ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের গল্প || পাথরের কাছে শোনো

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যুদ্ধদিনের গল্প || পাথরের কাছে শোনো

|| মাহবুব ময়ূখ রিশাদ ||


ঝড়ের সময় কান পাতলে কি শোনা যায় পাতার কণ্ঠস্বর? অথবা পাতারা কি একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম? প্রশ্নগুলো অবান্তর মনে হলেও অযৌক্তিক নয়। পাথরের যদি আলাদা জগৎ থাকে, যেখানে সবাই বুঝতে পারে পরস্পরের মন, করতে পারে যোগাযোগ, তবে পাতাদেরও থাকতে পারে নিজস্ব গোপন জগৎ।

ষাট বছর পূর্বে মনসুর ভাইয়ের দোকানের একাংশে নিজের একটি জায়গা পেয়েছিলাম। জন্মান্ধ তবে কানে বহুদূর থেকে টেনে আনতে পারি শব্দ। আর সুশৃঙ্খল শব্দ মানে বাক্য, বাক্য থেকে আসে ভাষা, মানুষ মুখে যখন সেটা বলে পরিষ্কার হয় ভাষ্য, ভাষ্য জন্ম দেয় বোধের। ঐ বোধ হয়তো আমাকে সেদিন পাতার কথা শোনার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছিল। কিন্তু সামর্থ্য? যে জ্ঞান মানুষ অর্জন করতে পারে নি, তার অতল স্পর্শ করব সে সাধ্য কোথায় আমার? সামান্য এক পাথর আমি, মনে প্রশ্ন আসা তবু থামিয়ে রাখতে পারি না।
মনসুর ভাইয়ের দোকানের যথারীতি বসেছে নৈশকালীন আড্ডা। ঐ আড্ডার মাঝেই শুরু হলো ঝড়ো হাওয়া।

কেউ একজন বলল, কোনদিন যে দোকানটা ভেঙে পড়ে মনসুর ভাই।

মনসুর ভাই হাসলেন। হেসে বললেন, ভাঙব না। এদ্দিন যহন ভাঙে নাই, আর ভাঙব না।

মনসুর ভাইয়ের মনোভাবের সঙ্গে একমত হতে পারি না। যা আগে হয় নি, তা ভবিষ্যতেও হবে না- এমন সরলীকরণ বোধকরি মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব।

ঝড় যদি প্রকৃতি সৃষ্ট ব্যাপার হয়, তবে তা প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে বৃক্ষ। এই যে বাতাস বইতে শুরু করল, আর তার সাথে দোকান ভেঙে পড়ার একটি যোগ কিংবা সম্ভাবনা তৈরি হলো, ঐ বাতাসের জন্যই তো। সেদিনই প্রথম পাতার কথা বিষয়ক চিন্তা আমার মনে এলো। রঞ্জু আসার পর সেই চিন্তার বাস্তবায়ন এক ধরনের প্রয়োজনীয়তায় রূপ নিল।

দুই
পাথরের কান আছে এ কথা মানুষ জানে কিন্তু মানে না। আমি জানি এবং মানি যে ঐ কথা শোনা পর্যন্তই আমার সীমাবদ্ধতা। মানুষ, অন্য পাথরের কথা শুনে নিজের মাঝে ধারণ করা ছাড়া সত্যিকার অর্থে আমার কোনো ক্ষমতা নেই বলেই জানি। সেই জানার ভেতরেও যে সব সত্য থাকবে তাও নয়। হয়তো অন্যান্য শব্দ বোঝার একটি ক্ষমতা গোপনে আমার আছে আর সেই ক্ষমতাকে খোঁজার জন্য, কান উৎকর্ণ রাখলাম বেশ কিছুদিন। প্রতীক্ষার পুরস্কারও মিলল। কয়েকদিন পর কিছু প্রশ্নের উত্তর পেলাম।
আকাশে, ধূলিকণা, মেঘ জমে যখন বৃষ্টি হয় তখন পাতারা ব্যথা পায়। একটি পাতা তখন অন্যটিকে ব্যথার কথা জানায় আর ঠিক তখনই শুরু হয় একটি চক্রের। দলবদ্ধভাবে তারা ডানা ঝাপটাতে শুরু করে পাখির মতো- এতে প্রকাশিত হয় বাতাসের বেগ, জানান দেয় তাদের ক্ষোভও। এটা অনেকটা আত্মহত্যার মতো ব্যাপার হলেও প্রতিবাদ করাটাই মুখ্য হয় তাদের কাছে। কত পাতা ঝরে যায়, কত গাছ উপড়ে যায় শেকড় থেকে; মরে যায় মানুষের মতো। তাতেও কিছু যায় আসে না। লক্ষে তারা অবিচল।
তবে নিজ কানে শুনতে পারি নি। এই তথ্যটা আমাকে জানিয়েছে দেয়ালের সঙ্গে মিশে থাকা একটি লতানো গাছ। গাছটি ঠিক নয়, তবে ঐ গাছটি যে দেয়ালের ওপর নিজেকে বিছিয়ে রেখেছে সেই দেয়ালটিতে থাকা একটি পাথর। তাকে ঈর্ষাও হলো আমার। নতুন সময়, নতুন যুগ। আমরা যা করতে পারি নি, নতুন প্রজন্মের ইট পাথর সেগুলো করতে পারছে। ঈর্ষার সঙ্গে যুগপৎ আনন্দও পেলাম।

একদিন পাতাদের প্রতিবাদ শুরু হলে অর্থাৎ ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলে নিমিষেই মনসুর ভাইয়ের দোকান হলো নিঃশব্দ। শোনা গেল শাটার নামানোর আওয়াজ। ছাত্রদের পদশব্দ দূরে সরে গেল। এরপর প্রত্যক্ষ করলাম নিঃশব্দতায় ভাঙচুর, বাতাসের গর্জনধ্বনি তীব্র থেকে তীব্র হতে আমার মনে কাঁপন ধরিয়ে দিল। মনে হলো, আজ তারা চক্রাকারে ঘুরছে। অল্পক্ষণের জন্য পাতার নাচন বন্ধ হয়ে আবার শুরু হয়। যখন বন্ধ হয় তখন সবকিছু এত নীরব হয়ে যায় যে আমার পুরোনো একটি স্মৃতির কথাও মনে পড়ে যায়।
ঠিক এমন নীরবতা অনুভব করেছি যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের নয় মাস, ছাত্রদের কোলাহল ছাড়া রীতিমতো পাগল হবার দশা হয়েছিল আমার। মনে হলো, নীরবতা যখন ফিরে এসেছে আরেকটা বিপর্যয়ও বোধহয় আসবে আর হলো ঠিক তাই। মনসুর ভাইয়ের দোকানের ঠিক ওপরে একটি কড়ই গাছ আত্মাহুতি দিল। ভেঙে গেল দোকানের একপাশ, অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম আমি আর হারালাম দীর্ঘদিনের বন্ধুদের। অনেকেই গুঁড়ো হয়ে গেল। এরপর সেই নীরবতাকে ধারণ করলাম। ষাট বছরে এই প্রথম বুঝতে পারলাম প্রিয়জন হারালে কেমন লাগে মানুষের। কিন্ত যখন প্রশ্ন আসে নিজ অস্তিত্বের তখন অন্যকিছুর চাইতে মূখ্য হয়ে ওঠে পাথর সত্তা। আমারও তাই হলো। একজন এসে বলল, মনসুর ভাই আপনার দোকান পুরোটা ভেঙে আমরা ঠিক করে দেব। আর পুরো দোকান যদি ভেঙে ফেলা হয়, আমি যাব কোথায়? ইতিহাসগুলো আমাকে বলে যেতে হবে এই বোধ তৈরি হলো। আর ইতিহাস বলতে হবে কোনো মানুষকে। পাতার কথা বোঝার একটি সূত্র যেমন পেয়েছি, তেমন হয়তো মানুষের কাছে জমিয়ে রাখা ইতিহাসগুলো পৌঁছানোর পথ আবিষ্কার করে ফেলব।  কিন্তু তার আগে আমাকে বাঁচতে হবে আরও অনেকদিন।

মনসুর ভাই স্বয়ং এ যাত্রা বাঁচালেন। দোকানটি তার জীবনের অংশ, দোকানের ইট পাথর টিন সবই তার আপন। যতটুকু ভেঙেছে ঠিক ততটুকু সংস্কারের ব্যাপারে রাজি হলেন। এর বাইরে কিছুই ভাঙতে দিলেন না। তাই অক্ষত থেকে গেলাম। এভাবেই চলছিল দিন। চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, পাতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের। কৌতূহল তো আছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারও। যদি যোগাযোগ হয় আর যোগাযোগ থেকে বন্ধুত্ব তবে সবিনয়ে আশপাশে থাকা বৃক্ষগুলোকেও পাঠানো যাবে মনসুর ভাইয়ের দোকানে ভেঙে না পড়ার অনুরোধ।
এই চেষ্টার ভেতরেই একদিন শুনতে পেলাম নতুন একটি কণ্ঠ। কথোপকথনের সূত্র ধরে জানতে পারলাম ছেলেটির নাম রঞ্জু। এরপর অনেককিছুই বদলে গেল।

তিন
রঞ্জু কথা বলে খুব ধীরে, মেপে মেপে। আমি আগ্রহী হলাম অন্য কারণে। ছেলেটি কথা বলা শুরু করার পরেই সেই দেয়ালন্ধ লতানো গাছটি ছটফট করতে শুরু করায়, পাথর বন্ধুটি আমার কাছে সংকেত পাঠালো। জানালো, কিছু একটা হচ্ছে, ঝড় হলে যেমন হয় তেমন নয় কিন্তু কিছু একটা হচ্ছে, পাতারা খুব অস্থির হয়ে উঠেছে। রঞ্জুদের থেকে সরে মনোযোগ দিলাম প্রকৃতিতে। না, পাখির ডাক ছাড়া অন্য কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

রঞ্জুর ধীর কণ্ঠেই শুনতে পেলাম, মনসুর ভাই আপনি নান্নুকে চিনতেন?

মনসুর ভাইয়ের চেনা মানে আমারও চেনা। তিনি মনে করতে পারলেন না। নান্নু নামে বেশ কয়েকজনকে আমি চিনি, মানে মনে করতে পারি তাদের কথার ধরন। রঞ্জু কার কথা বলছে? চেনানোর জন্য হয়তো আরও কিছু বলবে এটা ভেবে স্মৃতির গভীরে ডুব দেওয়া বন্ধ রাখি সাময়িক। না, রঞ্জু আর কিছু বলল না। অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

তোকে ব্যাচ কমিটির দায়িত্ব নিতে হবে। আপত্তি আছে কোনো?

আপত্তি নেই। তবে যদি ব্যাচের অন্যান্যরা ভিন্নমত দেয়?

ভিন্নমতকে স্বপক্ষে আনা নেতার কাজ। তাই নয় কী?

রঞ্জু শব্দ করে হাসল। আর সেই হাসিতেই তোলপাড় শুরু হলো আমার ভেতরে। ঠিক এভাবেই হাসত খুব চেনা একজন। এই ক্যাম্পাসেরই কেউ। পার্শ্ববর্তী পাথরদের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাই। ওরাও আমার সাথে একমত হয় কিন্তু কার হাসি মনে করতে ব্যর্থ হলো।

রঞ্জু বলল, নান্নু ভাই এই ক্যাম্পাসের ছাত্র ছিলেন। আমার বড় চাচা। এটুকু বলেই সে থেমে গেল। কথা বিরতির মাঝে একটা পাখি ডেকে উঠল, কমপক্ষে দু জনের পায়ের আওয়াজ শোনা গেল।

রঞ্জু ফের বলতে আরম্ভ করল। যুদ্ধের সময় মারা গিয়েছিলেন। আপনি কি এখন চিনতে পেরেছেন মনসুর ভাই?

মনসুর ভাই হয়তো চোখ বন্ধ করে ভাবছেন, তবে তার আগেই নান্নুর কথা মনে পড়ল আমার। রঞ্জুর কণ্ঠের সঙ্গে ভীষণ মিল ছিল নান্নুর। উত্তেজনায় কেঁপে উঠলাম। আর তাতেই হলো বিপদ। দেয়ালটাও নড়ে উঠল। শোনা গেল, হৈ হৈ শব্দ। ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি?

ভূমিকম্প তো বটেই। ভূমির হয়তো নয়, আমার ভেতরে যে কম্পন হলো তা তো কম কিছু নয়। নান্নুর বংশধর এসেছে ক্যাম্পাসে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো। প্রথমবারের মতো নিজের অক্ষমতার জন্য আফসোসও হলো খুব। কিন্তু আর কিছুক্ষণ পর যে আফসোস বেড়ে দ্বিগুণ হবে, এতটাই দ্বিগুণ যে নিজের মৃত্যুও চেয়ে বসব আমি, ঐ মুহূর্তে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি।

চার
ভাবনা প্রসারিত হতে দিই। অপছন্দনীয় শব্দকে সরিয়ে রাখতে চাই দূরে, এই মুহূর্তে স্মৃতির অতলে ডুব দিতে হলে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে হবে চারপাশ থেকে। ওদিকে কথা বলে যাচ্ছে রঞ্জু। ওর কণ্ঠ শুনতে আমার এত ভালো লাগছে যে, বিচ্ছিন্নতার চুড়ান্ত সীমায় নিজেকে ওঠাতে ব্যর্থ হই। 

পহেলা বৈশাখের প্রোগাম নিয়ে হুমকি দিয়েছে ওরা। জানিস তো?

রঞ্জু বলল, জানি না। এমন কেন হবে? ওরা বাধা দিলেই কিছু কি এসে যায়?

তোদের মূল হোস্টেলে সিট দিতে পারলাম আজকে, তাও কত হ্যাঁপা পোহাতে হলো। বাধার সঙ্গে আরেকটি ব্যাপার যুক্ত আছে। সেটা হলো ভয়, নিরাপদে থাকার প্রবণতা। ধীরে ধীরে বুঝতে পারবি। তোকে যে ব্যাচের দায়িত্ব নিতে বললাম, এটাও একটা কারণ। পহেলা বৈশাখে কেন অনুষ্ঠান করতে হবে অথবা সন্ধ্যার পর কেন বাইরে থাকাটা অপরাধ না, এই বিষয়গুলো তুই বুঝিস। জিজ্ঞেস করে দেখ অধিকাংশ বন্ধুদের। ওরাও বলবে, আমরা প্রোগ্রাম করব। কিন্তু কেন করতে হবে? মুখস্থ কিছু একটা শুনিয়ে দেবে। আমাদের এই অবস্থানটা বদলাতে হবে। মানুষকে বদলাতে হবে।

ভাইয়া, আমার বিষয়ে একটা কথা জানা দরকার আপনার।

সেটা কী?

আমি যে নান্নুর কথা বলছিলাম, যিনি যুদ্ধের সময় মারা গিয়েছেন এই ক্যাম্পাসেই। অনেক কথা শুনেছি আমরা ওনাকে নিয়ে। যেমন, উনি স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা ওনাকে মেরে ফেলেন। আবার এটাও শুনেছি, উনি আত্মহত্যা করেছিলেন। দুটোর কোনো ঘটনাই বিশ্বাসযোগ্য না হলেও বিশ্বাস করে ফেলেন বাবা। বাবা তো চাচার অস্তিত্ব ছিল এটাই স্বীকার করেন না। আমার যে একজন চাচা আছে তাও জেনেছি কত পরে। আমি এখানে সুযোগ পেয়েছি শুনে একদমই আসতে দিতে চাননি আমাকে। বলেছেন, অভিশপ্ত জায়গা। কিন্তুও আমি নাছোড়বান্দা। এসেই ছেড়েছি।

এটুকু কথোপকথন শোনার পর আর কিছু শোনার ধৈর্য হলো না। মনসুর ভাইও নিশ্চুপ। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই এবার ধরতে পারলাম নান্নুর ব্যাপারে ওনার নীরবতার কারণ।
নান্নুর মৃত্যুর সময়ে তিনি ছিলেন না। বিষয়টি উনি জানেনই না। দোকান বন্ধ রেখেছিলেন যুদ্ধের পুরোটা সময়। হোস্টেলেই ক্যাম্প করেছিল মিলিটারিরা। রঞ্জুরা যা জানে মোটেও তা সত্য নয়।
দেয়ালন্ধ লতানো গাছটি রঞ্জুর কথার মাঝে ফের বার্তা পাঠালো। রঞ্জু এখানে আসার পর বৃক্ষ সমাজে এই ধরনের অস্থিরতার লক্ষণ দেখতে পেয়েছিয়াম। এখন বার্তাটি পেয়ে তার পেছনের কারণ স্পষ্ট হলো। সব বোঝার পর ঝড় ওঠাতে ইচ্ছে হলো আমার। এমন এক ঝড় যার কথা মানুষ কল্পনাও করতে পারে নি। যে ঝড়ে নিজেও ধ্বংস হবো, ইতি ঘটাবো স্মৃতিবদ্ধ জীবনের। নিজস্ব কোনো স্মৃতি তো নেই আমার। তবে কেন এই বেঁচে থাকা? খানিক আগে বেঁচে থাকার ইচ্ছায় ভেবেছিলাম গাছের সঙ্গে সন্ধি পাতানোর সম্ভব্যতা নিয়ে। সময়ের অল্প পরিবর্তনে আত্মভাবনার এমন ঘুরে যাওয়া দেখে নিজেই অবাক হই।

পাথর বন্ধুটিকে বলি, তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। লতানো গাছটি ভুল কিছু বলে নি। গাছটির ভাষ্যমতে মানুষের মৃত্যুর পর আসলে সে পাতা হয়ে যায়। তাহলে পাথরের মৃত্যু হলে কী হয়? নান্নু পাতা হয়ে বেঁচে আছে দীর্ঘকাল। মৃদু শব্দে কাঁদছে সে। এতদিন কতকিছু সামলে সে ঝুলে ছিল ক্যাম্পাসের কোনো একটি গাছে। নিজের বংশধরের আঁচ পেয়ে পাতাটি অস্থির হলো। আর অস্থিরতার কারণ বুঝতে না পেরে সহপাতারাও বাজাতে শুরু করল করুণ সুর।

রঞ্জু কি শুনতে পাচ্ছে?

রঞ্জু, ঐ যে শোনো পাতার শব্দ। কেউ একজন তোমার সাথে কথা বলতে চায়। তোমাকে কথা বলতেই হবে। একটি মিথ্যা গল্প বয়ে বেড়াচ্ছে তোমাদের পরিবার। গল্পে যদি ফাঁক থাকে মৃত্যুর পর পাতা জীবন থেকে মুক্তি মেলে না মানুষের। যত ঝড় হোক, যত বাতাস বয়ে যাক, যত কান্না পাক না কেন, একটি ক্ষয়িষ্ণু ডাল বেয়ে তাকে ঝুলে থাকতে হয়। ভেবো না, এসব আমি এমনিতেই বলছি। আমি সত্যটা জেনেছি। তোমার চাচার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারি নি এখনো। কিন্তু অনুভব করতে পারছি তিনি তোমাকে যা বলতে চান তার সবটুকুই।

আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছে কেউ? উত্তর জানা সত্ত্বেও প্রশ্নটা করি। হয়তো একই ধরনের প্রশ্ন করছে পাতারাও। পাতাদের ভেতরেই তো আছে নান্নু। একটা বিষয় স্পষ্ট হয় আমার কাছে। এই যে আচমকা আমার একদিন পাতার কথা শোনার ইচ্ছে হলো, ভেঙে পড়ল মনসুর ভাইয়ের দোকান, রঞ্জু এলো; এসব মূলত বহন করে এনেছে ইঙ্গিত এবং ইঙ্গিতটি আমার জন্য- আমাকেই বলে যেতে হবে নান্নুর গল্প, সেই সঙ্গে যবনিকা টানতে হবে অর্থহীন পাথর জীবনেরও।
রঞ্জু বলছে, আপনারা থাকতে ক্যাম্পাসে কোনো প্রোগ্রাম হবে না, এটা মেনে নেয়া যায় না। আমরাও থাকব। শুনেছি, জীবনও যেতে পারে আমাদের।

জীবন দিতে ভয় থাকবে না রঞ্জুর, এটা অনুমিতই। ওর রক্তে আছে। সাময়িক হয়তো ভুলে ছিলাম, এখন চাইলেই কি আমি আর ভুলতে পারব যুদ্ধের সেই দিনটির কথা?

পাঁচ
অল্পকিছু কথা শুনে মনে হলো সাহস তোমার রক্তে আছে, নিশ্চয় আত্মপ্রত্যয় ঝিকমিক করছ সত্তাজুড়ে। রঞ্জু, এখন তোমরা যেমন ভাবছ দেশ নিয়ে তোমার চাচাও ঠিক একভাবেই ভাবতেন। যুদ্ধের দিনটার কথা বলি, তোমাকে। মনসুর দোকানপাট বন্ধ করে চলে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। আর যাই হোক, পাকিস্তানিদের তিনি সেবা দিতে রাজি নন। ছাত্ররাও নেই। আমার দিন রাত সবকিছু অর্থহীনতার চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। আজকে তোমার কাছে কথাগুলো বলতে না পেরে যেমন অনুভূতি হচ্ছে ঠিক তেমন কিংবা বলব তারচেয়েও অনেক গভীর হাহাকার আঁকড়ে ধরেছিল আমাকে।
সময়টা ঠিকঠাক বলতে পারব না। যুদ্ধ শুরু হয়েছে কয়েকমাস। একদিন শুনতে পেলাম বিস্ফোরণের জোরালো শব্দ। শত শত কাক একসঙ্গে কা কা করতে করতে উড়ে গেল দূরে। সেই সঙ্গে কেঁপে উঠল মাটিও। এত কাছে বিস্ফোরণ ছিল সেটাই প্রথম। খানিক বিরতির পর শুরু হলো ভারী বুটের পদচারণা। প্রথমে পদক্ষেপে ছিল সতকর্তা, এরপর এক ধরনের হুড়োতাড়া। উর্দু ভাষায় শোনা যাচ্ছিল এলোমেলো কথা। দোকানের কাছে স্থির হচ্ছিল না কিছুই। তখন আমার বয়স কম। অভিজ্ঞতাও। তাই বোঝার কিংবা শোনার চেষ্টা করিনি। আর উর্দু ভাষার মর্মোদ্ধার করতে চাওয়ার কোনো যুক্তিও সেই মুহূর্তে খুঁজে পাই নি। যুদ্ধ তোমরা দেখো নি, গল্প শুনে নিশ্চয় এটা বুঝতে পারো বিস্ফোরণ, বুটের আওয়াজ, গুলি এসব শব্দ শুনতে পেলে মানুষের একটা সময় গিয়ে আর ভাবান্তর হতো না। মৃত্যুকে তখন স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিল মানুষ। আর আমি তো মানুষের চিন্তার, ভাষ্যের এক ধরনের ফলাফল- তাই আলাদা গুরত্ব দিই নি। এরপর যখন কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজ হলো তখনও নয়।

রাজাকারদের ভাষ্যে দু দিন পর পুরো ঘটনা জানতে পেরে আমি আহত হই। তবে সময়ের পরিক্রমায় যা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম।
হাসপাতাল আর হোস্টেলের সংযোগ সড়কের মধ্যবর্তী এক জায়গায় মাইন দিয়ে ফাঁদ পাতল। সে একা ছিল নাকি সঙ্গে অনেকেই ছিল সেই বিষয়ে কখনোই কোনো কথা শুনি নি। উদ্দেশ্য তো বুঝতেই পারছ। মিলিটারি নাশ। কিন্তু ঘটল ঠিক উল্টো একটি ঘটনা। মাইন বিস্ফোরণ হলো কিন্ত তাতে মারা পড়ল একেবারে সাধারণ একটি পরিবার। হাসপাতালের স্টাফ। মিলিটারি ক্যাম্পের এত কাছে ঐ পরিবার কী করছিল? তা আর জানা যায় নি। সবার শরীর ছিন্নভিন্ন। উত্তরটা দেবে কে? নান্নু ভুল বুঝতে পেরে ওদের দেখার জন্য হয়তো একটু বেশি পথ এগিয়ে হোস্টেলের সামনেই চলে এলো। কিংবা কে জানে, নিরীহ মানুষকে তার ফাঁদে পড়তে দেখে জেগে উঠেছিল অপরাধবোধ। প্রতিশোধ নিতে অথবা মৃত্যু আলিঙ্গন করে নিতেই সে এসে থামল মনসুর ভাইয়ের দোকানের পশ্চিম পাশে। পড়ল পিশাচের মুখে।  আর শুরু হলো গুলি।
শুনতে পাচ্ছ কি?

রঞ্জু পাতাদের কথা শোনো, আমার কথা শোনো। সবাই মিলে তোমাকে কিছু বলতে চাইছি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়