ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাট্যে দেশজ ভাবনা

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৫, ৬ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রবীন্দ্রনাট্যে দেশজ ভাবনা

|| ড. তানভীর আহমেদ সিডনী ||

এই লেখার অভিপ্রায় স্পষ্ট- রবীন্দ্রনাথের নাটকের মাধ্যমে তাঁর থিয়েটার ভাবনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঝালাই করে নেওয়া। তাঁর বেশির ভাগ নাটকেই একটা ভূমিকা পর্ব আছে। সেই পর্বে তিনি নাট্যচিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা এ থেকে উপলব্ধি করবো, রবীন্দ্র নাট্যভাবনা কোন পথে প্রবাহিত হয়েছে। এখানে তাঁর চারটি নাটককে নির্বাচন করার মাধ্যমে একটি পর্ব চিত্রায়িত হলো। নাটক চারটি হলো- ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, ‘মায়ার খেলা’, ‘রাজা ও রাণী’ এবং ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। এখানে নাটকের প্রারম্ভে নাট্যকারের রচনা থেকে তাঁর নাট্যপ্রয়োগ ভাবনাকে খুঁজে বের করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।

‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকটি ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর নিজস্ব নাট্যকৌশলের সূচনা দেখা যায় নাটকটিতে। এখানে আমাদের পরিচয় ঘটে সন্যাসীর সঙ্গে পরবর্তী পর্যায়ের নাটকসমূহে মিলে ঠাকুরদা যিনি পুরো নাটকটিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটক সম্পর্কে কবি দাবি করেছিলেন যে এই নাটকেই তাঁর জীবনতত্ত্ব প্রথম আভাসে দেখা দিয়াছে। নাটকে তাঁর থিয়েটার ভাবনা সম্পর্কে লিখেছেন:
‘বেদনার ভিতর দিয়ে ভাব প্রকাশের প্রয়াসে সে শ্রান্ত, কল্পনার পথে সৃষ্টি করবার দিকে পড়েছে তাঁর ঝোঁক। এই পথে তার দ্বার প্রথম খুলেছিল। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় যদিও তার উপকরণ গান নিয়ে, কিন্তু তার প্রকৃতিই নাট্যীয়। তাকে গীতিকাব্য বলা চলে না। কিছুকাল পরে তখন আমার বয়স তেইশ কিংবা চব্বিশ হবে, করোয়ার থেকে জাহাজে আসতে আসতে হঠাৎ যে গান সমুদ্রের উপর প্রভাত সূর্যালোকে সম্পূর্ণ হয়ে দেখা দিল তাকে নাট্যীয় বলা যেতে পারে, অর্থাৎ সে আত্মগত নয়, সে কল্পনায় রূপায়িত।’

সংগীত আর নাটকের বিক্রিয়ায় তিনি বাংলা নাটকের নতুন পথ সন্ধানী ছিলেন। আঙ্গিকের দিক থেকে এটি প্রাচ্যমুখীন; তাঁর মূল প্রবনতা- সংগীতকে সঙ্গী করে নাট্যনির্মাণ, যেখানে গানই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয় বিবেচনায় কল্পনার জমিনে তিনি ফোটাতে চেয়েছেন বাস্তবের ফসল। নাটকে নানা পথ দেখা যায়- এই পথকে আমরা বিবেচনা করতে পারি, সংসার তথা জীবনযাত্রাকে। তিনি পথ দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, জীবন এমনি বিচিত্রমুখীন। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকে তিনি জীবনতত্ত্ব অনুসন্ধানী। ফলে আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নাট্যকার কোনো একটি বিশেষ পথে ধাবিত হননি। তাঁর ভাবনা দেখা যেতে পারে: 
‘এই আমার হাতের প্রথম নাটক যা গানের ছাঁচে ঢালা নয়। এই বইটি কাব্যে এবং নাট্যে মিলিত। সন্যাসীর যা অন্তরের কথা তা প্রকাশ হয়েছে কবিতায়। সে তার এলাকার কথা। এই আত্মকেন্দ্রিক বৈরাগীকে ঘিরে প্রাত্যহিক সংসার নানা রূপে নানা কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠেছে। এই কলরবের বিশেষত্বই হচ্ছে তার অকিঞ্চিৎকরতা। এই বৈপরীত্যকে নাট্যিক বলা যেতে পারে। এরই মাঝে মাঝে গানের রস এসে অনির্বচনীয়তার আভাস দিয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তির পর আর বলা প্রয়োজন নেই যে, তিনি তাঁর নাটকের আঙ্গিক কোন পথে নিয়ে যেতে চেয়েছেন।

গীতিনাট্য ‘মায়ার খেলা’ মূলত  সংগীতকে আশ্রয় করে রচিত। এখানে নাট্যের চেয়ে গীতই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। গীতিনাট্য তা নামেই কেননা এখানে গান থাকলেও নাটকের ভূমিকা নেই বললেই চলে। এই নাটকের আঙ্গিক প্রসঙ্গে তিনি প্রথমেই জানিয়ে দেন পাঠককে, ‘এই নাট্যকাব্যের সংক্ষিপ্ত আখ্যায়িকা পরপৃষ্ঠায় বিবৃত হইল। নতুবা বিচ্ছিন্ন গানের মধ্য হইতে ইহার আখ্যান সংগ্রহ করা সহসা পাঠকদের পক্ষে দুরুহ বোধ হইতে পারে।’ নাট্যঘটনাকে গৌণ বিবেচনা করায় নাট্যকার প্রথমেই আখ্যায়িকার একটি বর্ণনা দিয়ে দেন পাঠককে। গানের সংশ্লেষে নাটকটি অসাধারণ হয়ে উঠেছে। এখানে তাঁর সাঙ্গীতিক প্রতিভার পরিচয় পেয়েছে পাঠক ও শ্রোতা।

'বাল্মীকি প্রতিভা'য় মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইন্দিরা দেবী

 

‘রাজা ও রাণী’ নাটকটি আগস্ট ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত হয়। এই নাটকের বিষয়বস্তু কাল্পনিক উপাখ্যান। স্থান ও পাত্র বিবেচনায় ঐতিহাসিক আভাস তৈরির প্রয়াস রেখেছেন নাট্যকার। নাটকের রাজা বিক্রমদেব জালন্ধরের রাজা আর তার স্ত্রী কাশ্মীর রাজকন্যা সুমিত্রা। এর আখ্যানভাগ অবলম্বনে ‘তপতী’ নাটক রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় ‘তপতী’। ‘রাজা ও রাণী’ নাটক প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: 
‘একদিন বড় আকারে দেখা দিল একটি নাটক- রাজা ও রাণী। এর নাট্যভূমিতে রয়েছে লিরিকের প্লাবন, তাতে নাটককে করেছে দুর্বল। এ হয়েছে কাব্যের জলাভূমি। ওই লিরিকের টানে এর মধ্যে প্রবেশ করেছে ইলা এবং কুমারের উপসর্গ। সেটা অত্যন্ত শোচনীয়রূপে অসংগত। এই নাটকে যথার্থ নাট্য পরিণতি দেখা দিয়েছে যেখানে বিক্রমের দুর্দান্ত প্রেম প্রতিহত হয়ে পরিণত হয়েছে দুর্দান্ত হিংস্রতায়, আত্মঘাতী প্রেম হয়ে উঠেছে বিশ্বঘাতী।’

এখানে নাটককে দুর্বল মনে করা হয়েছে পাশ্চাত্য শিল্প শৃঙ্খলায়, কিন্তু নাট্যকার যে প্রাচ্যকৌশলে আপন নাট্যভূমি তৈরি করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ফলে আঙ্গিক বিবেচনায় নাট্যকার বাঙালির শিল্পরীতির অনুসারী হয়েছেন। আর নাটকে তিনি যে প্রেমের কথা বলেছেন তা ভোগবাদী প্রেম নয়। দেহে সে প্রেম লভ্য নয়, আত্মার আলো হয়ে ফুটে থাকবে। তবেই না প্রেম সফল হয়। সুমিত্রার মৃত্যুর পর রাজার সংলাপে আমরা সে প্রেমের সন্ধান পাই। রাজা বলেন, ‘দেবতার মতো তুমি নিশ্চল নিষ্ঠুর, অমোঘ তোমার দন্ড, কঠিন বিধান।’ আমরা প্রেমের অনির্বচনীয় রসে নাটকের পথে হাঁটতে হাঁটতে নাট্যকারের শক্তি উপলব্ধি করি। লিরিকধর্মী নাটকের পথে তাঁর পথচলার প্রধান কারণ বাংলা নাটকের চিরায়ত গীতধর্মীতা। বাঙলা নাট্যের এই গীতধর্মীতাকে স্বীকার করেই তিনি আপন নাট্যসূত্র তৈরি করতে চেয়েছেন। যা তাঁর নাটককে করেছে গীতল, প্রচলিত পাশ্চাত্য নানা নামে অভিহিত হয়ে কখনও কখনও নাট্য বিশ্লেষকদের ভ্রান্ত পথে ধাবিত করেছে।

১৮৮১ সালে প্রকাশিত হয় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। এই নাটকের পাত্রপাত্রী গদ্য কিংবা পদ্য সংলাপ নয়, গানের সুরে নির্মিত হয়েছে নাটকের সংলাপ। কবি নিজেকে বাল্মীকি ভেবে নাট্যঘটনাকে অগ্রসর করেছেন। বিষয়ই নাটকের আঙ্গিক নির্মাণের শক্তি- সে বিবেচনায় বলা চলে রামায়ণের আদি কবিকে নিয়ে যে নাটক রচিত হয়েছে তাতে রামায়ণ পরিবেশনার চিহ্ন থাকবে। তাই গীতকেই তিনি অবলম্বন করেছেন, রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যমুখীন হয়ে ওঠেন। এই নাটকের প্রারম্ভে নির্মাণের সূত্র লিখে দেন তিনি:
‘বাল্মীকি প্রতিভায় একটি নাট্যকথাকে গানের সূত্র দিয়ে গাঁথা হয়েছিল, মায়ার খেলায় গানগুলোকে গাঁথা হয়েছিল নাট্যসূত্রে। একটা সময় এসেছিল যখন আমার গীতিকাব্যিক মনোবৃত্তির ফাঁকের মধ্যে নাট্যের উঁকি ঝুঁকি চলছিল। তখন সংসারের দেউড়ি পার হয়ে সবে ভিতরমহলে পা দিয়েছি; মানুষে মানুষে সম্বন্ধের জাল বুনোনিটাই তখন বিশেষ করে ঔৎসুক্যের বিষয় হয়ে উঠেছিল।’

রবীন্দ্রনাথের নাটকের ভূমিকার মধ্য দিয়ে নাটকের আঙ্গিক বিষয়ে তাঁর অভিপ্রায় জানা যায়। তিনি প্রাচ্য নাট্যভাবনার ন্যায় গীতকেই তার বাহন করে তুলেছেন। প্রাচ্য নাট্যকৌশলে কাহিনীর সঙ্গে গীত, নৃত্য এবং বর্ণনার হরগৌরী মিলনে নাট্যঘটনা অগ্রসর হয়। রবীন্দ্রনাথ রচিত নাটকসমূহে গীতকেই ঘটনা প্রকাশের মাধ্যম করে তুলেছেন। গান এখানে অলংকার নয় ঘটনাকে নতুন একটা পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম। একই সঙ্গে নাট্যকার হিসেবেও সচেতন যে, পাশ্চাত্য রীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে এনেছেন। ফলে নিজে আঙ্গিকের পথে হাঁটতে হাঁটতে সে আঙ্গিকের পরিচয়ও দিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথ রচিত চারটি নাটকের ভূমিকা থেকে রবীন্দ্র নাট্য ভাবনা অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাঁর দেশজ ভাবনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়