ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বিশ্ব দেখার সরল বর্ণনার সাবলীল বয়ান

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২০, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্ব দেখার সরল বর্ণনার সাবলীল বয়ান

মুম রহমান: ‘আমাদিগকে ভ্রমণ করিতেই হইবে, আমাদিগকে বিদেশ যাইতেই হইবে... যদি আমাদিগকে যথার্থই পুনরায় একটি জাতিরূপে গঠিত হইতে হয়, তবে অপর জাতির চিন্তার সহিত আমাদের অবাধ সংস্রব রাখিতেই হইবে।’ (স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামীজীর বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৪২)

কতো কারণে মানুষ ভ্রমণ করে। কতো তার উদ্দেশ্য, বিধেয়! সেই সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ভ্রমণকাহিনি সমগ্রে স্বীকার করেছিলেন ‘পায়ের তলায় সর্ষে’, মনে হয়, সত্যি আজন্ম যাযাবর মন নিয়ে মানুষ জন্মায়। চার্লস ডারউইন বিগল নামের জাহাজে ভ্রমণ না-করলে হয়তো বিবর্তনবাদেরই জন্ম হতো না। ‘দ্য ভয়েজ অব দ্য বিগল’ ভ্রমণ সাহিত্যেও সমীহ করার মতো বই। মার্কো পোলো, ইবনে বতুতা, হিয়েং সান পরিব্রাজক হিসেবেই নমস্য। কেউ কেউ নেহায়েত নতুন খাদ্যের আস্বাদনে ভ্রমণ করেন, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে নাওমি দুগিদের লেখা ‘টেস্ট অফ পার্সিয়া’র কথা! পারস্যের স্বাদ নিতেই ঘুরে বেড়ানো। আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলী আফগানিস্তানকে তুলে ধরেছেন অন্য চোখে তার ভ্রমণ কাহিনিতে। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকাহিনি তো সংস্কৃতি আর ইতিহাসের আকর। কেউ কেউ অনেক বেশি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়, দুর্গম পাহাড়, সাগরের তলদেশ, মরুভূমি কিংবা মেরুভূমি টানে তাদের। কেউ সাইকেলে চড়ে ঘোরে, কেউ দু’পায়েই ভরসা করে। 

এ তো কিছু মনে করার অনুষঙ্গ তৈরি হলো সম্প্রতি ভ্রমণ সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক শাকুর মজিদের ঢাউস চারটি বই দেখে। সম্প্রতি হাতে এলো কথাপ্রকাশ প্রকাশিত শাকুর মজিদের ভ্রমণসমগ্র। চার খণ্ডের এই সমগ্রে শাকুর মজিদের মিশর, তুরস্ক, আরব আমিরাত, চীন, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, গ্রীস, চিলি, সুইডেন, চেকোশ্লভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ভ্রমণের বিবরণ পাই। লেখকের সতেরটি বই ঠাঁই পেয়েছে ভ্রমণসমগ্রে। বইগুলো হলো: ‘আমিরাতে তেরোরাত’, ‘আমেরিকা: কাছের মানুষ দূরের মানুষ’, ‘সক্রেটিসের বাড়ি’, ‘পাবলো নেরুদার দেশে’, ‘নদীর নাম টে’, ‘মিং রাজার দেশে’, ‘নাশিপাড়া লিজিয়াং’, ‘মালয় থেকে সিংহপুরী’, ‘কালাপানি’, ‘হো চি মিনের দেশে’, ‘সিংহল সমুদ্র থেকে’, ‘সুলতানের শহর’, ‘ফেরাউনের গ্রাম’, ‘নোবেলের শহর’, ‘প্রাগের ঠাকুরোভা, লবণপুরের মোজার্ট’ এবং ‘অন্নপূর্ণায়’।

বলা দরকার, এই ভ্রমণ সমগ্রের চারটি বইয়ের আকার, প্রকৃতি এমন যে, প্রথমত বই হাতে নিলে সমীহ জাগে। দুর্দান্ত ছাপা, ঝকঝকে চকচকে প্রকাশনা, ঢাউস চার রঙা এমন বিশাল সংকলন করতে যথার্থই সাহস লাগে। বলাবাহুল্য কথাপ্রকাশ এই বইয়ের মাধ্যমে তাদের সাহসের প্রমাণ দিয়েছে। ইতোপূর্বে তাদের অসাধারণ প্রকাশনার নমুনা দেখেছি ‘মুনতাসীর মামুন রচনাবলী’র মতো বই প্রকাশে।

এই ভ্রমণসমগ্র উল্টাতে-পাল্টাতে গিয়ে বারবার মনে পড়ছিল, আদি সিলেটের আরেক সাহিত্যিক, বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের দিকপাল সৈয়দ মুজতবা আলী’র কথা। তিনি বলতেন, ‘নিতান্ত বিপদে না পড়লে আমি আপন গাঁ ছেড়ে যেতে রাজি হইনে। দেশ ভ্রমণ আমার দু’চোখের দুশমন।’ তার এই কথা যে সত্য নয়, তার প্রমাণস্বরূপ হাজির করা যায় তার রচিত ‘দেশে বিদেশে’, ‘জলে ডাঙ্গায়’ ও ‘চাচাকাহিনী’র মতো বইগুলোকে। এটা অবশ্য ঠিক যে সৈয়দ মুজতবা আলী কখনোই নেহায়েত ভ্রমণের আনন্দ উপভোগের জন্য ঘর থেকে বের হননি। বরং নানা কাজেই তিনি ঘুরেছেন দেশে-বিদেশে। সেই ঘুরে বেড়ানো অমর হয়ে আছে তার রচনাশৈলীর অনন্যতায়। রচনাশৈলীতে নয়, বরং শাকুর মজিদের একটি মন্তব্য থেকে সৈয়দ সাহেবকে স্মরণ করলাম। ‘প্রাগের ঠাকুরোভা, লবণপুরের মোজার্ট’ গ্রন্থে শাকুর মজিদ বলছেন, ‘আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শুধু বেড়ানোর জন্য আমি এখনো পৃথিবীর কোনো শহরেই একবারের বেশি যাইনি। ৩০টিরও বেশি দেশের শতাধিক শহরে যাওয়া হয়েছে। প্রথমবার দেখার যে রোমাঞ্চ, দ্বিতীয় সফরে তা একেবারেই থাকে না। সুতরাং অতি জরুরি কোনো কাজ না পড়লে এই চমৎকার লোকালয়টিতে হয়তো আর দ্বিতীয়বার আসা হবে না।’

শাকুর মজিদের ভ্রমণসমগ্র পড়লে এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, তিনি খুব কমই বিদেশে বেড়াতে গেছেন। তার ভ্রমণকাহিনি লেখা, বিদেশে যাওয়া ‘রথ দেখা কলা বেঁচার’ চেয়ে বেশি কিছু। তিনি অধিকাংশ সময়ই বিদেশে গেছেন স্থপতি হিসেবে; কোনো সম্মেলনে কিংবা দলের সফর সঙ্গী হয়ে। এছাড়াও তিনি বিদেশে গেছেন শুটিং করতে; সেটা নাটক কিংবা তথ্যচিত্র- যাই হোক। ‘মালয় থেকে সিংহপুরী’ ভ্রমণটি তিনি করেছেন সপরিবারে। ‘স্রেফ বেড়াতে যাওয়ার জন্য অনেক কম ঝামেলায় যখন-তখন যেসকল দেশে যাওয়া যায়, তার মধ্যে মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুর অন্যতম। আমার এই ট্রাভেল এজেন্টের কাছে পাসপোর্ট পৌঁছানোর ৬ দিনের মাথায় তিনি আমার ৪ সদস্যের পরিবারের সবার জন্য দুবছরের মাল্টিপল ভিসার সিল মারা পাসপোর্ট ফেরত দিলেন। তার মানে, যখন-তখন সিঙ্গাপুর যাওয়ায় আর কোনো সমস্যা নেই।’

আগেই বলেছি, শাকুর মজিদের অধিকাংশ ভ্রমণই ‘স্রেফ বেড়াতে’ যাওয়া নয়। তার ভ্রমণের আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো তিনি বেশ গুছিয়ে, পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে ভ্রমণ করেন। অনেকটা প্যাকেজ ট্যুরের মতোই সব কিছু তৈরি থাকে। শুধু তৈরি নয়, বেশ ভালো আয়োজন থাকে। সেরা হোটেল, উৎকৃষ্টতম বাহন ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ভ্রমণের ভাগ্য তার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাকুর মজিদের ভ্রমণগুলো পাঁচ সদস্যের। ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘পঞ্চপর্যটক’-এর পাঁচজন মূল দল থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। তিনদিন পরে স্থাপত্য সম্মেলন শুরু হবে, তার আগে আমরা অন্য একটি জায়গা ঘুরে আসব। ঢাকা থেকেই আমাদের দশ দিনের ট্যুরের সবকিছু ঠিকঠাক করা। আমার কোনো কাজ নেই। আমার কাজ শুধু আমার পিপিমেটদের (পঞ্চপর্যটকের এই দলভুক্ত সদস্যরা নিজেদের পিপিমেট হিসেবে ডাকে) ফলো করা আর আমার দুই ক্যামেরায় ছবি তোলা (সিংহল সমুদ্র থেকে)। এই পঞ্চপর্যটক সম্পর্কে আরো বিস্তৃত জানা যায় ‘কালাপানি’ গ্রন্থেও- ‘আমাদের এই পিপি (পঞ্চপর্যটক) ট্যুরে বেশ কিছু নিয়মকানুন আছে। প্রথম নিয়ম হচ্ছে- ‘না’ শব্দটিকে ঢাকা জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন লাউঞ্জের ওপারে রেখে আসতে হবে। পঞ্চপর্যটকের যে-কোনো জন প্রথম প্রস্তাব দেয়ামাত্র বাকি চারজনের তা মেনে নিতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে ভোটাভুটি যদিও হয়ও তিনজন একমত হওয়ার পর বাকি ২ জনের কোনো ক্ষমতা নেই কোনো বিষয়ে দ্বিমত করা।’

এই পঞ্চপর্যটকের ভ্রমণের ফোকাল পয়েন্ট বলা যায় স্থাপত্যকলা। ফলে স্থাপত্যকলায় আগ্রহীদের জন্যে শাকুর মজিদের ভ্রমণসমগ্র অবশ্য পাঠ্য মনে করি। স্থাপত্যপ্রেমী শাকুর মজিদের পরিচয় পাই একাধিক গ্রন্থেই। ‘প্রাগের ঠাকুরোভা লবণপুরের মোজার্ট’ গ্রন্থে তিনি লিখছেন, ‘ছোট ছোট ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে আমাদের ভ্রমণতরী ছুটে চলছে। আর আমাদের ক্যামেরার ফ্রেমের মধ্যে ভেসে যাচ্ছে বিভিন্ন স্থাপত্যশিল্প সমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলো। গোথিক, রেনেসাঁস, নিও-রেনেসাঁস, আর্ট-ডেকো, বারোক, রকোক, ক্লাসিক, নিও-ক্লাসিক- এমন কোনো স্থপত্যধারা নেই, যে ধারার অনুসরণে তৈরি ভবন নেই এই নদীর দুই তীরে। বিগত প্রায় এক হাজার বছরে ইউরোপে যতগুলো রীতির দালানকোঠা বানানো হয়েছিল, তার প্রায় প্রত্যেক রীতির উদাহরণ আছে এই শহরে।’ স্থাপত্যকলার ইতিহাস যেন উঠে এসেছে এক নৌবিহারের আদলেই। 

সালজবুর্গে লেখকের মনে হলো,  ‘বিদেশে এসে পুরনো ঐতিহ্য কোথাও ধরে রাখা হয়েছে, এমন কিছু দেখলেই আমরা আমাদের পুরনো ঢাকার কথা তুলি। বুয়েটে আর্কিটেকচারে পড়ার সময় পুরান ঢাকার কনজার্ভেশন নিয়ে কত ক্লাস প্রজেক্ট করেছি। অনেকে থিসিসও করেছে এটার ওপর। বছরের পর বছর ধরে কত কাগজ নষ্ট হয়েছে। কোনো ছাত্রের, কোনো শিক্ষকের, কোনো গবেষক বা বুদ্ধিজীবীর কথা টেকেনি। পুরনো ঢাকার কোনো ঐতিহ্যকে বিদেশিদের দেখানোর উপযোগী করে তৈরি হয়নি।’ দুঃখজনকভাবে, আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যর্থতা ও বেদনার কথা ওঠে এসেছে ‘প্রাগের ঠাকুরোভা লবণপুরের মোজার্ট’ গ্রন্থের এ অংশে।

‘সুলতানের শহর’ গ্রন্থে শাকুর মজিদ একজন স্থপতির চোখ দিয়েই যেন দেখছেন মসজিদের শহর তুরস্কের ইস্তাম্বুলকে। তার বর্ণনায় বিখ্যাত ঐতিহাসিক মসজিদগুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ‘প্রায় বর্গাকৃতির এই বৃহৎ মসজিদটির আয়তন প্রায় ৩৬ হাজার বর্গফুট। প্রকাণ্ড গুম্বুজ ১৬০ ফুট উঁচু, ৮০ ফুট ব্যস। যখন এ-গম্বুজটি বানানো হয়, তখন ছিল এটা সেসময়ের সবচেয়ে বড় মসজিদের গম্বুজ। যে পিপার ওপর গম্বুজটি দাঁড়ানো সেখানে ৩২টি জানালা। সুলতান সুলেমানের নির্দেশে এর স্থপতি মিমার সিনান এ-মসজিদটির নির্মাণকালে এ-শহরের প্রাচীন স্থাপত্য পুরাকীর্তির সাথে তার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন। সেকারণে ইস্তামবুলে তৃতীয় (মতান্তরে চতুর্থ) শতাব্দীর অনুপম স্থাপত্য হাজিয়া সোফিয়ার কাঠামো দ্বারা মসজিদটির অবয়বকে প্রভাবিত করা হয়।’ এই বর্ণনার সঙ্গে লেখক সুলেমানিয়া মসজিদের ফ্লোরপ্ল্যান, এলিভেশন এবং মিনারের ডিজাইন তুলে ধরেন। শুধু ভ্রমণপিয়াসী নয়, স্থাপত্যপ্রেমীদেরও তৃষ্ণা মেটায় এ বর্ণনা।

স্থপতি শুধু নন, শাকুর মজিদ একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও। তিনি স্থির ও চলচ্চিত্র দুই ব্যাপারেই আগ্রহী। একাধিকবার শুটিং করতেই বিদেশ গেছেন। তার লেখাতে চিত্রগ্রাহক মানুষটির সংবেদনশীল মনের পরিচয়ও পাবেন পাঠক। ‘কালাপানি’ গ্রন্থের একটি জায়গায় পাই, ‘আমাদের সামনেই এক চিলতে একটা দ্বীপ। ৫৭২টি দ্বীপের একটি এটি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে একটা ষাঁড় শুয়ে আছে পানির নিচে, তার কুঁজটা শুধু ভাসছে।’ তার একটু পরেই দেখতে পাই, ‘আমরা যে-তীরটাতে বসে আছি, তা থেকে সিকি মাইল দূরে, সাগরের মধ্যে একটা সিংহশাবক দেখে চোখ আটকে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ওটা সিংহ না, তবে সিংহের মতো। কোনো এক গাছের কাণ্ড ওপর থেকে ভেঙে গেছে। গাছের মূলের সাথে আটকানো যে-অংশটা সুনামির কঠিন তীব্র আঘাতে পরাস্ত হয়নি, তা জেগে আছে পানির ওপরে এবং এই বৃক্ষটি যে-আকার নিয়ে জেগে আছে, তা একটি সিংহের।’ সমুদ্রের মাঝের একটি দ্বীপকে পানিতে ভেসে থাকা ষাঁড় আর একটি গাছের ভাঙা কাণ্ডটিকে সিংহ কল্পনা করতে পারার এই চোখ ও মন একজন ফটোগ্রাফারেরই থাকে।

তার ফটোগ্রাফিক মনের পরিচয় তুলে ধরতে ‘অন্নপূর্ণায়’ গ্রন্থের একটি অংশ তুলে ধরা যাক, ‘ফটোগ্রাফির ডার্করুমে ছবি প্রসেস করার সময় এক্সপোজ করা ব্রোমাইড পেপারে কেমিক্যাল মেশানো পানিতে চুবিয়ে রাখার খানিক পর থেকে যেমন করে সাদা কাগজের ওপর ক্রমশ ছায়ারেখাগুলো ভাসতে শুরু করত, ঠিক তেমনি আকাশের গা থেকে বেরিয়ে আসছে এই পর্বতরেখা। এগুলোই হিমালয়ের অন্নপূর্ণা রেঞ্জের পাহাড় আর পর্বত!’ ফটোগ্রাফির সাথে যাদের পরিচয় আছে তারা এই বর্ণনার ‘ডার্করুম’, ‘প্রসেস’, ‘এক্সপোজ’, ‘ব্রোমাইড’, ‘ক্যামিক্যাল’ ইত্যাদি শব্দকে অন্তরঙ্গভাবে গ্রহণ করতে পারবেন। সংযোগ করতে পারবেন শাকুর মজিদের ছবির সঙ্গে।

শাকুর মজিদকে আমরা একাধিকবার দেখি তার দুইটি ক্যামেরা আর ট্রাইপয়েড নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতে। দলের অন্যরা প্রায়শই তার ট্রাইপয়েড কিংবা ক্যামেরা বহনে সাহায্য করে আন্তরিকতার সঙ্গে। তবুও কোথাওবা শাকুর এই ফটোগ্রাফারের জ্যাকেটটি যেন খুলে রাখতে চান। কতোই আর ভালো লাগে টানা সাটার টিপে যাওয়া! মন আর চোখ কখনোবা প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে চায় সাটার স্পিড আর এক্সপোজার মিটারের সীমানা পেরিয়ে। তাই, ‘হো চি মিনের দেশে’ গ্রন্থে শাকুর মজিদ লেখেন, ‘বালির ওপর বসে থাকি। ছবি তুলতে ইচ্ছা করে না। এই ক্যামেরাকেও মাঝে মাঝে শত্রু মনে হয়। জগতের অনেক সুন্দর বস্তু সরাসরি আমার চোখ দিয়ে দেখতে পারি না।  সময় কম থাকে কিংবা হয়তো কোথাও চলছি। স্থির নয় ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখি বলে জিনিসগুলোকে পরেও দেখতে পারি ও কাউকে দেখাতেও পারি। কিন্তু নিজের দেখাটা থেকে যায় অদেখা।’

একটানা ছোটাছুটিও হয়তো সব সময় দেখাটা উপভোগ করার সুযোগ দেয় না। শাকুর মজিদ ও তার দল মাঝেমাঝে খুব দ্রুত ছোটেন। পাঠক হিসেবে তখন আমরা থই পাই না। মনে হয়, আমরাও ছুটছি লাগামহীন। একটু জিরিয়ে নেয়ার অবসর কই? ‘আমস্টার্ডাম থেকে সাওপাওলো হয়ে আমাদের যাত্রা চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো। মাঝখানে ইউরোপ ছুঁয়ে যাব, একটু দেখে যাব না, এমন কী হয়! তাই ঠিক করা হলো, যাওয়া এবং আসার পথে দুই কিস্তিতে আমাদের ইউরোপের ৪টি দেশ সফর হবে। চিলি যাবার আগে জার্মানির বার্লিন, যেখানে খুব সম্প্রতি বিশ্বসেরা কিছু নতুন আঙ্গিকের স্থাপত্যকর্ম হয়েছে। গ্রিস শেষ করে আমরা ব্রাজিলের সাওপাওলো থেকে রওনা দেব পাবলো নেরুদার দেশ চিলিতে। চিলি থেকে ফেরত এসে নেদারল্যান্ডসে ১ দিন থেকে যাবো লুভ মিউজিয়াম দেখতে শিল্পের নগরী প্যারিস।’ (সক্রেটিসের বাড়ি) এই বর্ণনা পড়তে গিয়ে মনে এক ধরনের আফসোস থাকে। মনে হয়, আহা! শাকুর মজিদ যদি একটু জিরোতেন হয়তো অন্য কোন ছবি আমরা পেতাম, হয়তো তার চোখ দিয়ে, লেন্স দিয়ে আমরা আরো গভীরে যেতে পারতাম। মনে মনে ভাবি, স্থপতি শাকুর মজিদ আরেকটু থামলেই ভেতরের লেখকটি জেগে উঠতেন আরো গভীরতর বোধ নিয়ে। কিন্তু উপায় কি! ‘সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার।’ আদতে নিজেকে দেখতে পারার চোখটিই বোধহয় সবচেয়ে উত্তম চোখ। কিন্তু সে দেখতে পারা সব সময় হয়ে ওঠে না। পরিবেশ পরিস্থিতি সব সময় অনুকূল থাকে না।

পরিবেশ পরিস্থিতির প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো শাকুর মজিদের আমিরাত ভ্রমণের কথা। ১৯৯৭ সাথে লেখা ‘আমিরাতে তেরোরাত’ তার প্রথম ভ্রমণকাহিনি। প্রথম ভ্রমণকাহিনিতেই আমরা স্বদেশ সচেতন সংবেদনশীল লেখকের পরিচয় পাই। ‘কুয়েত এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জ থেকে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে ঢোকার সময় প্রথম সাম্প্রদায়িক দুরাচারের বিষয়টি টের পেলাম। নিরাপত্তা-তোরণের ভেতর দিয়ে নিরাপদে প্রবেশ করে রেহাই মিলল না। আমার পরনে যেহেতু প্যান্ট-শার্ট এবং চেহারা পশ্চিমাদের মতো নয়, তাই আমার দেহেও চালানো হলো নিখুঁত তল্লাশি। দুই হাত ওপরে উঁচিয়ে ভালো করে দেখাতে হলো। বগলের তলায় এবং বেলটের তলায় কিছু না পেয়ে কুয়েতি সুঠামদেহী নিরাপত্তাকর্মী সম্ভবত মন খারাপ করে ছেড়ে দিল। লাউঞ্জে এসে বসে দেখি, কালো বোরকা পরা রমণী এবং সাদা আলখাল্লা পরা পুরুষেরা পুরো শরীর কাপড়ে ঢেকে নির্বিচারে ঢুকে যাচ্ছে। তাদের জন্য ঐ কর্মীর কোনো উৎকণ্ঠা নেই; উৎকণ্ঠা নেই ইউরোপ-আমেরিকার সাদা চামড়ার যাত্রীদের জন্যেও, কিন্তু উৎকণ্ঠা আছে আমাদের নিয়ে।’ এই তীর্যক শ্লেষের আড়ালে আছে গভীর বেদনাবোধ। আমরা যারা একবারও বিদেশে গেছি তারা জানি, বর্ণ আর ধর্মের সংস্কারের দোহাই দিয়ে এয়ারপোর্টে হেনস্থা হতে হয় নিরীহ পর্যটককেও। নিরাপত্তার নামে এইসব সূক্ষ্ম উৎপাত প্রায়শই ভ্রমণপিপাসু মনকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়।

আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি টেনেছে শাকুর মজিদের ‘কালাপানি’ গ্রন্থখানি। প্রথমত বিষয় বস্তুর কারণেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। ভারতীয় স্বাধীন সংগ্রামী দুর্ধর্ষ বিপ্লবীদের ধরে সুদূর আন্দামান দ্বীপে আনা হতো দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে। এই দুর্গম্য দ্বীপে তৈরি করা হয় ভয়াবহ জেলখানা, যা নির্যাতনের জন্যে কুখ্যাত ছিলো। এমনি সব বন্দীদের কথা, তাদের দ্বীপান্তরের কথা, দ্বীপের ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি, নৃগোষ্ঠীর কথা এই বইতে সরল ও সাবলীলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। শাকুর মজিদের বর্ণনা ও বয়ানের সাথে আমরা আন্দামান দ্বীপকে দেখতে পাই চোখের সামনে। তবে অন্তত দুইবার এই বইতে একই তথ্যের পুনরাবৃত্তি আছে। এটা হতে পারে ইন্টারনেট কিংবা ভ্রমণের জন্যে ব্যবহৃত ব্রুশিয়ার ব্যবহারের কারণে। একটু সচেতন সম্পাদনার মাধ্যমে এ পুনরাবৃত্তি এড়ানো যায় এবং তাতে পাঠকের জন্যে বইটি আরো সাবলীল হয়ে উঠতে পারে।

শাকুর মজিদের ভ্রমণকাহিনিগুলো অনেক বেশি গোছানো মনে হয়েছে। তাতে অবশ্য দোষের কিছু নেই। পর্যটকের রকমফের বিশ্বব্যাপী আছে। শাকুর মজিদকে পাহাড়, সমুদ্র, প্রকৃতির চেয়ে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বিশেষত স্থাপত্যকলা বেশি টানে। সেই টানের কারণে আমরা বাংলা সাহিত্যে অন্য রকম কিছু ভ্রমণকাহিনি পেয়ে যাই। তবুও, মন চায় আরো। মন চায়, শাকুর মজিদের বয়ানে জাপান, রাশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, আরববিশ্ব দেখি। আরো বেশি অপেক্ষায় রইলাম শাকুর মজিদের কলম থেকে বাংলাদেশের স্থাপত্য আর পুরানো ঢাকার গল্প শুনতে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়