ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

একুশ শতকে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা

শরীফ আতিক-উজ-জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ৭ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একুশ শতকে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা

|| শরীফ আতিক-উজ-জামান ||

অমর্ত্য সেন তাঁর ‘The Argumentative Indian’ গ্রন্থের Culture and Communication অধ্যায়ে Tagore and His India শিরোনামের প্রবন্ধে এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নানা তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। প্রবন্ধটি উল্লিখিত শিরোনামের গ্রন্থে সংকলিত হওয়ার আগে ১৯৯৭ সালের ২৬ জুন ‘New York Review of Books’-এ প্রথম প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশ ও ভারতে রবীন্দ্রচর্চার গভীরতা অসীম। তাঁর রচিত সাহিত্যের পঠনপাঠন ও সঙ্গীতের চর্চা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। কিন্তু বিশ শতকের শুরুতে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে ইয়োরোপ ও আমেরিকায় তাঁকে নিয়ে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল তা একেবারেই থেমে গেছে। যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা তৈরির মাধ্যমে ‘গীতাঞ্জলি’ নোবেল জিতে নিয়েছিল সেই প্রতীচ্যে তিনি এখন সেভাবে পঠিত নন।

সেই ১৯৩৭ সালে গ্রাহাম গ্রীন বেশ শ্লেষের সাথে বলেছিলেন, ‘As for Rabindranath Tagore, I cannot believe that anyone but Mr. Yeats can still take his poems very seriously.’ পণ্ডিতেরা বাংলা শিল্প-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল উপস্থিতি ও বাইরের বিশ্বে রবীন্দ্রচর্চার ক্ষয়িষ্ণুতার নানান ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতার বহুমাত্রিকতা ধারণ করার ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের অক্ষমতা একটি বড় কারণ বলে অনেকেই মনে করেন। ইয়েটস, পাউন্ড ও তাঁর প্রতীচ্যের বন্ধুরা তাঁর মরমি প্রতিকৃতির বিক্রেতা ও প্রচারক ছিলেন যা দীর্ঘদিন মানুষকে টানেনি। তাঁর খণ্ডিত উপস্থাপনা ও তাঁকে সামগ্রিকভাবে ধারণ করতে না পারার অক্ষমতা বাইরের জগতে তাঁর বিভ্রান্তিকর এক অবয়ব নির্মাণ করেছে। রুশ সমালোচক আনা আখমাতোভা, যিনি তাঁর প্রচুর কবিতা রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন, ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মন্তব্য করেছিলেন: ‘that mighty flow of poetry which takes its strength from Hinduism as from the Ganges, and is called Rabindranath Tagore.’ বহির্বিশ্বে উপলব্ধির ক্ষেত্রে ভাষার প্রতিবন্ধকতার সাথে সাথে খণ্ডিত উপস্থপনাও অনেকাংশে দায়ী।

রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ কুশারীরা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের খুলনা জেলার অন্তর্গত পিঠাভোগ গ্রামের বাসিন্দা এবং অন্ত্যজ শ্রেণির ব্রাহ্মণ। কিন্তু তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের অগ্রণী। ভারতে প্রথম ব্রাহ্মমতে রবীন্দ্রনাথের বড় বোন সুকুমারীর বিয়ে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের উপনয়নও হয়েছিল ব্রাহ্মমতে। দ্বারকানাথ ভালো আরবি ও ফার্সি জানতেন এবং ঠাকুর বাড়িতে আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের মধ্যে তিনি বেড়ে উঠেছেন। তাঁর মানস গঠনে সর্বধর্ম, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। একটি পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিফলন তাঁর সামগ্রিক জীবনাচারের মধ্যে ছিল। ফলে আখমাতোভার এই মত কতটা বিভ্রান্তিমূলক তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। অমর্ত্য সেন এই মন্তব্যের অসারতা বোঝাতে গিয়ে বলেছেন যে হিন্দুত্ববাদ আর গঙ্গা থেকেই তিনি সব নিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা তাঁর ভাবনা ও চেতনার সাথে একাত্ম বোধ করতে সমস্যা হয়নি। তাই ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে তারা তাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তাঁর মরমি অবয়ব, যা বর্হিবিশ্বে আজ কোনো প্রভাব রাখতে পারছে না, আদৌ তাঁর সৃষ্টির সামগ্রিকতা প্রকাশের পক্ষে অনুকূল নয়। তাঁর সৃষ্টিশীলতার বহুমাত্রিকতা আমাদের বিস্মিত করে। কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সঙ্গীতস্রষ্টা ইত্যাদি নানা পরিচয়ে তিনি পরিচিত। এমনকি জীবনের শেষপাদে এসে ছবি আঁকা শুরু করে ভারতীয় চিত্রকলাকে নতুন পথের দিশা দিয়ে গেছেন।

প্রবন্ধের বিষয় হিসেবে জাতীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজনীতি, ধর্ম, দার্শনিক বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে তিনি তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বহির্বিশ্ব তার খবর খুব কমই রাখতে পেরেছে। তাঁর সেই ‘প্রাচ্যের মরমি প্রতিকৃতি’ কারো কারো ভালো লাগলেও বেশিরভাগ লোকের কাছেই ছিল একঘেঁয়ে ও বিরক্তিকর। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, রবীন্দ্রনাথের এই প্রতিকৃতি ছিল প্রতীচ্যের নিজস্ব আবিষ্কার। তাঁর সাধুসন্তদের মতো জোব্বা পরার অভ্যাস, লম্বা লম্বা সাদা চুল-দাড়ি, শান্ত-সমাহিত একটি ভাব এই ধরনের দূরকল্পী এক প্রতিকৃতি তৈরি করেছে। জাপানের নোবেল পুরস্কার লাভকারী লেখক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা সন্তের মতো চেহারার এই কবি দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কথা বলেছেন। তাঁর এই রূপটিই পাশ্চাত্যে তাঁকে মরমি হিসেবে প্রচার করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। ফ্রান্সিস কর্নফোর্ড উইলিয়াম রবীন্দ্রনাথকে দেখে রোদেনস্টাইনকে বলেছিলেন: ‘I can now imagine a powerful and gentle Christ, which I never could before.’

ইয়েটস, এজরা পাউন্ড প্রমুখ যারা তাঁকে পাশ্চাত্যে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারাই পরবর্তীকালে অদ্ভুত ঔদাসিন্যে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং অমার্জিত ভাষায় সমালোচনা করলেন। যে ইয়েটস ১৯১২ সালে ‘These lyrics... display in their thought a world I have dreamed of all my life long’, ‘the work of a supreme culture.’ বলে প্রশংসা করেছিলেন তিনিই ১৯৩৫ সালে এসে তাঁকে আক্রমণ করে লিখলেন: ‘Damn Tagore. We got out three good books, Sturge, Moore and I, and because he thought it more important to see and know English than to be a great poet, he brought out sentimental rubbish and wrecked his reputation. Tagore does not know English, no Indian knows English. Nobody can write music and style in a language not learned in childhood and ever since the language of his thought.’

রবীন্দ্রনাথের লেখনীর গভীরে প্রবেশের অক্ষমতার কারণেই তিনি এই অবিমৃশ্যকারী মন্তব্য করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অনবরত লিখেছেন এমনকি ইংরেজিতেও, কিন্তু তাঁর বাণী ইয়েটসের মতো অনেকের কানেই সঠিকভাবে পৌঁছায়নি। ডি এইচ লরেন্স তাঁর সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তা রীতিমতো ঘৃণা ও বিরক্তির প্রকাশ: ‘I become more and more surprised to see how far higher, in reality, our European civilization stands than the East, Indian and Persian, ever dreamed of... This fraud of looking up to them this wretched worship of Tagore attitude is disgusting.’ রবীন্দ্রনাথ বেনিতো মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে Manchester Guardian-এ একটি চিঠি লিখলে তাঁর ভাই প্রত্যুত্তরে Popolo d’Italia তে লিখেছিলেন: ‘Who cares? Italy laughs at Tagore and those who brought this unctuous and insupportable fellow in our midst.’ এ বিষয়ে অমর্ত্য সেনের মন্তব্য বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের এই অতি উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকে যতটা বিস্ময় ও আনন্দের সাথে মেনে নিয়েছিলেন ঠিক ততটাই বিস্মিত ও বেদনাহত হয়েছিলেন তাদের অযথার্থ ও অনাকাঙ্ক্ষিত সমালোচনায়। তিনি সি এফ এন্ড্রুজকে লিখেছিলেন: ‘These people... are like drunkards who are afraid of their lucid intervals.’  

১৯৩০ সালে রাশিয়া ভ্রমণের অনেক আগে থেকেই তিনি রাশিয়াতে অনেক পরিচিত নাম। তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’র কয়েকটি রুশ অনুবাদ তখন সহজলভ্য। ১৯১৭ সালে একটি অনুবাদগ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন প্রথম রুশ হিসেবে সাহিত্যে নোবেলজয়ী আইভান বুনিন। পরবর্তী সময়ে আরো অনেক অনুবাদ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করেছিলেন। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি টেনেছিল সেখানকার মৌলিক শিক্ষা বিস্তার কর্মসূচি। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে তিনি ভারতে বৃটিশ রাজ কর্তৃক নিরক্ষরতা লালনের সাথে রাশিয়ার শিক্ষাবিস্তারের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছেন। কিন্তু কমিউনিস্ট রাশিয়ার সমালোচনা করে ‘Izvestia’ পত্রিকায় যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তা স্টালিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকাশিত হয়নি। চিন্তার স্বাধীনতা খর্ব না করা এবং সহিংসতা ও প্রতিশোধপরায়ণতাকে বাদ দেওয়ার আহ্বান ছিল তাতে। ৬০ বছর পর ১৯৮৮ সালে পত্রিকাটি তা প্রকাশ করে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় জীবন, মৃত্যু ও স্রষ্টার সাথে নির্ভীক এক সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে। ‘গীতাঞ্জলি’র অনেক কবিতায় তার প্রকাশ দেখা যায়। এক ধরনের অস্পষ্ট ধর্মীয় অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতার মর্মবাণী যা সব ধর্মের মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ, যুদ্ধ ও শান্তি, বহুসংস্কৃতি, স্বাধীনতা, সম্প্রীতি, ঐতিহ্য ও আধুনিকতা প্রসঙ্গে তাঁর অজস্র রচনার কোনো খোঁজ এইসব সমালোচকদের কাছে ছিল না। তাই প্রতীচ্যে বিভিন্ন বক্তৃতায় যখন তারা অতীন্দ্রয় বা আধিবিদ্যক বিষয় নিয়ে কথা শুনতে আগ্রহী ছিল তখন ‘রাজনৈতিক বিষয়’ নিয়ে তাঁর বক্তৃতা তাদের বিরক্তি উৎপাদন করেছিল।

ইংরেজ সাংবাদিক-লেখক Ian Jack তাঁর Rabindranath Tagore was a global phenomenon, so why is he neglected? প্রবন্ধে আক্ষেপের সাথে উল্লেখ করেছেন যে তিনি Oxford I Penguin কর্তৃক প্রকাশিত ‘Dictionaries of Quotations’ ঘেঁটে দেখেছেন সেখানে Tacitus থেকে Hippolyte Taine পর্যন্ত লেখকের উদ্ধৃতি থাকলেও রবীন্দ্রনাথের লেখনী থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার মতো কোনো পঙ্‌ক্তি তারা খুঁজে পান নি। যদিও উদ্ধৃতির নিরিখে একজন লেখকের মান নির্ণিত হয় না। বাংলার বাইরে রবীন্দ্রচর্চার ধারাও খুব বেগবান নয়। জ্যাক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে Philip Larkin-এর একটি অশ্লীল মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রতীচ্যে তাঁর সম্পর্কিত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। ১৯৫৬ সালে বন্ধু Robert Conquest কে তিনি লিখছেন যে, একজন ভারতীয় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানতে চাইলে তার মনে হয়েছিল তাকে এভাবে একটা টেলিগ্রাম করবেন: ‘Fuck all.’ আয়ান জ্যাক  খুব যথার্থ বলেছেন যে, এখন সময় এসেছে রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি ছিলেন এই কথাটা ভুলে যাওয়ার। দেশ-কাল-সমাজ-জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়-শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর আলোকিত ভাবনার জগতটিকে সবার সামনে তুলে ধরা জরুরি। এ রকম কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে ২০১৫ সালে ভারত থেকে দেবাশিস ব্যানার্জী’র সম্পাদনায় Rabindranath Tagore in the 21st Century শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কিছু প্রসঙ্গ অনুধাবনের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থ ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয়।

২০১০ সালে কলকাতা’র রত্মাবলী থেকে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ: গ্রহণে, বর্জনে’ শিরোনামে সুমিতা চক্রবর্তীর একটি গ্রন্থ বেরিয়েছে যেখানে তিনি খুব অকপটে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্পর্কে তাঁর পছন্দ-অপছন্দের দিকটি উল্লেখ করেছেন। একুশ শতকে আমাদের জীবনে তিনি কি প্রাসঙ্গিক? হলেও কতটা তা নিয়ে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের প্রাককথনে তিনি জানাচ্ছেন: ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও অনেকের মতোই আমারও ভাবনা, রুচি, নান্দনিকতা বোধ, জীবনযাপন, কর্তব্য নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। বিশেষ করে বাঙালির বেঁচে থাকায় তাঁর দুর্মর উপস্থিতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একজন মানুষ প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই আর একজন মানুষের সবটাই গ্রহণ করতে পারেন না, পার্থক্যের জায়গা থাকেই। মানুষের মস্তিষ্কের স্বাতন্ত্র্যের লক্ষণ অত্যন্ত স্পষ্ট। কোনো দুজন মানুষ একরকম হতে পারেন না। কোনো দুজন মানুষের বুদ্ধি, মেধা, কর্মক্ষমতাও একরকম নয়। কাজেই একজন মহৎ মানুষকেও যখন তাঁর অনুরাগী ব্যক্তি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন, তখনও সেই আদর্শের সবটাই গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়। সেই অ-গ্রহণ খানিকটা ক্ষমতার অভাবে;  খানিকটা আদর্শ এবং ভাবনার পার্থক্যের কারণেও। এটা কোনো নতুন কথা নয়, চিরকালের কথা।’

তিনি নিজের অনুভবের কথা বলতে গিয়ে অনেকেরই মনের কথাটি বলেছেন। ১৫ বছর বয়স থেকে চৈতন্যে মিশে থাকা রবীন্দ্রনাথ আর একমাত্র রইলেন না সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ প্রমুখের আবিষ্কারে। তার ‘রবীন্দ্রকাব্যরস নিষিক্ত কল্প-পৃথিবী একেবারে ঘুরে গেল।’ রবীন্দ্রনাথকে আংশিক বর্জনের সূচনা এখান থেকেই। ‘রবীন্দ্রনাথের নিবিড় ও নির্দ্বিধ’ অধ্যাত্মভাবনা, তাঁর গভীর ঈশ্বরবিশ্বাসও তাঁকে টানল না। ফলে ‘রবীন্দ্রনাথের ভক্তগীতি বা পূজার গান আমি গ্রহণ করতে পারি না। তার ভাববস্তু আমি বর্জন করি।’ জানিয়েছেন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও তাই মনে করি। তবে উপলব্ধির প্রকাশশৈলী তার মতো আমাকেও মুগ্ধ করে।

রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনা নিয়ে অনেকেই অনেক রকম মন্তব্য করেছেন। প্রায় সব মন্তব্যই খণ্ডিত। ওইসব বিশ্লেষণের মধ্যে সত্য আছে তবে পরিপূর্ণ সত্য নেই। নারী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সব সময়ই আন্দোলিত হয়েছে। নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব অতিক্রম করে এগিয়েছে। তবে যেটুকু মানতে কষ্ট হয় সবটুকুই তাঁর তরুণ বয়সের ভাবনা। সুমিতা চক্রবর্তী যথার্থই বলেন, ‘রবীন্দ্র-ভুবনে নারীর অবস্থান, রবীন্দ্র-মানসে নারীভাবনা এক দ্রুত পরিবর্তনশীল কালপর্বের মধ্যে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ছে। সেই গতিমুখ পেছনের দিকে নয়, সামনের দিকেই। রবীন্দ্র-মানসের প্রগতিমুখীন চলিষ্ণুতা এর মধ্য দিয়েই অনুভব করা যায়।’ একটু গভীরভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথের গ্রহণের দিকটিই প্রবল। সেটা তিনি স্বীকার করেছেন। কারণ কাব্য-সঙ্গীত-সাহিত্য ছাড়াও তাঁর রাজনীতি, কৃষি ও সমবায়নীতি, সমাজ, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রকৃতি, লোকসাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার জায়গাগুলোর পরিপূর্ণ উপলব্ধি এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ভাষার ক্ষেত্রেও তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। বাংলা ভাষার সংস্কৃত মেদবাহুল্য ঝেড়ে ফেলে তিনি ভাষাকে ঝরঝরে করে তুললেন, নতুন এক চেহারা দান করলেন। সেই বিষয়টিও গবেষণার দাবি রাখে।

অমর্ত্য সেন ‘Tagore and His India’- তে উল্লেখ করেছেন যে খোদ ভারতেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত প্রচারণায় গলদ রয়েছে। তাঁকে পুরাণের খোলস থেকে বের করে আনাকে নিজের প্রধান কাজ বলে তিনি মনে করেছেন। রবীন্দ্রনাথের আন্তর-জটিলতা ও অসঙ্গতি সম্পর্কে অমর্ত্য সেন সচেতন ছিলেন। তিনি চেষ্টা করেছেন তাঁর সর্বোচ্চ মৌলিকতা তুলে ধরতে। কিন্তু ‘মরমি’, ‘আধ্যাত্মবাদী’ ও ‘প্রতি-আধুনিক’  হিসেবে তাঁর ইমেজের কাছে বাকি সবকিছু ম্লান হয়ে যায় বলে তার ধারণা। রবীন্দ্রনাথকে রেনেসাঁ-পুরুষ হিসেবে তুলে ধরতে তিনি ১৯৯৫ সালে ‘Rabindranath Tagore: The Myriad-Minded Man’ রচনা করেন। দেখান যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র ইত্যাদি তাঁর সৃষ্টিশীলতার পূর্ণ প্রকাশ নয়। তাঁর দু’ হাজারের বেশি গান এবং আড়াই হাজারের মতো ছবি রয়েছে যা তার সৃষ্টিশীলতার অন্যমাত্রা তুলে ধরে। মজার ব্যাপার হলো, যখন ‘গীতাঞ্জলি’ প্রতীচ্যে অভ্যর্থনা পেয়েছিল তখন তাঁর গদ্যরচনা সম্পর্কে কোনো খোঁজ ছিল না। কিন্তু এখন অনেকেই মন্তব্য করেন যে তাঁর গদ্যরচনা সহজেই নোবেল পুরস্কার নিশ্চিত করতে পারত। পণ্ডিত রবিশংকর তাঁর ‘Raga Mala’ গ্রন্থে লিখেছেন যে পাশ্চাত্যে জন্মালে রবীন্দ্রনাথ শেক্সপীয়র ও গ্যেটের মতো সম্মান পেতেন। এই কথার মধ্যে আক্ষেপ আছে আবার মনোযোগী রবীন্দ্রচর্চার আহ্বানও আছে। রবীন্দ্রনাথ এমনই এক ভাণ্ডার যার প্রাসঙ্গিকতা কখনো ফুরায় না, তবে গুটিকয়েক গান আর সীমিত শিক্ষায়তনিক পঠনপাঠনের মাঝে তাঁকে আটকে ফেললে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে তাঁর রচনা অব্যবহৃত থেকে যাবে। জ্ঞানের সেই আকর থেকে দরকারি মুক্তো আহরণের সময় বয়ে যাচ্ছে।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মে ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়