ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সুধীন দাশ : নিভে গেল সুরের প্রদীপ

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২৮ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুধীন দাশ : নিভে গেল সুরের প্রদীপ

সুধীন দাশ (১৯৩০-২০১৭)

তাপস রায় : সুরকার, সংগীত বিশেষজ্ঞ, সংগীত পরিচালক, গবেষকসহ অনেক পরিচয়েই তিনি পরিচিত। তবে যে পরিচয়ে তিনি সমধিক পরিচিত এবং সম্মানিত তা হলো, নজরুলগীতির স্বরলিপিকার হিসেবে। এর বাইরে সংগীতশিল্পী তো তিনি ছিলেনই। ফলে ‘সুরের আকাশে শুকতারা’ তাঁকে বলা যায়। দূর আকাশে মিলিয়ে গেল তারাটি। সুরের যে প্রদীপ তিনি জ্বালিয়েছিলেন নিভে গেল হঠাৎ করেই অনেকটা নিভৃতে, আমাদের অনেকের অগোচরে। হঠাৎ করেই কি? বার্ধক্যের নানা রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছিল। প্রস্থান তাই অনেকটা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু প্রস্থান মানেই তো চলে যাওয়া নয়। তবুও গত সন্ধ্যারাতে চলে গেলেন সুরের আকাশে শুকতারা সুধীন দাশ। গানপাগল একজন।

সুধীন দাশের জন্ম ১৯৩০ সালে। কুমিল্লায় মানে কুমিল্লা শহরেই। বাবা নিশিকান্ত দাশ, মা হেমপ্রভা দাশের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তিনি। ভাই বোন সব মিলিয়ে নয়জন। ছোট বলেই হয়তো পরিবারে সকলের আদরে বড় হয়েছেন। পড়াশোনার প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল বামচন্দ্র পাঠশালায়। এর মধ্যেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধ জগৎ সংসারের অনেক কিছুই উল্টে দিয়েছিল। তার আঁচ এসে লেগেছিল সুধীন দাশের ছাত্রজীবনেও। যুদ্ধের কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাল্টাতে হয়েছে। কিন্তু লেখাপড়া থেমে থাকেনি।

সুধীন দাশের গানের আগ্রহ সেই ছেলেবেলা থেকেই। বলা যায়, পরিবারে গানের চর্চা ছিল। বড়দা সুরেন দাশ স্বয়ং গানের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু হলে কী হবে দাদার কাছে ভাইটি খুব একটা পাত্তা পেত না প্রথম দিকে। তিনি বলতেন আগে পড়াশোনা, তারপর গান। পড়াশোনার ক্ষতি করে  চঞ্চল ভাইটিকে তিনি গান শেখাতে চাননি। যদিও বাড়িতে প্রতিদিনই ছাত্রছাত্রীরা তার কাছে গান শিখতে আসত। আড়ালে দাঁড়িয়ে সুধীন দাশ গানের পাঠ নিতেন দাদার কাছ থেকে। একদিন ছাত্ররা গান তুলতে পারছে না দেখে দাদা রেগে বললেন, এত চেষ্টা করেও তোমাদের শেখাতে পারছি না, অথচ আড়ালে দাঁড়িয়ে একজন তো ঠিকই শিখে চলে যাচ্ছে। এই কথাটিই ছিল সুধীন দাশের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এরপর দাদাও আর সম্ভবত তাকে দূরে সরিয়ে রাখেননি। ছোটভাইকে দিয়েছেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম। দাদার সেই শিক্ষাই ছিল সুধীন দাশের সংগীত জীবনের পাথেয়।

১৯৪৮ সাল থেকে সুধীন দাশ বেতারে নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। গান বলতে রবীন্দ্রসংগীতই বেশি গাইতে হতো, পাশাপাশি আধুনিক এবং রাগপ্রধান গান। তখন এমন এক সময় যখন ‘নজরুলগীতি’ বলে আলাদা কিছু ছিল না। নজরুলের গানই ওই নামে গাওয়া হতো অনেক সময়। ১৯৫৪ সালের পর থেকে পাকিস্তান রেডিওতে নজরুলের গান ‘নজরুলগীতি’ নামে পরিচিত হতে শুরু করে। মনে রাখতে হবে, সে সময় নজরুলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সেই মোহে পড়ে গেলেন অনেকে। তারা জনপ্রিয় হবার আশায় অশুদ্ধ সুরে কবির গান গাইছিলেন।

বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ‘নবশক্তি’ পত্রিকার সম্পাদককে কাজী নজরুল ইসলাম লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন :

‘... আমার গান প্রত্যহই কোনো না কোনো আর্টিস্ট রেডিওতে গেয়ে থাকেন। আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত তা শুনেও ফেলি। এক উমাপদ ভট্টাচার্য মহাশয় এবং ক্বচিৎ দু’একজন গাইয়ে ছাড়া অধিকাংশ ভদ্রলোক বা মহিলাই আমার গান ও সুরকে অসহায় ভেবে (বা একা পেয়ে) তার পিণ্ডি এমন করে চটকান যে মনে হয়, ওর গয়ালাভ ওখানেই হয়ে গেল।

...একদিন এক রেডিও স্টার (মহিলা) আমার ‘আমারে চোখ ইশারায়’ গানটার ন্যাজামুড়ো হাত পা নিয়ে এমন তালগোল পাকিয়ে দিলেন যে তা দেখে মনে হলো বুঝিবা গানটার ওপর দিয়ে একটা মোটর লরি চলে গেছে।’

এ সময় কবির গান ভিন্ন অনেকের নামে চালাতেও দেখা যায়। সত্যি বলতে নজরুল গান রচনা ও তাতে সুর সংযোজনের ব্যাপারে যতটা যত্নবান ছিলেন, সেগুলো সংরক্ষণে ছিলেন ততটাই উদাসীন। সেটা হয়তো সম্ভবও ছিল না। গায়িকা ইন্দুবালা দেবীর কথায় তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। সে সময়ের স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন :

‘রিহার্সেল ঘরে খুব হৈ-হুল্লোড় চলছে, নানা জনে করছেন নানা রকম আলোচনা। কাজীদাও সকলের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করছেন, হঠাৎ চুপ করে গেলেন। একধারে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন খানিক। এই গোলমালের মধ্যেই তিনি কাগজ কলম টেনে নিলেন। তারপর মাত্র আধঘণ্টা কী তারও কম সময়ের মধ্যে পাঁচ-ছ’খানি গান লিখে পাঁচ-ছ’জনের হাতে হাতে বিলি করে দিলেন। যেন মাথার মধ্যে তার গানগুলি সাজানোই ছিল, কাগজ-কলম নিয়ে সেগুলো লিখে ফেলতেই যা দেরি।’

বর্ষার ঝরনার জল তরঙ্গের মতো এ সময় প্রবহমান ছিল কবির সৃষ্টি প্রক্রিয়া। ভাবা যায়! ‘গীতবিতানে’ গানের সংখ্যা ২২১৯। গানগুলোর রচনার সময়কাল ষাট বছর। অখণ্ড নজরুলে গানের সংখ্যা ২৮৭২।  রচনার সময়কাল মাত্র দুই বছর।

যাই হোক, কবির গান নিয়ে স্বেচ্ছাচার, কথা ও সুরের বিকৃতি তার অসুস্থ হওয়ার পর আরো বাড়তে থাকে। এ সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল ভুলে ভরা নজরুল গানের স্বরলিপি। ওদিকে কবি পুরোপুরি অসুস্থ। ফলে এ বিষয়গুলো দেখারও যেন কেউ আর রইল না। বিষয়টি সুধীন দাশের মনে ব্যাপক নাড়া দেয়। তিনি উপায় ভাবতে শুরু করলেন।

সুধীন দাশ ছেলেবেলা থেকে নজরুলের গানের আদি গ্রামোফোন রেকর্ড শুনে বড় হয়েছেন। ফলে তার কানে বড় বেশি বাজত ভুল সুর। মন থেকে তাড়িত হয়ে তিনি নজরুলের গানের আদি রেকর্ড সংগ্রহের কাজে নেমে পড়লেন। কাজটি সহজ ছিল না। কিন্তু তারপরও বলা যায় সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় তিনি সেগুলো যতটা পারলেন সংগ্রহ করে প্রকাশিত স্বরলিপির সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চিত হলেন সত্যি সেগুলো ভুলই ছিল। কিন্তু কে শোনে সেই সত্যভাষণ। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর অবশেষে এগিয়ে এলো নজরুল একাডেমি। এ কাজ যে তাদেরই আগে করার কথা ছিল!

প্রতিষ্ঠানটি নজরুলের গানের শুদ্ধ স্বরলিপি প্রকাশের কাজে হাত দিল। স্বাভাবিকভাবেই এই দায়িত্ব যার কাঁধে বর্তালো তিনি সুধীন দাশ।

আজ এতো বছর পরে এসেও আমরা জানি এই গুরু দায়িত্ব কত নিষ্ঠার সঙ্গেই না তিনি পালন করেছেন। সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বিদূষী নীলিমা দাশকে। তার সঙ্গে পরিচয় দাদার সেই গানের পাঠশালা থেকে। সতীর্থ থেকে নীলিমা হয়েছিলেন সহধর্মিণী। আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে স্বরলিপি উদ্ধারের কাজে স্বামীকে সুযোগ্য সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। যদিও এ কাজের প্রাপ্য মর্যাদা সুধীন দাশ পাননি। ১৯৮২ সালে ২৫টি স্বরলিপি নিয়ে ‘নজরুল সুরলিপি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। কিন্তু কোথাও স্বরলিপিকার হিসেবে তার নাম ছাপা হয়নি। নজরুল একাডেমি বিষয়টি উহ্য রেখেই যেন তাদের দায়িত্ব পালন করে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন।

সুধীন দাশ মনে না নিয়ে বিষয়টি মেনে নিতে তখন বাধ্য হয়েছিলেন। এর মধ্যেই স্থাপিত হলো নজরুল ইনস্টিটিউট। সেখান থেকে তার কাছে কবির গানের স্বরলিপি তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি সানন্দে রাজি হলেন।  পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ৩৩ খণ্ডে ‘নজরুল সুরলিপি’ প্রকাশিত হয়। এর প্রচ্ছদে স্বরলিপিকার হিসেবে সুধীন দাশের ঠাঁই হয়। কষ্টসহিষ্ণু একাগ্রতায় সৃষ্ট এ কাজ সুধীন দাশকেও ইতিহাসের পাতা চিরদিনের জন্য ঠাঁই করে নেয়।

গানের প্রতি তার ছিল প্রাণের টান। সব ধরনের গান গেয়েছেন তিনি। কিন্তু তার আগে পরম যত্নে শিখেছেন। নিষ্ঠায় ফাঁক রাখেননি। তারুণ্যে ভালো দাবা খেলতেন। ছিল মাছ ধরার ঘোর নেশা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছেন: ‘সারা দিন হয়তো স্বরলিপি আর গান নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, ওদিকে সারা রাত দিয়ে দিতাম ধানমন্ডি লেকে মাছের পেছনে। হাতে ছিপ, পাশে হারিকেন। মাছের জন্য কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বললে গল্প মনে হবে, কিন্তু সেই সময় ধানমন্ডি লেক থেকে ৩৬-৩৭ কেজি মাছও ধরেছি আমি।’

শিল্পী সুধীন দাশের জীবনে ধরা দিয়েছিল সুর। এখানেই থেমে থাকেননি। শুদ্ধ স্বরলিপি তৈরির কাজটা তিনি জীবনের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে ভেবেছেন। যখন দেখলেন লালনের গানেরও একই দশা। তখন গবেষকের দৃষ্টি ফেরালেন সেদিকে। লালনের গানের স্বরলিপি করে বই প্রকাশ করলেন। এ কাজটির সূচনাও তার হাতে, তিনিই প্রথম। এ সবই করেছেন প্রাণের টান থেকে। সব সময় ভালোবেসেছেন নিজস্ব সংস্কৃতি। আরো স্পষ্ট করে বলতে হয় শুদ্ধ সংস্কৃতি। যখনই কোথাও ভুল দেখেছেন শুদ্ধসত্য প্রকাশে আত্মনিবেদন করেছেন। আমরা তার স্বর্গীয় আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুন ২০১৭/তারা/ইভা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়