ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একই চক্কর || নাসরীন জাহান

নাসরীন জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একই চক্কর || নাসরীন জাহান

আজকের আবহাওয়া খুব ভালো।

মাথা ঘুরিয়ে লোকটিকে দেখি। সামনে জলের স্রোত, টকটকে লাল সূর্যের অর্ধেকটাই খেয়ে ফেলেছে সমুদ্র, এ রকম পরিবেশে এই স্থানে কারও সঙ্গে কথা জমানোর জন্য এই বাক্যের তুলনা হয় না। আমিও মৃদুকণ্ঠে বলি, তা ঠিক বলেছেন, এ রকম আবহাওয়া সচরাচর পাওয়া যায় না।

বুঝলেন, এ নিয়ে তিনদিন এসেছি, সূর্য ডোবার মুহূর্তটি দেখব, লোকটি সেই কাঙ্ক্ষিত দুর্লভ দৃশ্যটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, প্রতিদিনই ঠিক এই সময়ে কোত্থেকে যে একটা কুফা মেঘ আসে!

আমিও সেই দৃশ্যের সম্মোহনের মধ্যেই রীতিমতো গেঁথে ছিলাম।

এ এমনই এক দুর্দান্ত অনুভব, এমনই হিমজ্যোতিচক্র খেলা করে চারপাশে, মহাবিশ্বের কোন অতলে নিজেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে হারিয়ে ফেলার এমনই এক ধারালো তলোয়ার, যেন বনবন ঘুরছে, জীবাণু পড়া মাত্র দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে। সেই অনুভবের মুহূর্তে ব্যাটা কী রকম এঁটো হাত ঢোকাচ্ছে।


ভ্রুর মধ্যে বিরাট এক ঢেউ তুলে দেখি, আমি রাহুমুক্ত হয়েছি। খপ করে গিলে ফেলেছে সূর্যটি, এরপর কী নির্বিকার, কী স্থির জল, যেমন- আমি খাইনি, এমনই এক গোবেচারা মুখ। আকাশটা এখন সাদাটে, শুধু একটু কালো রং উড়ে উড়ে তার মধ্যে কি এক বিষণ্নতা ঢুকিয়ে দিতে চাইছে।

কদিন যাবত আপনাকে দেখছি, লোকটি ধুলো ঝেড়ে দাঁড়ায়, মনে হচ্ছে আপনিও আমার মতন নিঃসঙ্গ।

সব ছায়া কেটে গেলে এবার অবাক হওয়ার পালা।

লোকটি সেধে নিজেই কথা বলতে চাইছে। বয়সের এমন একটা প্রান্তে এসে পৌঁছেছি, কাউকে ডাকলেও একটা সুস্থির জবাব পাই না। আমিও কোনো রকম একটা কিছু বলে লাপাত্তা হয়ে যাই।

এককালে জীবনে আলো ছিল, গান ছিল, সে সময় অনেকেই চিনত। ইচ্ছে করে আলাপ জমাতে চাইত। সেই সূর্যাস্তের মুহূর্তে আমি যেন নিমজ্জিত ছিলাম সেই বয়সে, আমার কপালে জমেছিল সেই বয়সের ভাঁজ। গত দশ বছরের মধ্যে কেউ আমার সাথে সেধে আলাপ জমাতে চায়নি। আমার বিস্মিত হওয়ার কথা ছিল, তার বদলে কী-না উল্টো বিরক্তি? মাটিতে হাত চেপে আমিও দাঁড়াই, বয়সটাই এমন, নিঃসঙ্গতার! বুঝলেন, এই দেশে তা-ও কিছু দাম আছে- বাইরের দেশে কুকুরও শুঁকে দেখে না।

কথাটা বলেই মনে হলো বেখাপ্পা হয়ে গেল। লোকটির সামনে অস্বস্তিবোধ করি-এ জন্যেই হয়তো আমার সাথে কেউ কথা বলে শান্তি পায় না।

লোকটি যেন আমার মনের চিন্তা ছিঁড়ে নেয়, বুঝলেন, কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে সুখ পায় না।

কিছুক্ষণ বলার পরই দেখি হাই তুলছে, বলে বড় পেঁচাও তুমি অথবা বলে, বড়ো শব্দ তোমার কথায়। কত কী যে বলে। আমি কিন্তু চেষ্টা করি যদি একটু রসিয়ে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু শব্দের ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারি না। দেখা যায় যে কথাটা বলতে হয় ফিসফিসিয়ে তার মধ্যেও শব্দ ঢুকে পড়েছে, আপনিই বলুন মানুষের কথাতেই তো শব্দ হবে। গাছপালা পশুপাখি জলের মাছেরা কি শব্দ করে আলাপ করে ?

তার কথার তোড়ে আমিও হাঁপিয়ে উঠি। তার সমস্যাটা ধরতে পারি, বড়ো খরখরে কণ্ঠ তার, এ ছাড়া বলার ভঙ্গিটা ক্লান্তিকর, যেন মুখস্ত কিছু আউরে যাচ্ছে।

হোটেলে ফেরার জন্য হাঁটছি, সে বলে, আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?

না না, আমার ভালোই লাগছে।

ভালো লাগার অবশ্য কোনো কারণ নেই। কোটে হাত ঢুকিয়ে মৌজ করে সূর্যাস্ত দেখছিলেন। আমিও এই মুহূর্তটার জন্য কদিন যাবত মুখিয়ে আছি, অথচ দেখুন সেই মুহূর্তেই আমি আপনার সঙ্গে বকবক শুরু করে দিয়েছিলাম, যেন এমন জরুরি কথা সেই মুহূর্তে না বললেই চলত না।


আপনি কথা জানেন ভালো।

ধন্যবাদ! কিন্তু আমার বলার ভঙ্গিটা বড়ো বিশ্রী।

না, তা হবে কেন? বলে আমি দাঁড়িয়ে চশমার ধুলো মুছি, আপনি একাই এসেছেন?

আমি একাই এসেছি, বলে লোকটি হাসে, মানুষ তো একাই, কী বলেন, এই যে পৃথিবীতে আপনার এত লোক আছে কিন্তু আপনি একটি বিপজ্জনক বয়সকে সঙ্গে নিয়ে একা পথ চলছেন।

আমি হেসে ফেলি, মানুষের সব বয়সই বিপজ্জনক, একটি শিশু, একজন যুবতী, বৃদ্ধা। ঠিকই বলেছেন আপনি, যদি অসুখে পড়ি, সে তো এই বয়সে হতেই পারে, না? যদি মাথা ঘুরে যায়, কেউ ধরার নেই। পৃথিবীতে অনেক লোক আছে আমার কে বলল আপনাকে, তাহলে কি একা পথ চলি?

আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?

কেন বারবার এই প্রশ্ন করছেন?

আমি কিছু কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে, সে এক দীর্ঘ কাহিনি। জানেন বুক ফেটে মরে যাচ্ছি, কাউকে বলতে পারছি না, আপনি একলা একজন এই বয়সের মহিলা, সমুদ্র পাড়ে, সূর্যাস্ত দেখছেন, লক্ষ করছি, হ্যাঁ কদিন যাবতই। খোঁজও নিয়েছি আপনার সম্পর্কে, আপনার কী সব বইটই আছে। তার মানে লেখিকা, আপনি আমার বিষয়টা বুঝবেন। শুধু বিরক্ত হবেন না, ধৈর্য ধরে শুনবেন, তাতেই আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচব।

তাহলে তো বহু দূর এগিয়েছেন, আমি হেসে ফেলি, আমার অনেক খবরই জানেন। সে কাহিনি কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ?

আমার জন্য সেটা আমার অস্তিত্বের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি শুধু শুনবেন, এরপর আপনার সরল প্রতিক্রিয়া জানাবেন, আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

ঠিক আছে আপনি কাল সন্ধ্যায় আসুন, আজ আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।

অসীম দয়া আপনার।


পরদিন লোকটি এসে একটানা নিজের দুঃখ-কষ্টের বর্ণনা দিয়ে সকালটাকে পচিয়ে ফেলে। প্রথমে আমি অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে তার বেদনার সঙ্গে একাত্ম হতে চাইছিলাম। তার স্ত্রী অন্যের হাত ধরে চলে গেছে, সন্তানেরা তাকে দেখছে না, বোকার মতো সে তার সব সম্পত্তি ওদের নামে লিখে দিয়েছিল, এরপর এখন কি রকম দুর্বিষহ তার দিনরাত্তির যাচ্ছে, স্রেফ পথের ভিখিরি সে, এইসব কথাই সে বলছিল খুঁটিনাটি বর্ণনার মাধ্যমে, স্ত্রীর চেহারা, গড়ন, প্রতিটি সন্তানের আলাদা বৈশিষ্ট্য, পিতা হিসেবে নিজ চরিত্রের বিশাল মহানুভবতা, সবই তাৎপর্যময়, কিন্তু বলার ধরন একঘেঁয়ে, ফলে তার বেদনাও হয়ে ওঠে আমার জন্য ক্লান্তিকর।

আমি দুপুর পেরোতে থাকলে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিই।

সে অদ্ভুত কণ্ঠে বলে, এখনো তো আসল প্রসঙ্গেই আসি নি।

আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি, বলি আমাকে এসব বলে কী লাভ? আমি কী করতে পারব আপনার?

আপনি লেখিকা মানুষ, আপনি আমাকে নিশ্চয়ই একটা পথ দেখাতে পারবেন। মানুষ, মানুষের মন এসব নিয়ে আপনার কাজ, আপনি যদি না পারেন-

দেখুন, আমি মনোচিকিৎসক নই, এ ছাড়া আপনার যা সমস্যা সেখানে মনোচিকিৎসকেরও কিছু করার নেই, আসামি আপনার সন্তানেরা, আপনি নিজে তাদের সব লিখে দিয়েছেন, এখানে আইনও কিছু করতে পারবে না।

আমি তো বলেছিই, আমার মূল সমস্যায় এখনো আমি আসি নি। লোকটি নখ খুঁটতে থাকে, সমস্যা আমার বন্ধু আবদুর রহমানের।

কী আশ্চর্য! আপনি আপনার বন্ধুর সমস্যা বলার জন্য আমাকে খুঁজে বের করেছেন? তা ছাড়া আমি কে? কয় অক্ষরই বা লিখেছি? এ দেশে আপনি আর লেখক খুঁজে পেলেন না?

আপনার প্রশ্নের উত্তর পর্যায়ক্রমে দিচ্ছি, লোকটির কণ্ঠ অকস্মাৎ ঝনঝন করে ওঠে, প্রথমত, এখন আমার বন্ধুর সমস্যাই আমার সমস্যা, আমি তাকে সেইভাবেই অনুভব করি।

দ্বিতীয়ত, আপনি কে এই তো? আপনি আমারই মতো সংসার পরিত্যক্ত, কিন্তু অসীম মনোবল নিয়ে একাকী জীবনযাপন করছেন এ রকম একজন নারী, তৃতীয়ত আমি যে সমস্যার কথা বলব, সেটা উপলব্ধি করার ক্ষমতা একমাত্র আপনার আছে। আমি অন্তত এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে এসেছি।

আমি চুপ হয়ে থাকি। এমনিতে কারোর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য পাগল হয়ে থাকি। এ রকম অবস্থায় কেউ যখন আগ্রহে কথা বলতে চাইছে, আমার আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু এ রকম অবস্থায় আমি একজন শ্রোতা চাই, যে আমাকে আমার নিঃসঙ্গতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে অনুভব করবে। কারও দুঃখ-বেদনা-বিপর্যয় শোনার মতো মানসিক অবস্থা আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এই লোক আজ আমাকে ছাড়বে না, জানি না কখন তার সব বৃত্তান্ত বর্ণনা শেষ হবে।


আবদুর রহমান ছিল নিজে অসুখী, ধীর কণ্ঠে লোকটি শুরু করে। নিজের জীবনে অশান্তি থাকলে যা হয়, যা কিছু সহজ যা কিছু সুন্দর সবকিছুই কুৎসিত বাঁকাচোরা মনে হয়। অন্যের জীবনের সুখ মনের মধ্যের দাউদাউ ঈর্ষাকে ফাঁপিয়ে তোলে।

আমি মাথা তুলে বলি, আপনি নিজের উপলব্ধি আবদুর রহমানের ওপর চাপাচ্ছেন কেন?

লোকটি বলে, এই উপলব্ধি নিছক আমার নয়, সাধারণ মানুষের যা হয় আমি সেটাই বললাম, আবদুর রহমানেরও তা-ই হয়েছিল, তার মধ্যবয়স্ক এক সহকর্মীর সুখ-শান্তি তাকে উন্মাদ প্রায় করে তুলেছিল।

সেই সহকর্মীও ছিলেন যন্ত্রণাকর চরিত্রের, সারাক্ষণ স্ত্রীর গল্প, এই বয়সেও স্ত্রী তার প্রতি কেমন নিবেদিত, সারাবছর দুজনে কীভাবে সঞ্চয় করেন শীতকালীন ভ্রমণের জন্য, অফিস শেষ হতেই কীভাবে ঘর তাঁকে টানে, এইসব গল্প, লাঞ্চ ব্রেকের সময় সারাক্ষণ আবদুর রহমানের সঙ্গে, কাহাতক সহ্য হয় তার? একদিন সহকর্মীকে চ্যালেঞ্জ করে বসে সে, মানুষের কোনো-না-কোনো শূন্যতা থাকেই, নিশ্চয়ই এত কিছুর পরও সহকর্মীর কিছু শূন্যতা আছে।

সহকর্মী স্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, আমার কোনো শূন্যতা নেই।

আবদুর রহমান ক্ষেপে ওঠে, দীর্ঘ জীবনে স্ত্রীকে নিয়েই আপনি পূর্ণ- এ হয় না, নিশ্চয়ই আপনি এখনো কোনো সুন্দরী যুবতীর প্রেমে পড়তে পারেন। আপনি সেই পথের ধার ঘেঁষেন না বলেই নিজেকে আপনার জানা হয়ে ওঠেনি।

সহকর্মীর সে কী বেদম হাসি, তুমি মানুষের জীবনের নির্মল সুখ কি তা-ও চেনো না, তুমি যে কথা বলছ সে হলো পৈশাচিক সুখের কথা। আমি নির্মল সুখেই পূর্ণ।

আমি ঘাড় তুলে বিষয়টির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করি, কিন্তু আবদুর রহমানের অসুখটা কি ছিল?

লোকটি এতে বিগলিত হয়ে পড়ে। শুনতে চান? সে এক লম্বা কাহিনি, আপনি শুনতে চাইলে অবশ্যই আমি বলতে পারি।

আপনি সংক্ষিপ্ত করে বলুন।

লোকটি দমে গিয়ে বলে, সব কথা কি অত অল্পের মধ্যে সারা যায়?

আমার ক্ষুধা পেয়েছে, ভাবি, আপনি কাল এসে বিস্তারিত বলুন, এটাই বলব তাকে।

ইতিমধ্যে সে আবদুর রহমান বৃত্তান্ত শুরু করে দিয়েছে। তার জন্ম, কীভাবে সে বড় হচ্ছিল, তার চিন্তার গতি প্রকৃতি, লোকটি আবদুর রহমানের শৈশবের মধ্যেই এক ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়, ততক্ষণে আমি ধৈর্য রক্ষার শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি।


সত্যি বলতে তার এরপরের বর্ণনাগুলো সঠিকভাবে আর আমার কানে যায় না। তবে বিচ্ছিন্নভাবে, কিছু টুকরো শব্দ জোড়া করলে সেই দীর্ঘ কাহিনির সংক্ষিপ্ত রূপ যা দাঁড়ায় তা হলো, সেই ভয়ানক জেদ আর ঈর্ষা আবদুর রহমানকে উন্মাদ প্রায় করে তুললে সে অফিস শেষে একদিন তার সহকর্মীকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে। তার স্ত্রী ছিল তারচেয়ে পনেরো বছরের ছোট।

সেই সুন্দরী স্ত্রী আবদুর রহমানকে একদম ভালোবাসত না। স্ত্রীকে সে অনুরোধ জানায়, সে যেন সহকর্মীর সঙ্গে আন্তরিক সুন্দর আচরণ করে।

এই খেলায় সে একসময় সফল হয়। দু-তিন সন্তানের মা হয়েও মহিলার মধ্যে ছিল হাজার রঙ, কুমারীর অভিব্যক্তি।

যা হোক, ক্লান্ত আমি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এই ঘটনা শুনে হেসে ফেলি, তাহলে সেই দাম্পত্য জীবনে সুখী লোকটি সেই সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়েছিল?

লোকটি গভীর বেদনার্ত কণ্ঠে বলে, প্রেম কি সোজা প্রেম? একেবারে পৈশাচিক প্রেম, সব মিলিয়ে আবদুর রহমানের যখন হুঁশ হয় তখন বেলা অনেক গড়িয়ে গেছে। অফিসের ফাঁকেও কাজ ফাঁকি দিয়ে সেই সহকর্মী আবদুর রহমানের স্ত্রীর কাছে চলে যেত।

আপনি এখন বলতে চান কী?

আমি বলতে চাই, আবদুর রহমানের কি প্রায়শ্চিত্ত হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

আমি হেসে ফেলি, দেখুন যে ঘটনা বলছেন সেখানে সবাই পরিণত, যে সহকর্মীকে স্ত্রী সুখের চেয়েও বেশি টেনেছে অন্য সুখ, এখানে মূল নায়ক সে, সে আবদুর রহমানের ওপর কিছু সময়ের জন্য ভর করেছে মাত্র। নিশ্চয়ই তার মধ্যেও কিছু শূন্যতা ছিল। সেই লোকটি কি বাচ্চা, তাকে ফুঁসলে কেউ বিপথে নিয়ে গেছে বলা যাবে ?


তবুও, অস্ফুটকণ্ঠে উচ্চারণ করে লোকটি, মানুষের নির্মল সুখের মধ্যে কখনো ছায়ার মতো হাত বাড়ায় অশরীরী জন্তু, পরিণত বয়সেও, একজন মানুষ তার খপ্পরে পড়তে পারে। মানুষের মধ্যে একটা আজন্ম শিশু সত্তা আছে, ঠিক সেইটাকে নাগালে নিয়ে, আমি কি আপনাকে বোঝাতে পারছি? আপনি বুঝতে পারছেন না কেন মন্দের জোর বড়ো বেশি? একজন লোক মুক্ত সুন্দর জীবন নিয়ে যখন সুখী, ধরা যাক সেই মানুষ বড়ো সরল, তার সেই সরলতার পথ ধরে মন্দের বহুবর্ণ চেহারায় সেই মানুষকে ধাঁধিয়ে কেউ যদি সব তছনছ করে দেয়, আপনি তাকে দোষ দেবেন না? তাহলে তো শয়তানও দোষী নয়, সে-ও তো পরিণত মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়।

দেখুন, আমি এই ঘটনায় নতুন করে আবদুর রহমানের প্রায়শ্চিত্তের কিছু দেখছি না, সে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল দিয়েছে।

লোকটির কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে ওঠে, আপনি মনে করছেন তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে?

কেন বুঝতে পারছেন না, আপনি এমন কোনো অজানা রহস্যের প্যাঁচ আমার সামনে কষেন নি আমি বুঝব না আপনি কে, বলতে বলতে আমার শরীরে হিমস্রোত বয়ে যায়, যা ছিল অচেতন, নিস্তরঙ্গ, সেই ঘটনা, যা ছিল একান্তই নিজস্ব পাথরের মতো স্থবির তা একসময় আশ্চর্য এক আঁধারে রূপ নেয়, আমার গলা ঠিকরে তেতো জল উঠে আসে, আপনার স্ত্রী-তো এখন সেই লোকেরই সংসার করছে এক সময় যে আমার স্বামী ছিল, সে কবেকার কথা; কেন এতদিন পর এইসব নিয়ে এসেছেন?

লোকটি কেঁদে ফেলে, অনেক ঘুরেছি, কোথাও আমার শান্তি হয় না, সেই নির্মম ঘটনার নির্দোষ বলি ছিলেন আপনি এবং আমিই সেটা ঘটিয়েছি, যতবার ভেবেছি, বিশ্বাস করুন-

আমি এইবার আক্ষরিক অর্থেই, নেতিয়ে পড়ি, নির্দোষ বলি? মিস্টার আবদুর রহমান, আপনি ভালোই বলেছেন, মানুষের সংসারে সুখের ফাঁক না থাকলে কাউকে কেউ অত সহজে মন-ভোলানো পথে টেনে নিয়ে যেতে পারে? আমাদের দাম্পত্য জীবনে সুখ ছিল, বড় একঘেয়ে বড়ো ক্লান্তিকর সেই সুখ, সে যখন সেই পথে হেঁটে গেল, সে-ও বাঁচল, আমিও নিজেকে একলা করে জানার, চেনার সুযোগ পেলাম। বুঝলেন, একধরনের শৃঙ্খল থেকে যেন আমার মুক্তি হলো, এই দেখুন, কথা বলার নেশায় পেয়েছে আমাকে আর এখন আপনি কেমন ঝিমিয়ে পড়ছেন-।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়