ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জর্জ সন্ডার্সের করুণ-হাস্য

কে এম রাকিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২০ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জর্জ সন্ডার্সের করুণ-হাস্য

জর্জ সন্ডার্স

কে এম রাকিব : ‘আস্ক দি অপ্টিমিস্ট’ নামের একটা লেখা পড়ে জর্জ সন্ডার্সের লেখার সঙ্গে পরিচয়। লেখক হিসেবে তার শক্তিমত্তা বিবেচনায় নিলে লেখাটি এমন আহামরি কিছু ছিল না, অথচ ওই লেখাতেই টের পেয়ে গিয়েছিলাম একটা তুমুল হাস্যরসাত্মক গল্পও কি পরিমাণ ডার্ক আর ডিস্টার্বিং হতে পারে। পরে তার সমস্ত রচনা খুঁজে খুঁজে পড়তে চেষ্টা করেছি। এবার প্রিয় এই লেখক ম্যান বুকার পুরস্কারে ভূষিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজনা বোধ করেছি। এই লেখা সন্ডার্সের একজন পুরনো পাঠক হিসেবে প্রতিক্রিয়াধর্মী, সমালোচনাধর্মী নয়।


সন্ডার্স শুধু গল্পকার বা ঔপন্যাসিকই নন, একজন ভালো প্রাবন্ধিকও। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ‘দ্য ব্রেইনডেড মেগাফোন’-এর মতো প্রবন্ধের বইয়ে। বর্তমানে লেখার এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রাবন্ধিক বা ঔপন্যাসিক হিসেবে নয়, মূলত গল্পকার হিসেবে সন্ডার্সকে নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে চাই সংক্ষেপে।

আমেরিকায় বইয়ের বাজার-কাঠামো যেমন, তাতে উপন্যাস না লিখে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ পৃথিবীজুড়েই উপন্যাসের তুলনায় গল্পের বইয়ের বাজার নেই বললেই চলে। অথচ অনেকেই সন্ডার্সকে বলে থাকেন ‘লেখকদের লেখক’। ওস্তাদ লেখক হিসেবে এই খ্যাতি কিন্তু তার উপন্যাস ‘লিংকন ইন বার্ডো’ প্রকাশের অনেক আগে। সন্ডার্সের ব্যাপারে যা আশ্চর্যের এবং বলতে গেলে আমেরিকান অন্য কোনো সাহিত্যিকের ব্যাপারে দেখা যায় না, তা হলো অন্যান্য লেখকদের থেকে প্রাপ্ত সমীহ। টবিয়াস উলফ, জন আপডাইক, লরি মুর, জুনো দিয়াজ, স্যাম লিপস্টি থেকে কার্ট ভনেগাট, এমনকি ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের মতো দিকপাল পর্যন্ত সন্ডার্সের লেখনীর ওস্তাদি স্বীকার ও প্রশংসা করেছেন। তার প্রশংসা কে করেননি এমন লেখক খুঁজে পাওয়া মুশকিলই বটে! অথচ সমস্ত প্রশংসা ও স্বীকৃতি সবই এমন একজন লেখককে লক্ষ্য করে যিনি মূলত একজন ছোটগল্পকার (সন্ডার্সের প্রথম ফুল-লেন্থ নভেল ‘লিংকন ইন দ্য বার্ডো' প্রকাশিত হয় এ বছর)।


কোন ঘরানার গল্প লেখেন সন্ডার্স? সরাসরি এককথায় জবার দেওয়া কঠিন। পোস্টমর্ডানিস্টদের নিরীক্ষা-ধর্মীতা যেমন তার গল্পে আছে, তেমন আছে পপুলার ঘরানার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ঢঙে গল্প বলা। একই গল্পে হয়তো দেখা যায় তিনজন ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প বলা হয়। তাছাড়া তার বিভিন্ন সময়ে রচিত গল্পের মেজাজেও পার্থক্য আছে। অবশ্য বেশিরভাগ গল্পের ভুবন ভবিষ্যতের, অদূর ভবিষ্যতের পৃথিবী। সারা দুনিয়ায় যখন ভোক্তাদেশ (কনজুমারল্যান্ড) আর এমিউজমেন্ট পার্ক, রাষ্ট্র যখন চালায় কয়েকটা কর্পোরেশন, সরকার নয়; বিজ্ঞাপন যেখানে মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নির্ধারণ করে দেয়, সেই ডিস্টোপিয়ান সমাজের গল্প বলেন সন্ডার্স।   

বেশিরভাগ গল্পেই সন্ডার্সের চরিত্রেরা বাইরে থেকে খুবই ইতিবাচক, উৎফুল্ল দেখায়, সেলফ ইম্প্রুভমেন্টে বিশ্বাসী অথচ সকলেই ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়া, নুয়ে পড়া, বিষণ্ন মানুষ।


প্রথম দিকের গল্পগুলোতে যেমন ‘সিভিল ওয়ার ল্যান্ড ইন ব্যাড ডিক্লাইন’ (১৯৯৬)-এ সন্ডার্স বেশিই নিষ্ঠুর। হাস্যরসপূর্ণ হলেও হজম করা কঠিন। এমনকি ‘পেস্টোরালিয়া’ (২০০০)-তেও যেখানে গল্পটিতে একজন লোকের (গল্পের ন্যারেটর) এমিউজমেন্ট পার্কে গুহামানবের ভূমিকায় জীবনযাপন করাই যার কাজ, পোকামাকর খাওয়া ইত্যাদি- সন্ডার্স পাঠককে বেশি অস্বস্তির মধ্যে ফেলেন। অবশ্য সন্ডার্সের এই নির্মোহ হতে পারাটাই হয়তো অস্বস্তিকর এমন সব বিষয় তুলে আনতে সাহায্য করে যা অন্যথায় করা সম্ভব হতো না। ‘পেস্টোরালিয়া’ গ্রন্থেরই আরেকটা গল্পে একজন বাবা তার ছেলেকে প্রশ্ন করে, ডু য়্যু থিংক য়্যু হ্যাভ টু বি রিচ টু বি নাইস? ছেলের জবাব, আই গেস সো।


পাঠক হিসেবে আমি দেখেছি গল্প পাঠান্তে অস্বস্তি নয়, এক ধরনের তৃপ্তি পাই। এই ভায়োলেন্ট দিকগুলো নেগেট করে ভারসাম্যটা কীভাবে আনেন তিনি? শুধু হাস্যরস কিংবা জীবনের অ্যাবসার্ড নিয়ে তার সূক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে বলে শুধু নয়, আমার বিশ্বাস, একই সাথে সন্ডার্স তুমুল সেন্টিমেন্টালিস্টও। অন্তত তার সর্বশেষ  গল্পের দুটি গল্পগ্রন্থে সন্ডার্স অনেক বেশি সেন্টিমেন্টাল। আমার মনে হচ্ছে, দিন দিন তার গল্প পাঠকের জন্যে আরও আরামদায়ক, অধিক সহনীয় হয়ে উঠছে। অন্তত প্রথম দুই গল্পগ্রন্থের রাগী সন্ডার্স হয়তো এখন তুলনায় কিছুটা কম রাগী। তবু সাধারণ ঘরোয়া জীবন যাপনের মধ্যেও যে অসন্তোষ, ভায়োলেন্স আর অ্যাবসার্ডিটি সেগুলো তুলে আনার দক্ষতায় আগের মতোই রয়ে গেছেন।   

সন্ডার্সের গল্প নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যে সমস্যায় পড়ি তা হলো, গল্পগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করা। বললেই মনে হয় অতিসরলীকরণ করে ফেলছি। এবং নিশ্চিতভাবে সন্ডার্সের গল্প এই সরলীকৃত মন্তব্যের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ধরা যাক আমার প্রিয় একটা গল্প ‘টেন্থ অফ ডিসেম্বর’-এর কথা। সম্ভবত সন্ডার্সের সবচেয়ে ইতিবাচকভাবে শেষ হওয়া গল্প এটি। এমনিতে অসম্ভব অন্ধকার এক পৃথিবীর গল্পকার সন্ডার্স। জয়েস ক্যারল ওটস যে কারণে তার কল্পভুবনকে এক কথায় বলেন ‘নিষ্ঠুর’। বর্তমান লেখায় অন্তত একটা গল্প নিয়ে বিস্তারে আলাপ করি।  তো ‘টেন্থ অফ ডিসেম্বর’ গল্পের বিষয়বস্তু কী? রাফলি, একজন আত্মহত্যাপ্রবণ লোককে বেঁচে থাকার প্রেরণা খুঁজে পেতে সাহায্য করে।


স্বপ্নবাস্তবের মতো এক জগতে ১১ বছর বয়সী রবিন অরণ্যের মধ্যে নিজেকে নায়ক কল্পনা করতে করতে হেঁটে চলে। অরণ্যের ভেতরে, নেথার নামক কাল্পনিক প্রাণীর পেছনে ছোটে যারা তার প্রহেলিকাময় ক্লাসমেট সুজান ব্লেডসকে কিডন্যাপ করেছে।  রবিনের এই কল্পনার বিস্তারের মধ্যেই বাস্তবতা এসে হাজির হয়। সে একটা থার্মোমিটার পড়ে থাকতে দেখে। সে প্রকৃতপক্ষে মানুষের পদচিহ্ন ধরে চলতে থাকে আর ভাবতে থাকে যেন সে নেথারদের পেছনেই ছুটছে। কিছুদূর গিয়ে একটা শীতের কোট পেলে সে উত্তেজিত হয়ে চলতে থাকে।

গল্পটা বারবার স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে যেন ঘুরপাক খায়। প্রায়শই স্বপ্ন আর বাস্তব আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে। সন্ডার্সের যে কোনো গল্প পড়তে গেলে এমনটা মনে হতেই পারে যে মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, মিথ এগুলোও তার বাস্তবতা- বাস্তব জীবনেরই অংশ।


গল্পের আরেক চরিত্র,  ৫৩ বছর বয়সী ডন অ্যাবারের মাথার ভেতরেও কাল্পনিক সংলাপ চলতে থাকে। সেও তার বীরোচিত কর্ম সম্পাদন করতে চায়। দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভুগছে সে। তার অসুখও বেড়েই চলেছে ক্রমশ। সে জঙ্গলে গিয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে মরে যেতে চায়, যাতে তার মতো বোঝা ও দুর্ভোগ থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের সে মুক্তি দিতে পারে।    

ডন অ্যাবার কল্পনা করে তার জীবিত সন্তানেরা মৃত্যুর পর তাকে চরম স্বার্থপর মানুষ ধরে নিয়ে তাদের মধ্যে আলাপ করছে।  ডন ভাবে তার সেইসব স্বপ্নের কথা যেমন, বিশাল জমায়েতের সামনে ‘সমবেদনার উপরে একটা বক্তৃতা দেওয়া’ যা কখনও বাস্তবায়িত হবে না। আশ্চর্যের ব্যাপার তার এই স্বপ্ন কিন্তু ১১ বছর বয়সী রবিনের নেথারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সুজানকে মুক্ত করার ফ্যান্টাসি থেকে তেমন আলাদা নয়।

স্বপ্ন ও বাস্তবের এরকম অনায়াস মিল পরাবাস্তব পরিস্থিতির সৃষ্টি করে- বিশেষ করে অরণ্যের ঠান্ডায় ডন অ্যাবার যখন জমতে শুরু করে, হাইপোথারমিয়া হ্যালুসিনেশন তৈরি করে।


শুরু থেকেই রবিন কল্পনা আর বাস্তবকে স্পষ্টত আলাদা করতে পারে না। সে ভাবে নেথারেরা তাকে টর্চার করবে আবার এ-ও ভাবে, সে যতটা সহ্য করতে পারবে ততটাই টর্চার করবে তারা! কল্পনা করে সুজান তাকে ইনভাইট করবে শার্ট খুলে পুলে নামতে বলবে। অথচ কয়েকবার পড়ে ডুবতে গিয়েও বেঁচে যাওয়া আর ঠান্ডায় জমতে শুরু করায় সে বাস্তবে ফিরে আসে আর ভাবে, ‘Ugh. That was done, that was stupid, talking in your head to some girl who in real life called you Roger’    

ডন অ্যাবার তখনও ভাবতো আত্মহত্যার কথা, যাবতীয় ক্লেদা আর অশান্তি থেকে সম্মানজনক মুক্তির কথা। তখনই ‘সম্মানজনক মুক্তি’তে বাধা আসে। অ্যাবার দেখে রবিন অ্যাবারেরই কোট হাতে বরফের মধ্যে বিপজ্জনকভাবে ছুটছে। তাছাড়া রবিনের যে ঠান্ডায় জমে যাওয়া বা পুকুরে পড়ে যাওয়া- তার মূলেও তো আছে অ্যাবারকে বাঁচাতে চাওয়া ( অন্তত অ্যাবারের দৃষ্টিকোণ থেকে তো তেমনই)। ফলে রবিনকে বাঁচাতে হলেও অ্যাবারকে বেঁচে থাকতে হয়। এছাড়া রবিন তার মাকে লোকটাকে উদ্ধার করতে বলে।  ডন অ্যাবারের উপলব্ধি হয়, সে তো শুধু এক মৃত্যুপথযাত্রী লোকই না। সে তার জীবনের আরও উপভোগ্য নানা দিক আবিষ্কার করতে পারে যার জন্যে বেঁচে থাকা অর্থময় হয়ে ওঠে।


আপাতভাবে রূপকথাময় মনে হতে পারে কিন্তু যেভাবে জীবনের জটিলতাসমূহ ধারণ করেন গল্পে তাতে এই গল্পটা পুরোপুরি মরালিস্টিক গল্পের মতো থাকে না। তবু অন্য যেকোনো মহৎ স্যাটায়িস্টের মতো সন্ডার্সও একটা মাত্রায় মরালিস্টই।  

সন্ডার্স হাসতে হাসতে এবং হাসাতে হাসাতে অনায়াসে আপনাকে নিয়ে যাবে অস্বস্তিকর মানবিক দ্বন্দ্বের ভেতরে। বিষাদ ও হাস্যরস তার গল্পে হাত ধরাধরি করে চলে। ‘অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে’ রয়ে যায় ‘অমোঘ আমোদ’। প্রিয় পাঠক, আপনি যদি টলস্টয়, চেখভ, দস্তয়ভস্কিদের সাথে গ্রুশো মার্ক্স, মার্ক টোয়াইন  বা স্টিভ মার্টিন-এর মতো কমিকদের মিশ্রণ অর্থাৎ সিরিয়াসনেসের আর অ্যাবসার্ডিস্ট কমেডির স্বাদ একই সাথে পেতে চান- জর্জ সন্ডার্স আপনারও লেখক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়