ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

জগতের মায়েরা ভালো থাকুক || মনি হায়দার

মনি হায়দার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জগতের মায়েরা ভালো থাকুক || মনি হায়দার

মা!
একটি শব্দমাত্র। অস্তিত্বের গভীর গোপন নিবিড়  থেকে ডেকে ওঠে পরাণের ঘুঘু... উদাস দুপুরে, বর্ষার দিনে অথবা জোৎস্নাঝরা গভীর রাতে। ঢেকিতে ধান ভাঙার কুরুৎ  কুরুৎ শব্দের উৎসই তো আমাদের হাজার বছরের মায়ের প্রতিধ্বনি।  মায়েরা আমাদের জীবনে কতো অনুষঙ্গে, কতো নিবেদনে, কতো প্রেরণায় আছেন উৎসের আধার হয়ে। মা আছেন বলেই আমি আছি। আমরা আছি। কোটি কোটি মানুষ ও প্রাণী আছে, আছি।

আমার জীবনে  মায়ের ভমিকা দূরাগত। শৈশবে, সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে পরম পিতা পরলোকগমন করলে, আমাদের সংসারে নেমে আসে গভীর ঘন অন্ধকার। মায়ের প্রথম সন্তান আমি। আমার পরে আরও তিনটি ভাইবোন। পরপর দুটি বোন। শেষেরটি ভাই। আয়ের কোনো পথ নেই। বড় বিমাতার গর্ভজাত দুই ভাইয়ের হাতে সংসারের হাল। তারা বুদ্ধি সুপরামর্শ করে সংসার এগিয়ে নেয়ার বদলে, কুবুদ্ধিতে সংসারে নেমে আসে আরও বিপর্যয়। আমি পরের বছর চলে যাই সংসার থেকে অনেক দূরে, লজিং থেকে অষ্টম, নবম, দশম শ্রেণীতে পড়ার জন্য। কারণ, আমি জেনে গেছি, আমাকে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। আমি প্রতিষ্ঠা পেলে সংসার টিকে যাবে। মা বাঁচবেন। ভাইবোনেরা বাঁচবে।  আজ প্রায় চল্লিশ বছর পর পিছনে তাকিয়ে অনুভব করি, দূরের হলেও আমরা যে ভাইবোনেরা এক সুতোয় গেঁথে আছি তার পেছনে বড় অবদান আমার পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া মায়ের।

আজ, এতোদিন পরে আমি যখন ভাবি, সেই চল্লিশ বছর আগে, যদি আমাদের পিতা মারা না গিয়ে আমাদের মা মারা যেতেন, আমরা কোথায় থাকতাম? কিভাবে থাকতাম? কে আমার অসহায় ভাইবোনদের নিজে না খেয়ে আশ্রয় দিতেন মমতার ডানার নিচে? যেহেতু শৈশব থেকে মায়ের নিবিড় মমতার ছায়া থেকে দূরে আমার অবস্থান, ফলে গড়ে ওঠেনি সংযুক্ত কোনো বন্ধন। মায়ের সঙ্গে আমি পারি না স্বাভাবিক হাতে। কিন্তু আমার গোটা নির্মাণের পিছনে মায়ের দৃষ্টি আর আমার জীবনের কৌটায় তিনি তুলে দিয়েছিলেন স্নেহের অতুলনীয় ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে আমি বিভোর। আমি বিশ্বাস করি বা ধারণ করি, আমার মতো অনেক মানুষ মাকে এভাবেই অনুভব করেন।

আবার এই মায়েদের যখন আগ্রাসী, বেহিসেবী, আত্মকেন্দ্রীক রূপান্তর দেখি, তখন মেলাতে পারি না। আপনারা দেখে থাকবেন, মায়েরা নিজের মেয়ের ছেলেমেয়ে বা নাতীনাতনীদের প্রতি একটু বেশি পক্ষপাতী। সেই তুলনায় ছেলের পক্ষের নাতীনাতনীদের তিনি ভিন্ন চোখে দেখেন। কেনো? এখানে কি এটা কাজ করে, মেয়ে বা মেয়ের ছেলেমেয়েরা দূরে থাকে বলেই এই টান?  আবার ছেলের বৌ বা পুত্রবধূদের প্রতি মা, শাশুড়িদের এক ধরনের অবজ্ঞা আছে। পরম্পরা হিসেবে দেখেছি একজন পুত্রবধূ বাড়িতে এলে প্রথমেই শাশুড়ি দেখেন বৌয়ের শরীরের রং কেমন? নিজের বা নিজের ছেলের বা মেয়ের রং কালো, তাতে কিছু যায় আসে না। পুত্রবধূর শরীরের রং কেনো  কালো?  বধূ খায় কেমন? বেশি না কম? বৌ কি কথা বলার সময় হাসে? জোরে? পাশের ঘর থেকে শোনা যায়? একটু বেশি জোরে হাসলেই শাশুড়ি পাশের বাড়ির পরিচিতজনের হাতে পান তুলে দিতে দিতে বলেন, বৌ ভালা না। কতা কয় জোরে। হাসলে ঘর নড়ে। কি দেইখা পোলার পছন্দ অইলো- মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন।

এই মা ভাবতে পারতেন, আমার মেয়েও তো শ্বশুরবাড়ি গেছে। আমিও একদিন এই বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছিলাম। আমার শাশুড়ি আমার সঙ্গে যা করেছেন, সেটা না করে, সব ছেড়ে আসা এই বধূটিকে আমার মেয়ে ভাবি। হয়তো আমার অধিক কল্পনা। বাস্তবে কখনো সম্ভব কি না, জানি না। এ্ই যে সংসারে বৌ-শাশুড়ির দূরত্ব, যা আমাদের নিত্য দিনের সংসারের কলহ সৃষ্টির প্রথম কারণ- এটা পরম্পরা। যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের মায়েরা শোষিত হয়ে এসেছেন, তিনি যখন নিজেই শাশুড়ি হচ্ছেন, তখন শোধ তুলছেন। বিরল হলেও দুই একটা সংসারে এখনও বৌ ও শাশুড়ির মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়ার সম্পর্ক আছে।

আমাদের মায়েরা আসলে পাষাণে গড়া প্রতিমা। কবি শামসুর রাহমানের একটি কবিতার লাইন আছে- ‘কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি...’। কবি কতোটা বেদনায় ক্ষত হয়ে কবিতায় মায়ের শোক ও বেদনাকে ধারণ করে লিখেছেন ওই পঙ্‌ক্তি। কেমন করে পুরুষ শাষিত সংসারে আমাদের মায়েরা জীবন যাপন করে? এখন হয়তো সময় ও পরিবেশের কারণে মায়েরা অনেকটা অধিকার আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু আর একটু আগে কেমন ছিল আমাদের মায়েদের কাল? সেই কালটার একটা বিবরণ পাই আমাদের আরেক প্রতিভাবান কবি খ্যাতিমান অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের লেখা কবিতায়:

‘আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।

আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,

কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না।

আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে

মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।

আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।

আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেণীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।

বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম

বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম

বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচণ্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই

মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।’

(আমাদের মা)

মা দিবসে মায়েদের নিয়ে  অন্যরকম অনুষঙ্গে লেখা দরকার। কিন্তু যা লিখলাম সবই মায়েদের সাতকাহন। আমাদের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী শামসুদ্দিন আবুল কালামের উপন্যাস ‘কাশবনের কন্যা’। এই উপন্যাসে অসহায় বধূর সঙ্গে, গত শতকের শেষের দিকে শাশুড়িরা কী ধরনের ব্যবহার করতেন সে কথা বলা আছে। সেখানে অবসর সময়ে বধূ বাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী ভাবছে, সেটাও জানতে চাচ্ছেন শাশুড়ি। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। এখানে আমরা পাই ভিন্ন এক মাকে। যে মা নিজের সন্তানকে উৎসর্গ করেন বাংলার স্বাধীনতার বেদীমূলে। এবং তখন সেই মা কেবল একজন  প্রতিবন্ধী বুধার মা নয়, হয়ে ওঠেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াকু সাড়ে সাত কোটি জনতার একক জননী। আবার বিশ্বখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের মা সমান্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সাম্যবাদের লড়াইয়ে প্রিয় পুত্রকে উৎসর্গের একক অনন্য নজির। এভাবে এক একজন মা নিজেকে দেশ কালের বাইরে গিয়ে ছড়িয়ে দেন অনেকের মাঝে। প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বসত্তা। মায়েরাই আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে এই বোধ, এই করুণা, এই মায়া তৈরি করতে পারেন।

মাসখানেক আগে, আমার কাছে একজন ‘মা’ নিয়ে একটি গল্প চেয়েছেন। আগেই লিখেছি- আমার সঙ্গে মায়ের দূরত্ব  আছে। আমি দূর থেকে মাকে অনুভব করি। কারণ, শৈশব থেকে আমি দূরের মানুষ। প্রশ্নটা শুরুতেই উত্থাপন করেছিলাম। আবারও করি, আমার বাবা মারা না গিয়ে যদি মা মারা যেতেন, বাবা কী করতেন? তার বয়স ছিল পঞ্চাশ বা পঞ্চান্ন বছর। তিনি রোমান্টিক  ছিলেন। মা মারা গেলে বাবা কি আর একটা বিয়ে করতেন? অজুহাত তো ছিলই- ছেলেমেয়েরা ছোট, পালবে কে? কারো কিছু বলার ছিল না। কিন্ত মায়ের বয়স তুলনামূলকভাবে কম ছিল। মায়ের চাচা এসেছিলেন, নিয়ে যেতে। মা যাননি। বলেছেন, আমি এই ছেলেমেয়ে রেখে কোথায় যাবো? আমি না থাকলে ওরা বাঁচবে না। কে ওদের দেখাশোনা করবে? আমি নীরবে আমার মায়ের আত্মত্যাগকে ধ্যান করি। তিনি চলে গেলে, আমি কি আজ এখানে আসতে পারতাম? আমি পথের একরত্তি ধুলো হয়ে পায়ে পায়ে ধ্বসে যেতাম। আমার মায়ের মতো আরও কতো শত বিচিত্র মা আছেন, সংসারে। আমাদের মায়েরা পাখির পালকের মতো হালকা, আমাদের মায়েরা মধুর মতো মিষ্টি, আমাদের মায়েরা থরে থরে সাজানো লাবণ্যমাখা শিমুল তুলোর মতো।

মায়েদের পায়ের নিচে বেহেশত থাকে কিনা আমি জানি না। কিন্তু মায়েদের পায়ে যে ঘ্রাণ, যে ঘাসফুলের মহিমা থাকে, পৃথিবীর মানুষেরা চিরকাল এই সব মায়েদের জন্য সেই ফুলগন্ধ নিয়ে বাঁচে। আমার মা, আমাদের মা, ফিলিস্তিনের সন্তান হারানো মা, কাশ্মিরে সন্তান হারানো মা, সিরিয়ায় সন্তান হারানো মা, মিয়ানমারে সন্তান হারানো মা- জগতের সকল মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।  সকল মায়েরা, আপনারা এই মা দিবসে  কেবল নয়, প্রতিটি দিন ভালো থাকুন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়