ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নিজেকে কখনও তত্ত্ব বা এজেন্ডার বেড়াজালে আবদ্ধ করিনি: রিজিয়া রহমান

মোজাফফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৫, ১৭ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিজেকে কখনও তত্ত্ব বা এজেন্ডার বেড়াজালে আবদ্ধ করিনি: রিজিয়া রহমান

রিজিয়া রহমান

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অগ্রগামী ও প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের অন্যতম রিজিয়া রহমান। তাঁর উপন্যাস ও গল্প বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস থেকে আধুনিক বাংলাদেশের জন্মকথা, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বাস্তবতা, যৌনপল্লীর  নিষিদ্ধ-জীবন এবং চা-শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক, আদিবাসী ও হাওর জীবনের সংগ্রাম প্রভৃতি বিষয় তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন আশ্চর্য নির্লিপ্ততায় এবং শিল্পিতভাবে। এই আলাপচারিতায় তাঁর সাহিত্য, সমাজ ও জীবনভাবনার কিছু অংশ উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন মোজাফফর হোসেন।

মোজাফফর হোসেন: গল্প লিখতে শুরু করলেন কখন?
রিজিয়া রহমান: লেখা যখন শুরু করেছি তখন আমার বয়স সবে আট পেরিয়েছে। তখন কবিতা লিখতাম; ছন্দ মিলিয়ে। ক্লাস ফোরে উঠে ভ্রমণকাহিনি লিখেছি। আর গল্প লেখা আরেকটু বড় হলে; কলকাতায় ‘সত্যযুগ’ নামে একটা পত্রিকা বের হতো, ওখানে আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়। এরপর কলেজে উঠে কিছু গল্প লিখেছি। কেন লিখেছি, এখন সেটা বলা মুশকিল।

মোজাফফর হোসেন: শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
রিজিয়া রহমান: সিরিয়াসলি গল্পচর্চা শুরু করি ষাটের দশকে এসে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়ি। প্রথম উপন্যাস লিখি ফাইনাল ইয়ারে উঠে, ১৯৬৭ সালে ‘ঘর ভাঙা ঘর’। এই সময় প্রথম গল্পের বই বের হয়। গল্প আমি আগে থেকেই লিখতাম। কিন্তু ষাটের দশকে এসে আমাদের রাজনৈতিক বোধটা স্বাধীনতা অর্জনের দিকে প্রবাহিত হলো। ভেতরে একটা উদ্যম তৈরি হলো। ষাট ও সত্তর দশকে আমি লিখেছি একটা সচেতনতা থেকে। আমি মনে করেছি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা করে আমরা বাংলাদেশের জন্য একটা সাহিত্য তৈরি করবো- নিজস্ব সাহিত্য। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য আলাদা হয়েছে কারণ সেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ আলাদা। একাত্তরের পর আমরা সদ্য স্বাধীন জাতি, অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্য ক্ষেত্রেও একটা স্বকীয় ক্ষেত্র গড়ে তোলার চেষ্টা আমাদের ভেতর ছিল। বাংলাদেশের জীবনটাই এখানে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। অবদমিত ও বঞ্চিত জাতি হিসেবে সাহিত্যটা ছিল আমাদের একটা প্রতিবাদের হাতিয়ার। সামনে আমাদের ছিল রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হলে, আমরা তাঁকে সামনে রেখেই আন্দোলনে নেমেছি।

বাংলাদেশের সাহিত্যকে ‘আঞ্চলিক সাহিত্য’ হিসেবে ভাগ করা যায় না। কেননা বাংলাদেশ কতগুলো অঞ্চলের সমষ্টি। আমার মতে, খাল-বিল হাওর আছে, সমতল ভূমি আছে, উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ, পার্বত্য অঞ্চল- ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছু মিলে একরকম মনে হলেও জীবনযাপনে বিশেষ বৈচিত্র্য আছে। এই বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে আমি আমার গল্প-উপন্যাসে আনবার চেষ্টা করেছি। তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশ- সেটাই আমাদের নিজস্ব সাহিত্য।

মোজাফফর হোসেন: আপনার কি মনে হয়, এতদিনে আমরা সেই স্বকীয় সাহিত্যসুর নির্মাণ করতে পেরেছি?
রিজিয়া রহমান: অবশ্যই পেরেছি।  

মোজাফফর হোসেন: কথাসাহিত্যে আসার কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছিল?
রিজিয়া রহমান: না। ওরকম কোনো চিন্তা তখনো করিনি। লেখক হবো এই চিন্তাটাই মাথায় এসেছে অনেক পরে।

মোজাফফর হোসেন: গল্প লেখার জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছেন?
রিজিয়া রহমান: না, সচেতনভাবে কোনো প্রস্তুতি আমি নিইনি। আর কাউকে পড়ে অনুকরণও করতে যাইনি। সত্যি কথা বলতে, যখন যে বিষয় আমাকে ধাক্কা দিয়েছে, আমি সেই বিষয়ে গল্প লিখেছি। আমি তৈরি হয়ে গল্প কখনোই লিখিনি। উপন্যাস হয়ত অনেক তৈরি হয়ে লিখতে বসেছি, কিন্তু গল্পে আমি কখনো সেটা করিনি।

মোজাফফর হোসেন: আপনার লেখার কৌশল বা ক্রাফট কী?
রিজিয়া রহমান: নির্মাণশৈলী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে। সত্তর দশকের ভাষা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আশির দশকের পরে এসে বদলেছে। ষাটের দশকের উত্তাল রাজনৈতিক আবহ আবার আরেক রকম ছিল। সময়ের এই বাকবদলের সঙ্গে সঙ্গে আমার সাহিত্য-ভাষা ও আঙ্গিক বদলেছে। যেমন এখন যে গল্পগুলো লিখছি সেগুলো নির্মাণে আগের লেখাগুলো থেকে ভিন্নতা চোখে পড়বেই। আমার ‘দূরে কোথাও’ বইয়ে ফর্মটা অটোমেটিক ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এভাবেই হয়। মোটা দাগে, আঙ্গিকনির্ভর বা প্রথাবিরুদ্ধ গল্পগুলো আমার নব্বই দশকে লেখা। আবার আমার শেষ উপন্যাসে ইচ্ছে করেই পুরো আঙ্গিক গুঁড়িয়ে দিয়েছি, আদি-মধ্য-অন্ত বলে কিছু রাখিনি। ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসটিও খুব স্বাভাবিক আঙ্গিকে লিখিনি। ‘সূর্য সবুজ রক্ত’ উপন্যাস পুরোটাই ফ্ল্যাটভাবে লেখা। কোনো প্রধান চরিত্র সেখানে নেই। মিলন-বিরহ-ট্র্যাজেডি-ক্লাইমেক্স- এসব নেই।

মোজাফফর হোসেন: ছোটগল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই ক্ল্যাসিক সংজ্ঞাটা কি যায় এখনকার গল্পের সঙ্গে?
রিজিয়া রহমান: সাহিত্যকে তো সংজ্ঞা দিয়ে বেঁধে দেওয়া যায় না। সৃজনশীল সাহিত্য বাংলা ব্যাকরণ বই নয়। প্রতিনিয়ত পৃথিবী বদলাবে, জীবন বদলাবে, তাই মানুষের সৃজনশীলতার রূপ বদলাবে। তাই অনেক সময় বড় বেদনাও ছোটগল্পের বিষয় হতে পারে, একটা অংশ হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ একটা ভালো গাইডলাইন দিয়েছেন। কিন্তু ছোটগল্প এখন এই গাইডলাইন থেকে বের হয়ে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের সময়কার সেই কলোনিয়াল পিরিয়ড আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এক না। বাংলাদেশ এখন ফার্স্ট গ্রোয়িং কান্ট্রি, অথবা গ্লোবাল ভিলেজের অংশ, কিংবা বলা যায় জঙ্গীআক্রান্ত বাংলাদেশ। এখন রবীন্দ্রনাথের সেই ছোট দুঃখ, ছোট ব্যথা, ছোট বেদনা নিয়ে বসে থাকা যায় না।   

মোজাফফর হোসেন: আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কী?
রিজিয়া রহমান: নিজের লেখা মূল্যায়ন করার মতো দুঃসাহস আমার নেই। আমি যা লিখি এবং পরে যখন পড়ি, আমার খুব লজ্জা লাগে। আরো ভালো করে লেখা যেত বলে প্রতিপাঠে মনে হয়। আমি কী লিখতে চেয়েছিলাম, সেটা বলতে পারি, কিন্তু নিজের গল্পের মূল্যায়ন আমি করতে পারি না।

মোজাফফর হোসেন: আপনার প্রিয় গল্পকার কে কে?
রিজিয়া রহমান: ছোটবেলা ছিল শিবরাম চক্রবর্তী, আরো ছোটবেলা ঠাকুরমার ঝুলি। বড় হলে যাঁদের গল্প আমার ভালো লেগেছে তাঁদের নাম করতে গেলে লম্বা একটা তালিকা হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব গল্প আমার পড়া। অসাধারণ গল্পকার তিনি! মানিক-শরতের কিছু কিছু গল্প ভালো লেগেছে। তারাশঙ্করের গল্প ভালো। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের চেয়ে উপন্যাস আমাকে টেনেছে বেশি। সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রমথ চৌধুরী ও বনফুলও আমার প্রিয় গল্পকার। প্রেমেন্দ্র, অচিন্ত্য, মতি নন্দী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এঁদের অনেক ভালো গল্প আছে। বুদ্ধদেব ও সুনীলের একটি দুটি গল্প খুব ভালো লেগেছে। বাংলাদেশ পর্যায়ে হাসান আজিজুল হকের সব গল্পই আমার ভালো লাগে। সৈয়দ শামসুল হকের নাম তো করতেই হয়। এরপর শওকত আলী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, রাবেয়া খাতুন এঁদের কিছু কিছু গল্প আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আর বাইরের গল্পের ভেতর আমি খুব পছন্দ করতাম রাশিয়ান আর ফরাসি ছোটগল্প। বিশ্বসাহিত্যে পুশকিন, তলস্তয়, গোগল, মপাসাঁ- এঁদের অধিকাংশ গল্পই সাংঘাতিক ভালো!

মোজাফফর হোসেন: কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন?
রিজিয়া রহমান: আমি যখন লিখি তখন পাঠকও থাকে না, আমিও থাকি না। কেবল চরিত্ররা থাকে। অনেকে আমাকে বলেন যে, আপনার লেখা তো মেয়েদের মতো হয় না। আমি ওদের বলি, আমি যখন লিখি তখন আমি নারীও না, পুরুষও না। তখন আমি আমার চরিত্রের সঙ্গে থাকি। ওদের নিজস্ব গতি আমাকে টেনে নিয়ে যায়। আমি কারো কথা মনে রেখে কিন্তু কোনো গল্প লিখিনি। তবে আমি পাঠকের দিকে তাকিয়ে না লিখলেও পাঠক সৃষ্টি করতে চাই। আমি চাই আমার জন্যে পাঠক তৈরি হোক।

মোজাফফর হোসেন: আপনার সাহিত্যে নারী চরিত্ররা অনেক বেশি দৃঢ় ও বলিষ্ঠ। এটা কি কোনো চেতনা থেকে? মানে নারীবাদী লেখক হিসেবে নিজেকে কখনো ভেবেছেন কিনা?
রিজিয়া রহমান: আমি নিজেকে কখনও কোনো তত্ত্ব বা এজেন্ডার শ্লোগানের বেড়াজালে আবদ্ধ করিনি। লেখাকে তো নয়-ই। তাছাড়া নারীকে আমি মানুষ হিসেবে দেখতে পছন্দ করি, শুধু নারী হিসেবে নয়। আমি মনে করি, জন্মগতভাবে এ পৃথিবীতে সবকিছুতেই মানুষমাত্রই রয়েছে অধিকার। তিনি নারী বা পুরুষ  যিনিই হোন। বিশ্বাস আমাকে দিয়ে লেখায়- আমি সেই ধারারই লেখক। এতে নারীবাদ, মানবতাবাদ, প্রকৃতিবাদ সবই থাকতে পারে। আসলে আমি লিখি সব মানুষের কথা, মানুষেরই জন্য।

মোজাফফর হোসেন: প্রাচীন বাংলা থেকে বর্তমান বাংলা, বেলুচিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, চা-শ্রমিক, মুক্তিযুদ্ধ, নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী, যৌনপল্লী- এমন বিচিত্র বিষয় নিয়ে আপনি উপন্যাস লিখেছেন। এমন বিষয়বৈচিত্র্য বাংলাদেশের আর কোনো কথাশিল্পীর সৃষ্টিকর্মে পাই না। বিষয় পরিবর্তনের সাথে সাথে আঙ্গিক নির্বাচনে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা?
রিজিয়া রহমান: বিষয় ও আঙ্গিক নির্ধারণে তেমন জটিলতার সম্মুখীন আমাকে হতে হয়নি। তবে অনেক উপন্যাস, বিশেষ করে, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক উপন্যাসগুলো লিখতে গিয়ে তথ্য পেতে প্রচুর লেখাপড়া করতে হয়েছে। উপন্যাসের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে পূর্ব পরিকল্পিত বা সচেতনভাবে আঙ্গিক তৈরিতে মনোযোগ দিইনি আমি। উপন্যাসের বিষয়ই আঙ্গিক নির্বাচন করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াবার অভিজ্ঞতা থাকায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকেই এসে গেছে উপন্যাসের বিষয়। কখনও ইতিহাস বা নৃতত্ত্বের পড়াশোনা থেকেও খুঁজে পেয়েছি উপন্যাস লেখার বিষয়। যে অঞ্চল, যে মানুষ, যে জীবন আমাকে আকৃষ্ট করেছে, সে বিষয় ধরে লিখতে পেরেছি উপন্যাস।

মোজাফফর হোসেন: শেষ প্রশ্ন, বাঙালির জাতীয়তাবোধ, স্বকীয় সাহিত্যভাষা তৈরিতে আপনাদের সময়কার লেখকদের তো বড় ভূমিকা ছিল। এটা কি আপনারা সময়ের দাবি থেকে করেছেন?
রিজিয়া রহমান: বাঙালির জাতীয়তাবোধ রাতারাতি তৈরি হয়নি। এদেশের অধিবাসীরা পৃথিবীর নানা স্থান হতে আগত মানবপ্রবাহ, বিভিন্ন ভাষাভাষী, সংস্কৃতি-ধর্মের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক মিশ্র জাতি। আর এই বহুত্ববাদি স্রোত একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার বিবর্তনের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির জাতীয়তার পূর্ণত্ব প্রাপ্তির বিষয়টি। আইডিনটিটি বা আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটিও বারবার তাই সামনে এসেছে। অস্বীকার করা যায় না, বাঙালির ‘আইডিনটিটি ক্রাইসিস’ বা আত্মপরিচয় বিভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠার জন্যই ঐতিহাসিক দুটি ঘটনার প্রয়োজন হয়েছে-একটি আমাদের ভাষা আন্দোলন, অপরটি মুক্তিযুদ্ধ।

বাঙালি আইডিনটিটি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের। উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি শাসন আমাদের ভাষার ওপর আঘাত হানলে সাহিত্যকেই আমরা প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে কলমে তুলে আনি। দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত এদেশে যে সাহিত্য আমরা পেয়েছি, সে সাহিত্য আত্মপরিচয়ের সংকটে কিছুটা বিভ্রান্তিতে ছিল। পঞ্চাশের দশকে এসেই সে সংকট কেটে গেল। আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন প্রমুখ প্রতিভাবান কথাসাহিত্যিক এবং কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল গণি হাজারী প্রমুখ কয়েকজন আত্মপরিচয় সচেতন কবি নতুন ধারার সাহিত্য মঞ্চ গড়ে তুললেন, তৈরি করলেন বাংলাদেশের মজবুত ভিত।

ষাটের দশক ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসের এক নতুন বাঁক, বলা যায় এক নতুন জাগরণ। যে জাগরণ ছিল জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ। এই সময় পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনে বাঙালি জাতিসত্তা বিলোপের চক্রান্তে ভেদমূলক শিক্ষানীতির প্রণয়ন, এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্য-শিল্পের দমন প্রচেষ্টা যখন প্রবল, ঠিক তখন ইতিহাসের দাবি মেটাতেই বাংলা সাহিত্যাঙ্গণে এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ সাহিত্যিকের উত্থান ঘটে। শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, রাহাত খান, সেলিনা হোসেন ও আরও উজ্জ্বল কিছু কথাশিল্পীর আবির্ভাব এই ষাটের দশকেই। বিশেষ করে, বাংলাদেশের কবিতায় এলো অভূতপূর্ব স্বকীয়তার জোয়ার। একইসঙ্গে এতজন প্রতিভাদীপ্ত জাতি ও দেশ সচেতন কবি বাংলা কবিতায় আর দেখা যায়নি। এই ষাটের দশকেই বাঙালি-জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ নবীন সাহিত্যিকেরা সাহিত্যকেই করে তুললেন প্রতিবাদের অস্ত্র। দ্রোহে-ক্ষোভে, সংক্ষুব্ধ-প্রতিবাদে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ী চেতনার উৎসারণ ঘটল। বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন বিপুল সম্ভারে। স্বৈরাচারী বিদেশি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবোধের শক্তিশালী মঞ্চ। এ সবই ছিল ইতিহাসের দাবির পরিপূরণ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়