ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

হারিয়ে যাওয়া চিঠিতে প্রেমের পঙ্‌ক্তিমালা

নাজমুল হক তপন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২০, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হারিয়ে যাওয়া চিঠিতে প্রেমের পঙ্‌ক্তিমালা

|| নাজমুল হক তপন ||

প্রেম শাশ্বত, চিরন্তন। তবে সময়ের স্রোতে প্রেমের প্রকাশে আসে ভিন্নতা। মাত্র দু’আড়াই দশক আগেও আবেগ প্রকাশের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল চিঠি। প্রেমের চিঠি বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য কল্পনা করা যায় না। কবি গুরুর শেষের কবিতার ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও…’ প্রেমের চিঠির আবেদনকে করেছে কালজয়ী। আমাদের সময়ে তারুণ্যের দ্রোহ-প্রেমের সঙ্গে মিশে আছে অনিমেশ-মাধবীলতার প্রেমের চিঠি। প্রেমের চিঠি পাওয়ার জন্য আকুতি কিংবা অপেক্ষা নিয়ে কত যে বাংলা গান তা হিসাবের বাইরে। ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিওন, নাইরে টেলিগ্রাম…’ গানটি একসময় সবার মুখে মুখে ছিল। সম্প্রতি পরলোকে পাড়ি জমানো শিল্পী শাম্মী আখতারের ‘চিঠি দিও প্রতিদিন…’ গানটি শুনে বুকে দোলা দেয় না এমন বাঙালি খুব কমই পাওয়া যাবে। প্রেমের জন্য আকাশকে ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করে চিঠি লিখেছেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। পাঠক এবার সংগীত, সাহিত্য থেকে তাকানো যাক সাধারণের প্রেমের চিঠির দিকে।


ক্লাস ওয়ান থেকে এসএসসি পর্যন্ত আমি পড়েছি গ্রামের স্কুলে। বলাবাহুল্য, আমাদের স্কুল ছিল কো-এডুকেশন। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়তাম। বড় ভাই-বোনরা প্রেমে পড়তেন। তাদের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় আমরা ছিলাম বড়দের বিশ্বস্ত(!) পিওন। পরীক্ষায় খারাপ ফল করলে কেউ শাস্তি না পেলেও প্রেমের চিঠি ধরা পড়লে সে এক ভয়াবহ কাণ্ড! সপাং, সপাং বেতের বাড়ি অপেক্ষাকৃত কম শাস্তি। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ আর ছেলেদের টিসি দেয়ার অনেক ঘটনাই ঘটেছে প্রেমের চিঠিকে কেন্দ্র করে।


এবার আমার অভিজ্ঞতায় প্রেমের চিঠির কথা বলি। আগেই বলেছি, সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় আমরা ছিলাম পিওন। চকলেট, কটকটি, পেন্সিল-রাবার গিফট পাওয়ার লোভের সঙ্গে খানিকটা অ্যাডভেঞ্চারের নেশাতেও আমরা এই ঝুকিপূর্ণ কাজটা করতাম। চিঠির বিষয়ে কাউকে কিছু না বললেও মাঝেমধ্যেই চিঠি পড়ে ফেলতাম। সেখান থেকে দু’একটি চিঠির বর্ণনা দিচ্ছি। গ্রামর স্কুলে প্রেমের চিঠিতে অবধারিতভাবেই থাকত ছন্দ। যেমন:

     ‘LOVE আমার পাওনা

          YOU আমায় ভুলো না

          HAPPY হবো দুজনা

          IT IS কামনা’

বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে লেখা জাকারবার্গের ফেসবুক আবিষ্কৃত হওয়ার অনেক আগ থেকেই আমাদের ভালোবাসার চিঠিতে এমন ‘বাংলিশ’ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রেমের চিঠিতে একটা সম্বোধন প্রায়শই দেখা যেত: I SUGAR YOU- আমি তোমাকে চিনি। ভালোবাসার মানুষকে চেনাটা শুধু চেনা নয়, বাড়তি কিছু। প্রেমের চেনাকে মিষ্টিমাখা, মধুমাখা করতেই যে সুগার আমদানি তা বলাবাহুল্য।


ভাড়ায় চিঠি লেখার (প্রেমিক-প্রেমিকাদের আবদার মতো চিঠি লিখে দেয়া) কাজটাও অনেকেই আনন্দ নিয়ে করত। চা-সিগারেটের খরচ যোগানোর জন্য ভাড়ায় চিঠি লেখার কাজ যথেষ্ট স্মার্ট ছিলো। ক্লাস টেনে ওঠার পর এই সুযোগটা আমি লুফে নেই। যারা ভাড়ায় লিখতেন উচ্চতর শিক্ষার জন্য তাদের অনেকেই গ্রাম থেকে চলে গেছেন শহরে। ফলে জায়গাটা খালি ছিল। টুকটাক লেখালেখির সুবাদে পেশাদার(!) লেখালেখিতে হাতেখড়ি দিয়ে আমি জায়গাটি পূরণ করলাম। বেশ ধুমছে চিঠি লেখার কাজ করতে লাগলাম। একটা পর্যায়ে একটু দুই নম্বরীর আশ্রয় নিলাম। খেয়াল করলাম, প্রেমের চিঠি সবাই খুব সাবধানে রাখে। কেউ কাউকে বলে না। এতে একজনেরটা আরেকজন জানতে পারে না। বুঝতে পেরে, একই লেখা কয়েকজনকে দিয়ে দিলাম। নতুন লেখার জন্য মাথা খাটানো বাদ! বেশিদিন লাগেনি, মাস ছয়েকের মধ্যেই ধরা পড়ে গেলাম- সবাইকে একই মাল(!) গছাচ্ছি। সবার জন্যই সেই লেখাটা ছিল:

‘আমি সাজাহান তুমি মমতাজ

স্বপ্নের তাজমহল গড়ি আজ’

আমার এই প্রেমের অণুকাব্যটি বড় ভাইদের প্রেমিকারা দারুণ পছন্দ করেছিল! কিন্তু সবার পছন্দ হওয়াতেই আমার জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল।


শুনেছি ভালোবাসার মই চাঁদও পেড়ে আনতে পারে! স্কুলে পড়ার সময় এক প্রেমিক বড় ভাইয়ের ঘটনা থেকে এর উদাহরণ পেলাম। একটু-আধটু কবিতা লিখতেন। তিনি দূরদর্শী ছিলেন। প্রতিটি বিষয়ের নতুন ব্যাখ্যা দিতে পারতেন। প্রেমিকাকে লেখা তার একটা চিঠি আলোচিত ছিল বিশেষভাবে। তার ভাষায়, আমার ইচ্ছা করে গোটা দুনিয়াতে যারা বিদ্যুতের কাজ করে তাদের সব মইগুলো নিজের কাছে আনি। তারপর মইয়ের সঙ্গে মই বেঁধে আকাশের চাঁদ পেড়ে এনে তোমার হাতে ধরিয়ে দেই।

এবার আমার নিষ্ফলা প্রেমের চিঠির কথা বলি। এসএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক ‘সুরবালা’র সঙ্গে পরিচয় হলো। পরীক্ষা শেষে বেশ কয়েকদিন পর প্র্যাকটিক্যাল। বন্ধুরা বলল, ওই মেয়েটাকে যদি তুই বাগ মানাতে পারিস তবে বুঝব ‘তুই একটা জিনিস’। নিলাম চ্যালেঞ্জ। বেশ টুকটাক কথাও হলো। আত্মবিশ্বাস গেল বেড়ে। পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, একটু খাতির হওয়ার পরের পর্ব হলো ছন্দসমৃদ্ধ চিঠি। সুতরাং আমিও লিখলাম:

       ‘টুনটুনি ঝুনঝুনি মহারানী

              বুনবুনি খুকুমনি শুয়োরানি’

চিঠি লিখে দেয়ার পর সে নিলো কিন্তু কিছু না বলে মেজাজ দেখিয়ে গটগট করে চলে গেল। ভাবলাম কেল্লা ফতে! কিন্তু পরদিন আমার চিঠি ফেরত এলো। আর কখনো এসব না লিখতে বলেছে সে। লিখলে… শাসানি আর কি! এই ঘটনার পর বন্ধুরা চরম হতাশ। আমি সাহসে বুক বেঁধে ফিরতি চিঠিতে আরও দুই লাইন যোগ করে লিখলাম:

‘টুনটুনি ঝুনঝুনি মহারানী

 বুনবুনি খুকুমনি শুয়োরানি

ইউনানি আয়ুর্বেদী’


জীবনের শেষ চিকিৎসা। বলাবাহুল্য ইউনানি আয়ুর্বেদিক ফর্মুলাও কাজ করেনি! যাই হোক, এবার সবার জন্য ধাঁধা: আমার ‘সুরবালা’র নাম কী?

প্রেমের চিঠি মানে কাগজে-কলমে লেখা। চোখের পানি, দীর্ঘশ্বাস, মান-অভিমান, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশার সঙ্গে কালি ও কলমের আত্মিক যোগ। এখনও প্রেম আছে। প্রেম প্রকাশের মাধ্যম এখন শতমুখী। কলমের কালির প্রতি ফোঁটায় যে আবেগ-অনুভূতি কিংবা হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ ওঠে তেমনটা কি-বোর্ডের টাইপে হয় কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে প্রেমের চিঠি বাদ দিয়ে বাঙালির প্রেমের ইতিহাস কখনোই যে সম্পূর্ণ হওয়ার নয়, এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়