৃহস্পতিবার আমার জন্মদিন। এইদিনে বাবাকে কেন যেন আজকাল খুব মনে পড়ে। এতো বয়স হয়ে গেল তারপরও। এতো বয়সের জন্যই কি না কে জানে। একবারও এই জীবনে দেখলাম না তাকে। তবে তাকে আমি সত্যিই ক্ষমা করে দিয়েছি। বড় করুণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল  আমার সুপ্রিয় রমণী। তার মায়ামাখা মুখের দিকে চেয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, আমার জন্মদিনও এই মাসে।

১৩ তারিখে। রেবেকা অবাক হয়ে বলল, বৃহস্পতিবারই তো ১৩ তারিখ। আমরা দুজনই হঠাৎ খুশি হয়ে উঠলাম। রেবেকা বলল, এ কারণেই সম্ভবত তোমাকে আমার এতো পছন্দ। আমিও মাথা দোলাতে লাগলাম। ক্ষত ভরাতে সচেষ্ট হলাম। জানি জন্মদিনটি আমেরিকানদের কাছে খুবই ইমপরটেন্ট। শুনলে হয়তো রেবেকা অবাকই হবে আমার দেশের বহু আবাল-বৃদ্ধাবণিতা আছে যারা জানে না তাদের জন্মদিন কবে, কোনটি তাদের জন্মতারিখ। জানার জন্য বিশেষ কোনো তাগিদও তারা অনুভব করে না। হয়তো, করলেও উপায় নেই তা জানার। ১৩ তারিখে জন্মেছি বলেই বোধহয় আমি এতো ভাগ্যহীনা, কি বলো।

বললাম, আমি সবসময়ই এই বিশ্বাস করেছি যে, ১৩ তারিখের এই অপবাদ ঘোচানোর জন্যই আমার জন্ম। বলে হাসতে লাগলাম। আমার এই কথায় রেবেকা খুব খুশি হয়ে হাসতে থাকল। বলা হয় না পরেরটুকু, যা আমি মনে মনে বলছি, বলি সারাক্ষণ, এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাটিকেও আমিই পেয়েছি। বলি না কথাটা রেবেকাকে, তাকে কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু আমি জানি খুব গর্ব করেই বলতে পারবো আমার দেশে ফিরে গিয়ে এ কথাটা। ওখানে খুব কষ্টে কি কেউ পড়ে যাবে? মনে হয় না। ওখানে সব মেয়েই জানে, বিশ্বাস করে, শ্রেষ্ঠ বাবাটি যে তারই। তাই আমার দাবিতে কেউ বড় কষ্টে পড়ে যাবে না। বরং প্রতিবাদের ঝড় উঠবে ঘরে ঘরে। চিৎকার আসবে দিগ্বিদিক থেকে, শ্রেষ্ঠ বাবাটা তো আমার বাবা, আমার বাবাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষ। অসীম গর্ব থাকবে সেই দাবি করতে গিয়ে বিশ্বের দরিদ্রতম একটি দেশের শ্যামলা রঙের অসীম মমতাভরা দুই চোখে। আমি কি খুব ভুল ভাবলাম?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মে ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়