ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

প্রসঙ্গ: ‘হাছনজানের রাজা’

সুমনকুমার দাশ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ১০ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রসঙ্গ: ‘হাছনজানের রাজা’

নাটকের একটি দৃশ্য, আলোকচিত্র : মুনজের বাবু

|| সুমনকুমার দাশ ||

ইদানীং বাংলা নাটক প্রসঙ্গে কথা উঠলেই ভালো স্ক্রিপ্টের অভাবের বিষয়টি খুব জোরেশোরেই উচ্চারিত হয়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখনও যেন ত্রাণকর্তার ভূমিকায় রয়েছেন! তবে ফাঁকফোকরে যে ভালো মানের নাটক রচিত বা মঞ্চায়িত হচ্ছে না, তা-ও কিন্তু নয়। সে রকমই একটি নাটক ‘হাছনজানের রাজা’। প্রাঙ্গণেমোর প্রযোজিত এ নাটকটি দেখে মনে হলো, নাট্যদলটি ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বেশ আঁটঘাট বেঁধেই তবে মঞ্চায়নে নেমেছিল! মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে দলটির অতিপরিমিতিবোধ প্রযোজনাটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

দুই

হাসন রাজা দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার। সিলেট ও সুনামগঞ্জ মিলিয়ে বিশাল তাঁর জমিদারি। অল্প বয়সে তিনি এসব জমিজিরাতের মালিকও বনে যান। বেহিসাবি সম্পদ, ভোগবিলাস, উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। তবে মাঝ বয়সে এসে তাঁর মনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। জাগতিক মোহ ত্যাগ করে তিনি সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন শুরু করেন। জমিদারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খর্ব করে তিনি একের পর এক গান রচনায় মেতে ওঠেন। কিছুদিনের মধ্যেই পরিগণিত হতে শুরু করেন মরমিগানের কিংবদন্তি গীতিকার হিসেবে। এমনই তাঁর গানের বাণী, খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গান উদ্ধৃত করে বিদেশ-বিভূঁইয়ে বক্তৃতা পর্যন্তও দেন। তো, সেই জমিদার দেওয়ান হাসন রাজাকে নিয়ে গুণী নাট্যকার, লেখক ও স্থপতি শাকুর মজিদ রচনা করলেন ‘হাছনজানের রাজা’। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন  অনন্ত হিরা।

তিন

নাট্যকার শাকুর মজিদ হাসন রাজাকে অভিনব এক পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছেন। অত্যাধুনিক কিছু তরুণ-তরুণীর মুখোমুখি তিনি হাসন রাজাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। শহুরে কিছু তরুণ-তরুণী সুনামগঞ্জের হাওরে চাঁদনি রাতে নৌকা ভাসান কেবল হাসন রাজাকে দেখার উদ্দেশে। লোকশ্রুতির বদৌলতে তাঁরা জানতে পেরেছেন, ১৯২২ সালে মারা গেলেও বর্ষার ভরা জোছনায় ‘হাছন রাজার নাও ঘুরিয়া বেড়ায়/ কাছে গেলে এই নাও আকাশে মিলায়।’ কেবল এই তথ্যটুকু সম্বল করে তাঁরা সুনামগঞ্জে এসে নৌকা ভাড়া করে হাওরে রাত কাটাতে যান। আর সেখানেই ঘটনা পরম্পরায় তাঁদের দেখা হয়ে যায় সখী-পরিবেষ্টিত হাসন রাজার সঙ্গে। এরপর তাঁরা হাসন রাজাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেন তাঁর জীবনকাহিনি এবং তাঁকে নিয়ে প্রচলিত নানা জনশ্রুতির বিষয়েও। এমনকী হাসন রাজার গান রচনার বিস্তারিত তথ্যাবলিও আলাপে-আলাপে তাঁরা জেনে নেন। নাট্যকার রচিত পয়ার ছন্দ আর হাসন রাজার গানই মূলত এ নাটকের প্রাণ। আর নাট্যকারের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব হচ্ছে, প্রায় শতবর্ষ আগে মৃত্যুবরণকারী মরমিগানের সুবিদিত একজন প্রাচীন ব্যক্তির জীবনযাপন এবং গায়ন পদ্ধতিকে অতি আধুনিক কিছু তরুণ-তরুণীর চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সফলতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার করে দিতে পেরেছেন।
 

নাট্যকার শাকুর মজিদের সঙ্গে হাসন রাজার চরিত্রে রামিজ রাজু
 

চার

নির্দেশক অনন্ত হিরা মেধা, মনন ও অভিনয়গুণে এরই মধ্যে নমস্য শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। ‘হাছনজানের রাজা’ নাটকেও তাঁর মেধা ও মননের অহরহ পরিচয় পাওয়া যায়। বলা চলে, নাটকটি নির্দেশকের কল্যাণে এক সুসংযোজিত পরিবেশনা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। একদিকে নাটকের পাত্রপাত্রীরা অতি আধুনিক, অন্যদিকে হাসন রাজা এক প্রাচীন চরিত্র। শতবর্ষ আগে-পরের প্রজন্মের চিন্তা-চেতনা-রুচির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরিতে নির্দেশক সবসময় সজাগ ও সচেতন ছিলেন, সেটি নাটক দেখেই অনুভব করা সম্ভব। আর এখানেই নির্দেশকের মুনশিয়ানা এবং সফল হবার আকাঙক্ষার মেজাজটা ধরা পড়ে। বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিংবা মানসিক খচখচানো থাকলেও নাটকের আধুনিক তরুণ-তরুণীদের বাচনভঙ্গি ও শারীরিক ভাষা কিন্তু হালের প্রজন্মের সঙ্গে খাপেখাপে মিলে যায়। এর বাইরে আবহ সংগীত, মঞ্চভাবনা, কোরিওগ্রাফি, পোশাক, রূপসজ্জা, আলোক প্রক্ষেপণ থেকে শুরু করে আদ্যন্ত একটি ভালো নাটকই উপহার দিলেন অনন্ত হিরা। এজন্য অবশ্যই তিনি সাধুবাদ পাবেন।

পাঁচ

শাকুর-অনন্ত দ্বৈরথে প্রযোজিত ‘হাছনজানের রাজা’র মূল বাজির ঘোড়া কিন্তু রামিজ রাজু। যিনি এ নাটকের প্রধান চরিত্র হাসন রাজার নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন। মঞ্চের নিয়মিত দর্শকদের কাছে রামিজের অভিনয় ক্ষমতার বিষয়টি ভালোই জানা থাকবার কথা। এ নাটকের ক্ষেত্রেও পুনর্বার রামিজ তাঁর জাত চিনিয়েছেন। তাঁর কুশলী ও পরিশীলিত অভিনয়-দক্ষতা ছিল দেখার মতো। বলা চলে, অভিনয়, স্বরের ওঠানামা, অভিব্যক্তি ও গানে প্রায় একাই তিনি পুরো নাটকটিকে শেষ পর্যন্ত সফলতার দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। রামিজের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের প্রক্ষেপণ ও সংলাপ উচ্চারণ দুটোই ছিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ্য বিষয়। তাই তাঁকে কুর্নিশ জানাতেই হবে। এর বাইরে মাঝি চরিত্রে অভিনয়কারীর স্বচ্ছন্দ অভিনয়ও ছিল প্রশংসাযোগ্য। বাদবাকিরা গড়পরতা অভিনয় করলেও হঠাৎ কারও-কারও অভিনয় ছিল আবার অনেকটা চোখধাঁধানো পর্যায়ের। তবে, রামিজ দুর্দান্ত অভিনয় করে মন জয় করে নিলেও তাঁরই অভিনীত ‘ঈর্ষা’ নাটকের সংলাপ উচ্চারণের স্টাইলের প্রতিচ্ছবি এ নাটকেও কিছুটা পাওয়া গেছে। এটি এড়াতে পারলে সম্ভবত তাঁকে একশতে একশ দিতে কারও কোনো কার্পণ্য থাকবার কথা নয়।
 

নাটকের একটি দৃশ্য
 

ছয়

উপস্থাপনাগত দিক থেকে ‘হাছনজানের রাজা’ নাটকটি অনেক বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে। এর আগে এমন অতি-আধুনিক ধাঁচের নাটক প্রাঙ্গণেমোর-কে মঞ্চায়ন করতে দেখা যায়নি। নাটক দেখার আগে আমি একটু দ্বিধায় ছিলাম, এই একবিংশ শতাব্দে এসে বিংশ শতাব্দের দুয়ের দশকে মৃত্যুবরণকারী এক মরমিসাধকের কাহিনি আদৌও কি গ্রহণ করবেন দর্শক? কিন্তু, নাটক দেখে সে দ্বিধা আমার কেটে যায়। এখন অনেকটা এভাবেই বলা যায়, বাংলা নাটকের এই আকালের সময়ে ‘হাছনজানের রাজা’কে আলাদাভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়