ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মাঝির জীবনের বিনিময়ে বেঁচে আছি: নাসির উদ্দিন ইউসুফ

নাসির উদ্দিন ইউসুফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৮, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাঝির জীবনের বিনিময়ে বেঁচে আছি: নাসির উদ্দিন ইউসুফ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমরা ভারতে ট্রেনিং নেই। ট্রেনিং শেষ করে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশে ঢোকার পরিকল্পনা করি। আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উল্টো দিকে সীমান্তের কাছে মণিহল নামে গ্রাম ছিল। সেখানে একটা ক্যাম্প ছিল। সেই ক্যাম্পে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও হায়দার। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন(পরে অব. মেজর জেনারেল আইনুদ্দিন) সেখানে আমাদের পাঠান। সেখানে সেক্টরের যেসব সৈনিক(বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা) ছিলেন তাদের সঙ্গে এসে আমরাও রিপোর্ট করি।

ঢাকা যেহেতু আমাদের মূল লক্ষ্য সেহেতু আমাদের নিয়ে ঢাকা উত্তর মুক্তিবাহিনী হিসেবে রিইউনিট তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে শহীদ রেজাউল করিম মানিক ও আমার নেতৃত্বে দায়িত্ব দেয়া হয়। ঢাকা উত্তরের অংশগুলো বিশেষ করে- ঢাকার সঙ্গে আরিচা সড়কের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া, ঢাকা শহরে সেনাবাহিনীদের বিভিন্ন স্থাপনায় আক্রমণ করা আমাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল। তখন খালেদ মোশাররফ পরিকল্পনার একটি তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা যাও এ কাজগুলো তোমরা করবে। সেই তালিকা নিয়ে আমরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ি। 

আমাদের ৫২জন সৈনিক ছিল। আমাদের জন্য কিছু সু-ব্যবস্থা ছিল। সেটা খাওয়া-দাওয়া নয়; ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে আমাদের সীমান্তে নামিয়ে দেয়ার সুবিধা। সেখানে ট্রানজিট ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পে দুই একদিন থেকে গাইডের সিগন্যাল পেলে সুবিধাজনক সময়ে আমাদের বাংলাদেশে ঢুকানো হয়। এটাই ছিল সিস্টেম।

সেই প্রক্রিয়াতে আমরাও ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করি। আমাদের জানানো হয়, রাতে অপারেশন আছে। আমরা সন্ধ্যায় বর্ডারের দিকে এগিয়ে যাই। বর্ডারে ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের অধীনে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি আউটডোর ছিল। কিছুক্ষণ পর বড় বড় কয়েকটি নৌকা আসে। এ নৌকাকে গহনা নৌকা বলে। সেগুলোতে আমাদের তুলে দেয়া হয়। পাট বোঝাই এসব নৌকার খোলের নিচে আমরা অস্ত্র রাখি। তার উপর পাটাতন দিয়ে আমরা সাধারণ যাত্রীর বেশে বসে থাকি।

অন্ধকারের মধ্যে আমাদের নৌকা ধীর গতিতে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় ফরিদপুর কোম্পানি। তাদের নৌকায় অনেকগুলো মুক্তিযোদ্ধা। তাদের পাঁচটা নৌকা আমাদের চারটি নৌকা এগিয়ে চলছে। যখন আমরা আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল লাইনে পৌঁছলাম, সেখানে একটি হাওড়ের মতো ছিল। হাওড়টি সংযুক্ত হয়েছে তিতাস নদীর সঙ্গে। এই হাওড়ের পরেই হচ্ছে আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়ে। ভারত থেকে অর্থাৎ মুক্তাঞ্চল থেকে আমাদের ঢুকতে গেলে প্রথমে রেল লাইন, তারপর হাওড়, তারপর আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়ে। আমরা যখন রেল লাইন অতিক্রম করেছি তখনো কিছু বুঝতে পারিনি। সেখান থেকে আর একটু এগিয়ে যাওয়ার পর আমাদের নৌকা যখন রাস্তার কাছাকাছি তখন হঠাৎ করে গুলি এবং গোলার আঘাত আসতে থাকে আমাদের নৌকার উপর। বৃষ্টির মতো পানির মধ্যে গুলি এসে পড়ছে।

যাই হোক, যখন প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে তখন আমরা অন্ধকারের মধ্যে কিছুই করতে পারছিলাম না। আমরা এমন মুহূর্তের জন্য প্রস্তুতও ছিলাম না। প্রচণ্ড গোলাগুলির সময় যাদের হাতে অস্ত্র ছিল সেগুলো ছিটকে পানিতে পড়ে যায়। আমি তখন চেঁচিয়ে বলতে থাকি, এই যে পানিতে তোমরা অস্ত্র ফেলে দিচ্ছো এই অস্ত্র তো আমাদের পেতে হবে। অস্ত্র ছাড়া আমাদের জীবন বিপন্ন। আমাদের জীবনের চেয়ে একটি অস্ত্র কিংবা বুলেটের মূল্য অনেক বেশি। এ সময় আমার সহযোদ্ধা ছিল, স্বপন, রাইসুল ইসলাম আসাদ, নাঈম, মুনির, মানিক, কুতুবসহ অনেকে।

এমন সময় হঠাৎ ফরিদপুর কোম্পানির নৌকা থেকে খুব চিৎকার শুনতে পাই। লক্ষ্য করলাম, তারাই আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু হয়েছে, তারা সরাসরি আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। আমাদের উপরেও আঘাত হচ্ছে- আমাদের কয়েকটি নৌকা সরেও যায়। আমাকে বহনকারী নৌকাটি সামনের দিকে ছিল, খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মাঝি বুঝতে পেরেছিল- এগুলো খুব মূল্যবান জিনিস। মাঝি বলল, চিন্তা করবেন না, আমি নৌকা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। চারপাশে কান্না, চিৎকার, গোলাগুলির শব্দের মধ্যেও মাঝির কথা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। একেকটি গোলার আঘাতে পানি ছিটকে উপরে উঠে আসছে। নৌকাগুলো টলমল করছে। ছিটকে পড়ছে মুক্তিযোদ্ধারাও। এমন একটি ভয়াবহ মুহূর্তে হঠাৎ মাঝি নৌকা যখন ঘুরিয়ে নিতে গেল তখন আমার মনে হলো, সে কিছু একটা টের পেয়েছে। আমি তার পেছনে ডান দিকে বসেছিলাম, হঠাৎ সে ধাক্কা দিয়ে আমাকে পানিতে ফেলে দিলো। একটু পর পানি থেকে উঠে নৌকায় তাকিয়ে দেখি, মাঝির রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ দেহ নৌকার উপর পড়ে আছে। তার বুক ঝাঝড়া হয়ে গেছে। মুখের একাংশ, শরীরের বাঁ দিকে বুকের কাছ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার আগে তার দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেছে। 

ওদিকে প্রচুর ধান হতো। আমার ধারণা ছিল, ধান গাছ পানির সঙ্গে বাড়ে না। কারণ আমার জন্ম শহরে, বেড়েও উঠেছি শহরে। ওইদিন নৌকায় ওঠার পর মাঝিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখানে ধান গাছ পানি কম আপনি নৌকা চালাবেন কীভাবে? মাঝি বলেছিল, কেন স্যার আপনি জানেন না, ধান গাছ পানির সঙ্গে বাড়ে। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কতটুকু পানি হবে? জবাবে মাঝি বলেছিল, এখানে চৌদ্দ হাত পানি আছে। তার জ্ঞান দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন ছাত্র অথচ এই সাধারণ জ্ঞানগুলো আমার নেই! ওই মাঝির সঙ্গে আমার ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। সে বয়সে আমার পিতার বয়সি ছিল। আমি কমান্ডে ছিলাম জেনে তারও আমার প্রতি একটা রেসপেক্ট তৈরি হয়েছিল। সেই মাঝির জীবনের বিনিময়ে আমি আজও বেঁচে আছি। তার কথা সবসময় মনে পড়ে। আমার জীবনটা সে দিয়েছে। এজন্য আমি বলি, তিতাসের মাঝির জীবনের বিনিময়ে, নাম না জানা মাঝির জীবনের বিনিময়ে আমি বেঁচে আছি।  

অনুলিখন : আমিনুল ইসলাম শান্ত

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৭/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়