ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

‘নিন্দিত নন্দন’ থেকে প্রিয়ভাষিণীর শৈশব

কবি স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৮, ৬ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘নিন্দিত নন্দন’ থেকে প্রিয়ভাষিণীর শৈশব

স্বরলিপি: বড় লাল টিপ তাঁর ললাটে শোভা পেত। গলায় বহু বর্ণের মালা। কণ্ঠে সত্যের স্পষ্ট উচ্চারণ। মানুষটির নাম ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পৈশাচিক বর্বরতার শিকার হয়েছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশের নির্যাতিতা মা-বোনের উত্তরাধিকার বহন করে চলা তিনি এক সংশপ্তক। এই মহীয়সী লোকলজ্জা আর সামাজিক ভয় অগ্রাহ্য করে অকপটে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার কথা জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন। এজন্য তাকে মূল্য দিতে হয়েছে। অবহেলা, গঞ্জনা-বঞ্চনার চূড়ান্ত রূপ সহ্য করতে হয়েছে। তারপরও তিনি হার মানেননি। আজ তিনি হেরে গেলেন মৃত্যুর কাছে। বেশ কিছুদিন ধরেই হাসপাতালে শয্যায় ছিলেন তিনি। আজ ছিন্ন করে গেলেন জীবনের বন্ধন।   

দেশের বহু মানুষের কাছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস। ভাস্কর, বীরাঙ্গনা এই মহীয়সীর  জন্ম ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে, খুলনায় নানা বাড়িতে। মা রওশন হাসিনা, বাবা সৈয়দ মাহবুবল হক। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর শৈশব কেটেছে যশোরে। ছেলেবেলায় নানা বাড়ি বেড়াতে গেলে নানা আব্দুল হাকিমের সঙ্গে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নিতেন প্রিয়ভাষিণী। নানা ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিত্ব। সেই সময় থেকেই তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রবল। একদিন সেমিনার শেষে নানার সঙ্গে খাবার টেবিলে বসে ছিলেন  প্রিয়ভাষিণী। আয়োজকরা আদর করে তাঁকে ছোট চেয়ারে বসতে দিলেন, খেতেও দিলেন। কিন্তু কোনো খাবারই খেলেন না তিনি। নানা তাঁকে বুঝিয়ে বললেন, তাতে কাজ হলো না। অবশেষে তিনি ছোট্ট প্রিয়ভাষিণীর হাতে দু’আনা গুঁজে দিলেন। পয়সা নিলেন প্রিয়ভাষিণী কিন্তু খাবার খেতে রাজী হলেন না। এবার নানা বিব্রত হলেন। ফেরার পথে তিনি এর কারণ জানতে চাইলেন। তখন প্রিয়ভাষিণী বললেন, তাকে ছোট চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সবাইকে চা দেওয়া হলেও তাকে চা দেওয়া হয়নি। এই বিষয়টি তাঁর ভালো লাগেনি। নানা এরপর আর কিছু বলেননি। তিনি এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ছোট্ট প্রিয়ভাষিণীর আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় তখনই পেয়েছিলেন।

পঞ্চাশের দশকে ঢাকা চলে আসেন প্রিয়ভাষিণী। ২৪ নাম্বার কে এম দাস লেনের একটি বাড়িতে জীবনের আরেকটি পর্ব শুরু হয়। বাড়িতে বিরাট সামিয়ানা টানিয়ে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী উদযাপন করা হতো। মাঝে মাঝে বসত কবিতার আসর। প্রিয়ভাষিণীর বড় মামা নাজিম মাহমুদ আয়োজন করতেন। এই মামাকেই জীবনের আলোর উৎস মনে করতেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। বাড়িটিই হয়ে উঠেছিল তাঁর এবং মামা-খালাদের সংস্কৃতির চর্চা কেন্দ্র। এই বাড়ি থেকে ২-৩ বাড়ি পরে বাস করতেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। সেই বাড়িতে খালাদের সাথে বেড়াতে যেতেন প্রিয়ভাষিণী। ফজলুল হকের বাড়িটিকে প্রিয়ভাষিণী মনে করতেন রূপকথার রাজ্য। বাড়ির ভেতরে বাগান, বাগানে ছিল হরিণ। শিশু প্রিয়ভাষিণী দেখতেন, বাগানের হরিণ শেরেবাংলার আদর পাওয়ার জন্য কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াত। সেই বাড়িতে পিকনিক কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন প্রিয়ভাষিণী। তবে ফজলুল হকের কাছে ভয়ে খুব একটা ঘেঁষতে চাইতেন না। শেরেবাংলা নিজেও বিষয়টি বুঝতে পারতেন। তাঁর ভয় ভাঙাতে ফলজুল হকের স্ত্রীও চেষ্টা করেছিলেন।

একদিন ফজলুল হকের বাড়িতে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাদা শার্ট, ধুতি পরে, চোখে চশমা, মুখে পাউডার মেখে মাস্টার বাবু সাজলেন প্রিয়ভাষিণী। তারপর সুকুমার রায়ের ‘মাস্টার বাবু’ কবিতাটি আবৃত্তি করলেন। পেলেন প্রথম পুরস্কার। এ ঘটনায় শেরেবাংলা ভীষণ খুশি হয়ে সব দর্শকের সামনে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে উঁচু করে তুলে ধরে বলেছিলেন ‘দেখে নিন সেকাল ও একাল দুই ভাইবোনকে।’ পরদিন ‘আজাদ’ পত্রিকায় ফজলুল হক আর প্রিয়ভাষিণীর ছবি বড় করে ছাপা হয়েছিল। সেই ছবি দেখে প্রিয়ভাষিণীর বাবা বলেছিলেন ‘সাবাস বেটি সৈয়দজাদী’।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়