ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

রতনের বিপরীতে একটি কথা

প্রশান্ত মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১২, ৬ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ১৭:১১, ৮ মে ২০২১
রতনের বিপরীতে একটি কথা

১২৯৮ (?) এ লেখা গল্প ‘পোস্টমাস্টার’। গল্পের শেষে উল্লিখিত সালে প্রথম বন্ধনীতে একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন আছে। গল্পগুচ্ছে পাওয়া সাময়িক পত্রে প্রকাশের সূচি অনুযায়ী ‘পোস্টমাস্টার’ সপ্তম আর গল্পের শিরোনামের ধারাবাহিকতা থেকে ১২৮৪-র শ্রাবণ-ভাদ্রে, আশ্বিন ১২৮৪-ভাদ্র, ১২৮৫-তে প্রকাশিত ‘ভিখারিণী’ ও ‘করুণা’ এবং ‘মুকুট’-কে বাদ রাখলে চতুর্থ। এ সময় আধাযুগের বিরতি। কার্তিক ১২৯১-তে ভারতীতে প্রকাশিত হয় ‘ঘাটের কথা’, অগ্রহায়ণ ১২৯১-র নবজীবনে ‘রাজপথের কথা’, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১২৯২-এ বালকে ‘মুকুট’। এরপর আবার আধাযুগের বিরতি। ১২৯৮-এ হিতবাদীতে প্রথমে বের হয় ‘দেনাপাওনা’ এরপর ‘পোস্টমাস্টার’; একে একে ‘গিন্নি’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ব্যবধান’ ‘তারাপ্রসন্নের কীর্তি’। বাজারচলতি অখণ্ড গল্পগুচ্ছে ‘ভিখারিণী’, ‘করুণা’ আর ‘মুকুট’ পরিশিষ্ট ২-এ ‘অচলিত পুরাতন রচনার সংকলন’-এ জায়গা পেয়েছে বইয়ের শেষে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৪-তে প্রকাশিত ‘ছোটগল্প’ নামে রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প সংকলনেও ওই তিনটি গল্প বাদ।

এটা পোস্টমাস্টারের প্রকাশসংক্রান্ত মোটা দাগে হিসেব। এই হিসেব এদিক-ওদিক মিলিয়ে নিলে, ওই ‘পোস্টমাস্টার’র কাল রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্বের গল্প লেখার উত্তুঙ্গ সময়; হিতবাদীর কাল সেটি। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ একটানা, প্রায় এক টানেই, কয়েক সপ্তাহে লিখেছেন, একটানা কয়েকটি গল্প (গ্রন্থ পরিচয়, গল্পগুচ্ছ)।

‘‘সাধনা বাইর হইবার পূর্বেই হিতবাদী কাগজের জন্ম হয়।... সেই পত্রে প্রতি সপ্তাহেই আমি ছোটোগল্প সমালোচনা ও সাহিত্য প্রবন্ধ লিখতাম। আমার ছোটোগল্প লেখার সূত্রপাত ঐখানেই। ছয় সপ্তাহ কাল লিখিয়াছিলাম।...

‘ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস ‘রবীন্দ্র-রচনাপঞ্জি’তে (শনিবারের চিঠি, চৈত্র ১৩৪৬) লিখিয়াছেন: হিতবাদীর ফাইল পাই নাই, সুতরাং কোন তারিখে কোন গল্প প্রকাশিত হয় বলিতে পারিতেছি না। তবে নিম্নলিখিত গল্পগুলি প্রথম ছয় সপ্তাহে বাহির হয়- দেনা-পাওনা, পোস্টমাস্টার, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, তারাপ্রসন্নের কীর্তি, ব্যবধান, গিন্নি।’

‘পোস্টমাস্টার’ গল্প যে হিতবাদীতে প্রকাশিত হইয়াছিল, চন্দ্রনাথ বসু রবীন্দ্রনাথকে লিখিত এক পত্রে (২৫ পৌষ, ১২৯৮) তাহার উল্লেখ করিয়াছেন। ছিন্নপত্রে (২৯ জুন, ১৮৯২) রবীন্দ্রনাথও এই গল্পটির হিতবাদীতে প্রকাশ উল্লেখ করেন।’’

এ যেন সেই জোর আর জোড়কলমের টান, যে টানে প্রায় একই সময়ে, মাত্র ছয় সপ্তাহে লিখে ওঠা যায় প্রতি সপ্তাহে অমন এক-একখানি গল্প! আর তাতে একই দিকে সূচিত হলো রবীন্দ্রগল্পের কাল, হিতবাদী কারণে; অন্য দিকে, বাংলা ছোটোগল্প ওই ছয় সপ্তাহে প্রায় একটানে সৃষ্টিশীলতার সেই সিঁড়িতে চেপে বসল যেখান বাংলা গল্পকে আর কোনও ক্রমে কোনও দিনও নামা হলো না। যেন, এক রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ছোটোগল্প সেই ভরসা পেল, যে ভরসায় বাংলা ছোটোগল্পের ওই হয়ে গেল প্রায় স্থিরীকৃত মান, যে মান থেকে বাংলা গল্পের চ্যুতিতে সে-কথা ভেসে আসে- গল্পটি হলো না, দাঁড়াল না। এই ছিল পহেলা দিক; একইসঙ্গে রবীন্দ্রগল্পের, রবীন্দ্র-সাহিত্যের সোনার তরী-কাল; এক অর্থে রবীন্দ্র-বিশ্বের হয়ে ওঠার কাল; অন্য অর্থে, কালের শুরু। সম্প্রতি শঙ্খ ঘোষের একটি লেখায় এই কালের উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ভালোবাসা/ এ কী লাবণ্যে পূর্ণপ্রাণ’। এই সময়ে লিখিত গল্প, ‘পোস্টমাস্টার’।

ওদিকে ব্রিটিশ শাসন তখন উত্তুঙ্গ: কলকাতা রাজধানী আর রবীন্দ্রনাথকে পৈতৃক জমিদারী তদারকিতে চলে যেতে হচ্ছে কলকাতা থেকে উত্তর-পূবে, আজকের বাংলাদেশের পশ্চিম-মাঝামাঝিতে নদী ত্রিকোণবিস্তারী শিলাইদহ-পতিসর-শাহজাদপুরে। এই নৌভ্রমণসম্পন্নতায় বাংলার এই অংশের মানুষের প্রকৃতির যে যাপনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটল, তারই খণ্ড খণ্ড এদিক-ওদিক মিলিয়ে রূপ হয়ে দাঁড়াল গল্পগুচ্ছের প্রখম দুই খণ্ড। অন্তত সেই অংশ পর্যন্ত যতদিন তিনি এই নদীকূলে ছিলেন, পৈতৃক জমিদারি তদারকির চাপ ছিল, দায়িত্বের প্রশ্ন ছিল, সেই প্রশ্ন মেলাতে এই তিন খণ্ড ভূমির মানুষ দেখেছেন- সেই দেখায় গল্পগুচ্ছের পৃষ্ঠা ভরে উঠেছে, সেই ভরে ওঠায় যে দাগগুলো তাও যেন একটানে নিজের জীবনের এই অংশের সঙ্গে এই সময়কার কবিতায়, গানে আর গল্পে মিলিয়ে নেওয়া যায়। তখন ঔপনিবেশিক ভারতে কলকাতা তার মস্তিষ্কের আরেক উপনিবেশ, কলকাতার জীবনে যে উপনিবেশ তা ব্রিটিশ মহারানির, সেখান থেকে এই শিলাইদহে তার জীবনের যে বিস্তার তা উপনিবেশ-কলকাতার। একটার পিঠে একটা। রবীন্দ্রনাথ তার অংশ ভাগ করছেন ভাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে চিঠি লিখে। সেই চিঠিতে প্রবল ব্যক্তিগতায় মিলেমিশে আছে, ঔপনিবেশিক শাসনে বিধ্বস্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতাপে সামন্তচরিত্রের এক জমিদার তনয়ের হয়ে উঠবার কালের প্রতিরূপ। যার পেষণজর্জর সকল চিত্রকল্প রবীন্দ্রনাথ জানেন, জানেন বলেই ঐ চিঠিপত্রের একান্ততায় তিনি বারংবার হামলে পড়েন নিজেকে নিয়ে। দেখা যাচ্ছে এই হামলে পড়ার যে অতীত ইতিহাস আছে বা থাকে- সেখান থেকে সরে আসতে চাইলেও মগজের দুই উপনিবেশ তাকে কোনওভাবে রেহাই দিচ্ছে না। ফলে, এক জলবেষ্টিত, ভ্রমণসম্পন্ন নিঃসঙ্গ মানচিত্রে দুই উপনিবেশের জটিল চাপে রবীন্দ্র-চিঠির ঐ অংশগুলো হয়ে উঠেছে আত্মজীবনীর অন্য নাম; একই সঙ্গে ঐ আত্মজীবনী ব্যক্তিগত, সামগ্রিক, জটিল, ক্লান্ত আর অবশ্যই উপনিবেশবিরোধী আর গল্পগুচ্ছের সহজ পাঠ।

ছিন্নপত্রাবলী, ১৫.০৮.১২৯৬ : ২৯ নভেম্বর ১৮৮৯। শিলাইদহ :

... শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর- ধু ধু করছে- কোথাও শেষ দেখা যায় না- কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায় আবার অনেক সময় বালিকে নদী বলে ভ্রম হয়- গ্রাম নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই- বৈচিত্র্যর মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি- পূর্বদিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে অনন্ত পাণ্ডুরতা, আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূন্য, নীচে দরিদ্র শুস্ক কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূন্যতা। এমন তর desolation কোথাও দেখা যায় না। আর এই ক্ষণপরিসর নদী আর এই দিগন্ত বিস্তৃত চর আর ওই ছবির মতন পারাপার- ধরণীর এই উপেক্ষিত একটা প্রান্তভাগ এই বা কী বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠশালা! যাক। এ কথাগুলো রাজধানীতে অনেকটা ‘পৈট্রি’র মতো শুনতে হবে, কিন্তু এখানকার পক্ষে কথাগুলো কিছুমাত্র বেখাপ নয়।

এই চিঠি পর্যন্ত এই পর্বের গল্পগুলো লিখতে শুরু করেননি রবীন্দ্রনাথ। ‘বর্ষাযাপন’-এ তাই আরও কিছুদিন বাকি। অথচ বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠশালায় প্রবেশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি’তে করে এই যে বোটের উপর এসে উঠেছেন শিলাইদহে, যে জীবন কলকাতায় ‘পৈট্রি’র মতন- এই উপনিবেশের ভিতরকার মানস ও রাজনৈতিক উপনিবেশ প্রবেশমাত্র তার যাপনের ইতহাস বদলে যেতে শুরু করছে:

‘জগতের শত শত           অসমাপ্ত কথা যত,

       অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,

অজ্ঞাত জীবনগুলো             অখ্যাত কীর্তির ধুলা,

      কত ভাব, কত ভয় ভুল-

ফলে, যে ভাবনায় ‘বর্ষাযাপনে’ (১৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯) ব্যস্ত রবীন্দ্রনাথ, সোনার তরী পর্বে, সেই সময়ে এর এক বছর পরে এই গল্প লেখার কথাই এইসব কবিতায় সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে জানাচ্ছেন তিনি ছিন্নপত্রাবলীতে (৩০ আষাঢ় ১৩০০ : ১৩ জুলাই, ১৮৯৩) :

আজকাল কবিতা লেখাটা আমার পক্ষে যেন একটা গোপন নিষিদ্ধ সুখ-সম্ভোগের মতো হয়ে পড়েছে- এদিকে আগামী মাসের সাধনার জন্যে একটি লাইন লেখা হয়নি, ওদিকে মধ্যে মধ্যে সম্পাদকের তাড়া আসছে, অনতিদূর আশ্বিন-কার্তিকের যুগল সাধনা রিক্ত হস্তে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনা করছে, আর আমি আমার কবিতার অন্তঃপুরে পালিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছি।... আমি বাস্তবিক ভেবে পাইনে কোনটা আমার আসল কাজ। এক এক সময় মনে হয়-আমি ছোটো ছোটো গল্প অনেক লিখতে পারি এবং মন্দ লিখতে পারি নে- লেখবার সময় সুখও পাওয়া যায়। এক এক সময় মনে হয় আমার মাথায় এমন অনেকগুলো ভাবের উদয় হয় যা ঠিক কবিতায় ব্যক্ত করার যোগ্য নয়, সেগুলো ডায়ারি প্রভৃতি নানা আকারে প্রকাশ করে রেখে দেয়া ভালো, বোধ হয় তাতে ফলও আছে আনন্দও আছে। এক-এক সময় সামাজিক বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের লোকের সঙ্গে ঝগড়া করা খুব দরকার, যখন আর কেউ করছে না তখন তো কাজেই আমাকে এই অপ্রিয় কর্তব্যটা গ্রহণ করতে হয়। আবার এক-এক সময় মনে হয়, দূর হোক তা ছাই, পৃথিবী আপনার চরকার তেল দেবে এখন- মিল করে ছন্দ গেঁথে ছোটো ছোটো কবিতা লেখাটা আমার বেশ আসে, সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে আপনার মনে আপনার কোণে সেই কাজই করা যাক।

এই পর্যন্ত এই সমস্ত কাজের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে সামাজিক কর্তব্য করে, ঝগড়া করে, কবিতার ফাঁকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন পয়ত্রিশটি গল্প। রবীন্দ্রগল্পের প্রধান গল্পগুলো এই দুই বছর লিখিত; আর এর পরে একটু বিরতিসহ ১৩০২ পর্যন্ত চলবে প্রায় অবিচ্ছিন্ন।

যে ১২৯৮-তে লেখা হয়েছিল ‘পোস্টমাস্টার’ অর্থাৎ ১৮৯২’র গোড়ার দিকে হয়তো-বা, এর মাসছয়েক আগে, ওই শাহজাদপুর থেকে জুনে লেখা এক চিঠিতে এক অদ্ভুত স্বপ্নের কথা ইন্দিরা দেবীকে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছাপায় বাজারচলতি ছিন্নপত্রাবলীর দুই পৃষ্ঠা সেই চিঠি (পত্র ২৫)। সেইখানেই আছে এক অন্যতর কলকাতার কথা :

‘কাল রাত্তিরে ভারী একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলুম। সমস্ত কলকাতা শহরটা যেন মহা একটা ভীষণ অথচ আশ্চর্য ভাবের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে- বাড়িঘর সমস্তই একটা অন্ধকার কালো কুয়াশার ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে- এবং তার ভিতর তুমুল কী একটা কাণ্ড চলছে। আমি একটা ভাড়াটে গাড়ি করে পার্ক স্ট্রিটের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি- যেতে যেতে দেখলুম সেন্টজেভিয়ার কলেজটা দেখতে দেখতে হু হু করে বেড়ে উঠেছে- সেই অন্ধকার কুয়াশার মধ্যে অসম্ভব উঁচু হয়ে উঠেছে। তার পরে ক্রমে জানতে পারলুম এক দল অদ্ভুত লোক এসেছে, তারা টাকা পেলে কী এক কৌশলে এইরকম অপূর্ব ব্যাপার করতে পারে। জোড়াসাঁকোর বাড়ি এসে দেখি সেখেনেও তারা এসেছে- বদ দেখতে, কতকটা মোঙ্গোলিয়ান ধাঁচের চেহারা- সরু গোঁফ, গোটা দশ-বারো দাড়ি মুখের এদিক ওদিক খোঁচা খোঁচা রকম বেরিয়েছে। তারা মানুষকেও বড়ো করে দিতে পারে। তাই আমাদের দেউড়িতে আমাদের বাড়ির সব মেয়েরা লম্বা হবার জন্যে উমেদার হয়েছেন- তারা এঁদের মাথায় কি একটা গুঁড়ো দিচ্ছে আর এঁরা হুঁশ করে লম্বা হয়ে উঠছেন। আমি কেবল ওই বলছি, কি আশ্চর্য, এ যেন ঠিক স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। তার পরে, কে একজন প্রস্তাব করলে আমাদের বাড়িটা উঁচু করে দিতে। তারা রাজি হয়ে বাড়ি কতকটা ভাঙতে আরম্ভ করলে। খানিকটা ভেঙেচুরে বললে, ‘এইবার এত টাকা চাই, নইলে বাড়িতে হাত দেব না।’ কুঞ্জ সরকার বললে, সে কি হয়, কাজ না হয়ে গেলেই কি করে টাকা দেওয়া যায়। বলতেই তারা চটে উঠল- বাড়িটা সমস্তই একরকম বেঁকেচুরে বিশ্রি হয়ে গেল এবং মাঝে মাঝে দেখা গেল আধখানা মানুষ দেওয়ালের মধ্যে গাঁথা রয়েছে, আধখানা বেরিয়ে। সমস্ত দেখে শুনে মনে হল এসব শয়তানী কাণ্ড। বড়দাদাকে বললুম, ‘বড়দা, দেখছেন ব্যাপারটা! আসুন একবার উপাসনা করা যাক।’ দালানে গিয়ে খুব একাগ্রমনে উপাসনা করা গেল। বেরিয়ে এসে মনে করলুম ঈশ্বরের নাম করে তাদেও ভর্ৎসনা করব কিন্তু বুক ফেটে যেতে লাগল, কিন্তু তবু গলা দিয়ে কথা বেরোল না। তারপর কখন জেগে উঠলুম ঠিক মনে পড়ছে না। ভারি অদ্ভুত স্বপ্ন, না? সমস্ত কলকাতা শহরে শয়তানের প্রাদুর্ভাব- সবাই তার সাহায্যে বেড়ে উঠার চেষ্টা করছে, একটা অন্ধকার নারকী কুজ্ঝটিকার মধ্যে সমস্ত শহরের ভয়ঙ্কর শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু ওর মধ্যে একটু পরিহাসও ছিল- এত দেশ থাকতে জেসুয়িটদের ইস্কুলটার উপরেই শয়তানের এত অনুগ্রহ কেন?

এ বড় অদ্ভুত স্বপ্ন। নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের পরও, আরও পরে দেখা এই স্বপ্ন। ফেলে আসা কলকাতাকে নিয়ে। ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়ও নয়। ‘কল্পনা’ স্বপ্ন বহু দূরে। এখানে কোনও নির্দিষ্ট প্রাণের পরে কেউ বসে নেই, বসবার কোনও আকৃতি নেই হয়তো, কিন্তু এই স্বপ্নে ভাঙা-গড়া, মগজের রেশ ও উপনিবেশ আর দূরে থাকবার হাহাকার তো তীব্র, সর্বগ্রাসী। উল্টো ঘুরে এর পাশাপাশি এ কথাও ভাবতে হয়, এটা কি শুধু স্বপ্ন না এই স্বপ্ন কলকাতার মানস-উপনিবেশ থেকে, এই শাহজাদপুর-শিলাইদহ-পতিসরে প্রায় নির্বাসিত কবির স্বপ্নে প্রায় কুহক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া এক বিভ্রম। তা যদি হয়, আর নাও হয়, হলে, ধরে নেওয়া যায়, যে জীবনকে যাপন করার এক অন্তর তাড়িত ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক- রবীন্দ্রনাথের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে- সেই জীবনের প্রত্যক্ষ বাস্তবের বিপরীতে এই বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে আর-এক বাস্তব। জটিলও, রবীন্দ্রনাথ ওমোঘ চলতি রীতি পত্রগদ্যের গুণে পড়তে স্বাদু কিন্তু এর প্রতি পদে ও করতে ঐ ফেলে আসা, জটিল আর উপনিবেশের নাগরিক চাপে চ্যাপ্টা এক কলকাতা। সামনে, অথচ সামনে নয়। রবীন্দ্রনাথে করোটিতে যেখানে যেখানে ওই নগরী বর্তমান তারই এক ধসে পড়া চিত্র এই দূরপ্রাপ্ত থেকে ভাইজিকে জানাচ্ছেন তিনি। একটু বাদেই তা তন্দ্রা যেন, তন্দ্রা থেকে স্বপ্নে প্রবেশ, যেখান থেকে যখন স্বপ্ন টুটে যাবে তার পর তো আর এই জীবন তাকে যাপন করতে হবে না। অথচ তিনি যাপন করছেন, যে জীবনে আছেন, যেখানে আছেন, সেই শাহজাদপুরেই। ওই চিঠিতেই তাই ঘটেছে, এই অংশে শেষ, একটু ফাঁকা রেখে পরের অনুচ্ছেদে নিজেকে নিয়ে মহাব্যঙ্গ: ‘তারপর এখানকার শাহজাদপুরের ইংরেজি ইস্কুলের মাস্টাররা হুজুরের দর্শন-বিলাসী হয়ে এসে উপস্থিত।’ এই চিঠিতে নির্দিষ্ট তারিখ নেই। তবে, ৩০ জুন ইন্দিরা দেবীর হাতে পড়েছে কলকাতায়। মানে এর আগে লেখা। এটির আগেরটি ইন্দিরা দেবী পেয়েছেন ২৬ জুন। হয়তো, এই সপ্তাহের যে কোনও দিন লেখা হয়েছিল এই স্বপ্ন সংক্রান্ত চিঠিখানা। এই চিঠি, ওই তিন জমিদারি পত্তনের পাশাপাশিতে এক কলকাতাতে পাওয়া গেল; শাহজাদপুর থেকে স্বপ্নে পাওয়া কলকাতা।

এর মাস চারেক আগে ছিন্নপত্রাবলীতে (পত্র ১৭) প্রথম পোস্টমাস্টারের উল্লেখ পাওয়া যায়। গল্পের নয়, ব্যক্তির। যদিও গল্পের শিরোনাম আর ব্যক্তি এই দুই পোস্টমাস্টার মিলে মিশে একাকার। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮৯১’র আগে লেখা, হয়তো ৮ ফেব্রুয়ারির পরে। এর পর ১৬ জুন পর্যন্ত কোনও চিঠি নেই। পোস্টমাস্টারের চিঠির পরে, স্বপ্নের চিঠি পর্যন্ত মাঝখানে ৭ খানি চিঠি (পত্র ১৮ থেকে ২৪)।

এখানকার পোস্টমাস্টার এক-একদিন সন্ধ্যের সময় এসে আমার সঙ্গে এইরকম ডাকের চিঠি যাতায়াত সম্বন্ধে নানা গল্প জুড়ে দেয়। আমাদের এই কুঠিবাড়ির এক তলাতেই পোস্ট আপিস-বেশ সুবিধে, চিঠি আসামাত্রই পাওয়া যায়। পোস্ট মাস্টারের গল্প শুনতে আমার বেশ লাগে। বস্তির অসম্ভব কথা বেশ গম্ভীরভাবে বলে যায়। কাল বলছিল, এ দেশের লোকের গঙ্গার উপর এমনি ভক্তি যে, এদের আত্মীয় মরে গেলে তার হাড় গুঁড়ো করে রেখে দেয়, কোনো কালে গঙ্গার জল খেয়েছে এমন লোকের যদি সাক্ষাৎ পায় তা হলে তাকে পানের সঙ্গে সেই হাড় গুঁড়ো খাইয়ে দেয় আর মনে করে তার আত্মীয়ের একটা অংশের গঙ্গালাভ হল। আমি হাসতে হাসতে বললুম, ‘এটা বোধহয় গল্প?’ সে খুব গম্ভীরভাবে চিন্তা করে স্বীকার করলে, ‘হুজুর, তা হতে পারে।’

গল্পগুচ্ছেরও আগে, বাংলা ভাষায় এই প্রথম পোস্টমাস্টারকে পাওয়া। এখানেও পোস্টমাস্টার নামহীন। পোস্টমাস্টার তো পোস্টমাস্টার, নাম দিয়ে কি দরকার এই যেন রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায়। হোক, তবু রবীন্দ্রনাথের সামনে ছিন্নপত্রাবলীর এই পোস্ট মাস্টারের সঙ্গে কোথায় যেন গল্পগুচ্ছের পোস্টমাস্টারের মিল আছে। চেতনে বা অচেতনে। এই জন্যেই, এই পর্বের গল্পগুলোর সহপাঠ ছিন্নপত্রাবলী, ছিন্নপত্রাবলীর সহপাঠ এই পর্বের রবীন্দ্র-কবিতা।

৩.

রুশ সাহিত্যতাত্ত্বিক আনাতোলি লুনাচারস্কি ‘থিসিস অন দ্য প্রোব্লেমস অফ মার্ক্সিস্ট ক্রিটিসিজম’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন : A work of literature always reflects, whether consciously or unconsciously, the psychology of the class which the writer represents, or else, as often happens it reflects a mixture of elements in which the influence of various classes on the writer is revealed and this must be subject to a close analysis.

ছিন্নপত্রাবলীতে উল্লিখিত কলকাতা বিষয়ক স্বপ্ন পোস্টমাস্টার লেখার এক বছর আগে দেখেন রবীন্দ্রনাথ; একইসঙ্গে ছিন্নপত্রাবলীতে পোস্টমাস্টারের উপস্থিতিও ওই গল্প লিখিত হওয়ার এক বছর আগে। এরপর দ্বিতীয়বার পোস্টমাস্টারের উল্লেখ পাওয়া যায়, এক বছর বাদে ‘পোস্টমাস্টার’ প্রকাশিত হলে। এখানেও একইসঙ্গে দুই পোস্টমাস্টার উপস্থিত- একজন ব্যক্তি, অন্যটি গল্পনাম। আগেই উল্লেখ করা, পোস্টমাস্টার গল্পনাম আর ব্যক্তিনাম- দুটোই এই পত্রে, একেবারে জড়াজড়ি করে মিলেমিশে গেছে। এদিক-ওদিক হওয়ায় সুযোগ সেখানে নেই। নাম কখনও ব্যক্তি, কখনও গল্পনাম; অন্যদিকে একটি ঔপনিবেশিক পদেরও। তার আগমন, যেন এই নদীর বেষ্টনীর মাঝখান দিয়ে হয়ে পড়া ত্রিকৌণিকতার ভিতর দিয়ে, ঢুকে যাওয়ার ভিতর দিয়ে, পরস্পর জড়িয়ে যাওয়ার ভিতর দিয়ে, এই ঢুকে পড়ার মাঝামাঝিতে, একে অন্যের পরিপূরক যেন, যেভাবে, রবীন্দ্রনাথ শুরুতেই জানাচ্ছেন, তার নাম নেই। ‘প্রথম কাজ আরম্ভ করিয়াই উলাপুর গ্রামে পোস্টমাস্টারকে আসিতে হয়।’ এটি পোস্টমাস্টারের আগমন তার ওই ‘যেতে নাহি দিব’র বিপরীত পিঠ আগমন তাকে করতেই হবে, চাকরি সে, উপনিবেশের নতুন পদায়নে কুঠির সাহেব অনেক জোগাড় করিয়া এই নতুন পোস্ট-অপিস স্থাপন করিয়াছেন। তাতে যে পোস্টমাস্টারের দেখা পাওয়া গেল : ‘আমাদের পোস্টমাস্টার কলিকাতার ছেলে। জলের মাছকে ডাঙ্গায় তুলিলে যে রকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্টমাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে। একখানি অন্ধকার আট চালার মধ্যে তাহার অপিস: অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারিপাড়ে জঙ্গল। কুঠির, গোমস্তা প্রভৃতি যে সকল কর্মচারী আছে তাহাদের ফুরসত প্রায় নাই এবং তাহারা ভদ্রলোকের সহিত মিশিবার উপযুক্ত নহে।’

‘বিশেষত কলিকাতার ছেলে ভালো করিয়া মিশিতে জানে না। অপরিচিত স্থানে গেলে, হয়তো উদ্ধত নয় সপ্রতিভ হইয়া থাকে। এই কারণে স্থানীয় লোকের সহিত তাহার মেলামেশা হইয়া উঠে না।

এই জানা গেল পোস্টমাস্টারের নাগরিক পরিচয়: তার গুণ আর গুণহীনতাও। এরপর এই অনাগরিক স্থানে প্রায় কর্মহীন এমন মানুষটির জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজের প্রধান গুণটিই জুড়ে দেন: ‘অথচ হাতে অধিক কাজ নাই। কখনো কখনো দুটো-একটা কবিতা লিখতে চেষ্টা করেন। তাহাতে এমন ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন যে, সমস্ত দিন তরুপল্লবের কম্পন এবং আকাশের মেঘ দেখিয়া জীবন বড় সুখে কাটিয়া যায়...।’ এরপর ছিন্নপত্রাবলীতে উল্লিখিত স্বপ্নের এক বিপরীত স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আরব্য রজনীর দৈত্যের প্রচেষ্টায় যদি এই নিম্নগ্রাম যদি সারি সারি অট্টালিকা বহুল নগরীতে পরিণত হয়, তাহলে, ‘এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।’ রবীন্দ্রনাথ এই সোনার তরী পর্বে, শুধু ছিন্নপত্রাবলীর পৃষ্ঠায় নয় অথবা পোস্টমাস্টারের কল্পনায় নয়, সোনার তরীতেও তিনটি কবিতা (‘নিদ্রিতা’, ‘সুপোত্থিত’, ‘হিং টিং ছট’) পাওয়া যায়, রাতের স্বপ্ন, ঘুমের দেশের বা রাজার দেখার স্বপ্নের কথা। এগুলো একটিও পূর্ববাংলায়, এই পদ্মায় লিখিত নয়। ‘সোনার তরী’ শিলাইদহে বোটে রচিত। আর পোস্টমাস্টার রচনার কিছুদিন বাদে লেখা ‘দুই পাখি’ ওই শাহজাদপুরে রচিত। যে কবিতাটিতে খাঁচার বদ্ধ আর বনের মুক্ত পাখির ভেতরে কথোপকথন তো সেই মাত্রা পায়, যার ভেতর দিয়ে এই ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বিমুখী-কলে কলকাতা থেকে বহুদূরে প্রায় নির্বাসিত রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতা আর অধীনতাকে পাখির গলায় স্বরে মিলিয়ে দেন। এই স্বর একদিকে রবীন্দ্রনাথের অন্যদিকে গল্পের শাহজাদপুর ছেড়ে যাওয়া পোস্টমাস্টারের, অন্যদিকে পরাধীন ভারতের : যেখানে খাঁচার পাখি, ‘হয় মোর শক্তি নাহি উড়িবার’ বলে এক কাতর কান্নার হাহাকার করে।

কালান্তরে, ফ্রাইডের আগমনে রবিনসন ক্রুসোর স্বাধীনতা যে এই প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কে অধীনতায় রূপ নিয়েছিল, তাকে সমন্ধ মাত্রেই অধীনতা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। যেমন- অতি সামান্য বেতনের পোস্টমাস্টার, নিজে রেঁধে খায়, রতন নামে একটি অনাথ বালিকা তার কাজকর্ম করে দেয়, তার সঙ্গে এই সমন্ধের ভেতর দিয়ে পোস্টমাস্টারের এক নির্ভরতা তৈরি হয়। তাতে সন্ধ্যার সময় ‘দূর গ্রামের নেশাখোর বাউলের দল খোল-করতাল বাজাইয়া উচ্চেঃস্বরে’ জুড়িয়া দেয়া গান শুনে ‘অন্ধকার ছাওয়ায় একলা বসিয়া গাছের কম্পন দেখিলে কবি হৃদয়েও ঈষৎ হৃৎকম্পন উপস্থিত হইত’। এর ভেতর পোস্টমাস্টার রতনকে ডেকে বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করতেন। অনাথ রতন ‘মায়ের চেয়ে বাপ তাহাকে বেশি ভালোবাসিত, বাপকে অল্প অল্প মনে আছে।’ এই আলাপে ধীরে ধীরে ‘যে সকল কথা সর্বদাই মনে উদয় হয় অথচ নীলকুঠির গোমস্তাদের কাছে যাহা কোনমতেই উত্থাপন করা যায় না, সেই কথা একটি অশিক্ষিত ক্ষুদ্র বালিকাকে বলিয়া যাইতেন, কিছুমাত্র অসংযম মনে হইত না।’ ফলে, রতনের ভিতরে যা ঘটল :

অবশেষে এমন হইল, বালিকা কথোপকথনকালে তাহার ঘরের লোকদিগকে মা, দিদি, দাদা বলিয়া চিরপরিচিতের ন্যায় উল্লেখ করিত। এমনকি, তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়পটে বালিকা তাহাদের কাল্পনিক মূর্তিও চিত্রিত করিয়া লইয়াছিল। এরপর এই পোস্টমাস্টার গল্পে রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রাবলীর থেকেই যেন একটি অনুচ্ছেদ খুলে এনে বসালেন। সেখানে প্রকৃতির যে বর্ণনা, পোস্টমাস্টারের মনোভাব, যে নিঃসঙ্গতা, যে ভাবের উদয় হয় তাতে, ‘‘পোস্টমাস্টর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া ডাকিলেন, ‘রতন।’ রতন তখন পেয়ারা তলায় পা ছড়াইয়া দিয়া কাঁচা পেয়ারা খাইতেছিল; প্রভুর কণ্ঠস্বর শুনিয়া অবিলম্বে ছুটিয়া আসিল- হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, ‘দাদাবাবু, ডাকছো?’ পোস্টমাস্টার বলিলেন, ‘তোকে আমি একটু একটু করে পড়তে শেখাব’ বলিয়া সমস্ত দুপুরবেলা তাহাকে লইয়া ‘স্বরে অ’ ‘স্বরে আ’ করিলেন এবং এই রূপে অল্প দিনেই যুক্ত অক্ষর উত্তীর্ণ হইলেন।’’

তাহলে এই জানা গেল, রতন আর পোস্টমাস্টারের সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের। রবীন্দ্রনাথ প্রভু শব্দটিই ব্যবহার করেছে। সম্পর্কটি তাই ছিল। ওই সম্পর্কে, ওই নির্ণয়ে হেগেলের কথাটিরও একটি যথার্থ পাওয়া গেল : উপনিবেশে শাসক আর শাসিতের সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের। এই গল্পে পোস্টমাস্টার শাসক নন ঠিকই, নিয়ন্তা বটে। যদিও তিনি নিজেই উৎকেন্দ্রিক, গল্পের স্রষ্টার মতোই, কেন্দ্রচ্যুত এক উপনিবেশিক পেশায় এখানে আগমন। আর সেই চাপে খানিকটা বিধ্বস্তও। যেমন- দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় বাক্যে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, তার সম্পর্কে : ‘জলের মাছকে ডাঙ্গায় তুলিলে যে রকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্টমাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে।’

উল্লেখ্য কয়েকদিন বাদে জ্বরে পড়লেন, পোস্টমাস্টারকে প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারীরূপে জননী ও দিদির শুশ্রুষায় রতন আর বালিকা রহিল না। মুহূর্তের জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁধিয়া দিল এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাস করিল, ‘হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি।’ রতনকে শুনতে হবে পোস্টমাস্টারের প্রায় নির্দয় উচ্চারণ। পোস্টমাস্টার ক্ষীণ শরীরে রোগশয্যা ত্যাগ করিয়া স্থির করিলেন, আর নয়, এখান হইতে কোনমতে বদলি হইতে হইবে। স্থানীয় অস্বাস্থ্যের উল্লেখ করিয়া তৎক্ষণাৎ কলিকাতায় কর্তৃপক্ষের নিকট বদলি হইবার জন্য দরখাস্ত করিলেন। দরখাস্ত না-মঞ্জুর হলে পোস্টমাস্টারের কাছে জবাব দিয়ে বাড়ি যাওয়া স্থির করলেন :

পোস্টমাস্টার বলিলেন, রতন, কালই আমি যাচ্ছি

রতন। কোথায় যাচ্ছো দাদাবাবু?

পোস্টমাস্টার। আর আসব না।

এর পর রতন আর কোন কথা জিজ্ঞাস করিল না। এই অমোঘ বাক্যে। রতনের যেন আর কিছু জিজ্ঞাসার নাই; অথবা জিজ্ঞাসা করিতে নাই। শুধু একটি প্রত্যাশা আছে, অনাথিনীর :

‘দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?’ পোস্টমাস্টার হাসিয়া কহিলেন, ‘সে কী করে হবে।’

এর পর রতনের দাদাবাবু, রবীন্দ্রনাথ ও আমাদের পোস্টমাস্টারকে আর একবার ‘প্রভু’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। যখন একটু বাদে এই প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কটি প্রায় চুকে যাবে পোস্টমাস্টার চলে যাওয়ার আগে রতনের ডাক পড়ে। তখন রতন নিঃশব্দে গৃহে প্রবেশ করিল এবং একবার নীরবে প্রভুর মুখের দিকে চাহিল। প্রভু কহিলেন, ‘রতন, আমার জায়গায় যে লোকটি আসবেন তাকে বলে দিয়ে যাব তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন, আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।’ ভৃত্যের হাত বদল। ভৃত্যের বদল নয়। সেই ‘প্রভু’ ও রতনকে একই রকম যত্ন করবেন। এই আশ্বাস। কিন্তু এই কথা যত ‘স্নেহগর্ভ এবং দয়াদ্র’ হোক রতন ‘অনেক দিন প্রভুর অনেক তিরস্কার নীরবে সহ্য’ করুক-এই নরম সহিতে পারিল না।’ সে কেঁদে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ এই কান্নাকে ‘নারীহৃদয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যদিও এর আগে রতন যে নারী তা মনে হয়নি। রতন ‘উচ্ছ্বসিত হৃদয়ে কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, ‘না-না, তোমার কাউকে কিছু বলতে হবে না, আমি থাকতে চাইনে।’ এই বাক্যসহ কোনও বাক্যই পদ্মাপাড়ের কোনও গ্রাম্য বালিকার মুখের বাক্য নয়, সত্যি। এই গোছানো সংলাপ ওই জনপদের মানুষ কোনওকালে বলেনি। কিন্তু রতনের ওই আবেগ সত্যি। সেই আবেগের জোরে সে এই কথা বলেছে: এমনকি এরপর যখন পোস্টমাস্টার নতুন পোস্টমাস্টারকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে গমনোন্মুখ তখন আবার হতেও পারে। আবার চার্জ বুঝিয়ে দেয়ার পরে পোস্টমাস্টার আর পোস্টমাস্টারও নন। রবীন্দ্রনাথ তাকে আর পোস্টমাস্টার হিসেবে উল্লেখও করেন নি। একবার ‘ভৃতপূর্ব পোস্টমাস্টার’ উল্লেখ আছে। এখন তিনি (পোস্টমাস্টার) রতনকে ডেকে বললেন :

‘রতন তোকে আমি কখনো কিছু দিতে পারিনি। আজ যাবার সময় তোকে কিছু দিয়ে গেলুম, এতে তোর দিন কয়েক চলবে।’

কিছু পথ খরচা বাদে তাহার বেতনের যত টাকা পাইয়াছিলেন পকেট হইতে বাহির করিলেন। তখন রতন ধুলায় পড়িয়া তাহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, ‘দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি আমাকে কিছু দিতে হবে না’- বলিয়া একদৌড়ে সেখান হইতে পালাইয়া গেল।

‘পোস্টমাস্টার’ প্রকাশিত হওয়ার পরে, ছিন্নপত্রাবলীতে আবারও পোস্টমাস্টারের উল্লেখ পাওয়া যায়। রচনা পুঞ্জিকাররা সেই সূত্রে ‘পোস্টমাস্টার’ প্রকাশকাল উল্লেখ করেন। এই উল্লেখের দিন দশেক আগে লিখেছেন, ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘দুই পাখি’ যদিও এই চিঠি লেখার সময় রবীন্দ্রনাথের হাতে কালিদাস, এরপর ‘সোনার তরী’ যে বর্ষায় বৃষ্টিতে, বাদলে পূর্ণ হয়ে উঠবে, তা এই কালিদাস লগ্নতায় বেশ বোঝা যায়। তবে ‘দুই পাখি’ লেখারই খুব কাছাকাছি সময়ে ‘পোস্টমাস্টার’ লেখা- দূর থেকে হলেও সে মিল আজ বুঝে নেয়া যায়। ছিন্নপত্রাবলীতে (পত্র ৬২) কালিদাসের উল্লেখের সময়ই পোস্টমাস্টারের প্রবেশ; রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে জানাচ্ছেন সকৌতুকে : তোকে চিঠিতে লিখেছিলেম, কাল ৭ PM এর সময় কবি কালিদাসের সঙ্গে একটা এনগেজমেন্ট করা যাবে। বাতিটি জ্বালিয়ে টেবিলের কাছে কেদারাটি টেনে যখন বেশ প্রস্তুত হয়ে বসেছি, হেনকালে কবি কালিদাসের পরিবর্তে এখানকার পোস্টমাস্টার উপস্থিত। মৃত কবির চেয়ে একজন জীবিত পোস্টমাস্টারের দাবি ঢের বেশি- আমি তাকে বলতে পারলুম না ‘আপনি এখন যান, কালিদাসের সঙ্গে আমার একটু বিশেষ আবশ্যক আছে’। বললেও সে লোকটা ভালো বুঝতে পারত না। অতএব পোস্টমাস্টারকে চৌকিটি ছেড়ে দিয়ে কালিদাসকে আস্তে আস্তে বিদায় নিতে হল। এই লোকটির সঙ্গে আমার একটু বিশেষ যোগ আছে। যখন আমাদের এই কুঠিবাড়ির এক তালাতেই পোস্ট অফিস ছিল এবং আমি তাকে প্রতিদিন দেখতে পেতুম, তখনি আমি একদিন দুপুর বেলায় এই দোতলায় বসে সেই পোস্টমাস্টারের গল্পটি লেখেছিলুম এবং সে গল্পটি যখন হিতবাদীতে বেরোল তখন আমাদের পোস্টমাস্টার বাবু তার উল্লেখ করে বিস্তর লজ্জামিশ্রিত হাস্য বিস্তার করেছিলেন। যাই হোক, এই লোকটিকে আমার বেশ লাগে। বেশ নানারকম গল্প করে যায়, আমি চুপ করে বসে শুনি। ওর মধ্যে আবার বেশ একটুখানি হাস্যরসও আছে। তাই এজন্যে খুব শীঘ্র জমিয়ে তুলতে পারে। সমস্ত দিন চুপচাপ একলা বসে থেকে মাঝে মাঝে এই রকম জীবন্ত মানুষের সংঘাতে আবার যেন সমস্ত জীবনটা তরঙ্গিত হয়ে ওঠে...।

এই ছিন্নপত্রাবলীর পোস্টমাস্টার; যার সঙ্গে পোস্টমাস্টার গল্পের পোস্টমাস্টারের মিল থাকুক কি না-ই থাকুক, তাকে দেখে এই গল্প লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রতন তিনি অনেক দেখেছেন, ছিন্নপত্রবলীর অন্যত্র তাদের উল্লেখ আছে। তবে এই হল পোস্টমাস্টার গল্পের পোস্টমাস্টার তাকে দেখে, নিজের কল্পনা আর পারিপার্শ্বের চাপ আর আত্মজীবনের দৈনন্দিন উপলব্ধি এক করে পোস্টমাস্টারের পোস্টমাস্টার। যে কোনক্রমে এই পারিপার্শ্বিক মিলিয়ে নিতে পারে না। রতনের কাছে থেকে প্রভু পোস্টমাস্টার নৌকায় উঠে গেছেন, ওই বালিকার সঙ্গে, এই চাকরির সঙ্গে এই গ্রামের, গ্রাম্যতার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেছেন নাগরিক পোস্টমাস্টার। ব্রিটিশ উপনিবেশের দ্বিতীয় নগরী কলকাতার ছেলে পোস্টমাস্টার। তিনি রতনের সপ্রত্যাখান পলায়নের পর নৌকায় উঠেছেন। নৌকা ছেড়েও দিয়েছে। তার ‘একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি কিন্তু পালে বাতাস পাইয়াছে…’ পোস্টমাস্টার শিক্ষিত, উপনিবেশের চাকুরে, নৌকার পালেও ঔপনিবেশিক হাওয়া, তাতে তার মনে তত্ত্বের উদয় হলো : জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।’

এরপর শেষ অনুচ্ছেদ। যে অনুচ্ছেদটি নিয়ে গল্পের তাত্ত্বিক আলোচনায় প্রচুর আপত্তি ওঠে। তখন বাংলা ছোটগল্পের আঁতুরকাল। ফলে, ওই তাত্ত্বিক আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ এক প্রকার নবীশী ছাড় পান। অথচ এই বাক্যগুলোই এই গল্পের এক বিপরীত ভর। যেন গল্পের ‘শেষ হইয়া হইল না শেষ’ নয়, গল্পের শেষে শেষ। এ কোনও তত্ত্ব নয়। প্রয়োজন। তাত্ত্বিকতার এই বিপরীতের পিঠটি রবীন্দ্রনাথ জানতেন। কিন্তু রতনের মনে কোনও তত্ত্বের উদয় হইল না। সে সেই পোস্ট অফিস গৃহের চারিদিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বোধ করি তাহার মনে ক্ষীণ আশা জাগিতেছিল, দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে-‘সেই বন্ধনে পড়িয়া কিছুতেই দূরে যাইতে পারিতেছিল না। হার বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়। ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহু বিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভেতর প্রাণপণে জড়িয়ে ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ি কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতন হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তি পাশে পড়িবার জন্য চিন্তা ব্যাকুল হইয়া উঠে।’

তাহলে এমন তত্ত্বের জবানিতে শেষ কথাকে মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের এতখানি জবাবের বিপরীতে দাঁড়াল রতনের জন্যেই সেই অমোঘ বাক্য : ‘রতন আর কোন কথা জিজ্ঞাস করিল না।’ হয়তো শেষ পর্যন্ত রতনেরা কোনও কথা কহে না। হয়তো নীরবে দাঁড়ায়ে থাকে। নগরচ্যুত নাগরিক, সে পোস্টমাস্টার কি রবীন্দ্রনাথ, কেউই তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না। তখন ‘উন্নতি’র পালে হাওয়া লাগে, সেই হাওয়া পশ্চিমমুখো। হয়তো পোস্টমাস্টার রতনকে ভুলে যাবেন, কারণ, জগতে কে কার। চাকরি তো চাকরির, যেমন- রবীন্দ্রনাথ এসেছেন পৈতৃক জমিদারি দেখতে। পোস্টমাস্টার রতনকে মনে রাখবেন কি রাখবেন না, জানা যাবে না; ওদিকে রবীন্দ্র-সাহিত্য থেকেও এই পদ্মাপর্ব অর্ন্তহীত হবে। সেটা স্বাভাবিক। তারা দু’জনই কলকাতামুখী। তাই গন্তব্য। রতনের নাম রতন; রতনকে পোস্টমাস্টার গল্পে পাওয়া গেল, কিন্তু পোস্টমাস্টারের কোনও নাম নেই। নাম পাওয়া গেল না। শুধু রতনের সেই কোনও কথা না পাওয়ার ভেতরে সব কথা থেকে গেল।

‘আর ওই তত্ত্বের উল্টো পিঠে আর এক কথা : ‘পৃথিবীতে কে কাহার।’ উপনিবেশ ও উপনিবেশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সৃষ্ট পদ, সেই পদের চাকরিতে যে উৎকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠি পাওয়া গেল, তারা কারুর নয়। চাকুরে। যিনি চাকুরে, তিনি নগরের, অথবা নগরে-শিক্ষিত, গ্রাম্যচ্যুত। শুরু হল গ্রাম আর শহরের এই দ্বন্দ্ব। (কখনও) ‘গ্রাম্যতা’ আর নাগরিকতা এই দ্বন্দ্ব-এই প্রথম পাওয়া গেল বাংলা সাহিত্যে। পোস্টমাস্টার প্রথম সেই চরিত্র। রবীন্দ্র-ছোটগল্প রচনার নিরবচ্ছিন্ন এই পর্বের প্রথমেই, দ্বিতীয় প্রয়াসে পোস্টমাস্টারকে হাজির করলেন। চাকুরে, নিয়ন্ত্রতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রিতের এই বিচ্ছিন্নতা আজও বহমান। রবীন্দ্রনাথের এই বাংলাদেশে এখনও গ্রাম কি মফস্বল থেকে আসা নগরে শিক্ষিত মানুষ চাকরির বাতাবরণে ওই গ্রাম বা মফস্বলে ফিরে যেন এটে উঠতে পারে না। ওই অমোঘ সত্য সেখানে ‘জলের মাছকে ডাঙ্গায়’ তোলার অবস্থা। এই ফাঁক কোনও ভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। এই পোস্টমাস্টার রচনার আগেই ইংরেজ শাসনে বাঙালির যে ‘নবজাগরণ’ অন্তত যাকে গাল ফুলিয়ে নবজাগরণ বলা হয় তা যে সব মানুষের নয়, কখনও বধু উচ্চারণের, কখনও উঁচু শ্রেণির (মার্ক্সীয় অর্থে), কখনও নাগরিকতার; এই জাগরণ সব মানুষের করা যায়নি। এর ফল সবার জন্য হলো না, এর ফল ভোগ করল শুধু শহর বা নগর, মূলত নগরই। গ্রাম শহরের এই দ্বন্দ্ব আজও বর্তমান। ওই নবজাগরণ শুধু উপনিবেশের পালে হাওয়া দিল। যেমন- পোস্টমাস্টারের নৌকা ‘তখন পালে বাতাস পাইয়াছে।’ এই বাতাস বন্ধন ছিন্ন করে ‘পৃথিবীতে কে কাহার।’ গ্রামের রতনের শেষ কাজই হল, নগর থেকে আগত-বিগত পোস্টমাস্টারদের সেবা দেয়া। যেমন দিয়েছে পোস্টমাস্টারকে। প্রভুকে ভৃত্য। একটি গ্রাম্য বালিকা নাগরিক পোস্টমাস্টারকে যেমন, এই ছিন্নপত্রাবলীর পৃষ্ঠাজুড়ে শিলাইদহ-পতিসর-শাহজাপুর, রবীন্দ্রনাথকে।

এই ছিল উপনিবেশ ও উপনিবেশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কাঠামোর পেষণে ধ্বস্ত রতনের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা। রতনকে সঙ্গে লওয়া যায়? ‘সে কী করে হবে।’ এই হওয়ার উত্তর রবীন্দ্রনাথেরও জানা ছিল না। তবে, প্রকাশটা তিনি দেখিয়েছেন গল্প রচনার প্রায় শুরুতেই, ওস্তাদের মার পহেলাই।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়