ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বাউল বাড়ির আঙিনায় চিরঘুমে বারী সিদ্দিকী

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৭, ২৪ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাউল বাড়ির আঙিনায় চিরঘুমে বারী সিদ্দিকী

বারী সিদ্দিকী, ছবি: সংগৃহীত

শিহাব শাহরিয়ার: ২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর, সন্ধ্যা-রাত। যে-রাত স্মৃতিময় হয়ে গেল আমার জীবনে, সেই সন্ধ্যা রাতের কথা আমি ভুলি কী করে! যে রাতে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেন তার কয়েক ঘণ্টা আগে সন্ধ্যা-উত্তীর্ণ সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা, শেষ কথা, শেষ ছবি তোলা এবং তাঁকে শেষ বিদায় দেয়া। সেই সন্ধ্যায় তিনি শাহবাগে জাদুঘরে এসেছিলেন গান শুনতে। সেদিন শিল্পী আতিকুর রহমান গান গেয়েছিলেন। দর্শক সারির প্রথম সারির একটি চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ গান শুনেছেনও। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকে। অনুষ্ঠানের মাঝ সময়ে তিনি বাড়ি ফেরার জন্য উঠে গেলেন। তখন কি তাঁর শরীর খারাপ লাগছিল?

কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন থেকে তিনি ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে আসছিলেন। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি তাঁকে এই জাদুঘরেই আমার কর্মকক্ষে নিয়ে গেলাম। তাঁর পরনে ছিল কালো পাঞ্জাবি-পায়জামা আর মাথায় প্রিয় কালো টুপি। আমি তাঁকে আমার কক্ষে বসালাম, নাস্তা আর কফি খেতে দিলাম। তিনি সবটুকু খেলেন না, কিছুটা খেলেন। এরপর কফি পান করলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর ছোট ছেলে, যে এবার স্ট্যান্ডার্ড সেভেনের স্টুডেন্ট। বাবার মতোই চেহারা। তখন আমার কক্ষে ছিলেন তরুণ কণ্ঠশিল্পী মারিয়া। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা, কথাবার্তা হলো। আমি বললাম, বারী ভাই, আগামী ৮ ডিসেম্বর জাদুঘরে আপনার একক সংগীত সন্ধ্যার আয়োজন করেছি। বললেন, জি আমি অবশ্যই আসবো এবং গান করবো। আমরা এতক্ষণে জেনে গেছি, আমাদের প্রিয় এই শিল্পী আর আসতে পারবেন না। তিনি আর গাইবেন না কোনো দিন।

শিল্পী মারিয়া সম্প্রতি আমেরিকা ঘুরে এসেছে, সে বারী ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, স্যার আমি ভবিষ্যতে আমেরিকা চলে যাবো। বারী ভাই উত্তরে বললেন, কেন তুমি আমেরিকা যাবে? আমি প্রায় ১৬ বার আমেরিকা গিয়েছি। ওদের বহু অঙ্গরাজ্যে আমি ঘুরে ঘুরে গান করেছি, কিন্তু আমার তো কখনো মনে হয়নি বাংলাদেশ ছেড়ে ওই দেশে চলে যাই? তুমি কেন যেতে চাও দেশ ছেড়ে? জন্মভূমির মতো শান্তি পৃথিবীর কোথাও নেই।

আমি বললাম, বারী ভাই আপনি গত ১০ নভেম্বর জাদুঘরের আয়োজনে কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের ওপর দারুণ সুন্দর বলেছেন এবং খালি গলায় তাঁর লেখা শেষ গানটি অসাধারণ গেয়েছেন। এরপর আমি একটি ডায়েরি বারী ভাইয়ের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, বারী ভাই এই ডায়েরিতে আপনার একটু স্মৃতি-স্বাক্ষর রাখতে চাই, যা মন চায় লিখুন। তিনি আমার পাইলট কলমটি হাতে নিয়ে ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় লিখলেন: ‘ড. শিহাব ভাই, আপনার আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ হলাম, আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি’।

বাসায় ফিরে সেদিন তিনি যদি আর কোনো কিছু না লিখে থাকেন তাহলে এটিই তাঁর হাতের শেষ লেখা। তারপর তিনি চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, বারী ভাই আপনার সঙ্গে আমরা ছবি তুলতে চাই। তিনি সম্মতি দিলেন। মারিয়ার মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে আমার এক কলিগ তিন জনের কয়েকটি ছবি তুলে দিয়েছিলেন সেদিন। এরপর মারিয়া তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলতে চাইলে, তিনি বললেন, আমি সেলফি তুলি না। সেলফি আমার পছন্দ নয়। এরপর আমার দিকে ফিরে বললেন, শিহাব ভাই, আসি, আপনার আপ্যায়নে আমার খুব ভালো লাগল। এরপর আমি তাঁকে জাদুঘরের সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে বিদায় দিয়ে এলাম। বললাম, ভালো থাকবেন। লক্ষ্য করলাম, মারিয়া সেই ছবিগুলো দিয়ে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস রাতে পোস্ট করল। আমি সেখান থেকে একটি ছবি ডাউনলোড করে আমার এফবি অ্যাকাউন্টে আরেকটি স্ট্যাটাস দিলাম। ধারণা করছি আমি যখন স্ট্যাটাসটি পোস্ট করছি, সম্ভবত সেই সময়ের একটু আগে বা পরেই তিনি স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মনে করি, এই ছবিগুলো তাঁর জীবনের শেষ ছবি। তাঁকে দেখে সেদিন ভেতরে ভেতরে আমার কেবলই যেন মনে হচ্ছিল, তিনি কি অসুস্থ বোধ করছেন? পরদিন সকালে অফিসে এসেই খবর পেলাম তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মনটা ভীষণ ভারী হয়ে উঠল। আমি কি তখনও ভাবতে পেরেছিলাম, তিনি আর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরবেন না। 

অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির আগে এটিই শিল্পীর শেষ ছবি। বামে মারিয়া, ডানে লেখক 


আজ ২৪ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে টিভি স্ক্রলে যখন তাঁর মৃত্যুর খবর জানলাম, মন কেঁদে উঠল। ইউটিউবে গিয়ে শুনতে থাকলাম, তাঁর গাওয়া গান-‘শোয়া চান পাখি, আমি ডাকিতেছি তুমি ঘুমাইছ নাকি?’ ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ ‘সাড়ে তিন হাত কবর’ প্রভৃতি অসাধারণ হৃদয় আকুল করা গান। আমি তিন সত্যি দিয়ে বলছি, বারী সিদ্দিকীর গান আমার হৃদয় আকুল করে। আমি তাঁকে চিনি এবং জানি অনেক আগে থেকেই। সম্ভবত আশির দশকের শেষ দিক থেকে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন তিনি বাঁশি বাজাতেন, আমি যেতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, আবৃত্তি ও নেপথ্যে কণ্ঠ দিতে। মনে পড়ছে, সংগীত শিল্পীদের রিহার্সেল রুমে একদিন ঢুকে তাঁকে দেখেছিলাম বাঁশি বাজাতে; সেদিনই প্রথম দেখা। এরপর তিনি বংশীবাদক থেকে হয়ে উঠলেন সংগীতশিল্পী, গীতিকার। তাঁর গাওয়া বেশ কিছু অনন্য লোক ও আধ্যাত্মিক গান তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। এজন্য কৃতিত্ব দিতে হবে জননন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ও গীতিকার হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর এই খ্যাতি আসে নব্বইয়ের দশকে। হুমায়ূন আহমেদের ‘রঙের বাড়ই’ নামক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রথম সংগীত পরিবেশন করে তিনি বাঁশি থেকে গানে আসেন। এরপর ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ৭টি গানে কণ্ঠ দেন। এর মধ্যে ‘শোয়া চান পাখি’ গানটির জন্য তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। একই বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

বারী সিদ্দিকী বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ও গানের কথা লিখেছেন। তাঁর সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও জনপ্রিয় গানগুলো হলো- ‘শোয়া চান পাখি’ ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ ‘সাড়ে তিন হাত কবর’ ‘তুমি থাকো কারাগারে’ ‘পূবালী বাতাস’। তাঁর গানের অ্যালবামগুলো হলো- ‘দুঃখ রইলো মন’ ‘সরলা’ ‘ভাবের দেশে চলো’ ‘সাদা রুমাল’ ‘মাটির মালিকানা’ ‘মাটির দেহ’ ‘মনে বড় জ্বালা’ ‘প্রেমের উৎসব’ ‘ভালোবাসার বসত বাড়ি’ ‘নিলুয়া বাতাস’ ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’ ও ‘দুঃখ দিলে দুঃখ পাবি’। এবং মিশ্র অ্যালবাম- ‘আসমান সাক্ষী’ ‘চন্দ্রদেবী’। যেসব চলচ্চিত্রে গান করেছেন সেগুলো হলো- ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ‘রূপকথার গল্প’ ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ‘ও আমার দেশের মাটি’ ও ‘মাটির পিঞ্জিরা’। শেষের এই চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। তাঁকে আমরা নাটকেও অভিনয় করতে দেখেছি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অজস্র সম্মাননা।

বারী সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর। সে অনুযায়ী তিনি জন্ম মাসেই মারা গেলেন। তাঁর জন্মস্থান নেত্রকোনার এমন এক পরিবারে যেখানে আগে থেকেই গানের চর্চা হতো। মাত্র ১২ বছর বয়সে নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ওপর বারী সিদ্দিকীর ছিল অসম্ভব দখল। যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি বাঁশির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং উচ্চাঙ্গসংগীতে মনোনিবেশ করেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে এসে লোকগীতির সাথে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন। এখানে বলে রাখা ভালো, তিনি গোপাল দত্ত এবং ওস্তাদ আমিনুর রহমানের কাছ থেকে লোকসংগীত এবং শাস্ত্রীয়সংগীতের পাঠ নিয়েছেন। তবে তাঁর পরিচিতি আসে মূলত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সংস্পর্শে আসার পর। তিনি খুব কম সময়ের মধ্যেই বিরহ-বিচ্ছেদের মর্মভেদী গান গেয়ে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ আমার গাওয়ার পেছনে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন। মূলত তার সাহস নিয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস পেয়েছি’।

বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিল্পী বারী সিদ্দিকীর অসংখ্য সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর সর্বশেষ দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাঁরই একনিষ্ঠ ভক্ত, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট লেখক, গবেষক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। ‘কথা ও গান’ শিরোনামের এই সাক্ষাৎকারটি বাঙালিদের জন্য একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে সংরক্ষিত থাকলো।

এই মহান শিল্পীর প্রয়াণে দারুণ ক্ষতি হলো বাংলা গানের। বিশেষ করে লোকগান ও আধ্যাত্মিক গানের যে ধারা তিনি তৈরি করেছেন তা বেঁচে থাকবে অনেক দিন। ভাটি অঞ্চল নেত্রকোনার এই কৃতি শিল্পীর তুলনা নেই। তিনি নিজেকে ‘বাউল’ বলতেন। জন্মগ্রামে গড়ে তুলেছেন ‘বাউল বাড়ি’। সেই বাউল বাড়ির আঙিনায় চিরশান্তিতে আজ ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ নভেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়