ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

টেক্সাসান জীবন থেকে : ১৫তম পর্ব

দিলরুবা আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২২, ৬ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টেক্সাসান জীবন থেকে : ১৫তম পর্ব

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

দিলরুবা আহমেদ : এক ডলার দেন যে আংকেল উনাদের বাসায় যাবে কি মা আজকে? প্রশ্নটা আমার মেয়ের। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হয়ে আসার পর কোথায় কোথায় কার কার বাসায় আগে বা পরে যাব সেই আলোচনা আর ভাবনাটা করতেই শুমাইসা জানতে চাইল তার ডলার আংকেলের কথা।

ছোট বেলায় ঈদের দিনে ঐ আংকেলের বাসায় গেলেই সে পেয়েছে একটি করে ডলার। ছোট্ট শুমার কাছে তাই ছিল যক্ষের ধন। স্মৃতির ধনে ধনবতী হয়ে শুমাও এত বছর পরে মনে রেখে জানতে চাইছে তার সেই আংকেলের কথা। আর ঐ ভাই সবসময়ই প্রবাসী বাচ্চা বাহিনীকে দিয়ে এসেছিলেন ঈদী, বয়স ভেদে ১, ২, বা ৫টি ডলার, জানাতে শিখাতে আমাদের দেশে নামাজ শেষে পা ধরে সালাম করে মুরব্বীদের কাছ থেকে আমরাও পেয়েছি এত্ত এত্ত টাকা। মুঠো মুঠো ঈদী, সালামি আর আনন্দময় এক গাল হাসি। বুঝলাম ওনার ঈদী প্রথাকে জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। না হলে আমার মেয়েইবা প্রায় ১০/১২ বছর পরে আজ এক ঈদের সকালে ওনাকে মনে করছে কেন?

বাড়ি কিনে আমরাও যেমন চলে এসেছি উনিও অন্য কোথাও বাড়ির বাসিন্দা হয়ে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের বাচ্চাদের সাক্ষাৎ  পান না এখন আর। আমাদের বাচ্চারা পায় না উনাকে খুঁজে।  

এদেশে অযাচিতভাবে যাওয়া যায় না কারও বাসাতেই। কেউ  ডাকলে, সময় দিলে, অপেক্ষার আশ্বাস দিলে তবেই যাওয়া হয়।  তাই যখন তখন দেখার সুযোগ নেই। তবে আমার ভাল লাগলো শুমাইসার এই মনে পড়াটা। ভালই স্মৃতি তৈরি করেছেন উনি আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মাঝে।

আমাদের এই প্রবাস জীবনে এই তো আমরা করি। খুব সচেতন বা অচেতন মনে স্মৃতিরই রোমন্থন করি। সেই সাথে স্মৃতি তৈরি  করে শিশুর মানসপটেও ভরে দিতে চাই সেই হারানো কথা, সংস্কৃতি, শৈশব স্মৃতি দিয়ে যা ছিল একান্তই আমাদের। উত্তরাধিকার দিয়ে যেতে চাই যেন। মাটি ছেড়ে এসেছি অথচ রয়ে গেছে মাটির টান। এবং তা রয়েছে প্রচণ্ডভাবেই। প্রচণ্ড নিনাদে। আমাদের এই প্রবাস জীবনে খুঁজে খুঁজে বার করি অতীতকে। যখন দেশে ছিলাম কবে কি করেছি ঐ ঈদে ঐ চাঁদে আনন্দে উৎসবে।

সত্যি বলছি, তাই করি।

আসলে আমাদের সংস্কার সংস্কৃতি আমাদেরই সাথে সাথে ঘোরে। কাছে আসে, কাছে থাকে, পাশে বসে থাকে, ফেলে রেখে আসা হয় না কোথাও, মহাবিশ্বের সব কোনেই ঘরের ভেতর ঘর স্টাইলে গড়ে তুলি লিটল বাংলাদেশ। নতুন ভুবনে আপনকে আপনাকে বপন করার আপ্রাণ চেষ্টা থাকে। ঈদ এলেই তাই ফিরে আসে জর্দা পায়েস এর সুগন্ধ দারুণ এক আবেগ আর ভালবাসা নিয়ে। আমার শিশুকাল থেকে না পছন্দের খাবার জর্দা পায়েস ফিরনি অথচ ঈদ এলেই তা পরম মমতায় শুমাইসার মুখের কাছে তুলে ধরি যেন অতি সুখাদ্য।

যখন অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম তখন ঐ কমপ্লেক্সের মোটামুটি সবকটা  বাংলাদেশির বাসাতেই সবার ঈদ যোগাযোগ থাকত দুই কদম ফেলে এ বাড়ি ও বাড়ি আসা যাওযায়। এখন বাড়ি কেনাতে হাত বাড়িয়েই পাশের বাসায় কাওকে পাওয়া যাচ্ছে না যে  একসাথে দেশীয়, মুসলমান এবং বন্ধুও। তবে যা আমরা করি তা হলো কোন একজনের বাসায় মিলিত হই সবাই নামাজ শেষে। ব্রাঞ্চ (Brunch)  করা হয়। রাতে হয়তোবা অন্য কোনো গ্রুপের  ডিনার পার্টিতে অন্য কোনো গ্রুপের বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। এখানে মানুষের মাঝে অনেক গ্রুপ আছে। দল উপদল। ছোট দল। বড় দল। স্মার্ট দল। হা হা, ইয়া, গাইয়া দলও আছে। অস্বাভাবিক বা খারাপও বলার নেই একে। স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছে এগুলো। আছে ডালাস এলাকাভিত্তিক বন্ধুত্ব। মন মানসিকতাভিত্তিক বন্ধুত্ব। বাংলাদেশের জেলাভিত্তিক দলও আছে , বন্ধুত্বও। মানুষ দেখা হলেই দেখেছি জানতে চায় দেশ কোথায়। কতদূরে চলে এসেছি দেশ ছেড়ে। এখন দেশ বলতে তো বাংলাদেশ। তারপরও সবাই জানতে চায় কোন জেলা, কোন গ্রাম , কোন থানা। আমি যদি শেরপুর বলি তাতেই বা কি মন্দ বের হবে আর টাঙ্গাইল বললে কার আপন হয়ে যাব জানি না, ফেনীতেও কোনো অসুবিধা নেই, মাদারীপুরেও না। আমার কাছে ডিসটিকালিজম প্রাধান্য না পেলেও সব সময়ই মানুষ এটিই জানতে চায় দেখেছি।

আরেকটি বিষয় প্রায়ই জানতে চাইবে সেটা হচ্ছে, কোন সালে এসএসসি পাস করেছি। মুখ বাকিয়ে বলতে চাইলে বলা যায় এটা বয়স বের করবার একটা ফন্দি ফিকির পন্থা, কিন্তু বলা যাবে না কারণ কি ভদ্রভাবে জানতে চাওয়া হচ্ছে লেখাপড়ার সাথে যুক্ত করে। যদি বলে বসি পড়ি নাই জীবনেও, কখনোও, তখন !! এখন ভাবছি আগামীতে তাই করবো। আপনার থেকে কেউ  যদি দুদিনেরও ছোট হতে পারে তবে তার আনন্দের সীমা থাকবে না। ওদিকে যে ক অক্ষর গো মাংস তার খবর নেই। কিংবা আচ্ছা, যাই হোক, বাদ দিন পরচর্চা, আমার আসে না। এ ছাড়াও রয়েছে সমবয়সী বাচ্চাভিত্তিক বন্ধুত্ব। কর্ম ও পেশাভিত্তিক বন্ধুত্ব। সবারই আবার একাধিক উপদলের সাথে যোগাযোগ থাকে।

এক বাসা থেকে যে কজনা বন্ধুর বাড়িতে বুড়ি ছু করা যায় বলা যায় তারই একটা দৌড় শুরু হয় সকাল থেকে। তবে শুধু তাদের বাসাতেই যাওয়া হয় আগেই বলেছি যারা বলে দেন উনাদের বাসায় যাবার জন্য। অন্যরা হয়তো বা বেড়াচ্ছেন বা অফিস করছেন। সকালে নামাজ পড়েই অনেকে মসজিদ থেকে অফিস চলে যান। মসজিদে ঢোকার সময়ই সবার হাতে একটা করে পলিথিনের ব্যাগ ধরিয়ে দেন ভোলানাটিয়ার ভাই বা বোনেরা। বিভিন্ন দেশীয় তারা। রং বর্ণ, গোত্র, ভাষা ভিন্ন, মিল শুধু ধর্মের, ঐ বন্ধনে মসজিদে দেখা মিলে ঐ ধরনের বহু ভাই বোনের। মসজিদের বিবিধ কাজে তারা স্বেচ্ছায় শ্রম দেন। তাদের দেওয়া ব্যাগের ভেতর জুতা ভরে যে যারটা সাথে রাখে। জুতা রাখবার জন্য আলাদা করে থাকে থাকে র‌্যাকও তৈরি করা আছে কমবেশি সব মসজিদেই।

এখানে ডালাস এ অধিকাংশ মসজিদই দোতলা। ওপরের তলাটা মহিলাদের জন্য বরাদ্দ থাকে বলা যায়। লেন্ডা পোণ্ডা আন্ডা বাচ্চার মায়েদের জন্য বিশেষভাবে আলাদা করা একটা রুম থাকে যাতে তারা আরাম করে একসাথে বসতে পারে আর তাদের বাচ্চাদের কাকা কুকু যেন অন্যদের বিরক্ত না করে। কিন্তু কোথায় কি? প্রায়ই দেখি ঐ রুম এতই ভর্তি থাকে যে বাচ্চা ওয়ালা মা-রা পুরো মহিলাদের এলাকায় সর্বত্র যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। তবে আমার দেখতে খুবই সুন্দর লাগে ফুটফুটে বাচ্চাগুলো চারদিকে সুন্দর সুন্দর পাজামা পাঞ্জাবি, সেলোয়ার কামিজ পরে অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছে এত ধরনের এত রঙের মানুষের সমাহার।

সবাই আসে যার যার দেশীয় ধাঁচে। সাজও তাই বিবিধ। বাচ্চাগুলো অবাক চোখে দেখছে বিভিন্ন ধরনের সাজের মানুষ। এবার মসজিদে ঈদের দিনে আমার হাতে ছিল গোল একটা পার্স। সোনালী রঙের। তিন চারটা পর্তুগীজ তিন-চার বছরের বাচ্চা গোল হয়ে তার পাশে বসে পড়লো। নড়েও না, চড়েও না। ধরেও না। ওরা জানে অন্যের জিনিষ ধরা নিষেধ। কিন্তু এত সুন্দর সোনালি বল ছেড়ে যায় কিভাবে? থেকে থেকে আমার দিকেও চাইছে। আমিও দেখলাম নয়নজুড়ে শিশুতোষ নির্মলানন্দের মিছিল। নামাজ শুরু হতেই মাগুলো বাচ্চাগুলোকে টেনে নিয়ে গেল। গেল তারা চলে তবে দেখলাম ঘুরে ঘুরে তারা দেখছে আমার ব্যাগটাকে। কি সুন্দর এই মানব শিশুরা।

একটু পরেই দেখলাম বড় সাইজের কিছু বাচ্চা ছোট ছোট পা ফেলে সবার মাঝে ঘুরে বেড়াতে লাগালো দান বাক্স নিয়ে। ফিতরার টাকা নামাজ শুরুর আগেই দান করতে বলা হচ্ছে মাইকে। বাক্সগুলো অল্প সময়েই ভরে যাবে জানি। ১০ ডলার করে জনপ্রতি এ বছরের ফিতরা। নামাজ শুরুর আগেই দেখলাম সবাই হাত ভরেই ডোনেট করছে। যাদের টাকা আছে বলে জানি এদেশে দেখেছি তাদের দুহাত ভরেই দান করতে। বিশেষ করে রোজার মাসে যে হারে ইফতারি পাঠানো হয় মসজিদে তা অভাবনীয়। আমিও বহু বছর ধরে শুনে এসেছিলাম মসজিদে ইতফারির পার্টটা দর্শনীয়। এবারই প্রথম বারের মতন লুৎফর ভাই ও ভাবীর আগ্রহে এত বছরের প্রবাস জীবনে মসজিদে ইফতারি করলাম দুদিন। যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। শয়ে শয়ে মানুষ পাশপাশি বসে এত সুন্দর ও উন্নত ব্যবস্থাপনায় ইফতারি করছে যা খুবই প্রশংসনীয়। ইফতারি বাক্স নিয়ে সবাই অবশ্যই ফ্লোরে গালিচা বা চাদরের ওপরে লাইন ধরে বসছে। সাথে থাকছে পানির বোতল। মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়তে আসা মাত্রই সবাইকে খোরমা আর একটা করে বোতল ধরিয়ে দেওয়া হয়। খতমে তারারি যারা পড়েন তারা প্রতিদিনই মসজিদে নামাজে আসেন, ইফতারি করেন তারা, এশা আর তারারি পড়ে গভীর রাতে বাড়ি ফেরেন। খুবই পবিত্র মনোমুগ্ধকর একটি ব্যবস্থা।

চলবে...




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জুলাই ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়