ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উত্তর-মানব চেতনা ও সাহিত্য || অভিজিৎ মুখার্জি

অভিজিৎ মুখার্জি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ৯ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উত্তর-মানব চেতনা ও সাহিত্য || অভিজিৎ মুখার্জি

অভিজিৎ মুখার্জি : অনুবাদক ও অধ্যাপক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

মিশেল ফুকোর প্রথম প্রামাণিক রচনা ‘ধ্রুপদী যুগে উন্মাদনার ইতিহাস’(Histoire de la folie à l’âgeclassique) গ্রন্থের আলোচনায়, শ্রী অমল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘উত্তর আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক’ বইতে, ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন:

‘আমরা যাকে প্রাতিস্বিকতা বলতে অভ্যস্ত, যাকে আমরা ধরে নিই মানুষের অনড়, ধ্রুব চরিত্র বলে, সেটি মূলত কিছু সামাজিক ও নৈতিক বিধিনিষেধের প্রত্যাদেশে আমাদের ওপর আরোপিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে, একজন সামাজিক প্রাণী তার নিজের কাছে বিদেশী ও বিচ্ছিন্ন।’

মিশেল ফুকোর জন্ম ১৯২৬-এ, আর ফ্রাঞ্জ কাফকা মারা গেছেন ১৯২৪ সাল নাগাদ। অথচ কাফকা ততদিনে সেই গল্পটা লিখে রেখে গেছেন, ইংরেজি তর্জমায় যেটার নাম ‘মেটামরফোসিস’। আইডেন্টিটি ও বিচ্ছিন্নতার সংকট নিয়ে এক নির্ভুল সতর্কবার্তা। মানুষকে নিয়ে একটা প্যারাবল বা নীতিশিক্ষার গল্প লিখেছিলেন কাফকা। তাতে লিখেছিলেন:

‘He has two antagonists: the first presses him from behind, from the origin. The second blocks the road ahead. He gives battle to both. To be sure, the first supports him in his fight with the second, for he wants to push him forward, and in the same way the second supports him in his fight with the first, since he drives him back. But it is only theoretically so. For it is not only the two antagonists who are there, but he himself as well, and who really knows his intentions?’

এই প্রথম আর দ্বিতীয় যদি হয় যথাক্রমে অতীত ও ভবিষ্যৎ, মানুষের ভূমিকাই যে এদের মধ্যে একটা ছেদ তৈরি করছে, কেননা সেই ভূমিকাটা এখনও মানুষের কাছেই পরিষ্কার নয়, এটা যে কাফকাই ইঙ্গিত করে গিয়েছিলেন, আমরা যেন এই আলোচনা পড়তে পড়তে তা মনে রাখি।

১৯২৭ নাগাদ এইচ.টি. লো-পোর্টার অনুবাদক হিসেবে থমাস মানের উপন্যাস ‘দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন’র ইংরেজি অনুবাদের উপক্রমণিকায় লিখলেন:

‘...it stands as it does to-day with human beings, not least among them writers of tales: it is far older than its years; its age may not be measured by length of days, nor the weight of time on its head reckoned by the rising or setting of suns. In a word, the degree of its antiquity has no ways to do with the passage of time…

…It takes place or, rather, deliberately to avoid the present tense, it took place, and had taken place in the long ago, in the old days, the days of the world before the Great War, in the beginning of which so much began that has scarcely yet left off beginning. Yes, it took place before that; yet not so long before. Is not the pastiness of the past the profounder, the completer, the more legendary, the more immediately before the present it falls?’

দ্বিতীয় অংশটায় ঐতিহাসিক সময়ের ধারাবাহিকতায় ছেদের কথা এলেও প্রথমাংশে দেখা যাচ্ছে তখনও ‘মানব’-এর ধারণায় আস্থা টলেনি ‘দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন’ লেখকের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে উত্তর-আধুনিক চিন্তকেরা ইতিহাসে মানবচরিত্রের কোনো অনড় সত্য আবিষ্কার করার মত আস্থা থেকেই নড়ে গেলেন, শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়ানে:

‘ইতিহাস বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝে থাকি তা শুধু ঘটনাস্রোতের বিবরণ নয়, তার ধারাবাহিকতা ও তার মধ্যে থেকে একটা সুস্পষ্ট ক্রমোন্নতি, একাধিক মানুষের সংহত, সঙ্ঘবদ্ধ চিন্তার একত্ব, একটা সুস্পষ্ট বক্তব্য বা পরিণতিকে আবিষ্কার করার চেষ্টা...সাম্প্রতিক, উত্তর-আধুনিক চিন্তায় সে ইতিহাসবোধের নাভিশ্বাস উঠেছে। যুদ্ধোত্তর ইতিহাস-চিন্তা ঘটনার ক্রমান্বয়ে আস্থাহীন ও তার অন্তর্নিহিত কোনো সামূহিক তাৎপর্যে অবিশ্বাসী। যেখানে প্রাচীনেরা দেখতেন ধারাবাহিকতা, আধুনিকরা সেখানে দেখেছেন একটি ছেদের পর আর একটি ছেদ, যার মধ্যে নেই কোনো গূঢ় তাৎপর্য, নেই কোনো ক্রমিক প্রগতির ইঙ্গিত।’

মিশেল ফুকো সেই পথ ধরে ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষ একটি আবিষ্কার, যার জন্মতারিখ- যে আমাদের চিন্তার প্রশ্নতত্ত্ব সহজেই দেখায়- সাম্প্রতিক। এবং সম্ভবত তার সম্ভাব্য সমাপ্তি আসন্ন।’ আরেকবার তাহলে মনে করিয়ে দিই মেটামরফোসিস বলে যে একটা গল্প লেখা হয়েছিল!

কাফকা তার সাহিত্যের মাধ্যমে প্রথম দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে মানুষ পথ হারিয়ে, কোনোরকম মানব থেকে বিচ্যুত হয়ে চলে এসেছে অনেক দূর। ভুল হয়ে গেছে বহু, ভুল হয়ে গেছে সব। এত সুস্পষ্ট ছিল তাঁর পর্যবেক্ষণ, এত অমোঘ ছিল তার ইঙ্গিত যে আজকের পৃথিবীতে সাহিত্যের পাঠককে যে লেখকেরা ভাবাচ্ছেন সবচেয়ে বেশি তারা তো প্রকারান্তরে নিজেদের কাফকার উত্তরসূরি বা তার কাছে ঋণী বলে ঘোষণাই করে দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম রাখছেন কাফকাকে স্মরণ করাতে।

ভুল হয়ে গেছে বহু, ভুল হয়ে গেছে সব। এবং হয়েছে সেই আলোকপ্রাপ্তির উল্লাসের সময় থেকেই, ভুল হয়ে গেছে নবজাগরণের সূত্রেও। আজ আর তাই, কেউ ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গাইলে হাসি পেয়ে যায়। সস্নেহে স্মিত হাসা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। যেটা স্বাভাবিক, এখন কিছুকাল মানুষের জয়গানের সাহিত্য কৃত্রিম সাহিত্যই হবে, সাহিত্যে আমরা এখন ব্যতিক্রমহীনভাবে বিচ্যুতির বিভিন্ন ছবিকেই নানা গভীরতা থেকে উঠে আসতে দেখব।

অলাত এহ্‌সানের ছোটগল্পগুলোর ক্ষেত্রেও, বলা বাহুল্য, এর ব্যত্যয় ঘটছে না। একটা পরিবারের মাত্র দু-তিন পুরুষের ইতিহাসও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হারিয়ে গেছে। (ইমানুয়েল) কান্টই প্রথম ব্যক্তি যিনি বুঝলেন যে মানুষের জীবন ও অভিজ্ঞতা সর্বতোভাবে অনিশ্চয় ও আকস্মিক; এক তাণ্ডব, যেখানে অনিয়ম এমনই প্রবল যে কোনো মানুষই জানে না ঠিক পরের মুহূর্তে কী ঘটবে। এমতাবস্থায় কোনো জ্ঞান আহরণ আদৌ সম্ভব কিনা সেটাই প্রশ্ন। তাই ‘ইছহাক নামের পারিবারিক ভূত’-গল্পে ভূতকে আসতে হচ্ছে সেই ইতিহাসটা ধরিয়ে দিতে। কিন্তু ইতিহাসটা ভূতুড়ে হচ্ছে না! সেটা মনে হচ্ছে যেন হয়ে যাচ্ছে অলাত এহ্‌সান যে নির্দিষ্টভাবে সেই ইতিহাসটাকে গ্রন্থিত হতে দেখতে চায়। এই নিশ্চয়তার ভূত কিন্তু আজ, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে, একটা লক্ষ করার মতো দিক। মিলান কুন্দেরা তাঁর ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’ বইতে গর্ব করে দাবি করেন যে, ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতেই আছে তার সংশয়ের সংস্কৃতি আর সেটা স্পষ্ট অভিব্যক্তি পেয়েছিল প্রথম সেই মহাদেশের উপন্যাসে। কালচার অব ডাউট। এই ডাউটকে সাহিত্যের প্রকরণের ভেতরে স্থান দেওয়া মননের ক্ষেত্রে একটা বড় সাধনা, যা আজকের বাংলা সাহিত্যের কোথাও ছিঁটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া যায় না। দেখার চোখ মানেই যেন প্রশ্নাতীত সিদ্ধান্তে আসার ক্ষমতা। এটি এক প্রকার স্লোগানধর্মিতা এবং সমাজে অপরিণত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের অবদান। দুই বাংলার ক্ষেত্রেই এটি খাটে। প্রশ্নটা এখানে ঠিক ন্যারেটিভের উৎকর্ষের নয়, সমাজদর্শনের সঠিকত্বের দাবির প্রশ্ন।

‘সাপ ও হিসহিসের গল্পে’ ন্যারেটিভের আইডিয়াটা অভিনব, বার্তাটাও নির্দিষ্টতা রোগে আক্রান্ত নয়। মনসামঙ্গল সাপের খোঁজে ভিটেয় এসে সাপুড়েদের হাজির হওয়ার মধ্যে আজকের বাংলাদেশের যে মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্নই ছুড়ে দেওয়া হয়েছে।

আমি মনে করি, প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যের সেভাবে অবিসংবাদিত বিচার হয় না, হওয়ার কথাও নয়। যে পাঠককে যেভাবে স্পর্শ করে একটা লেখা, সেটাই সেই পাঠকের ক্ষেত্রে লেখাটার প্রকৃত মান, এবং নিজস্ব অধিকারে। এহ্‌সানের চোখ আছে ঘটনাসমষ্টি থেকে গল্পটাকে খুঁজে নেওয়ার, তার উপস্থাপনার ধাঁচ নিয়ে যে ইনট্যুইটিভ বা স্বজ্ঞাপ্রসূত পক্ষপাত তৈরি হয়, আমার বিশ্বাস, তা অধিকাংশ পাঠককে স্পর্শ করবে, পাঠক উপভোগ করবে। প্রকরণগত কাঠামোর দিক থেকেও  এহ্‌সানের গল্পে কাহিনীর উপস্থাপনা বেশ আধুনিক, বুদ্ধিদীপ্ত।



এহ্‌সানের গল্প পড়তে গিয়ে যে জিনিসটা আশ্বাস জাগায়, সেটা হচ্ছে জগতের নানা বিস্ময়কর খুঁটিনাটি খবরের সঙ্গে ওর পরিচিতি। সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত জ্ঞানগম্যির পরিসর সাহিত্যের মানের একটা বড় নির্ণায়ক। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই দিকটা, কে না জানে, খুব আশ্বাসব্যঞ্জক নয় একেবারেই। নিউরোসায়েন্টিস্ট অর্থাৎ স্নায়ুবিজ্ঞানী ভি. এস. রামচন্দ্রনের নাম ও কাজের সঙ্গে পরিচয় যে বাংলার একজন ছোটগল্পকারের খানিকটা হলেও আছে, দেখে আশা জাগে। তবে ‘আয়নায় দেখা দুই হাত’ গল্পটা বাক-পরিমিতির দিক থেকে, আরও কয়েকটা গল্পের মতই, খুব সন্তোষজনক অবয়ব ধারণ করেনি। গল্পকার হিসেবেই, বাক্যগঠন ও শব্দের নিখুঁত প্রয়োগ, এই দুই দিকে মনোযোগী হওয়ার এখনও প্রয়োজন আছে বলেই আমার মনে হয়েছে।

চেতনে বা অবচেতনে আবার শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার যে প্রকল্প এই সংকলনে আপাতগ্রাহ্য, তার সঙ্গে ‘পথের ধারেতে ফুটিল যে ফুল, জানি জানি তারা ভেঙে দেবে ভুল’ লাইনটার কোথাও কোনো স্তরে একটা যোগ রয়ে গেছে। যেখানে মানুষ এক সংহত, সুষম বিশ্বে অন্য প্রাণী ও বস্তুর অংশ মাত্র। সেটাই হয়তো এই তাণ্ডবের সময়ে মানুষের বোধোদয়সঞ্জাত প্রত্যাশা ভবিষ্যতের পৃথিবীর কাছে। ততদিন পর্যন্ত এহ্‌সানরা নিজের আবেগের কাছে সৎ থেকে যে গল্পগুলো লিখছে, সেগুলোই মানুষের মুখ।

অলাত এহ্‌সানের গল্পগ্রন্থ ‘ অনভ্যাসের দিনে’ প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃতি থেকে। বইটির মূল্য ২২০ টাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন বিপুল শাহ। পশ্চিমবঙ্গে বইটির পরিবেশক একলব্য।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়