ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিশ্বে রবীন্দ্রচর্চা : গ্রহণ ও বর্জন

মোজাফফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২২, ৬ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বে রবীন্দ্রচর্চা : গ্রহণ ও বর্জন



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসেন ১৯১৩ সালে, গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম নন-ইউরোপীয় হিসেবে এই পুরস্কারটি পেলেন। ফলে এই পুরস্কার সাহিত্যবিশ্বকে রবীন্দ্রনাথের দিকে ঘুরে তাকাতে বাধ্য করে। নিশ্চিত করেই গোটা বিশ্ব তখন পরিবর্তিত সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পরের বছর শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। একদিকে তুরস্কে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, অন্যদিকে রুশ বিপ্লব, আরেকদিকে চীন-জাপান সংকট। ও-দিকে লাতিন আমেরিকা সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিরতা আনার প্রচেষ্টায় রত। বিশ্বশক্তি হিসেবে উত্থান ঘটছে আমেরিকার। ঠিক এই মুহূর্তে বিশ্বের কাছে একজন অপরিচিত ভারতীয় লেখক সাহিত্যে নোবেল পেলেন। সবে তাঁর একটি মাত্র বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ইউরোপ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই হৈচৈ পড়ে যাওয়ার মতোই ঘটনা বটে। নিশ্চিত করেই এটা নোবেল কমিটির অরাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়। ইউরোপীয় এলিটীয় সাহিত্যধারা এর শক্তিমত্তা এবং সম্মান হয়ত বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। তারা কতটুকু সফল হয়েছেন জানি না, তবে রবীন্দ্রনাথ সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে বিশ্বে তাঁর নিজস্ব মতাদর্শ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন, সেটা বলা যায়। নোবেলপ্রাপ্তির পর খুব শিঘ্রই তাঁর লেখা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হতে শুরু হয়। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নির্ভরযোগ্য অনুবাদকদের ভেতর আছেন ম্যারিনো রিগন যিনি বাংলা থেকে সরাসরি ইটালি ভাষায় অনুবাদ করেছেন, ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন আদ্রেঁ জিদের মতো প্রখ্যাত লেখক, যিনি পরবর্তীকালে নিজেও সাহিত্যে নোবেল পান, স্পেনে আরেক নোবেলজয়ী লেখক হুয়ান রামোন হিমেনেস, আর্জেন্টিনায় ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো, নেদারল্যান্ডে ফ্রেদেরিক ভন ইডেন, চেক ভাষায় ভিনসেনস লেসনি এবং দুসান জাভিতেল, লাটভিয়াতে কার্লিস ইগল এবং রিচার্ডস রুডিটিস, আরবে মুহাম্মদ সুখরি আয়াদ এবং রুশ ভাষায় এ পি নাতুক-ডানিল’চাক।


রবীন্দ্রনাথ পূর্ব এবং পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার মিশরসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফরে যান, বক্তৃতা করেন। তাঁর বক্তৃতার বিষয় হয়ে ওঠে বিশ্বের সাহিত্যচর্চা বা নিজের কাব্যপ্রসঙ্গ নয়; বিশ্বশান্তি। তিনি বিভিন্ন দেশে গিয়ে সেই দেশের প্রখ্যাত পণ্ডিত-লেখক-শিল্পী-রাজনীতিবিদ-সমাজকর্মী প্রভৃতি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্বের গুরুতর কিছু সমস্যা নিয়ে কথা বললেন। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির বহুত্ববাদী, বৌদ্ধ ধর্মের অহিংস ও ইসলাম ধর্মের সুফি এবং বাংলার বাউলদের ভাববাদী চেতনা সমন্বয় করে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিলেন। ফলে তিনি মানবতাবাদী বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে আইকন হিসেবে চিহ্নিত হলেন। সেটা কেবল ভারত নয় বিশ্বজুড়েই। যেমন: চেকোস্লোভাকিয়ায় জার্মান সাংস্কৃতিক আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রেরণা হয়ে দেখা দেন। আবার জার্মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মর্মাহত জনগণের আশ্রয় হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। আরববিশ্বে, বিশেষ করে তুরস্ক এবং ইরানে রবীন্দ্রনাথকে 'ইসলামিকীকরণ' করা হয়েছে। তাঁর লেখার ভেতর সুফিবোধের অনুসন্ধান করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপে খ্রিস্টীয় ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের মহিমা উদ্ধার করা হয়েছে রবীন্দ্র-রচনায়। আবার কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডের বৌদ্ধরাও রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরভাবনা নিজেদের মতো করে ভেবে নিয়েছেন। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহুজাতিক ঈশ্বর ও নৈতিকতা বোধের সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।


কাজেই বলা চলে ভারতীয় উপমহাদেশের আর কোনো লেখক যে তাঁর মতো বিশ্বে এতটা চর্চিত এবং পঠিত হননি এর প্রধান কারণ কেবল নোবেল বিজয় নয়। নোবেল জয়ের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা পরিচিতি বিশ্বে পেয়েছেন বটে কিন্তু সেই পরিচিতি শুধুমাত্র সাহিত্যজগতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বকালে স্বদেশের বাইরে যতটা না পঠিত হয়েছেন তার চেয়ে বেশি চর্চিত হয়েছেন। সেটা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ইস্যুভিত্তিক আলোচনায় তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে। তিনি যে উগ্র জাতীয়তাবোধ ভর্ৎসনা করে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ববোধের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা বিশ শতকের শুরুর দিকে যুদ্ধাক্রান্ত এবং নানামুখি সংকটাক্রান্ত বিশ্বের জন্য মোক্ষম বার্তা হয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথ পূর্ব এবং পশ্চিমকে যূথবদ্ধ করে আরো মানবিক, ন্যায়নিষ্ঠ, আধ্যাত্মিক সমাজ ও মানসগঠনে কাজ করতে চেয়েছেন। তাই রবীন্দ্রনাথকে পাঠ না করেও তাঁর ভাষণ শুনে বা তাঁর সম্পর্কে জেনে তাঁকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি অনেক ভিনদেশি পণ্ডিত। সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথের যে বিশ্বসাহিত্যে প্রভাব পড়ে সেটা যতটা না সাহিত্যিক প্রভাব, তার চেয়ে বেশি মতাদর্শিক প্রভাব। এটা তো পরিষ্কার যে, সাহিত্যে রাবীন্দ্রিক ধারা রাবীন্দ্রিকীয়তা বলতে যা বোঝায় তা তাঁর সময়ে ইউরোপ হয়ে অন্যান্য মহাদেশে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা পেলেও খুব দ্রুত যুদ্ধোত্তর আধুনিকতা ও পুঁজিবাদী ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থার বিকাশের সাথে সাথে রবীন্দ্রকাব্য সেকেলে এবং অতিমাত্রায় ঈশ্বরবাদী বা রোমান্টিক বিবেচনায় কিছুটা নিষ্প্রভ বা ফিকে হয়ে আসে। বিশ্বসাহিত্যে উত্তর-আধুনিক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক ধারার জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে চাপা পড়ে গেছে তাঁর নাম। কিন্তু স্বকালে এলিয়ট-বোদলেয়ারদের চেয়ে মতাদর্শিক প্রভাবে এগিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যে কারণে এক ব্রিটিশ সৈনিককে যুদ্ধে গীতাঞ্জলি সঙ্গে রাখতে দেখা গেছে। রবীন্দ্রনাথের প্রথমদিককার জাপানি অনুবাদক কবি মাশিনো সাবুরো (১৮৮৯-১৯১৬) যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রশান্তির জন্য রবীন্দ্রকাব্যে মনোনিবেশ করেন। মৃত্যু যত সন্নিকটে এসেছে তিনি তত রবীন্দ্ররচনা অনুবাদের দিকে ঝুঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি যখন উত্তুঙ্গে তখন তাঁর বহুল অনূদিত ও পঠিত গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ পড়ে ইউরোপীয় পাঠকরা যতটা না এর কাব্যস্বাদ আস্বাদন করেছেন, তার চেয়ে বেশি আস্বাদন করেছেন এর ভাব। অর্থাৎ কবি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভাবুক রবীন্দ্রনাথ বড় হয়ে উঠেছে। সমসাময়িক যুদ্ধাক্রান্ত বিশ্বে এরকম একজন সর্বময় মঙ্গলকামী চিন্তকের প্রয়োজন ছিল। ফলে দেশে দেশে সাহিত্যের বাইরে তাঁর একটা সামাজিক, কোথাও কোথাও রাষ্ট্রিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে।

 

জাপান সফরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

একই কারণে আবার তাঁকে নিয়ে সমালোচনা এবং বর্জনের প্রশ্নটিও উত্থাপিত হয়েছে। যেমন কিছু কিছু দেশে রবীন্দ্ররচনা পরিমার্জনার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও সাময়িকভাবে নিষিদ্ধও হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও প্রকাশিত হলেও সেটা প্রচারণায় আনা হয়নি। রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়াতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে, ফ্রানকোর শাসনামলে স্পেনে এমনটি ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি রবীন্দ্রনাথের যুদ্ধবিরোধী ও জাতীয়তাবাদ-বিরোধী বোধকে গ্রহণ করার মতো ছিল না। অনুরূপভাবে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ-বিরোধী মনোভাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে যুগোস্লাভিয়া, তুরস্ক, পোল্যান্ড এবং জাপানে। কারণ তারা মনে করেছে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে তাদের উত্থানপর্বের সংকটকালে জাতীয়তাবোধ তাদের সমন্বিত শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। শুরুতে রবীন্দ্র-দর্শন নিজেদের জন্য উপযোগী নয় ভেবে রবীন্দ্রনাথকে আমলে নেয়নি জাপান। চীন-জাপান যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ চীনের পক্ষ নিয়েছেন বলে রবীন্দ্র-বিমুখতা রবীন্দ্র-বিরোধিতায় রূপান্তরিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপান সফরে দেশটির বুদ্ধিজীবী মহল থেকে খুব বেশি সাড়া পড়েনি। পক্ষে বিপক্ষে মতামত তৈরি হয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথের জাপান সফরকে সামনে রেখে দেশটির লেখক Uchigasaki মন্তব্য করেছেন : The Visit of the greatest poet born in modern India will be a great stimulus for us to take an interest in Indian thought. There is a tendency among the Japanese in general to ignore India’s philosophical ideas because of the country’s political subjugation, and thus to dismiss Rabindranath as one who has come from a ruined nation. This is a great loss for us.


অন্যদিকে দেশটির প্রতিষ্ঠিত কবি-কথাসাহিত্যিক-সমালোচক Iwano Homei বলেছেন : I think it was only a year ago that you (Rabindranath) suddenly gained popularity. This was only because translators and publishing houses were trying to make money by intruducing something new. We intellectuals were not really impressed by your poetry or philosophy since your ideas were very different from those of ours.


তবে দেশটির যুদ্ধোত্তর সময়ে ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে নতুন প্রজন্মের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে জাপানে নতুনভাবে পঠিত হয়। নতুন উদ্যমে আরো বিশ্বস্ত অনুবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালে ‘Memorial Society of Rabindranath Tagore’ প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয় যেখানে দেশটির পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন। ৮ খণ্ডে রবীন্দ্ররচনা বের হয়। এ  সময় বহুভাষী ও ভারতীয় দর্শন বিষয়ে পণ্ডিত অধ্যাপক Watanabe Shoko (1907-77)-এর অনুবাদে জাপানি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণ কৃপালনী রচিত রবীন্দ্রজীবনীর অনুবাদসহ আশির দশকের শুরু থেকে আজুমার সম্পাদনায় ১২ খণ্ডে রবীন্দ্ররচনা প্রকাশিত হতে শুরু হয়।


অন্যদিকে রাশিয়ার মতো কোথাও কোথাও সাংবাদিক-লেখকরা রবীন্দ্রনাথের কথা শোনা থেকে বিরত থেকেছেন এই বলে যে, রবীন্দ্রনাথ তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং রুশ বিপ্লবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী নন; তিনি এর ভোগান্তি কি বুঝবেন? রবীন্দ্রনাথ এর মধ্যে দুঃখজনক একটি ভুলও করে বসেন। তিনি ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সমালোচকদের কণ্ঠস্বর আরো শক্ত করে দেন।  বিশেষ করে ইউরোপের বামপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলো তার বিরুদ্ধে লিখতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি পক্ষে আনতে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বন্ধু চার্লস অ্যান্ড্রুজকে একটি চিঠি লিখতে হয় রবীন্দ্রনাথকে।


তবে আরববিশ্বে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তেমন বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। আরবের লেখকরা রবীন্দ্রনাথকে নন-ওয়েস্টার্ন আধুনিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখেন। এখানেও তিনি পরিচিতি পান নোবেল জয়ের পরপরই। তবে সেটি ইংরেজি কিংবা ফরাসি অনুবাদে। আরবে রবীন্দ্রনাথের প্রথম অনুবাদক সম্ভবত লেবানি কবি উয়াদি আল-বুস্তানি (১৮৮৬-১৯৫৭)। তিনি ১৯১৪ সালে ভারত আসেন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কয়েকদিন কাটান। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা অনুবাদের পাশাপাশি কবির সঙ্গে কাটানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। এর প্রায় এক দশক পর তানিয়াস আবদুহ-এর অনুবাদে কায়রো থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।


১৯২৬ সালের মে মাসের ২৭ তারিখ মিশর সফরে যান রবীন্দ্রনাথ। সফরকালে তিনি দেশটির প্রধান প্রধান কবি ও লেখকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রবীন্দ্র-অভ্যর্থনা এই পর্যায়ে যায় যে সেদিনের সংসদীয় অধিবেশন মুলতবি রাখা হয়। এরপর রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মিশরের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের ওপর দেশটির সাতজন বুদ্ধিজীবীর লেখা ৭টি প্রবন্ধ নিয়ে একটি সংকলন বের হয়। মিশরের পর ইরানের রাজা রেজা শাহ’র বিশেষ আমন্ত্রণে তিনি ১৯৩২ সালে ইরানের তেহরান সফর করেন। একই বছর তিনি ইরাক সফর করেন। কয়েকজন প্রখ্যাত ইরাকি কবি তাঁকে উৎসর্গ করে কবিতাও রচনা করেন।

 

১৯৩২ সালে ইরান সফরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের দর্শন এবং অর্জিত সম্মান লাতিন অঞ্চলের তরুণ লেখক ও কবিদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় এ কারণে যে, তারা অনুধাবন করতে পারেন, বড়মাপের লেখক হওয়ার জন্যে য়ুরোপীয়দের মতো করে লেখা বা চিন্তা করা আবশ্যক নয়। লাতিন বিশ্বের বড়কবি নোবেলজয়ী হুয়ান রামোন হিমেনেস-এর দক্ষ হাত দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লাতিনে প্রবেশ ঘটে। ১৯১৩ সালেই হিমেনেস আর তাঁর হবু বউ মার্কিন জেনোবিয়া ক্যামপ্রাবি মিলে ‘গীতাঞ্জলি’র অনুবাদ শুরু করেন। এই অনুবাদের পাশাপাশি হিমেনেস লিখছিলেন তাঁর বিখ্যাত Platero and I গ্রন্থটি যা পরবর্তীতে স্প্যানিশ সাহিত্যের অনবদ্য সাহিত্যসৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এটি রবীন্দ্রনাথের গীতিধর্মী গদ্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হন চিলির অন্যতম প্রধান কবি নোবেলজয়ী পাবলো নেরুদাও। নেরুদা তাঁর তারুণ্যে এই বাঙালি কবির প্রেমে পড়েন। নেরুদার প্রথমত উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বিশটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান-এ তরুণ নেরুদা তার ১৬তম প্রেমের কবিতায় একটি অন্বয় সংযোজন করেন, যা অনেক সমালোচক এ-ও মনে করে যে, এটি ঠাকুরের মালি কাব্যগ্রন্থের ৩০তম কবিতা: ‘তুমি সন্ধ্যারো মেঘোমালা’-এর একটি প্রচ্ছন্ন অনুবাদ। তাছাড়া, ১৯৪৫-এ নোবেলজয়ী আরেক চিলির কবি গ্যাবরিয়েলা মিস্ত্রাল রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো সংগ্রহে সহযোগিতা করেছিলেন, যেখানে তিনি ‘মালি নিয়ে উদ্বেগ’ -এর প্রতিক্রিয়ায় নিজের বেশ কিছু ব্যাখ্যা সংযোজন করেন। রবীন্দ্র-প্রভাবিত আরেক লাতিন কবি ওক্তাবিও পাস (১৯৯০ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্ত, যিনি ভারতে কিছুকাল অবস্থানও করেন) দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাকুরের পাণ্ডুলিপির একটি বক্তৃতা দেন। পাস রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখেন :

 

[Rabindranath Tagore]’s work, as well as himself, was a bridge between India and the world. Admired by the greatest in Europe, such as W B Yeats and Andre Gide, in the Hispanic countries he also had numerous and fervent readers.

 

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবিষয়ক চিন্তা লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোস্টারিকায় সংস্কৃত বিশারদ সল আরগুয়েলোর কোস্টারিকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ বছর রবীন্দ্রনাথের উপর এক আলোচনাসভা পরিচালনা করেছিলেন যেখানে ছাত্রছাত্রীরা এই রবীন্দ্রনাথকে শুধু পঠন-পাঠনই না, তাঁর কিছু নাটক মঞ্চস্থও করেছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সল আরগুয়েলোর জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক চিন্তার উপর সে দেশের শিক্ষার ভিত দাঁড়িয়ে আছে। তাছাড়া মেহিকোর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান চরিত্র ও লেখক হোসে ভ্যাসকোনসেলোস ১৯২০-এর দিকে পশ্চিমীয় সাহিত্যপদ্ধতির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পড়ানোর চিন্তাগুলো ব্যবহার করে সাজিয়েছিলেন মেহিকোর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। এখনও কোস্টারিকাসহ লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ পঠিত হন।


রবীন্দ্রনাথ লাতিন আমেরিকা এসেছিলেন ১৯২৪ সালে— প্রথমে আর্জেন্টিনা এবং পরে পেরুতে। এই সফর তাঁকে আর্জেন্টিনীয় কবি ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সাথে পরিচয়ের সুযোগ করে দেয়। ওকাম্পো তাঁর খুব কাছের বন্ধু হয়ে ওঠেন। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার সুযোগ বর্তমান গদ্যে নেই। এখানে কয়েকটি দেশে রবীন্দ্রনাথের স্বকালে তাঁর চিন্তা-চেতনার গ্রহণযোগ্য ও সমালোচনার একটা আপাত চেহারা দাঁড় করানো হলো মাত্র।

 

কৃতজ্ঞতা :

* Rabindranath Tagore: One Hundred Years of Global Reception সম্পাদনায় মারটিন ক্যাপচেন এবং ইমরে বাংঘা। ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১৪

* শাশ্বতিকী রবীন্দ্রসংখ্যা, সম্পাদনায় বর্তমান আলোচক, রাজশাহী, ২০১২

* 'ভাবনগর' জার্নাল, সেপ্টেম্বর সংখ্যা, সম্পাদক সাইমন জাকারিয়া

 

লেখক: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়