ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জসীমউদ্‌দীনের লোকজীবন ভাবনা: প্রসঙ্গ ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’

তাশরিক-ই-হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৭, ৯ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জসীমউদ্‌দীনের লোকজীবন ভাবনা: প্রসঙ্গ ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’

তাশরিক-ই-হাবিব: জসীমউদ্‌দীনের প্রধান পরিচয়, তিনি কবি। উপন্যাস, গল্প, লোকগাথা, লোকসঙ্গীত, ছড়া, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, স্মৃতিকথা প্রভৃতি লেখা, সংগ্রহ ও সংকলনের মাধ্যমে  অন্তর্গত মনস্বিতা ও শিল্পবোধ নানাভাবে আজীবন বিচ্ছুরিত করলেও তাঁর কথা মনে এলেই কবিতাপ্রিয় পাঠকের  মনে পড়ে পল্লির জনমানুষের বিবিধ চালচিত্র। এত আন্তরিক ভঙ্গিতে বাংলার গ্রামীণ মানুষের হাটে-বাটে, মাঠে-ঘাটে, ক্ষেত-খামারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাত্যহিক জীবনের অজস্র অনুষঙ্গ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির বৃত্তান্ত কবিতার ছন্দে ছন্দে, চরণ থেকে চরণে প্রবল মমত্ব ও অনুরাগের আভরণে উচ্চারণ করতে আর কেউ সমর্থ হননি। ‘পল্লীকবি’ অভিধার সমান্তরালে সংগুপ্ত অপেক্ষাকৃত স্বল্প মেধা ও সীমিত কৃতিত্বের অধিকারী গ্রামীণ কবির ইঙ্গিতটুকু তাঁর ক্ষেত্রে কোনোভাবেই প্রযোজ্য নয়। বরং ত্রিশের আধুনিক কবিরা, যাঁরা রবীন্দ্র-বিরোধিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের তেজোদীপ্ত কবিত্বশক্তি ও বিদ্রোহের বিভাকে কবিতানুরাগী পাঠকসমাজে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁদের কাতারেই জসীমউদদীনের অবস্থান; যদিও মনোভঙ্গি, জীবনবোধ ও শিল্পীসত্তার উন্মোচনে তিনি তাঁদের থেকে স্বতন্ত্র। এক্ষেত্রে প্রকৃতিনির্ভর, মাটিঘেঁষা, পরিশ্রমক্লিষ্ট গণমানুষের সঙ্গে বাল্যকাল থেকে নাড়ির টান এবং গ্রামীণ পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা ও যাপিত জীবনের উপলব্ধি তাঁকে লোকজ পরিমণ্ডলের প্রতিনিধি স্থানীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।

বিএ ক্লাসের ছাত্রাবস্থায় ‘কবর’ কবিতা রচনার মাধ্যমে তাঁর আত্মআবিষ্কারের পথে অগ্রযাত্রা শুরু হলেও তা সময়ের বিবর্তনে নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে বাংলার লোকমানুষের নিজস্ব কণ্ঠস্বরকে কবিতায় ধারণের অনায়াস দক্ষতায়। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁকে উদ্দেশ্য করে এক চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মত তোমার কবিতা (কবর) পড়ে আমি কেঁদেছি।’ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রাখালী’ ও ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ পড়ে অভিমত জানিয়েছিলেন- ‘জসীমউদদীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লিখবার ক্ষমতা নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।’

‘নক্সী কাঁথার মাঠ’  তাঁর রচিত শ্রেষ্ঠ কাহিনীকাব্য, যেখানে পল্লির দুই তরুণ-তরুণীর প্রণয়ভাবনা ভিত্তি করে লোকজীবনের প্রাতিস্বিক উপস্থাপনা দৈশিক গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও জসীমউদদীনের কবি খ্যাতি পৌঁছে দিয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লী-জীবন আমার কাছে চমৎকার একটি মাধুর্যময় ছবির মতো দেখা দিয়েছে।’ এ কাহিনীকাব্যে প্রতিফলিত গ্রামীণ বাংলার লোকসাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের রূপরেখা নিদের্শের মাধ্যমে কবির শিল্পভাবনার বিশিষ্টতা বুঝে নিতে আমরা সচেষ্ট হব।

চৌদ্দ পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত এ কাহিনীকাব্যের বিশেষ দিক হলো, কবি অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রতিটি পরিচ্ছেদের শুরুতে এমন কিছু সঙ্গীত উদ্ধৃত করেছেন, যেগুলোতে নিহিত রয়েছে বাংলার মাটি, প্রকৃতি আর লোকমানুষের সঙ্গীতপ্রীতির স্বাক্ষর। তাদের বংশপরম্পরাগত ঐতিহ্য তথা প্রাত্যহিক জীবনে চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে এসব লোকগীতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কাব্যটিতে বিধৃত রাখালী গান, মুর্শিদা গান, মেঘরাজার গান, আসমান সিংহের গান, মুসলমান মেয়েদের বিয়ের গান, গাজীর গান, জারী গান, মৈমনসিংহ গীতিকার চরণ প্রভৃতির সমবায়ে পাঠকের মনোলোকে নির্মিত হয় এমন এক লোকসাংগীতিক ভুবন, যেখানে পল্লির অনাড়ম্বর অথচ সহজাত রূপ, এর অধিবাসীদের জীবিকা ও জীবনাভিজ্ঞতার বর্ণিল উপস্থাপনা প্রাধান্য পায়। দৃষ্টান্ত হিসেবে লক্ষণীয়, ‘এক’ পরিচ্ছেদে বিধৃত রাখালী গানটি-

বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী,

উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল পাঙ্খা দেয় নাই বিধি।

কাব্যের নায়ক-নায়িকা তথা রূপাই-সাজুর বাসস্থান হিসেবে জলির বিলের দুপাশে অবস্থানরত, নামহীন এ-গাঁও আর ও-গাঁওয়ের বাসিন্দাদের প্রাত্যহিক জীবনে ওঠা-বসা, মেলামেশা, জীবিকানির্বাহ সূত্রে গড়ে ওঠা অন্তরঙ্গতা ও বিরোধের ইঙ্গিত দিতে এ রাখালী গান সূত্রধরের ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত, নায়ক-নায়িকার প্রেমময়তার স্ফুরণ পাঠকের কাছে আভাসিত করতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ‘দুই’ পরিচ্ছেদে বিধৃত মুর্শিদা গানটি-

এক কালা দাঁতের কালি যা দ্যা কলম লেখি,

আর এক কালা চক্ষের মণি, যা দ্যা দৈন্যা দেখি,

-ও কালা, তুই ঘরে রইতে দিলি না আমারে।

রূপাইয়ের দৈহিক সৌন্দর্যের পরিচয় তুলে ধরতে এ উদ্ধৃতাংশে দোয়াতের কালি ও নয়নের মণির পাশাপাশি গ্রামীণ লোককাহিনীর শাশ্বত নায়ক, রাখালবালক কৃষ্ণের উল্লেখ থেকে বোঝা যায়, কবির মনোলোকে বস্তু উপমার পাশাপাশি লোকসমাজে নন্দিত কাহিনী, কিংবদন্তির চরিত্রের আদলে এ কাব্যের নায়ককে গড়ে তোলার আগ্রহ। এক্ষেত্রে গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত সাজসজ্জা ও পোশাকই শুধু নয়, প্রাকৃতিক বিভিন্ন অনুষঙ্গও আলঙ্কারিক বিন্যাসে লোকসংস্কৃতির পরিচয়কে মূর্তময় করে তুলেছে। যেমন- চাষীর ছেলে রূপাইয়ের মুখাবয়ব কালো ভ্রমরের শ্যামলিমায় পেলবিত, মায়াময় মুখটিতে নবীন তৃণের সতেজতা, বাহুর সঙ্গে জালি লাউয়ের এবং দেহের সঙ্গে শ্রাবণের তমাল তরুর উপমায় প্রকাশিত হয়েছে কবির কল্পনাশক্তির অনিন্দ্যতা। কালো রঙের আড়ালে সন্নিহিত মাধুর্য রূপাইকে গ্রামবাসীর কাছে আরো মনোহর করে তোলে আসরে জারীগান পরিবেশন ও লাঠি খেলায় পারদর্শিতার গুণে। বলাবাহুল্য, গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্তর্গত বিভিন্ন উপাদান ও অনুষঙ্গ আত্মস্থ করেছিলেন বলেই কবি এভাবে নায়ককে গড়ে তুলেছেন। এর সমান্তরালে উদ্ভিন্নযৌবনা নায়িকা সাজুর রূপময়তার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি পাঠককে হাতছানি দেন সৌন্দর্য, রঙ ও ইন্দ্রিয়ময়তার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অপূর্ব সংবেদনশীল ভুবনে-

লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী,

ভোরের হাওয়া যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ী। ...

যে ফুল ফোটে সোনের খেতে, ফোটে কদম গাছে,

সকল ফুলের ঝলমল গা-বরি তার নাচে।

কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনার খেলা, ...

দু-একখানা গয়না গায়ে, সোনার দেবালয়ে ...

পড়শীরা কয়- মেয়ে ত নয়, হলদে পাখির ছা

ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে তাদের গাঁ।

এ উদ্ধৃতিতে বিবৃত হয়েছে গ্রামীণ নারীর রূপময়তার প্রতি কবির আলঙ্কারিক কারুভাষ্য, যা লোকসংস্কৃতির প্রতি তাঁর পক্ষপাত স্পষ্ট করে। শুধু তাই নয়, সাজু শিকায় রাখা শখের হাঁড়িতে রঙ দিয়ে নকশা আঁকা, পিঠা ও সেমাই বানানো, বিয়ের আসরে মেয়েলি গীত পরিবেশনের গুণে গ্রামে ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ হিসেবে সম্বোধিত। নারীর প্রতি এ ধরনের মনোভাবনা পোষণও লোকসংস্কারেরই অংশ। কেননা, যে নারী গৃহকর্মে নিপুণ, সংসারের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থ, তাকে বরাবর প্রশংসা করা হয়।

এ কাহিনীকাব্যে লোকসংস্কারের আরো কিছু দৃষ্টান্ত লক্ষণীয়। যেমন- চৈত্রের ভয়াবহ খরায় মাঠ-ঘাট ফেটে যখন চৌচির, কৃষকরা বৃষ্টির অভাবে বুক ফাটা হাহাকারে অস্থির, জনজীবনের স্বাভাবিক স্বস্তিটুকুও অন্তর্হিত দাবদাহের আগ্রাসনে, তখন পীরের দরগার সিন্নি এবং দুধ বিতরণ করা হয়। নিত্যদিনের বিবিধ সংকট থেকে মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে এ ধরনের লোকসংস্কারের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান না হওয়ায় গ্রামবাসী আরেকটি লোকাচারে অংশ নেয়, যেটিতে লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কারও জড়িত। সেটি হলো বদনা বিয়ে নামক অনুষ্ঠান। এর আয়োজনের একপর্যায়ে রূপাইয়ের সঙ্গে সাজুর প্রথমবার দেখা হয়, যা থেকে তাদের হৃদয়ে প্রেমের অনুরাগ জাগে। আদিম সমাজে প্রচলিত এ ধরনের অনুষ্ঠান মূলত অনুসরণমূলক জাদুচর্চার অংশ। বৃষ্টিপাতের অভিনয় করা হলে অবশেষে বাস্তবেই এর দেখা মিলবে, এ ধরনের প্রত্যাশা থেকে এ আয়োজন। ওই-গাঁয়ের বাসিন্দা হিসেবে সাজু এবং তার সঙ্গী চার তরুণী এ-গাঁয়ে আসে। সাজু মাথার ওপরে একটি কুলা রাখে। সেটির ওপর তেল ও হলুদ মাখানো জল ভরা বদনাটি বসানো থাকে।  ও-গাঁ থেকে এ-গাঁয়ে এসে চিকন সুরে গাইতে মেঘদের সম্বোধন করে রচিত বদনা বিয়ের গান শোনায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে, মাঙনের উদ্দেশ্যে-

কালো মেঘা নামো নামো, ফুল-তোলা মেঘ নামো,

ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো।

নয়নের কাজল, কৌটা ভরা সিঁদুর, নাকের নোলক বেচে মেঘকে তুষ্ট করার আগ্রহে একদিকে যেমন গ্রামীণ নারীর প্রসাধনকলার পরিচয় জানা যায়, অন্যদিকে প্রকৃতিনির্ভর মানুষের বৃষ্টির মাধ্যমে ভূমিতে নতুন ফসল ফলিয়ে পরিবার-পরিজনের জঠরাগ্নিকে প্রশমনের আকুলতাও এ গানে প্রতিধ্বনিত। বিভিন্ন বাড়ি থেকে চাল, ডাল, নুন ও  অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করে সেগুলো রান্না করে গ্রামবাসী একবেলা খায়, বদনা বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার অংশ হিসেবে।

আশ্বিনের ঝড়ে ঘর ভেঙে গেলে নতুন ঘর তুলতে রূপাই বাঁশ সংগ্রহ করে শেখের বাড়ির বাঁশঝাড় থেকে। রাম-কাটারী নিয়ে, কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে,  চিড়ার পুটুলি সঙ্গে নিয়ে রূপাই এ কাজে নামে। একপর্যায়ে সাজুর মায়ের মাধ্যমে জানা যায়, রূপাইয়ের মা তার খেলার সঙ্গী ছিল। সেই সুবাদে খালা হিসেবে সে রূপাইকে বাড়ি নিয়ে কুটুম্বিতা তথা আপ্যায়নের বন্দোবস্ত করে-

ও সাজু, তুই বড় মোরগ ধরগে যেয়ে বাড়ি

ওই গাঁ হতে আমি এদিক দুধ আনি এক হাঁড়ি।

রূপাইকে ঘরে এনে তার হাত-মুখ ধোয়ার পানি দিয়ে, শীতল পাটি বিছিয়ে আহারপর্ব সম্পন্ন করা হয়। এ কাব্যে অতিথি আপ্যায়নের আরো দৃষ্টান্ত রয়েছে। দুখাই ঘটক সাজুর মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তাকে পিঁড়িতে বসতে দেয়া হয়। তারপর ডাব্বা হুকায় তামাকযোগে ধুমপানের আয়োজনও করা হয়। বলাবাহুল্য, এসব আচরণ বাঙালি সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। অন্যদিকে, সাজুর প্রেমে দিশেহারা বলে তাকে দেখতে রূপাই বাজার থেকে কেনা গজা, পুঁতির মালা, রেশমি চুড়ি, রঙিন সুতা, ঢাকাই শাড়ি, হাসলী প্রভৃতি উপহার দেয়। ফলে অচিরেই গ্রামে কানাকানি শুরু হয় তাদের সম্পর্কে। অন্যদিকে, ছেলের আনমনা ভাব ও বিষণ্ন দৃষ্টি দেখে তার মা শাহলাল পীরের দরগায় সিন্নি মানত করে, পড়া-পানি খেতে দেয়। একপর্যায়ে প্রকৃত ঘটনা জেনে রূপাই ও সাজুর বিয়ে পারিবারিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। কবি এ বিয়ের বিবরণ ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রামীণ জীবনে প্রচলিত সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব হিসেবে, যেখানে সমষ্টিমানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ থাকে। বড়াই বুড়ির অপবাদ, খেঁদির মা ও টুনির ফুপুর তিরস্কারে অতিষ্ঠ রূপাইয়ের মা দুখাই ঘটকের প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। তবে, তার ছেলের নামে যারা কুৎসা রটায়, তাদের প্রতি সে অভিশাপ বর্ষণ করে, যা লোকসংস্কারেরই দৃষ্টান্ত-

রূপার মা কয়, “রুপা আমার এক-রত্তি ছেলে,

আজও তাহার মুখ শুঁকিলে দুধের ঘিরাণ মেলে।

তার নামে যে এমন কথা রটায় গাঁয়ে গাঁয়ে,

সে যেন তার বেটার মাথা চিবায় বাড়ি যায়ে

‘এগারো’ পরিচ্ছেদে লাঠি খেলার দীর্ঘ বিবরণে প্রকাশিত হয়েছে লোকসংস্কারের আরেকটি দৃষ্টান্ত, যেখানে মুসলমান বীর আলীকে স্মরণ করা হয়। রূপাই গাজনা চরের ধান কাটাকে কেন্দ্র করে দুষমনদের প্রতিহত করতে যেভাবে লাঠি হাতে তুলে নিয়েছিল, তাতে শক্তি ও উদ্যম যুক্ত হয়েছিল এ লোকসংস্কার অনুসরণে-

মাটির সাথে মুখ লাগায়ে, মাটির সাথে বুক লাগায়ে,

“আলী! আলী!!” শব্দ করি মাটি বুঝি দ্যায় ফাটায়ে।

হাজার লেঠেল হুঙ্কারী কয়,“আলী আলী হজরত আলী,”

সুর শুনে তার বন-গেঁয়োদের কর্ণে বুঝি লাগল তালি!

ঘটকের মাধ্যমে  প্রস্তাব এলে পাত্রের পারিবারিক বৃত্তান্ত, বংশগত পরিচয় ও মর্যাদা, বৈষয়িক অবস্থা প্রভৃতি বিবেচনা করে তবেই কনেপক্ষ বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। তেমনিভাবে বিয়েতে যৌতুক দেয়া-নেয়ার রীতিও প্রচলিত বিধায় দুখাই ঘটক সাজুর মাকে জানায়-

পোণে দিব কুড়ি দেড়েক বায়না দেব তেরো,

চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় এই যে ধরো বারো।

সবদ্যা হল দুই কুড়ি এ নিতেই হবে বোন,

চাইলে বেশী জামাইর তোমার বেজার হবে মন।”

রূপাইয়ের মাকেও এ প্রস্তাবে রাজি করিয়ে দুখাই ঘটক কৌশলে নিজের পকেট ভারি করে। বিয়ের আয়োজনের দীর্ঘ বর্ণনা থেকে অনুমান করা চলে, গ্রামীণ সমাজে এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ লোকাচার এবং উৎসব হিসেবে বিবেচিত হতো। কনেপক্ষ অর্থাৎ সাজুদের বাড়ির কাছারিঘরে অতিথিদের বসানো হয়। গ্রামের মোড়ল ও অন্যদের উপস্থিতিতে সেখানে পুঁথিপাঠের বন্দোবস্ত করা হয়, যা তাদের চিত্তবিনোদনের অন্যতম মাধ্যম।

কেতাব পড়ার উঠল তুফান; চম্পা কালু গাজী,

মামুদ হানিফ সোনাবান ও জয়গুণ বিবি আজি;

রূপকথা, লোককাহিনী ও কিংবদন্তির বিচিত্র জগতকে কবি বাক্সময় করে তুলেছেন লোকমানুষের সমষ্টিচেতনায় এসবের প্রতি দুর্বার আগ্রহ রূপায়ণে। সেকারণেই কারবালার শোকময় ঐতিহ্যও একইভাবে তাদের ভাবনায় অনুরণিত হয়-

লাল ঘোড়া তার উড়ছে যেন লাল পাখিটির প্রায়...

স্বপন দেখে জয়গুন বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে,

মেঘের বরণ চুলগুলি তার পড়ছে এসে ভূঁয়ে; ...

দেখছে চোখে কারবালাতে ইমাম হোসেন মরে,

নারীমহলে গল্পগুজব, রান্নাবান্নার তদারকি ও সাজসজ্জার বিবরণও রয়েছে কবির বর্ণনায়। বর হিসেবে রূপাইয়ের মাথায় শোভিত থাকে ফুলতোলা পাগড়ি, পরনে জোড়া জামা। তাকে দেখতে নারীরা উৎসুক হয়ে ওঠে। বিয়ের অনুষ্ঠানে বরকে শরবত পান করানোর রীতি প্রচলিত। কনেপক্ষের লোকেরা বরপক্ষের প্রদত্ত উপহার দেখে এ নিয়ে কখনো কখনো দোষ ধরে। উপহার পছন্দ না হওয়ার দোহাই দিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কৃত্রিম কথা কাটাকাটি ও মান-অভিমানের বৃত্তান্তকে কবি এ কাব্যে যেভাবে রূপায়িত করেছেন, তা থেকে অনুমান করা চলে, বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছে। পান খাওয়ার সাদা পাতা না আনা, সিঁদুর না আনা, যে শাড়ি কনের জন্য উপহার দেওয়া হয়েছে, সেটি আকারে খাটো- প্রভৃতি অভিযোগ ওঠায় বিয়ের আসরের জমজমাট রূপটি আরো বেশি প্রাণবন্তভাবে ফুটে ওঠে। এরপর মোল্লা কলেমা পড়ালে সাক্ষী-উকিলের উপস্থিতিতে বর-কনের সম্মতিতে বিয়ে পড়ানো হয়। এরপর তাদেরকে ক্ষীর খাওয়ানো হয়। এভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

বিয়ের পর রূপাই-সাজুর দাম্পত্যজীবনের যে পরিচয় ‘দশ’ পরিচ্ছেদে বিবৃত, তা গ্রামীণ কৃষকজীবনের অনুপুঙ্খ বৃত্তান্তকে তুলে ধরে। দিনের বেলা ক্ষেতে ধান লাগানো, যত্ন করা, ফসল তোলা, মাড়াই ও ঘরে আনা, রাত জেগে ধান ভানা প্রভৃতির পাশাপাশি সংসারের বিভিন্ন কাজে তাদের ব্যস্ততা, রাতে বাঁশিতে সুর তুলে রূপাইয়ের গান শুনতে শুনতে সাজুর বিভোর হওয়ার মতো মধুর দৃশ্য এ কাব্যে বর্ণিত হয়েছে, যা লোকসমাজের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিতুল্য।

গাজনার চরে ধান কাটাকে কেন্দ্র করে বছির মামুর প্ররোচনায় রূপাই লাঠিয়াল হিসেবে নিজের গ্রামের মানুষকে নেতৃত্ব দিলেও এর জের ধরে বহু মানুষকে জখম ও  হত্যার অভিযোগে তাকে ফেরারী হতে হয়। ফলে তার দাম্পত্যজীবন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। শাশুড়ির মৃত্যুর পর স্বামীর ভিটা ছেড়ে সাজু মায়ের কাছে এলেও রূপাইয়ের বিরহে একপর্যায়ে সে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে। দিনের পর দিন স্বামীর জন্য প্রতীক্ষার প্রহর ফুরাতে সে ব্যস্ত থাকে নকশি কাঁথার জমিনে সুঁই দিয়ে রঙিন সুতার ফোঁড়ে জীবনের উল্লেখযোগ্য মুহূর্তগুলো, বিশেষত রূপাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকে তার ফেরারী হয়ে আত্মগোপন পর্যন্ত দৃশ্যগুলো ফুটিয়ে তুলতে। প্রকৃতপক্ষে, এ কাব্যের নামকরণেও বিষয়টি স্বতন্ত্র আবেদন সঞ্চারে সমর্থ। কারণ, এ দুঃখী নারীকে জীবনের অমিত সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করার পূর্বেই যে মৃত্যুর দেশে যাত্রা করতে হয়, এর যৌক্তিকতা নিহিত রয়েছে তার বোনা কাঁথার প্রতিটি ফোঁড়ে। স্বামী, সন্তানকে নিয়ে সুখী জীবন যাপনের প্রত্যাশা রূপায়িত হবার আগেই তাকে বাধ্য হতে হয় প্রবল শোকগ্রস্ত অবস্থায় একাকী জীবন নির্বাহে। নারীর অসহায়ত্ব ও পরনির্ভরতা, অথনৈতিক স্বাধীনতা না থাকার পরিণতি কতটা করুণ, বিষাদময় হতে পারে, সাজু তারই দৃষ্টান্ত। বহুদিন পর গ্রামে প্রত্যাগত রূপাই সাজুর কবরের ওপর বিছানো নকশি কাঁথাটি দেখে বুঝতে পারে, তাকে হারিয়ে সেই নারী কতটা শোকাতুর অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের বিষাদান্ত  প্রেমকাহিনী কিংবদন্তিরূপে বহুদিন ধরে গ্রামের মানুষের মুখে পল্লবিত হয়ে চলেছে।

এ কাব্যের প্রকরণরীতি ও ভাষা ব্যবহার, সংলাপ গ্রন্থনায় ও দৃশ্য রূপায়ণে কবি সচেতনভাবে লোকভাষার প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গরাজি প্রয়োগ করেছেন। বিশেষত লোকসঙ্গীতের ব্যঞ্জনাধর্মিতা, সুরমূর্ছনা ও শ্রুতিময় ভাবাবেশের বিস্তার এ কাব্যে প্রাণময় রূপ পেয়েছে। ‘দশ’ পরিচ্ছেদে রাতে কাজের অবসরে রূপাই-সাজুর নিভৃতে কালযাপনের বিবরণ-

রূপা কয় “শোন সোনার বরণি, আমার এ কুঁড়ে ঘর,

তোমার রূপের উপহাস শুধু করে সারাদিন ভর।

তুমি ফুল! তবু ফুলের গায়েতে বহে বিহানের বায়ু,

আমি কাঁদি সই রোদ উঠিলে যে ফুরাবে রঙের আয়ু।

ফরিদপুরের গ্রামীণ লোকভাষাকে কবি নিপুণভাবে এ কাব্যে ব্যবহার করেছেন। কুশীলবদের আলাপে শুধু দেশজ ও আঞ্চলিক শব্দই যুক্ত হয়নি, পাশাপাশি তাদের অঙ্গভঙ্গি, সংলাপ উচ্চারণের বিশিষ্ট ধরনটিও কবির সতর্ক দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে।

“কি করগো রূপার মাতা? খাইছ কানের মাথা?

ও-দিক যে তোর রূপার নামে রটছে গাঁয়ে যা তা!...

রূপার মায়ের রুঠা কথায় উঠল বুড়ীর কাশ,

একটু দিলে তামাক পাতা, নিলেন বুড়ী শ্বাস।

এ কাহিনীকাব্যের আবেদন এতটাই সংক্রামক ও হৃদয়প্লাবী যে, স্বয়ং কবি জানিয়েছেন ‘আমার এই গ্রাম্য কাহিনী কাহারও ভাল লাগিবে কি না, জানি না। শুনিয়াছি কাহারও কাহারও আমার লেখা ভাল লাগে।’ ই এম মিলফোর্ড ‘দ্য ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট’ নামে ইংরেজিতে এবং দুশন জবভিতেল চেক ভাষায় এর অনুবাদ করেন। ভেরিয়ার এলউইনের মতো প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ কাব্যটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। জসীমউদদীন এ কাব্যে দেখিয়েছেন,  গ্রামের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষেরা প্রাত্যহিক জীবনকে যেভাবে যাপন করে, এতেই নিহিত রয়েছে বাঙালির আবহমানকালের ঐতিহ্য ও  সংস্কৃতির বীজ। তাই তাদের চালচিত্র রূপায়ণের তাগিদ থেকেই এটি রচিত হয়ে কালজয়ী মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। বাংলার প্রকৃতি, নিসর্গ ও গ্রামীণ জনজীবনের অন্তরঙ্গ সুর, মাটির মমতামাখা আহ্বান তিনি সবচেয়ে সফলভাবে কবিতায় ধারণ করেছেন। তিনি লোকমানুষের প্রতি আজীবন যে অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, এ কাব্যটি তারই উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ জুন ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়