ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পয়লা বৈশাখে বাঙালিত্বের শপথ নেয়াটাই জরুরি: সন্‌জীদা খাতুন

দীপংকর গৌতম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ৩১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পয়লা বৈশাখে বাঙালিত্বের শপথ নেয়াটাই জরুরি: সন্‌জীদা খাতুন



দীপংকর গৌতম : একদিকে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা, অন্যদিকে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব। নিশ্চয়ই বিষয়টি চ্যালেঞ্জ ছিলো। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা ও বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন আপনার ভেতরে কাজ করছিলো কখন থেকে?

সন্‌জীদা খাতুন : খ্রিস্টাব্দ নয়, হিজরী নয়, সন নয়, বাংলা অব্দের পয়লা বৈশাখ যখন বাঙালির আবিষ্কারের অঙ্গ হিসেবে উৎসব হয়ে উঠতে চাইছে তখন পাকিস্তানের রমরমা। নবম শ্রেণীতে পড়বার সময় পাকিস্তান হলো। গানে গানে ‘চাঁদতারা সাদা আর সবুজ নিশান’ মিল জুড়ে কওমি নিশান-টিশান উড়ানো হলো। কিন্তু বালা নববর্ষের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হলো না তখনও। কলকাতায় থাকতে যেসব মুসলমান বাঙালি জাতিকে ‘কওম’ ধনীকে ‘মালদার’ প্রদীপকে ‘চেরাগ’ ডিমকে ‘আন্ডা’ এসব বলার ধ্বনি তুলেছিলেন তারাই নতুন রাজধানী ঢাকায় এসে ‘কলিজার খুনে ওয়াতানের ধূলি করিয়া লাল/ আজাদীর তরে শহীদ হলে যে বীর দুলাল’ বা ‘পাকিস্তানের গুলিস্তানে আমরা বুলবুলি/... মোরা সালওয়ার পরি মোরা ওড়না ওড়াই’ এ রকম গানের ফোয়ারা ছোটালেন। নতুন স্বাধীনতার আনন্দে আমরা সেইসব গান গাইছি। কিছু কিছু আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার হলে দোষের কীই বা আছে। বাংলা ভাষার নদীতে কত শব্দই তো মিশেছে এসে, নানান সংস্পর্শের পরিচয় অঙ্গে ধরে। তবে বাড়াবাড়ি হচ্ছিলো। ‘মাহে নও’ (পত্রিকার নামেই বাড়াবাড়ি!) পত্রিকার এক গল্পে লেখা হয়েছিল, ‘লেবাসের অন্দরে তার তামাম তনু পোষিনায় তরবর্ত’। এই উদ্ভট ভাষার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র আন্দোলনের দরকার হয়নি। ভাষার বেগবান প্রবাহই সেই জঞ্জাল ফেলে এসেছে সে কালের আস্তাকুঁড়ে।

ওসবের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রয়োজন বোঝা গিয়েছিল ক্রমে ক্রমে। বিশেষ করে যখন ‘উর্দু একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা হলো; এই ঘোষণা আমাদের আপন সংস্কৃতি থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র স্পষ্ট করে দিলো। প্রিয় বাংলাভাষা আর বাঙালি ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্যের দিকে চোখ পড়লো তখন ভালো করে। মুসলমান হওয়া যেমন অসত্য নয়, বাঙালি হওয়াও নয় তেমনি অসত্য! কিন্তু শুধু মুসলমান হতে হবে, এবং বাঙালি সত্তাকে সম্পূর্ণ নিধন করে, আপন ভাষা ভুলে, তবেই হওয়া যাবে খাঁটি পাকিস্তানি- এ কেমন কথা! ফলে মুসলমান আর বাঙালিতে বা পাকিস্তানি আর বাঙালিতে বিরোধের কিছুমাত্র কারণ না থাকলেও, পাকিস্তানি আর বাঙালিতে বেঁধে গেল দ্বন্দ্ব।

দীপংকর গৌতম : এ আয়োজনের সংগ্রামী লক্ষ্যটা কী ছিলো?

সন্‌জীদা খাতুন : দ্বন্দ্ব ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছিল। বাঙালির বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদেরকেই চিনে নিতে হলো। কয়েকটি বিষয় ঘিরে বাঙালি মানস পরস্পর সন্নিহিত হলো। প্রথমটি হলো ভাষা। একুশ ফেব্রুয়ারির স্মারক শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে একত্র হলো বাঙালি। দ্বিতীয় বিষয় পয়লা বৈশাখ। বাঙালির নববর্ষ বাংলা নতুন বছরের উৎসব আয়োজনটি বাঙালিকে আর একটি মিলনবিন্দুতে ঘনিষ্ঠ করলো।

দীপংকর গৌতম : পয়লা বৈশাখকেই কেন বেছে নিয়েছিলেন?

সন্‌জীদা খাতুন : বৈশাখের প্রথম দিনের এই উৎসব বাঙালি জাতিসত্তার ধারায় স্নাত হয়ে আমাদের স্বরূপ সন্ধানের সহায়ক হয়েছে। বহুকাল ধরে প্রচলিত গ্রামীণ বৈশাখী মেলা কি দোকানি পসারীদের হালখাতা অনুষ্ঠানের সঙ্গে নগরীর বর্ষবরণ এক রকম নয়। এটা সমালোচনার বিষয়ও নয়। মনে রাখতে হবে, এর প্রয়োজন আমাদের জাতীয় সংকট থেকে সঞ্জাত।

এছাড়াও পয়লা বৈশাখ নিয়ে একটা ভালো লাগা আছে। এদিন বাঙালি আন্তরিকভাবে একে অপরের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। বাঙালি বলে বাঙালির সঙ্গে বুক মেলাতেই এ অনুষ্ঠানের সার্থকতা। প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটি কথা বলি, পয়লা বৈশাখে রমনার মাঠে যারা আসে তারা গ্রাম-গঞ্জের মানুষ না নগরসমাজের, তারা কে কোন পোশাক পরে আসে, রমনার মাঠে গিয়ে শখ করে পান্তা খায় না লুচি তরকারি খায় এই প্রশ্ন অবান্তর। এগুলো বৈশাখের মূল অনুভবের ধারাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারে না। সেই ভোরে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মানুষ যদি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে একবার মনে করতে পারে আমি বাঙালি তবেই এই উৎসব সার্থক।

দীপংকর গৌতম : পয়লা বৈশাখের এই উৎসব পালন কবে থেকে শুরু করলেন? অর্থাৎ এর সূচনাকথা জানতে চাইছি।

সন্‌জীদা খাতুন : পাকিস্তান আমলে ঘরোয়াভাবে নববর্ষ উদযাপনের চল হয়েছিলো সংস্কৃতিমনা কিছু মানুষের ভেতর। তখন কৃষ্ণচূড়ার ডাল দিয়ে সাজানো সান্ধ্য আসরে মিলিত হতেন তারা। এক কথায় বলা যায়, কারো বাসার ড্রয়িংরুমে, কারো বাসার আঙিনায় প্রাণ-প্রাচুর্যের সাথে পালিত হতো নববর্ষ উৎসব। ইংরেজি উনিশ শ সাতষট্টি তথা তেরো শ চুয়াত্তর থেকে পয়লা বৈশাখে রমনার অশ্বত্থ গাছটির তলায় প্রথম খোলামেলাভাবে হলো বাংলা নববর্ষের উৎসব। আমন্ত্রণলিপিতে পরিচয় লেখা হলো ‘রমনার বটমূল’। এর পেছনে একটি ঘটনা আছে- গাছটির পাতা বটের পাতার মতো নয়। তবু ‘বটমূল’ শব্দটি শুনতে ভালো লাগে। ‘অশ্বত্থমূল’ বা ‘অশ্বত্থতলা’ পছন্দসই শোনায় না। শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ‘বটমূল’ই স্থির হলো।

দীপংকর গৌতম : রমনা বটমূল বেছে নিলেন কেন? এর পেছনে কী বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছে?

সন্‌জীদা খাতুন : ঠিক তা নয়। তবে এ জায়গাটি যে সহজে পাওয়া গেছে এমনও নয়। এর পেছনেও একটা কাহিনী আছে। খোলা জায়গায় অনুষ্ঠান করার জন্য জায়গা খুঁজছিলাম আমরা বহুদিন ধরে। বন্ধুবর নওয়াজীশ আলী খান তখন ফিলিপাইনে। দেশে এলে তার চিত্রগ্রাহক সত্তার তাগিদে ঘুরে বেড়ান নানা দিকে। দেখে রাখেন প্রকৃতির নানা রূপছবি। আমি ও ওয়াহিদুল হক তাকে বলেছিলাম একটা জায়গা খুঁজে দিতে। তারই একখানা ছবির পটে তিনি বসিয়ে দিলেন ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব। তবে জায়গাটি তার পছন্দ হলেও প্রথম তিনি আমাদের বলেননি। একদিন তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন রমনা রেস্তোরাঁয়। সেখান থেকে বটমূলে। বটমূলে তখন বড় বড় ঘাস, গোবরের মধ্যে দিয়ে চলতে হয় এমন অবস্থা। তার মধ্য দিয়ে হেঁটে চললাম আমরা।

দীপংকর গৌতম : প্রথম বর্ষবরণ উৎসব কেমন ছিল?

সন্‌জীদা খাতুন : আগেই বলেছি, বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের সূচনাসাল উনিশ শ সাতষট্টি। এর চারবছর আগে মানে উনিশ শ তেষট্টি সালে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন চালু হয়। প্রথম প্রথম পয়লা বৈশাখের মঞ্চে বিদ্যায়তনের উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সকলকেই বসার জায়গা দেয়া যেত। একক গানের জন্য শিল্পী সংগ্রহ করতে হতো বাইরে থেকে। কলিম শরাফী, বিলকিস, নাসিরুদ্দীন, মালেকা আজিম খান, ফাহমিদা খাতুন, জাহানারা ইসলাম, মাহমুদা খাতুন, চৌধুরী আবদুর রহিম, পাকিস্তানের শেষ দিকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সরকারের বিরাগভাজন আমলা শামসুর রহমানের পত্নী আফসারী খানম... আরো কতজন! প্রথম যখন রমনা বটমূলে অনুষ্ঠান শুরু করি তখন বটমূলের গোড়া ঘিরে বাঁধানো বেদীটুকুই ছিলো সম্বল। পরে চৌকি জুড়ে খানিকটা বাড়িয়ে নেয়া হয়। মনে পড়ে, প্রথমবার অনুষ্ঠানে গাছ থেকে শুয়ো পোকা ঝরে ঝরে পড়েছে যত্রতত্র। মেয়েরা ভয় পেলেও গুরুজনের ভয়ে বসে থেকেছে মাথা গুঁজে। দ্বিতীয়বার ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে পোকা সরানোর জন্য কাঠি ধরিয়ে দেয়া হয়েছিলো।

দীপংকর গৌতম : মুক্তিযুদ্ধের বছর বর্ষবরণ হয়নি। সেদিনের কথা মনে আাছে?

সন্‌জীদা খাতুন : একাত্তর সালের এপ্রিল মাস। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ঢাকা শহরের ঘরে ঘরে তখন শোক আর সন্ত্রাসের বুক চাপা কান্না। একাত্তর সালের পয়লা বৈশাখে কোনো গান বাজেনি রমনা বটমূলে। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এমন কখনও হয়নি। সাভারের জিরাবো গ্রামে তখন নিরাপত্তার কারণে চলে গিয়েছিলাম। মাটির ঘরে থাকি। সন্তানদের নিয়ে ঘরে বসে গান গেয়ে বটমূলের প্রভাতী পরিবেশের কথা স্মরণ করেছি।

দীপংকর গৌতম : গান নিয়ে আপনাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা জানতে চাই।

সন্‌জীদা খাতুন : আমাদের পালিয়ে যেতে হয়েছিল কলকাতায়। সেখানে গিয়ে আমরা ‘রূপান্তরের গান’ নামে একটি গীতি আলেখ্য তৈরি করেছিলাম। তাতে ‘সার্থক জনম আমার’ ছিল, ‘সোনার বাংলা’ তো ছিলই। আরো অনেক গান ছিল। একটা গান ছিল এমন যার অর্থ চাঁদকে বলা হচ্ছে মুখ ঢেকে ফেলো, বড় লজ্জার দিন, বড় কষ্টের দিন, দুঃখের দিন। এই গানগুলো আমরা নতুন করে আবিষ্কার করে তখন গাইতাম। মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে, শরণার্থীদের শিবিরে এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে আমাদের বেদনার সাথে যুক্ত করবার জন্য আমরা এই গানগুলো গাইতাম৷ কাজেই রবীন্দ্র সংগীত আমাদের আন্দোলনের মস্ত বড় একটা হাতিয়ার ছিল এবং এখনও আছে। এখনও আমরা বলি, রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

দীপংকর গৌতম : এরপর দেশ স্বাধীন হলো। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। পট পরিবর্তনের পর বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন কি?

সন্‌জীদা খাতুন : সে আরেক দুঃসময়। পচাত্তরের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গিয়েছিলো ভিন্ন এক পরিবেশ জেঁকে বসছে। তখন হঠাৎ করে জাতীয় সংস্কৃতির হোতা হওয়ার আবেগ জাগলো কিছু তরুণের চিত্তে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৮ সালের কথা। ছায়ানট তো সবসময ভোরবেলা অনুষ্ঠান করে, তাই চৈত্র শেষের রাত বারোটায় অনুষ্ঠান করে জাতীয় সংস্কৃতির দিশারী হতে চাইলো ওরা। শুধু তাই নয়, তারা সিদ্ধান্ত নিলো তাদের অনুষ্ঠানও ওই রমনা বটমূলেই করবে। তো সোফা, গদি-চেয়ার-টেয়ার সাজিয়ে অনুষ্ঠান করলো ওরা। শুধু কি গান? সাথে ঝালমুড়ি, বাদাম খেয়ে সব ঠোঙা ফেলে রেখে গেল বটমূলের আশপাশে। সে বছর ওই বাসি বাসি চেহারার মাঠে হলো আমাদের অনুষ্ঠান। এর মধ্যেও আমরা পয়লা বৈশাখের আনন্দ করে এসেছি নিজেরাই পথ খুঁজে পাবো বলে, নিজেদের চিনে নেবো বলে। সংস্কৃতি চর্চায় অন্য সবাইকে পথ দেখাতে হবে বা প্রথম হতে হবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতার ভাব আমাদের ছিলো না, এখনো নেই।

দীপংকর গৌতম : এই পথ চলায় বাধা আসেনি?

সন্‌জীদা খাতুন : অনেকবার এসেছে। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর, একবার আমাদের মঞ্চের পাশে উঠলো জগদ্দল চেহারার মঞ্চ। লোকজন জায়গাই পায় না। দুটো মঞ্চের পর আর কতটুকু জায়গা থাকে। তামাশা দেখার ভাব নিয়ে গাছের উপর উঠলো অনেক লোক। আমাদের মঞ্চের উপর ছুঁড়ে ফেলা হলো মরা কাক। কিছুক্ষণ পর মোড়ের বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তার বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। ফলে মাইক্রোফোন অচল হয়ে গেল। জেনারেটর চালু করতে করতে সময় ব্যয় হলো, অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সেবার অনুষ্ঠান শেষে আলমগীর কবীর এসে বলেছিলেন, আপনি চালিয়ে যান... থামবেন না... আমরা আছি।

আরেকবার বিকেল থেকে টেলিফোন আসতে শুরু হলো আমাদের কাছে- যাবেন না, মঞ্চে যাবেন না, নিচে টাইম বম রাখা আছে। সাবধান! পুলিশে খবর দিলাম। টাইম বম আছে কিনা তা চেক করে দেখার দায়িত্ব পুলিশের। ফোন করে হয়রান হয়ে জানা গেল পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে স্টেডিয়ামে শিশুদের সমাবেশে প্রেসিডেন্ট উপস্থিত থাকবেন বলে পুলিশ ফোর্স সব সেখানে নিয়োজিত রয়েছে। আমাদের জন্য পুলিশের ব্যবস্থা করা যাবে না। দুর্ঘটনা ঘটলে দায় তাদের উপর বর্তাবে বলে ঘটাং করে ফোন রেখে দিলাম। ভোরে ছায়ানট সম্পাদকের সাথে কথা হলো। এত ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নেবে কে? তিনি নিষেধ করলেন ‘বটমূলে’ যেতে। কিন্তু মনকে মানাবো কি করে! গুটি গুটি গিয়ে হাজির হলাম সকালে। মজার কথা, গিয়ে দেখি সম্পাদক নিজেই আমার আগে গিয়ে সেখানে বসে আছেন! ছেলেমেয়েদের ঘুণাক্ষরেও কিছু বুঝতে দিলাম না। মঞ্চে গিয়ে বসলাম। নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠান শেষ হলো। অনুষ্ঠান শেষে সম্পাদককে বললাম, দেখলেন তো ভয় না করে ভুল হয়নি।

দীপংকর গৌতম : সামরিক শাসনের মধ্যে অনুষ্ঠান করতে সমস্যা হয়নি?

সন্‌জীদা খাতুন : যে বছর মঞ্চের তলায় বোমা রাখা আছে বলে ওরা ভয় দেখাল তার পরের বছর মার্চের শেষে জারি হলো সামরিক আইন। নববর্ষ উৎসবের মহড়া চলছে। কিন্তু সমাবেশ অনুষ্ঠানের অনুমতি পাওয়া যাবে কোত্থেকে! পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছিল না কিছু। শেষ পর্যন্ত অনেক ঘুরে পয়লা বৈশাখের আগের রাতে নয়টার সময় অনুমতি মিললো। সেই নববর্ষে অনেক রাজনৈতিক নেতা রমনায় উপস্থিত হয়েছিলেন। জমায়েত হবার এমন সুযোগ পাওয়া যাবে কেউ ভাবতে পারেননি। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক সুযোগ নেবার চেষ্টা আমাদের কয়েকবার বিব্রত করেছে। কখনো ছাত্ররা, কখনো নেতৃস্থানীয়রা ঝামেলা বাঁধিয়েছেন। এখন মনে হয় সবাই বুঝেছে পয়লা বৈশাখকে ঘিরে সমবেত হওয়াটাই বড় কথা। এই দিন বাঙালিত্বের শপথ নেয়াটাই জরুরি। আসলে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই কিছু বিষয় দেখে আসছি।  আমাকে ফলো করা হতো। রিপোর্ট করতো গোয়েন্দারা। অনেকে আমার কাছে গান শিখতো গোয়েন্দাগিরি করতে। আমি ওসব আমলে নেইনি।

দীপংকর গৌতম : আপনি কি ছোটবেলা থেকেই সংগঠন করতেন?

সন্‌জীদা খাতুন : হ্যাঁ, চাঁদের হাট করতাম।

দীপংকর গৌতম : কখনো কমিউনিস্ট পার্টি করেননি?

সন্‌জীদা খাতুন : না করিনি। করতে বলা হয়েছে। আমি সদস্য হইনি।

দীপংকর গৌতম : আপা, আপনাকে ধন্যবাদ। এবার উঠতে হবে। প্রণাম।

সন্‌জীদা খাতুন : তুমি আমার এ বইটা নিয়ে যাও। এখান থেকে আরো বিস্তারিত জানতে পারবে।

আপা ‘স্বাধীনতার অভিযাত্রা : ভাষা-আন্দোলন, নববর্ষ ছায়ানট মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি আমার হাতে তুলে দিলেন। বইটি নিয়ে আমি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি আপা তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে। স্নেহসুধা তার সমস্ত অবয়বে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়