ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পদ্মাবতী বিতর্ক: শিল্পের স্বাধীনতায় উগ্রবাদীদের হামলা

চিন্ময় মুৎসুদ্দী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২৩, ৩০ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পদ্মাবতী বিতর্ক: শিল্পের স্বাধীনতায় উগ্রবাদীদের হামলা

চিন্ময় মুৎসুদ্দী: পদ্মাবতী নিয়ে ভারতের উগ্রবাদীদের কর্মকা- শিল্পের স্বাধীনতায় নয়া হস্তক্ষেপ। তুচ্ছ বিষয়কে সামনে এনে তারা তুলকালাম বাধিয়েছে শ্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। তবে পদ্মাবতী নিয়ে সর্বশেষ সুসংবাদ হলো সিনেমাটি নিষিদ্ধের আবেদন তৃতীয় বারের মতো খারিজ করে দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আর দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পরোক্ষভাবে বলেছেন, ‘এর নাক কাটব, ওর মুণ্ডু কাটব, এ জন্য পুরস্কার দেব, গণতন্ত্রে এসব বরদাশত করা হয় না। দেশের আইন এভাবে কেউ নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না।’

ছবিটি মুক্তির ব্যাপারে বাধা দেওয়া আর ছবির পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলীকে হত্যার হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদে ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যান্ড টিভি ডিরেক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (আইএফটিডিএ) ২৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ে ১৫ মিনিটের ব্ল্যাক আউট কর্মসূচি পালন করে। চলচ্চিত্র এবং দূরদর্শনের সঙ্গে যুক্ত ২০টি সংস্থা ওই দিন বিকেল সোয়া ৪টা থেকে ১৫ মিনিট চলচ্চিত্র ও টিভি সংক্রান্ত সব ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকে। ২৮ নভেম্বর কলকাতার টালিগঞ্জের ছবিপাড়ায় ১৫ মিনিটের জন্য প্রতীকী ধর্মঘট পালন করা হয় ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কারস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া এবং ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচারস অ্যাসোসিয়েশনের ডাকে।

এর আগে হরিয়ানা রাজ্যের বিজেপি নেতা সুরুজ পাল আমু পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাক কেটে নেওয়ার হুমকি দেন। মমতা পশ্চিমবঙ্গে চলচ্চিত্রটিকে স্বাগত জানিয়ে এর প্রিমিয়ার কলকাতায় করার প্রস্তাব দেন। মমতার প্রস্তাবটি আসে গুজরাট, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন রাজ্যে এই ছবির মুক্তির ওপর রাজ্য সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরিপ্রেক্ষিতে। ওইসব রাজ্যে উগ্রবাদীরা মিছিল সমাবেশ করে ছবির পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালি ও অভিনেত্রী দীপিকা পাড়–কোনের নাক, কান, মাথা কর্তনকারীদের জন্য বিশ কোটি টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছে। এই ডামাডোলে এরই মধ্যে এক সাধারণ নাগরিকের প্রাণ গেছে। নিহত ২৩ বছরের তরুণ চেতন সাহনি জয়পুরে গয়নার ব্যবসা করতেন। জয়পুরের বিখ্যাত নাহারগড় দুর্গের বুরুজ থেকে তার মরদেহ ঝুলছিল। তার মৃতদেহের পাশে লেখাছিল ‘আমরা শুধু কুশপুতুল লটকাই না।’ আর একটি পাথরে লেখা ছিল ‘পদ্মাবতীর বিরোধিতা’।

পদ্মাবতী মুক্তি পাওয়া দূরে থাক, এখনও সেন্সর বোর্ড থেকে এ সিনেমা সম্পর্কে কোনো মন্তব্যই করা হয়নি। শুধুমাত্র একটা ধারণা থেকেই মাঠে নেমেছে উগ্রবাদী বিজেপি, বজরঙ্গ দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তারা বলছেন ‘আমাদের জাত্যাভিমানে চুনকালি লেপা হয়েছে, আমাদের দেবী মা পদ্মাবতিকে মন্দিরের পাদপিঠ থেকে নামিয়ে করে তোলা হয়েছে বাহরওয়ালি নাচনি, তাই পরিচালকের মুণ্ডু চাই.. ..’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সারা ভারতে ছবিটি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে তারা। বানসালির পদ্মাবতী অচ্ছ্যুত হলে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (পদ্মিনী উপাখ্যান, ১৮৫৮), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ, ১৮৭৫), ক্ষিরোদাপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (পদ্মিনী, ১৯০৬) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রাজকাহিনী, ১৯০৯) প্রমুখের এসব রচনা নিষিদ্ধ করতে হয়। কারণ তারাও ইতিহাসকে প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করেননি। ইতিহাসকে নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছেন। ইতিহাসকে ভিত্তি করে তারা গল্প বুনেছেন।

সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে ইতিহাস কি কেউ ভিন্ন দৃষ্টিতে এখন দেখতে পারবে না? অতীতে এমন হয়েছে। সেজন্যই শিল্পের স্বাধীনতা মুক্তচিন্তার আলোকে বিবেচনা করা হয়। তথ্যই কেবল ইতিহাস নয়, কিংবদন্তিও ইতিহাসের অংশ। কোনো শিল্প মাধ্যমই ইতিহাসকে প্রামাণ্য হিসেবে পেশ করে না। রানি পদ্মাবতী হয়তো তার জীবনে নাচেননি। নাচলেও এতটা ডিজিটাল ভেল্কি ছিল না। সিনেমার অনেকটাই পরিচালকের কল্পনা। আর ছবিটিও বানসালির ‘লাগ ঝমাঝম’ ভঙ্গিতে বলা একটি বলিউডি উপাখ্যান মাত্র। যেটা আমরা তার আরেকটি চলচ্চিত্র ‘দেবদাস’-এ দেখেছি। পাঠককে এখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, চলচ্চিত্রটিতে তিনি পার্বতী এবং চন্দ্রমুখীকে একসঙ্গে নাচিয়েছেন। শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’-এ কিন্তু এই ঘটনা ছিল না। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে- দেবদাস সাহিত্য, পদ্মাবতী ইতিহাস। সেক্ষেত্রে এই ইতিহাসের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। অনেক ঐতিহাসিকই পদ্মাবতীর অস্তিত্ব স্বীকার করেননি।

দূরদর্শনের সভাপতি রজত শর্মা একটি কথা বলেছেন যেটি প্রণিধান যোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘বানসালীর গবেষণা পুরোপুরি ইতিহাস নির্ভর, বর্ণে বর্ণে বাস্তবনিষ্ঠ। কোনো বিকৃতি নেই।’ আর পরিচালক সুভাস ঝা বলেছেন, ‘সত্যিই সে সময় রমণীরা নাচতেন, অন্তরালে জেনানা রানিবাসে। সেখানে রাজা ছাড়া আর কোনো দর্শক থাকত না। সিনেমায় যে ‘ঘুমার’ নাচের দৃশ্য আছে, তাতে কোনো বাইরের মরদ নেই। তাই, ইতিহাস বিকৃতি ঘটেনি। এখন তিনটি পক্ষ। উগ্রবাদীরা বিপক্ষে। বানসালীকে সমর্থনকারী পক্ষ বলছেন বিকৃতি হয়নি। আরেক পক্ষ বিকৃতি হয়েছে কি হয়নি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছেন না, তারা সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন- শিল্পের স্বাধীনতা নিয়ে। পদ্মাবতীর সমর্থনে তাই ইতিহাস বিকৃত হয়নি বলে সাফাই দিলে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। শিল্পের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটিকেই মূখ্য করে দেখতে হবে। ইতিহাসকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অধিকার সমুন্নত রাখা জরুরি।

বাস্তব ও কল্পনার মিশেল নিয়ে তৈরি আশুতোষ গোয়ারিকর’র ‘যোধা আকবর’ (২০০৮) ছবিতে আকবরের সঙ্গে যোধাবাঈয়ের প্রেমের কাল্পনিক ঘটনা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেও ছবিটি নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠেনি। তখন ইউপিএল আমল। এখন কেন্দ্রে বিজেপি, বিভিন্ন রাজ্যে ক্রমে তারা ক্ষমতার হাত প্রসারিত করছে। ১৮ রাজ্য তাদের শাসনে। দেখা যাচ্ছে ভারতে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক শক্তি জোরেসোরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ধর্ম নিরপেক্ষ ইমেইজ আর থাকছে না। গত তিন বছরে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর অসংখ্য হামলা সেটাই প্রমাণ করে। মুসলমানদের খাদ্যের ওপরও তারা বাধ সাধছেন। উত্তর প্রদেশে গরুর ব্যবসা করার দায়ে প্রাণ দিতে হয়েছে এক মুসলমান তরুণকে। এবার তারা শিল্পের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। বানসালী এরই মধ্যে বলেছেন, আলাউদ্দিন খিলজির স্বপ্নের রানি পদ্মাবতীর সঙ্গেঅহপযড়ৎ প্রেমের দৃশ্যটি ছবিতে নেই। এরপরও উগ্রবাদীদের এ ধরনের জঙ্গী আচরণ এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির নীরবতা মুক্ত চিন্তা ও গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত বলেই মনে করি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ নভেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়