ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বড়গল্প || পরেশ মাস্টারের পরিবার

কুলদা রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৭, ৩০ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বড়গল্প || পরেশ মাস্টারের পরিবার

অলঙ্করণ: অপূর্ব খন্দকার

|| কুলদা রায় ||


চৈত্রমাস। গেল দিন ওড়াকান্দির বারুণী মেলা শেষ হয়েছে। নমঃশূদ্র মতুয়ারা ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বাড়ির পথ ধরেছে।

চিতলমারীর মতুয়ার দলটি প্রতি বছরই পরেশ মাস্টারের বাড়িতে রাত্রিযাপন করে। নাম গান করে। বিজয় সরকারের বিচ্ছেদী ধুয়া গায়। মাতম সহকারে কাদামাটি করে। তারপর ঝোল খিচুড়ির পঙ্‌ক্তি ভোজ সারে।

আজ মতুয়া দলটির মন খারাপ। বাড়িতে পরেশ মাস্টার নেই। তিনি এতদ্-অঞ্চলের মান্যিগণ্যিজন। দেশের কাজে জীবন ব্যয় করেছেন। লোকের উপকারের জন্য যে কোনো ত্যাগ করতে দ্বিধা করেন না। এইসব কারণে বিয়াই করেননি। সদা সত্য বলেন। তিনি থাকলে দুটো জ্ঞানগম্যির কথা হয়। দেশ বিদেশের হাল হকিকত জানা যায়। মানুষের মনে আশা ভরসা জাগে। তিনি আজ সপ্তাহখানেক হলো ঢাকা গেছেন। সেখানে তাকে সাদা মনের মানুষ হিসেবে সংবর্ধনা দিয়েছে। তারপর সুসং দুর্গাপুরে যাবেন। হাজংদের মধ্যে পুরনো লোকজনের সন্ধান করবেন। তাদের সঙ্গে একবার পুলিশের গুলিও খেয়েছিলেন।

সংবর্ধনার সুসংবাদে আবার সকলের মন ভালোও বটে। বহুকাল পরে তাঁর জন্য নমঃশূদ্রদের সম্মান বেড়েছে। ফলে পরেশ মাস্টারের নামে ধুয়া তুলে দিল-

শুনো সবে ভক্তি ভরে করি নিবেদন-

এই বাড়ির বড় কত্তা বড় ভাগ্যবান।

সতী সাধ্বী স্ত্রী তাহার কোলে সোনার চান।।

এই বাড়ির ছোট কত্তা বড় পূণ্যবান।

লোক-হিতে পরাণ দানে না করেন আনচান।।


ঊষাকালে তারা কেঁদে কাঁদিয়ে চলে গেল। বলে গেল, ঠাকুর চায় তো আগামী বছর আবার দেখা হবে। তখন নিশ্চয়ই পরেশ মাস্টারের চরণধূলি তারা পাবে। গমগমে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। চারিদিকে ফুল্ল হাওয়া বইছে। ক’দিন ধরে মেঘ হবো হবো করছে। কিন্তু মাসখানেক মেঘের দেখা নেই। ভয়ানক গরম। এলাকার বুড়ো দেবেন শিলারী আকাশের দিকে চেয়ে বলেছেন, গতিক ভালো ঠেকে না। তাউড়া বাতাস কখন আইসা পড়ে কওন যায় না।

উঠোন ঝাড়ু দিতে গেলে পরেশ মাস্টারের বৌদি মণিমালা দেখতে পেলেন তাদের কদমতলায় দুজন ক্লান্ত মানুষ বসে আছে। একজন পুরুষ, আরেকজন নারী। দুজনের হাতে দুটো পুটুলি। এরা যে থেকে যাবে বা থেকে গেছে এরকম কথা কেউ বলেনি। অনেক সময় দীর্ঘ পথশ্রমে মতুয়াদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে দুএকদিন থেকে যায়। এরা ঠাকুরের লোক। কে জানে হয়তো ঠাকুরই ছদ্মবেশে আসেন। তাদের পরীক্ষা করতে চান। তার লীলা বোঝা ভার। তাদের মণিমালা যত্নআত্তি করেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি যায় তারা। তবে গেল তিরিশ বছরে এ ধরনের ঘটনা খুবই কম ঘটেছে।

মণিমালা হাত জোড় করে বললেন, আপনারা গাছতলায় কেন, কাছারিঘরে উইঠা বসেন।

তারা দুজনে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু মণিমালা এখন কিছুই শুনবেন না। আগে রোগীকে সুস্থ করে তোলাই তার দায়িত্ব। তিনি কলা সেদ্ধ গরম ভাত রেঁধে নিয়ে এলেন। আর তাজা থানকুনি পাতা বেটে রস করে দিলেন। বললেন, দুপুরে সিং-মাছের পাতলা ঝোল রাঁধবেন।

সন্ধেবেলা তাদের উদ্দেশ্যে ন্যাংটার পূজোও দেওয়া হলো। মণিমালা জানালেন, দরকার হলে তারা বিজিতেন ডাক্তারকে খবর দেবেন। তবে মতুয়া গুরু হরিঠাকুর সহায় আছেন। তাদের ডাক্তার লাগে না। তাঁর ধুয়াই যথেষ্ঠ।


দুদিনেই তাদেরকে চাঙ্গা দেখা গেল। মণিমালাকে গড় করে জানালেন, তারা দুজনে ভাই বোন। নারীটি দিদি। আর পুরুষটি তার আপন মায়ের পেটের ভাই। তাদের বাড়ি সাপলেজায়।

সাপলেজা! শুনে অবাক হলো মণিমালা। তিনি সাপলেজা গ্রামের নাম শোনেননি। তার নিজের বাপেরবাড়ি আন্ধারকোটা। এখান থেকে সোজা উত্তর দিক। পথ মোটে আট মাইল। বিয়ে হয়েছে পরেশ মাস্টারের বড়দার সঙ্গে। নাম নরেশচন্দ্র। তিনি অতিশয় নিরিবিলি মানুষ। স্থানীয় মুন্সি প্রেসের কম্পোজিটরের কাজ করেন। স্থানীয় মন্দিরের এককোণে বসে নাম গান করেন। তবে দলের সঙ্গে তাকে বসে গাইতে দেখা যায় না। যদি কেউ ডেকে বসে তবে হেসে বলেন, তার নাম একা করাও যা, দোকা করাও তা। সব ডাকই তিনি শোনেন। ফলে নরেশচন্দ্রের একা চলাতে কারো আপত্তির কিছু নেই।

সাপলেজার ভাইটির নাম রামনাথ। আর বোনটির নাম অন্নপূর্ণা। রামনাথ মণিমালাকে উত্তর দিলেন, দিদি গো, এই সাপলেজা গ্রাম দক্ষিণ দেশে। থানা মঠবাড়িয়া। জেলা বরিশালের পিরোজপুর। গ্রামের আকার সাপের ল্যাজের মতন লম্বা বইলা এর নাম সাপলেজা। সত্যি সাপের ল্যাজ না।

মণিমালা মুখে হাত রেখে শুনছিলেন। একটু শ্বাস ছেড়ে বললেন, তাইলে আর ভয় নাই।

রমানাথ হেসে বললেন, ভয় থাকে ক্যামনে। সাপলেজা গ্রামের আগে পরে যে কাউরে জিগাইলেই দেখায় দেবে মতি ঘরামির বাড়ি।

মণিমালা মতি ঘরামীর নাম এর আগে শোনেননি। শুধালেন, উনি কেডা?

রামনাথ এতে মোটেই ঘাবড়ে গেল না। উৎসাহ ভরে তার পরিচয় দিল, উনি আমাগো বাবা লাগে।

তিনি কোথায়?

তিনি উইঠ্যা গেছেন। বলে রমানাথ আর অন্নপূর্ণা করো জোড়ে উঠে যাওয়া বাবার উদ্দেশ্যে প্রণাম করল।

মণিমালার নিজের বাবাও বহুদিন উঠে গেছেন। তার নিজের কোনো ভাই বোন নেই। ভাইবোনের জন্য তার তৃষ্ণা আছে। এ দুজনকে তার নিজের ভাই বোন মনে হলো।

অন্নপূর্ণা আর রমানাথ মণিমালাকে বলতে চেষ্টা করল, তারা মতুয়ার সঙ্গে আসেনি। তারা চলে যাওয়ার কালেই এসেছে। কিন্তু এসব কথা শোনার সময় নেই মণিমালার। কে কিভাবে আসে কেন আসে তা জেনে লাভ নেই। তারা এসেছে, তাদের বাড়িতে পদধূলি দিয়েছে, এতেই তিনি খুশি।

এবার তিনি তাদের জন্য পিঠা বানাতে বসলেন। ঢেঁকিতে পাহার পড়তেই সাপলেজার অন্নপূর্ণা রান্নাঘরে উঁকি দিল। তার মাথায় ঘোমটা। দেখে মণিমালা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন বোধ করতিছ বুনডি?

অন্নপূর্ণা হেসে জবাব দিল, আপনে সাক্ষাত দেবী ভগবতী। মন্দ থাকনের উপায় নাই গো দিদি।

মণিমালা চালের গোলা করেছেন। সাজে চিতোই পিঠা তুললেন। অন্নপূর্ণা তার সঙ্গে লেগে গেল। সে নারকেল কোরায়, গুড় ঢেলে পাটি সাপটা পিঠে গুছিয়ে দেয়। কুলি পিঠে সিদ্ধ করতে বসে। তার ক্লান্তি নেই। 

ঘোমটা নেমে যেতেই মণিমালা দেখতে পেলেন, তার সিঁথি ফাঁকা। দেখে তার প্রাণ কেঁদে ওঠে। অকালে বিধবা হয়েছে।

তার হাত দুটি ধরে সান্ত্বনা দিতে গেলেন।

অন্নপূর্ণা তার আগে আঁচল খুলে দেখাল। দুটো শাঁখা খুব যত্নে বাঁধা আছে।

বিধবা হলে হাতের শাঁখা ভেঙ্গে ফেলার কথা। আঁচলে বেধে রাখার রীতি নেই। হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলেন। নতুন নয়। আবার পুরনোও নয়।

অন্নপূর্ণা জানাল, এই শাঁখা ২৬ বছর আগে তার মামি দিয়েছিল। মণিমালা শাঁখা দুটি হাতে নিয়ে খুব আস্তে করে শুধালেন, কবে খুলছিল?

এ প্রশ্নের জবাব দিল না। একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ২৬ বছর আগে।

শুনে মণিমালার চোখ দিলে জল পড়তে লাগল। এই নারীর সর্বনাশের শেষ নেই। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, দুঃখ করিস না বোন, ঠাকুরের পদে মতি রাখ। তিনি পরের জন্মে তোর শাঁখা সিঁদুর অক্ষয় কইরা রাখবেন।


অন্নপূর্ণা হতবিহ্বল হয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারছে না । আঁচল দিয়ে মুখ মুছল। আর মণিমালা চোখ মুছে বললেন, এই শাঁখা আঁচলে বাঁধিস না। ভাইঙ্গা ফেল। নইলে তাঁর অকল্যাণ হবে।

অন্নপূর্ণা শাখা নিজের হাতে নিয়ে বলল, তিনি আছেন। বাঁইচা আছেন।

বাঁইচা আছে? মণিমালা কান্না থেমে গেল। একটু বিস্মিত হলেন। বললেন, তোরে ছাইড়া দেছে?

এ কথার উত্তর নেই।

তার অমতে বিয়া দিছিল?

অন্নপূর্ণা কথা বলল না। শুধু মাথা নাড়ল।

এবার মণিমালা রেগে গেলেন। বললেন, বিয়ার আগে আরেকজনের লগে তার আশনাই ছিল?

এবার অন্নপূর্ণা মাথা নিচু করে জানাল, না। সে-রকম কিছু সে জানে না।

এবার মণিমালা খুব শান্ত স্বরে তার পিঠে হাত রেখে বললেন, পুরুষ মানুষরে বিশ্বাস নাই। এরা কখন কি করে জানাই যায় না। টাকা পয়সা নিয়ে আরেকটা বিয়া করতি পারে। রাড়ি বাড়ি যাতি পারে।

উনি সে রকম নন।

তাইলে কি নিমাই সন্ন্যাসী হইছেন?

না। তার ধর্মে মতি ছিল না বলে শুনছি। লোকে তার সুখ্যাতি করে। লোকে বলে, তিনি কোনো খারাপ কাজ করতি পারেন না। কাউরে কষ্ট দেন না।

তারপর বলল, আমার বাবা উইঠা যাওয়ার আগে কইছেন, তিনি ফিরা আসবেন। আশা ছাড়িস না।

শুনে চুপ করে রইলেন মণিমালা। এ-রকম হতে পারে। সংসারে নানা রকম মানুষ আছে। সবাইকে এক পাল্লায় মাপা যায় না। তারপর ঘর থেকে সিঁদুরের কৌটা নিয়ে এলেন। বললেন, শাঁখা দুইটা পইরা নে। আর সিঁথিতে সিঁদুর পর। সধবার হাত আর সিঁথি ফাঁকা রাখা ঠিক নয়।

অন্নপূর্ণা সিঁদুরের কৌটা ফিরিয়ে দিল। এভাবে পরতে চায় না। তিনি আসবেন। তাকে নিজে ঘরে ডেকে নেবেন। সবার সামনে তার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেবেন। এছাড়া তার আর চাওয়ার কিছু নেই এ জীবনে। এই মুহূর্তের জন্যই সে এতোদিন আশায় আশায় আছে।

মণিমালা অবাক হয়ে বললেন, কস কি তুই?

অন্নপূর্ণা উত্তরে বলল, তার খবর পাইছি দিদি। আর দেরী নাই।

মণিমালা খুশি হলেন। বললেন, আশা রাখ। ঠাকুর নিশ্চয়ই তাকে তোর কাছে ফেরত দেবে।

তারপর জানালেন, তার দেওর পরেশ মাস্টার সারা দেশের লোকজনকে চেনে। সে বাড়ি এসে যখন তোর কথা শুনবে তখন তারে নিশ্চয়ই খুঁজে দেবে।

এর মধ্যে অন্নপূর্ণা কাঁচা মরিচ দিয়ে দু’খোলা ঝালের পিঠে বানিয়েছে। দেখে মণিমালা বিস্মিত। বললেন, ঝালের পিঠা আমার দেওর পরেশ খুব পছন্দ করে। তুই জানলি কী কইরা?

অন্নপূর্ণা হাসে। কথা বলে না।

তারপর অন্নপূর্ণাকে অবাক করে দিয়ে মণিমালা বললেন, ২৬ বছর আগে যদি অন্নপূর্ণার দেখা পাইতাম তাইলে পরেশের সঙ্গে তোর বিয়া দিতাম। তোরে দেইখা সে না করতি পারত না।


পরেশের মা মরার আগে পর্যন্ত ছেলের জন্য মেয়ে দেখে গেছেন। তার আশা ছিল, সোনার প্রতিমার মতো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলে সে আর ঘর ছেড়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে পারত না। মৃত্যু শয্যায় মণিমালার হাত ধরে বুড়ি কেঁদে গেছেন। বলে গেছেন, তুমি যে কইরা হোক পরেশকে ফেরাও।

পিঠে বানানো শেষ হলো বেশ রাত করে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে উঠে খাবে। এর মধ্যে অন্নপূর্ণাকে নিয়ে মণিমালা রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছেন। রান্নাঘরে পিঠা রাখা যাবে না। শেয়াল কুকুরে খেয়ে ফেলতে পারে। সব কিছু গুছিয়ে বড় ঘরে নিয়ে যাবেন। কিছু বাটি তিনি হাতে নিয়েছেন। আর কিছু অন্নপূর্ণা নিয়ে তার পেছনে পেছনে গেল। ঘরের দরোজার চৌকাঠ অব্দি গিয়ে অন্নপূর্ণা থেমে গেল। তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে মণিমালা মিষ্টি করে বলল, ঘরে উঠে আয় অন্ন।

তিনি নিজে ঘরে ঢুকে হাতের পিঠার বাটি রাখলেন। কিন্তু অন্নপূর্ণাকে আসতে না দেখে আবার দরোজায় ফিরে এলেন। অন্ন তার হাতে বাসনপত্র এগিয়ে দিয়ে বলল, দিদি, এই নাও।

মণিমালা তার হাত ধরে আকর্ষণ করে বললেন, নিজের ঘর মনে কইরা ঘরে আয়।

অন্নপূর্ণা এবার হাত ছাড়িয়ে নিল। বলল, এটা আমার নিজের ঘর। পরের ঘর না।

মণিমালা হেসে বললেন, আমিও তাই কইছি, এটা তোরই ঘর।

অন্নপূর্ণা অন্য রকম গলায় উত্তর দিল, নিজের ঘর বলেই নিজে নিজে যাতি পারি না।

এবারে গায়ে ঢেউ খেলিয়ে মণিমালা বললেন, তুই দেখি ভালো রস করতি পারিস। ঘরে আয়। সব গোছগাছ কইরা রাখি। কাল আমার দেওর পরেশ মাস্টার ফিরবে। তার জন্য পাঠার মাংস রান্না করতি হবে।

এবার অন্নপূর্ণার গলায় এক দৃঢ়তা এসেছে। বলল, উনি আমার স্বামী।

মণিমালা এ কথাকেও রসিকতা মনে করে হি হি করে এই মধ্য রাতে হেসে উঠলেন। এ সময় একটা পেঁচা তীক্ষ্ম স্বরে ডেকে উঠল। আর একটা হাওয়া এসে টগর গাছটিকে দুলিয়ে গেল।

মণিমালা বললেন, স্বামী হইতে পারে না বোন- স্বামী হইতে পারত। ২৬ বছর আগে তোর সাথে দেখা হলি পরেশ মাস্টার তোর স্বামী হইতে পারত। এরপর তো আর সুযোগ নাইরে বোন!

অন্নপূর্ণা জড়তাহীনভাবে জানাল, হাসির কথা নয়। সত্যি সত্যি এ বাড়ির পরেশ মাস্টার তার স্বামী। ২৬ বছর ধরে তাকে খুঁজে চলেছে। এখন নিশ্চিত হয়েছে। পরেশ মাস্টার এসে তাকে হাতে ধরে ঘরে তুললেই সে নিজের ঘরে উঠবে। সেটাই তার জন্য সম্মানজনক। এর জন্যই এতোকাল অপেক্ষা করছে।

শুনে মণিমালার মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। একটা আশঙ্কায় মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। হাত থেকে ঝাল পিঠের বাসন মাটিতে পড়ে গেল। ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরোজা বন্ধ করে দিল।


সেটা ছিল মার্চ মাসের শেষ দিক। ছিল তীব্র গরম। বৃষ্টির দেখা ছিল না। মাঠ ফেটে গিয়েছিল। এই সময়ে বাড়ি থেকে কুকুর বিড়ালকেও তাড়ানোর প্রথা নেই। কিন্তু ভোর বেলাতেই কে একজন ঠিকা কাজের মেয়ে এসে অন্নপূর্ণাদের চলে যেতে বলল।

রমানাথ একটু ঘুমকাতুরে। তার ইচ্ছে আরেকটু ঘুমিয়ে নেবে। তারপর বেলা হলে উঠবে। এর মধ্যে পরেশ মাস্টার যাবেন। তার সঙ্গে দেখা করবে। এই জন্যেই তারা সেই বহুদূর সাপলেজা থেকে এসেছে।

তাদেরকে গা করতে না দেখে, কাজের মেয়েটি এসে আবার ঘোষণা দিল, এই ঘরটি তাকে ঝাড়পুছ করে রাখতে হবে। তার অন্য কাজ আছে। এই কাজে দেরি করার সময় নেই।

রামনাথ চলে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল। বাড়ি থেকে বেশ কয়েকদিন বেরিয়েছে। অনেক কাজ আছে তার। কিন্তু এভাবে রুক্ষভাবে চলে যেতে বলাটা স্বাভাবিক মনে হলো না। কাজের মেয়েটি হয়তো খামোখা ঝামেলা করছে।

রামনাথ জিজ্ঞেস করল, মণিমালা দিদি কি যাতি কইছে?

মেয়েটি ঝাঁটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। উত্তর দিল, তিনি না কইলে এ বাড়িতে একটা কাকপক্ষীও পড়ে না।

রামনাথ সেটা মানতে নারাজ। বলল, দিদির কাছে শুইনা আসি।

মেয়েটি একটু রুক্ষ সুরে বলল, বউদির শরীর ভালো না। তার লগে দেখা হবে না।

এরমধ্যে অন্নপূর্ণা ফুল তুলে এসেছে। সব শুনে দাদাকে ধরে থামাতে গেল। বলল, থাক ভাই, জিগানির দরকার নাই। বলে পোটলা হাতে কাচারি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

রামনাথ ছুটে গেল বড় ঘরের দিকে। কাল রাতে যত্ন করে চিতল মাছ রান্না করে খাইয়েছেন। বলেছেন, সকালে পিঠে খেতে দেবেন। বিকেলে ফেলা গোসাইয়ের আশ্রমে নিয়ে যাবেন। কোথায় কি? তার বদলে কাজের মেয়েটি এসে বের হয়ে যেতে বলছে। বিশ্বাস করা কঠিন। মনে হলো, তাদেরকে এভাবে চলে যাওয়ার ব্যাপারটি এ বাড়ির বউ মণিমালা হয়তো জানেই না। সে মণিমালা দিদিকে জিজ্ঞেস না করে যেতে পারে না। বড় ঘরের দরজার কাছে এসে সে একটু হেঁকে বলল, দিদি, আপনি কি এখন আমাগো চইলা যাতি কইছেন।

ঘরের দরোজা খুলল না। কিন্তু কয়েকটি জানালা খুলে গেল। এ বাড়ির কয়েকটি মুখ সেখানে ঘুমভাঙা চোখে উঁকি দিচ্ছে। সেখানে মণিমালা নেই। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে মণিমালার গলা ভেসে এলো। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, তারা যেন কাকপক্ষী জানার আগেই চলে যায়।

শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল রামনাথ। তবে বেশি দেরি করল না। এ বাড়িতে থাকা ঠিক নয়। অন্নপূর্ণার হাত ধরে বলল, চল দিদি। আমরা এ বাড়ির বাইরে গিয়া দাঁড়াই।

অন্নপূর্ণা ভাইয়ের কথায় না করে না। পুটলিটা হাতে নিয়ে কাচারি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাড়িটার দিকে ফিরেও তাকাল না। মাথা নিচু করে চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল।

রামনাথ একটু এগিয়ে গিয়েছিল। দিদির পায়ের শব্দ না পেয়ে পিছন ফিরে দেখতে পেল, অন্নপূর্ণা ঘরের বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে আছে। সেটা তখনো অব্দি খোলেনি। রামনাথ বলল, কিছু কি ফেলায় গেছো?

অন্নপূর্ণা কিছু ফেলে গেছে কি যায় নি সে প্রশ্নে গেল না। চুপ করে আছে।

অন্নপূর্ণা খুব লক্ষ্মীমতি। কখনো কাউকে বিরক্ত করে না। বিরক্ত হতে পারে এমন কোনো কাজ সে করে না। তাদের বাবামায়ের স্নেহের পুত্তলি। বাড়িতে কাজের লোক আছে। তবু সে-ই সব দায়িত্ব পালন করে। রামনাথের বউয়ের সঙ্গে বিয়ের পর থেকে আজ অব্দি কোনো ঝামেলা হয়নি। সে দিদি বলতে অজ্ঞান। এ বাড়ির মণিমালা যখন রুক্ষ স্বরে চলে যাওয়ার হুকুম দিয়েছেন, এরপর এক মুহূর্তে দাঁড়ানোর কথা নয়।

রামনাথ অন্নপূর্ণার হাত ধরে বলল, শরীর খারাপ লাগছে দিদি?

অন্নপূর্ণা মাথা নেড়ে বলল, না। সব ঠিক আছে।

তাইলে?

অন্নপূর্ণা ভাইয়ের এ প্রশ্নে দৃঢ় কণ্ঠে জানাল, সে যাবে না। পরেশ মাস্টার আসা অব্দি অপেক্ষা করবে। তিনি এসে বললেই চলে যাবে। তার আগে নয়।

বলে বড় ঘরের দরোজার সামনে ঘাট হয়ে বসে পড়ল। তারপর কি মনে করে আঁচল পেতে দরোজাজুড়ে শুয়ে পড়ল।


মুহূর্তের মধ্যে এ বাড়ির চেহারা পালটে গেল। মণিমালা দরজা খুলে বের হতে পারছে না। বের হতে গেলে অন্নপূর্ণাকে টপকে যেতে হবে। সেটা তিনি পারেন না। ঠাকুরের নিষেধ আছে। ফলে ঘরের ভেতর থেকেই তিনি তর্জন গর্জন শুরু করলেন। ব্যাপার দেখে ঠিকে ঝি ডাকাত পড়েছে বলে পাড়ার মানুষ জড়ো করে ফেলল। তাদের কেউ কেউ লাঠি সোটা নিয়ে এলো। তারা সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে ডাকাত পেল না। তার বদলে নিরীহ রামনাথ আর অন্নপূর্ণাকে দেখতে পেল। এদেরকে এ ক’দিন তারা এ বাড়িতে দেখেছে বটে। তাদেরকে ডাকাত মনে করার কোনো কারণ নেই। লোকজন মণিমালার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল, অ বউদি, ডাকাত গেল কই?

তিনি রামনাথ আর অন্নপূর্ণাকে দেখিয়ে বললেন, এরাই ডাকাত। এরা বরিশাইল্লা ডাকাত। ছদ্মবেশে এ কদিন ছিল।

লোকজনের অবিশ্বাস হলো না। দেশে ছদ্মবেশে ডাকাতি হয়। আর দেরী না করে অন্নপূর্ণাকে ঘিরে ফেলল যাতে সে পালাতে না পারে। কেউ কেউ তাদের পোঁটলাপুটলি খুলে ফেলল। তার মধ্যে নিত্য ব্যবহার্য দু’একখানা কাপড় চোপড় ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। রেগে মেগে কেউ কেউ রামনাথকে পিটাতে গেল।

এর মধ্যে পরেশ মাস্টারের দাদা নরেশচন্দ্র প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি নির্বিবাদী শান্ত মানুষ। তিনি দেখতে পেলেন, সাপলেজা গ্রাম থেকে আসা রামনাথকে পিটুনি দিতে লোকজন ঘিরে ধরেছে। তার জামার কলার ছিঁড়ে গেছে। আর দরোজার সামনে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদে চলেছে অন্নপূর্ণা। ভয়ংকর অবস্থা। এক্ষুনি না থামালে বড় বিপদ ঘটে যাবে। তিনি এসে সবাইকে থামালেন। বললেন, কি করছ তোমরা?

লোকজন উত্তর দল, ডাকাত ধরছি দাদা। এরা ডাকাত। আপনাগো বাড়ি ডাকাতি করতি আইছে।

কিন্তু নরেশচন্দ্র একদিন এদের সঙ্গে না মিশলেও বুঝতে পেরেছেন, এরা ডাকাত নয়। তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। সেটা জেনে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তার আগে নয়। ঘর থেকে মণিমালা হেঁকে বললেন, ডাকাত না হলি পরেশ ঠাকুরপোর বউ বইলা দাবি করে?

নরেশচন্দ্র স্ত্রীর দিকে তাকালেন একবার। তাকে কিছু বললেন না। কোনোদিন বলেনও নি। আজ হঠাৎ কী মনে কথা বললেন। তিনি রামনাথকে সাফসুতরো করে শুধালেন, আপনার দিদির বিয়া হইছিল কোথায়?

বাগেরহাটের মোল্লাহাটে।

শুনে একটু অবাক হলেন। বললেন, মোল্লাহাট তো আমাদের বাড়ি না। আপনারা যে পরেশচন্দ্রের সন্ধান করতিছেন তার বাড়ি মোল্লাহাট। তিনি আমার ভাই পরেশচন্দ্র না। মোল্লাহাটের অন্য কোনো পরেশচন্দ্র হবে।

তখন রামনাথ তাড়াতাড়ি করে বলে, মোল্লাহাটে ছেলের বাড়ি না।

তাইলে?

মোল্লাহাটের কালশিরা গ্রামে দিদির সঙ্গে তার বিয়াটা হইছিল।

এবার কপাল কুচকে নরেশচন্দ্র জিজ্ঞেস করেন, আপনাদের বাড়ি তো মঠবাড়ির সাপলেজা গ্রামে। আপনার দিদির বিয়া হইলে সাপলেজা গ্রামে বইসাই হবে। কালশিরা গ্রামের মধ্যে বিয়ার ঘটনা ঘটে কিভাবে?

রামনাথ দিদির দিকে তাকিয়ে বলে, কালশিরা গ্রামে আমাদের মামাবাড়ি। মামাবাড়িতে বইসা দিদির বিয়া হইছিল।

তখন আপনার বয়স কত ছিল?

চার বছর।

খুব ছোট। আপনার মনে থাকার কথা নয়।

সেটা সত্যি।

এ ঘটনার কথা সাপলেজার অন্য লোকেও জানে না। পরিবার থেকে গোপন রাখা হয়েছিল। মারা যাওয়ার আগে তার বাবা-মা তাকে সব বলে গেছে।

রামনাথ নরেশচন্দ্রকে বলে, মামাবাড়ি আমি গেছি কিনা মনেই নেই। তবে দিদি অন্নপূর্ণা ছিল মামাবাড়ির নেওটা।

ক্লাশ সিক্সে পড়ত অন্নপূর্ণা। ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরে মামা এসে তাকে কালশিরা গ্রামে নিয়ে গেছে। যেতে যেতে রাত হয়ে গেছে। মামি পিঠা বানাতে বসেছে। বেশ শীত জাঁকিয়ে বসেছে। অন্নপূর্ণা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।

মধ্যরাত। ঘুমের মধ্যে কি একটা হৈ চৈ শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো কোথাও আগুন লেগেছে।

এর মধ্যে মামার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ঘর ছিল অন্ধকার। কাউকে ভালো করে দেখা যায় না। মামি একটা লাল শাড়ি দিয়ে বলল, এটা পরে ফেল অন্ন। দেরী করিস না।

তখনো সে ঠিক শাড়ি পরে না। মামিই পরিয়ে দিল। এ সময়ে বাড়ির মধ্যে বেশ কিছু পায়ের শব্দ শোনা গেল। কেঁপে উঠে অন্নপূর্ণা মামিকে জড়িয়ে ধরল, বল, কি হইছে মামি?

মামি নিচু স্বরে বলল, কিছু হইতে পারে। তুই এখন ভরসা। পারবি না মা?

কি পারবে আর কি পারবে না সেটা জানার আগেই ঘরের মূল দরোজায় বাইরে থেকে জোরে জোরে ধাক্কা পড়তে লাগল। বাইরে থেকে ভারী গলায় কারা হেঁকে বলল, দরোজা খোল। আমরা পুলিশ। সার্চ করব।

যুবক মতো কে একজনকে অন্নপূর্ণার খাটে বসিয়ে দিয়ে মামা বলল, কেউ জিজ্ঞেস করলে কইবি, এ লোকটি তোর স্বামী। এ ছাড়া বাঁচনের উপায় নেই রে মা।

দরোজা ততক্ষণে খুলে গেছে। হুড়মুড় করে চার পাঁচজন ঢুকে পড়েছে। সারা ঘর তল্লাশি করছে। অন্নপূর্ণা যে ঘরে ঘুমিয়েছিল সে ঘরের দরোজা ছিল না। দরোজার বদলে ছিল পর্দা ঝোলানো। সেদিকে পুলিশ এগিয়ে যেতেই মামা বলে উঠল, আমার ভাগ্নি আর ভাগ্নি জামাই আইসে। নতুন বিয়া হইছে।

শুনে পুলিশরা পর্দা ঠেলেই ঢুকে পড়ল। ঢুকে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে দেখল, বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে জামাই। আর তার পাশে জড়সড়ো হয়ে লেপের ভেতর থেকে উঠে বসেছে অন্নপূর্ণা। মুখ নিচু। লজ্জা পাচ্ছে। তার কপালে লেপটে গেছে সিঁদুর। জামাইয়ের দিকে টর্চ লাইট ধরে দেখল, তার গালও লাল। সিঁদুর লেগেছে।

তারা টর্চ লাইট নিভিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, বাড়ি কোথায় জামাইয়ের?

জামাইয়ের উত্তর দেওয়ার আগে মামাই উত্তর দিল, শিয়ালকাঠি। কাউখালি। বরিশাল।

নাম কি?

সরবিন্দু ঘরামী।

কমিউনিস্ট নাতো?

চিরাপাড়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। অংক আর ইংরেজি পড়ায়।

পুলিশ আর দাঁড়াল না। সময় কম। অন্য বাড়িতে সার্চ করতে হবে। তারা শুনেছে এই গ্রামে কমিউনিস্ট এসেছে। তাদের যে করেই হোক ধরতে হবে। গোপাট দিয়ে তারা চলে গেল।

রামনাথের কাছে এই পর্যন্ত শুনে নরেশচন্দ্র বলে ওঠেন, ছেলেটির নাম কি?

রামনাথ উত্তর দিল, সরবিন্দু ঘরামি।

পরেশচন্দ্র নয়। আমার ভাই নয়। অন্য কেউ। বলে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন নরেশচন্দ্র।

আগে বলে নেই। তারপর আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব। রামনাথ তার কথায় ফিরে গেল।

পুলিশ চলে যেতেই অন্নপূর্ণার বিছানা থেকে সরবিন্দু নামের লোকটি উঠে পড়ে। তার এ-গ্রামে থাকা নিরাপদ নয়। আবার পুলিশ আসতে পারে। একবার চিনতে পারলে মেরে ফেলবে। শুধু তাকেই নয়, গ্রামের কেউই রক্ষা পাবে না। মামা তাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। সাবধানে গ্রাম পার করে দিল। সে রাতেই অন্নপূর্ণাকেও মামা সেই গ্রামে রাখেননি। রাতের আঁধারেই তাকে নিয়ে সাপলেজায় রওনা দিয়েছিলেন।

নরেশচন্দ্র এইখানে এসে প্রশ্ন করলেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে অন্নপূর্ণার সাথে সরবিন্দুর বিয়াও হয়নি?

এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে রামনাথ তার পুঁটলির সন্ধান করল। একটি খতির মধ্যে থেকে পুরনো এক তাড়া কাগজ বের করল। সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এইটা দেখেন।

কাগজের তাড়া খুললেন নরেশচন্দ্র।

এটা লেখা হয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে। লেখা হয়েছে ৮ অক্টোবর তারিখে। সাল ১৯৫০। কিন্তু ইংরেজিতে লেখা। নরেশচন্দ্র ইংরেজিতে পারদর্শী নন। সেটা বুঝে রামনাথ তাকে কাগজের তাড়া থেকে একটা হাতে লেখা বাংলা তর্জমা বের করে দিল। মঠবাড়িয়ার কে এম লতিফ ইনিস্টিটিউশনের ইংরেজির শিক্ষক মোহাম্মদ হাশেম আলী মৃধা অনুবাদ করেছেন। ১৫ নং অনুচ্ছেদ দেখিয়ে এইখানটা পড়েন। লেখা রয়েছে :

‘খুলনা জেলার মোল্লাহাটের অন্তর্গত কালশিরা গ্রামে ২০ ডিসেম্বর, ১৯৪৯ গভীর রাত্রে কালশিরা গ্রামের জনৈক জয়দেব ব্রহ্মার বাড়িতে সন্দেহজনক কমিউনিস্টদের খোঁজে চারজন কনস্টেবল হানা দেয়। পুলিশের আসার সংবাদে জনা ছয়েক তরুণ, কমিউনিস্ট বা সাধারণ, বাড়িটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ বাড়িতে ঢুকে জয়দেব ব্রহ্মার স্ত্রী এর উপর আক্রমণ চালালে তার চিৎকার তার স্বামী এবং বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া কিছু সঙ্গীর কানে আসে। মরিয়া হয়ে তারা গৃহে পুনঃপ্রবেশ করে এবং চারজন কনস্টেবলকে কেবলমাত্র একটি বন্দুকসহ পায়। সম্ভবত এই দৃশ্য তাদের প্রণোদিত করে এবং তাদের আঘাতে অস্ত্রধারী কনস্টেবলটি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। তারা তারপর দ্বিতীয় কনস্টেবলের উপরও হামলা চালালে বাকি দুইজন সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে আশপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং সফল হন। কিন্তু গ্রামবাসী এগিয়ে আসার আগেই রাতের অন্ধকারে অপরাধীগণ মৃতদেহসহ গা ঢাকা দেয়। পরদিন বিকেলে খুলনার এস.পি. একদল মিলিটারি এবং আর্মড পুলিশসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ইতোমধ্যে অপরাধীগণ এবং বুদ্ধিমান প্রতিবেশীগণ অত্র এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। কিন্তু বেশিরভাগ গ্রামবাসীই তাদের নিজ ঘরেই রয়ে যায় কারণ তারা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং পরবর্তীতে কি ঘটতে পারে সে সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।

এরপর এসপি, মিলিটারি ও আর্মড পুলিশ গ্রামজুড়ে নিরীহ গ্রামবাসীকে মারধর শুরু করে এবং আশপাশের মুসলিমদের লুটপাটে প্ররোচিত করে। বেশকিছু মানুষ নিহত হয়, বহু হিন্দু নর-নারীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। বাসাবাড়ির দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙচুর করা হয়, পূজোর স্থান অপবিত্র ও ধ্বংস করে দেয়া হয়। পুলিশ, মিলিটারি এবং স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য কর্তৃক হিন্দু মহিলারা ধর্ষিত হন। এভাবে শুধুমাত্র এক থেকে দেড় মাইল দৈর্ঘ্যের গ্রাম, এক বিরাট জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল কালশিরাই নয়, এর আশপাশের বেশকিছু নমঃশূদ্র গ্রামেও বাস্তবিক অর্থেই নরক নেমে আসে। কালশিরা গ্রামটি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কখনোই কমিউনিস্ট কার্যকলাপের জন্য সন্দেহের তালিকাভুক্ত ছিল না। কালশিরা থেকে তিন মাইল দূরবর্তী ঝালরডাঙ্গা গ্রামটি কমিউনিস্ট কার্যকলাপের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ঘটনার দিন এই গ্রামটিতে সন্দেহভাজন কমিউনিস্টদের ধরতে পুলিশের এক বিরাট বাহিনী হানা দিলে তাদের কিছু সংখ্যক পালিয়ে কালশিরা গ্রামের পূর্বোল্লিখিত বাড়িতে আশ্রয় নেয় যা তাদের কাছে নিরাপদ আত্মগোপনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।’


এটা পড়ার পরে লোকজন স্তব্ধ হয়ে গেল। পাড়ার প্রবীণ লোক হারান মজুমদারও শুনছিলেন। তিনি শুনে ঘটনাটি মনে করতে পারলেন। জানালেন, সে সময়ে তার পিসিদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জগা বিশ্বাসের ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িও আক্রান্ত হয়েছিল। ফেলা ঘরামী মনে করতে পারলেন তার ছোট মাসিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের বাড়িও ছিল কালশিরা গ্রামে। তবে হারান বিশ্বাস কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো। তার মামির তখন সবে বিয়ে হয়েছে কালশিরার মণ্ডল বাড়িতে। এ ঘটনার পাঁচদিন তার খবর মেলেনি। কিছুদিন চাপৈল বাজারে তার মতো কাউকে ঘুরতে দেখা গেছে বলে তারা খবর পেয়েছিল। গায়ে কাপড় চোপড় ঠিক নেই। বিড়বিড় করে। তারপর সেই মামির লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ফলতিতা গ্রামের বটগাছের ডালে।

নরেশচন্দ্র ১৬ নং অনুচ্ছেদ পড়লেন :

‘১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমি কালশিরা গ্রাম এবং তার সংলগ্ন গ্রামগুলো পরিদর্শন করতে যাই। খুলনার পুলিশ সুপার এবং মুসলিম লীগের নেতারা আমার সাথে ছিলেন। আমি যখন কালশিরাতে পৌঁছাই এক ধ্বংসপ্রাপ্ত বিরানভূমি দেখি। পুলিশ সূত্রে জানা এখানে ৩৫০ বাড়ি ছিল। এর ভিতর মাত্র তিনটি বাড়ি টিকে আছে। সব লুটপাট করা হয়েছে। আমি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, প্রধান সচিব, পুলিশ প্রধান এবং আপনার কাছে ঘটনাটি জানিয়ে ছিলাম।’

পাড়ার কানু সিকদার শুধালো, এটা কে লিখছেন?

নরেশচন্দ্র কাগজটির দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে উত্তর দিলেন, লেখকের নাম নিচে রয়েছে। লেখা, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।

কোন যোগেন মণ্ডল?

বরিশালের যোগেন মণ্ডল।

আর বলা লাগল না। সকলেই ঘটনাটি মনে করতে পারল। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়ে যোগেন মণ্ডল নমঃশূদ্রদের নিয়ে ভারতের বদলে পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাকে কথা দিয়েছিলেন, পাকিস্তান হবে হিন্দু-মুসলমান সকলের রাষ্ট্র। সেখানে নমঃশূদ্ররা মুসলমানদের সমান অধিকার ভোগ করবে। তিনি যোগেন মণ্ডলকে পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী করেছিলেন।

এটা যোগেন মণ্ডলের পদত্যাগ পত্র। তিনি কালশিরার এই ঘটনার উল্লেখ করে পদত্যাগ করেছিলেন মন্ত্রিত্ব থেকে। পাকিস্তানে থাকতে আর সাহস পাননি। সব কিছু ফেলে পশ্চিম বঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

নরেশচন্দ্রের পড়া শেষ হলে রামনাথ জানাল, দিদি বাড়ি ফিরে কিছুদিন গুম হয়ে থাকল। এর মধ্যে মামারা দেশত্যাগ করে চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল, অন্নপূর্ণার যেন বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের সম্বন্ধও আনা হয়েছিল। কিন্তু অন্নপূর্ণা বিয়ে করতে রাজী হয়নি। সে বাবাকে জানিয়েছিল, কালশিরায় সেদিন প্রাণ বাঁচাতে যার সঙ্গে বিয়ার অভিনয় করতে হয়েছিল, তাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়া করবে না। এবং তাকেই সে মনেপ্রাণে স্বামী হিসেবে বরণ করেছে। এইটুকু মেয়ে জেদ করে বসেছে।


অন্নপূর্ণার বাবা-মা এই মেয়েটিকে খুবই স্নেহ করতেন। পরিস্থিতি ভালো হলে তার বাবা কালশিরা গ্রামে গিয়েছিলেন সেই যুবকটির সন্ধান করতে। তবে যুবকটিকে চিনতে পারে এমন কোনো লোকই সে গ্রামে ছিল না। অধিকাংশই নতুন লোক। পূব পাড়ার এনসান আলী মাতুব্বর অন্নপূর্ণার বাবাকে চিনতেন। বলেছিলেন, সে সময়ে এই এলাকার ৩০ হাজার লোক দেশ ত্যাগ করেছিল। তবে সেদিনের ঘটনাটি তার মনে আছে। তিনি স্মরণ করলেন, এই এলাকার আশপাশে কিছু কমিউনিস্টদের কার্যক্রম ছিল। পাকিস্তান সরকার সেসব গ্রামে কমিউনিস্ট ধরার জন্য পুলিশি তৎপরতা জোরদার করলে এই কালশিরা গ্রামে তারা মাঝে মাঝে আশ্রয় নিত। তবে তাদের নাম তিনি জানেন না। শুধু জানেন, তারা লেখাপড়া জানা লোক। তারা সাধারণত ছদ্মনামে কাজ করতেন। তাদের বাড়ি কোথায় সেটাও ছিল অজানা।

সেদিন এনসান আলী মাতুব্বর তাদেরকে না খাইয়ে ছাড়েনি। তার মেয়ে কোহেতুর বানু অন্নপূর্ণার সখি লাগে। এই অবসরে দুজনে নীরবে নিভৃতে কথা বলল। আর কেঁদে ভাসল।

এরপর সেই রাতের অজানা লোকটির খোঁজ করা বৃথা।

অন্নপূর্ণাকে আর বিয়ে দিতে পারলেন না। বিয়ে দেওয়ার কথা শুনে অন্নপূর্ণা সাফ সাফ বলে দিল, অন্যত্র বিয়ে দিলে সে আত্মঘাতী হবে। বাবা-মা তাকে আর জোর করলেন না। চুপ করে থাকলেন। কেউ কিছু জানতে পারল না। তার বাবা-মা যতদিন বেঁচেছিল তাকে আদরে আদরে রেখেছেন। কিন্তু তারা মারা গেছেন। অন্নপূর্ণার বয়স বেড়েছে। দেশগাঁর পরিস্থিতি ভালো না। রামনাথ বহুদিন পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে সাপলেজা ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু অন্নপূর্ণা যাবে না। শুনে রামনাথ বিস্মিত হয়ে বলেছে, তোরে কই ফেলাইয়া যাবো রে দিদি?

অন্নপূর্ণা উত্তর দিয়েছে, সেই যুবক লোকটার বাড়িতেই থাকবে।

রামনাথ শুধালো, তুই তো তার নাম-ধামও জানিস না।

জানি। ছোট্ট করে উত্তর দিল অন্নপূর্ণা। বলল, আমি জানি।

জানিস! বিস্মিত হলো রামনাথ। বলল, তুই তাইলে এতোদিন কইস নাই ক্যান?


অন্নপূর্ণা এ প্রশ্নের উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে মাটি খুঁটতে থাকল। এতোকাল ধরে সে নামটি গোপন রেখেছে। তার ধারণা ছিল, যুবক লোকটি একদিন না একদিন নিজে থেকে আসবেন। সাপলেজা থেকে তাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবেন। সেটাই তার স্থায়ী ঠিকানা।

গত ২৬ বছরে তিনি আসেননি। তাতে তার কোনো খেদ নেই। আরো অপেক্ষা করতে পারে অন্নপূর্ণা। কিন্তু আজ রামনাথের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে সে একটু বিচলিত হয়েছে। মনে হলো এখন তার নিজেরই সন্ধানে নামা দরকার। আর অপেক্ষা করার সময় নেই।

অন্নপূর্ণা একটা কাগজ বের করে দেখিয়েছে রামনাথকে। সেটা একটা ডায়েরির পাতা। ডায়েরিটা সেই যুবকটির। যুবকটি ফেলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে লোকটি কিছু খেতে চেয়েছিল। কাকিমা গোটা কয়েক ঝালের পিঠে দিয়েছিলেন। যেতে যেতে মুখে দিয়ে তৃপ্তির স্বরে বলেছিল, আহ্।

সেদিন রাতে অন্নপূর্ণার মামা যখন যুবকটিকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল নিরাপদে গ্রাম থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য, তখন যুবকটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, সে তার ডায়েরিটা রেখে গেছে। সেটা নিয়ে যেতে হবে। সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা আছে।

যুবকটি নিজেই ডায়েরিটা আনতে ঘরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে অন্নপূর্ণার মামা আনতে গিয়েছিলেন। অন্নপূর্ণাই বিছানার পাশে ডায়েরিটা খুঁজে পেয়েছিল। মামার হাতে তুলে দিয়েছিল। দেওয়ার আগে আধো অন্ধকারে ডায়েরির একটা পাতা ছিঁড়ে রেখেছিল। সে পাতায় একটি নাম লেখা ছিল।

কি নাম? জিজ্ঞেস করলেন নরেশচন্দ্র।

পরেশচন্দ্র। রামনাথ উত্তর দিল। একটু বাঁকা করে লেখা।

দেখান তো সেই পাতাটি।

পাতাটি রামনাথের কাছে নেই। আছে অন্নপূর্ণার কাছে। রামনাথের সঙ্গে সাপলেজা থেকে রওনা করার আগে অন্নপূর্ণা পাতাটি সঙ্গে নিয়েছিল।

অন্নপূর্ণা তখনও দরোজাজুড়ে শুয়ে আছে। তার কাছে গিয়ে কাগজটি চাইল রামনাথ। অন্নপূর্ণা পোটলাটা খুঁজল। কিন্তু ডায়েরির ছেঁড়া কাগজটি পেল না। পোটলার মধ্যে না পেয়ে রামনাথ উঠোনে খুঁজল। পোটলাটি যখন লোকজন কেড়ে নিয়েছিল তখন হয়তো পড়ে গেছে। পড়ে গেলে উঠোনে থাকার কথা। কিন্তু সেখানেও পেল না। হতাশ হয়ে রামনাথ উঠোনেই বসে পড়ল। জানালা থেকে মণিমালা চেঁচিয়ে বলল, ওরা দেবতুল্য পরেশের সুনাম নষ্ট করতি আইছে। ওদের এক্ষুণি দূর কইরা দাও।

নরেশচন্দ্র সে কথায় কান দিলেন না। রামনাথকে বললেন, প্রমাণ ছাড়া তো কোনো দাবি মানা যায় না। তবে-

রামনাথ দেরী না করে জিজ্ঞেস করল, তবে?

তবে পরেশ যদি স্বীকার করে যে সে আপনার দিদিকে বিয়া করেছিল, বা বিয়া করার মতো কোনো ব্যাপার হইছিল তবে নিশ্চয়ই মেনে নেওয়া যাবে। পরেশ কখনো মিছে কথা বলার লোক নয়। তার মুখের কথাই প্রমাণ।


পরেশ মাস্টার কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়লেন। তিনি একা নন। সঙ্গে আরো কয়েকজন আছে। তাদেরকে দেখিয়ে নরেশচন্দ্র অন্নপূর্ণাকে জিজ্ঞেস করলেন, দেখান তো, এর মধ্যে সেদিনের সেই যুবকটি আছে নাকি?

অন্নপূর্ণা চোখ মেলে তাদেরকে দেখতে লাগল। ২৬ বছর আগেকার ঘটনা। রাত্রিবেলা। ঘরে আলো ছিল না। ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে তাকে দেখেছি কিনা, দেখে থাকলেও সেই মুখটিকে মনে করতে পারল না। মাথা নাড়ল।

নরেশচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, এখানে নাই?

আছে কিনা অন্নপূর্ণা জানাতে পারল না। তখন নরেশচন্দ্র অন্নপূর্ণাকে দেখিয়ে পরেশচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি একে চিনিস?

পরেশ মাস্টারের বয়স হয়েছে। মাথায় সামান্য টাকও পড়েছে। চোখে চশমা। সদা হাস্যময় মুখ। তবে অন্নপূর্ণাকে দেখে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, না, চিনি না। কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

রামনাথ জিজ্ঞেস করলেন, কালশিরায় তুই ১৯৪৯ সালে যাসনি?

পরেশ মাস্টার একটু ভাবলেন। পরে উত্তর জানাল, তিনি গিয়েছিলেন। তবে সেটা ১৯৪৯ সাল নয়। ১৯৪৮ সালে গিয়েছিলেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহের হাজং এলাকায় চলে যান। সেখানে টঙ্ক আন্দোলনে যোগ দেন। মণি সিংহ তাদের নেতা ছিলেন। কিছুদিন জেলও খেটেছেন।

এরপরে আর শালিস বৈঠকের প্রয়োজন হলো না। কোনো দাবিই প্রমাণ করা গেল না। এক্ষেত্রে লোকজন তাদেরকে কিছু বললও না। ছেড়ে দিল। অন্নপূর্ণার জন্য তারা সবাই এক ধরনের বেদনাই বোধ করতে লাগল।

রামনাথ কোনো কথা না বলে দিদির কাছে গেল। বলল, দিদি, চল।

অন্নপূর্ণা শোয়া থেকে উঠে পড়ল। দরোজা ছেড়ে দিল। তার সঙ্গে উঠে এলো। রামনাথের হাত ধরে কেঁদে পড়ল। বলল, ভাইরে। আমাকে ক্ষমা কইরা দে। আমার জন্য তুই এতো বড় অপমান হইলি।

রামনাথ দিদিকে এ রকম করে কখনো কাঁদতে দেখেনি। তার কান্না দেখে তার অপমান উবে গেল। তারা যাওয়ার জন্য রওনা করল। কিন্তু তখন আকাশে খুব মেঘ করেছিল। এই মেঘের চেহারা অন্য রকম। কালো নয়। ঘোলাটে। ভয়ঙ্করভাবে পাক খাচ্ছে। প্রবীণ মানুষ হারান মজুমদারের ভ্রু কুঁচকে গেল। এ রকম মেঘ দেখে তার প্রাণ কেঁপে ওঠে। তিনি রামনাথকে বললেন, এখনি রওনা হইও না বাপ। মেঘ দেইখা যাও।

রামনাথের দাঁড়াবার ইচ্ছে নেই। কিন্তু এর মধ্যে ঝপ করে বৃষ্টি নেমে পড়ল। শুধু বৃষ্টি হলে অসুবিধা হতো না। শিল পড়তে শুরু করল। প্রথম দিকে ছোট ছোট। তারপর বেশ বড় বড়। গাছে পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়লে লাগল। সেটা দেখে কেউ আর বাইরে থাকার সাহস পেল না। রামনাথ আর অন্নপূর্ণাকে হারান মজুমদার যেতে দিলেন না। কাচারি ঘরে ধরে নিয়ে এলেন। বললেন, তাদের লঞ্চ অপরাহ্নবেলায়। তার বাড়িতে খেয়ে তারপর যাবে। তিনি নিজে লঞ্চ ঘাটে যাবেন। এর মধ্যে আকাশ ঠিক হয়ে যাবে।


বৃষ্টি ও শিল পড়া থেমে গেল। আকাশটা রক্ত বর্ণ ধারণ করল। গাছ থেকে কা কা করতে করতে এক ঝাঁক কাক পালিয়ে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ রাখার মতো চারিদিকে স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর ঘূর্ণি বাতাস শুরু হলো। গাছপালা ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। হাওয়ায় টিন ঝনঝন করতে লাগল। কাচারি ঘরে থাকা নিরাপদ নয় বলে পরেশচন্দ্র ছুটে এলেন। কাচারি ঘর থেকে হারান মজুমদারসহ রামনাথ ও অন্নপূর্ণাকে বড় ঘরে যেতে বললেন। রামনাথ কিছুটা ইতস্তত করছে দেখে হারান মজুমদার বললেন, প্রাণ বাঁচানো এখন বড় ধর্ম। তখনও রামনাথ আর তার দিদি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে পরেশচন্দ্র দেরী করার সাহস পেলেন না। তিনি অন্নপূর্ণার হাত ধরে বললেন, আসেন।

অন্নপূর্ণা সেই ঝড়ের মধ্যে ভাইয়ের দিকে তাকাল না। সে পরেশচন্দ্রের হাত ধরে বড় ঘরেই চলে এলো।

বড় ঘরটা বেশ বড়ই। দোচলা। দুটো বড় বারান্দা আছে। মণিমালার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে অন্নপূর্ণা সিঁড়ির কাছে একা বসে রইল।

ঝড়ের গতি থামল না। কাচারি ঘরটা কাগজের মতো উড়ে গেল। একটা পুরনো আমগাছ ভেঙ্গে পড়ল বড় ঘরটির উপর। ঘরটি টিকে থাকতে পারল না। অনেকটাই ভেঙে পড়ে গেল।

নরেশচন্দ্রের এক পায়ের উপরে একটি খুঁটি পড়েছিল। মণিমালাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। রামনাথ এ ঘরে ঢোকেনি। বাইরে থেকে গিয়েছিল। তাকে হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়েছিল। তাকে পরে অচেতন অবস্থায় নদীর অন্য পাড়ে পাওয়া যায়। হারান মজুমদার মারা গিয়েছিলেন। তবে পরেশচন্দ্র অক্ষত ছিলেন। ঝড় থামলে উদ্ধার কাজে নেমে পড়লেন।

মণিমালার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তিনি চৌকির নিচে ছিলেন। চৌকির উপর সিঁড়িটা কাত হয়ে আছে। তাকে বের করতে গেলে সিঁড়িটা ভেঙে পড়ে যেতে পারে। একটু সাবধানে কাজটি করতে হবে। একা করা যাবে না। ততক্ষণে মণিমালার আর্ত চিৎকার এতো প্রবল হলো যে, দেরি করার জো নেই। পাড়ার সবার বাড়ি ঘরের একই অবস্থা। কাউকে ডাকার আগে পরেশচন্দ্র নিজেই চৌকিটা তুলতে গেলেন। তাতে সিঁড়িটা নিচের দিকে আরো চেপে বসল। আহ্ করে একটি নতুন কণ্ঠ শুনতে পেলেন। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, অন্নপূর্ণার গায়ের উপরে সিঁড়িটা পড়েছে। একটু নাড়া পড়লেই তার গায়ে আরো চাপ লাগে। সে পলকহীন চোখে পরেশচন্দ্রের দিকে চেয়ে আছে। তাকে সিঁড়ির নিচ থেকে আগে উদ্ধার করা সহজ।

তবে কাজটি একা করা যাবে না। লোকজন লাগবে। তিনি লোকজন ডাকতে যাবেন বলে ঘর থেকে বের হতে গেলেন তখনই মণিমালা চেঁচিয়ে বললেন, আমারে কি মাইরা ফেলতি চাও নাকি?

পরেশচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কি করব বৌদি?

মণিমালা বললেন, আগে আমারে বাইর করো।

তখন পরেশ মাস্টার চৌকিটা সরিয়ে মণিমালাকে বের করলেন। সিঁড়িটা আরো চেপে বসে গেল। কোনো শব্দ শোনা গেল না।

সেদিন ভোর রাতের দিকে সিঁড়ির নিচ থেকে অন্নপূর্ণাকে বের করা হলো। তাকে বাইরে হোগলার চাটাইয়ের পরে যখন নামানো হয় তখন তার চোখ দুটি খোলাই ছিল। আর তার হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা ছিল একটি ছোট পুরনো কাগজ। কাগজটি পরেশ মাস্টার খুলে নিলেন।

একটু তফাতে গিয়ে তিনি কাগজটি পড়লেন। লেখা :

Communists must be ready at all times to stand up for the truth, because truth is in the interests of the people; communist must be ready at all times to correct their mistakes, because mistakes are against the interests of the people.

-Karl Marx. selected works, vol iv, p-315

নিচে তারিখ লেখা: 2nd December 1949. Kalshira. Mollahat, Bagerhat. P.B

পি অক্ষরের মধ্যে একটা ফোঁটা। পরেশ মাস্টার এখনো এই রকম করে স্বাক্ষর দেন। একটুও বদলায়নি। পৃষ্ঠা নং দেওয়া আছে। এক পিঠে ৩৯ এবং অন্য পৃষ্ঠায় ৪০।

ঘরের মধ্যে পরেশ মাস্টারের একটি পুরনো ট্রাঙ্ক ছিল। সব কিছু ফেলে ট্রাঙ্কটি খুঁজে বের করলেন। সেটার মধ্যে তার কিছু কাগজপত্র আর পুরনো ডায়েরি রাখা আছে। তিনি বের করলেন ১৯৪৯ সালের ডায়েরি। দেখতে পেলেন, ৩৭-৩৮ পৃষ্ঠা আছে। ৪১-৪২ পৃষ্ঠা আছে। এই দুই পাতার মধ্যে একটি পাতা নেই। কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়