ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

ওয়ানগালা : গারোদের উৎসব

সঞ্জয় সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ২৯ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওয়ানগালা : গারোদের উৎসব

সঞ্জয় সরকার: গারো নৃ-গোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব ওয়ানগালা। এটি তাদের কৃষিভিত্তিক সামাজিক উৎসব হিসেবেও স্বীকৃত। গারো বা মান্দি ভাষায় ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ নৈবেদ্য বা দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার সামগ্রী। আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ কোনো কিছু উৎসর্গ করা। প্রাচীন গারোরা ছিলেন সাংসারেক ধর্মাবলম্বী। তারা নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় শস্যের কিছু পরিমাণ সূর্য দেবতা মিসি সালজং বা সালজং মিদ্দিকে উৎসর্গ করতেন। শস্য উৎসর্গ করার এ উৎসবটির নাম ওয়ানগালা। তবে গারোদের সাংসারেক ধর্মচর্চা এখন বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমান সময়ে গারোদের প্রায় সবাই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। কিন্তু তারপরও তারা ঐতিহ্যবাহী আদি উৎসবের প্রথাটি ধরে রেখেছেন। ওয়ানগালা মূলত নবান্ন উৎসব। এ উৎসবের আগে তারা নতুন উৎপাদিত ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন না। তবে এখন তারা ওয়ানগালা পালন করেন যিশুখ্রিস্টের উদ্দেশ্যে শস্য উৎসর্গ করে।

ওয়ানগালা উৎসবের আয়োজন করা হয় জুম ফসলকে কেন্দ্র করে। মান্দিরা সাধারণত বর্ষার শেষে এবং শীতকাল শুরু হওয়ার মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিনে জুম ফসল ঘরে তোলেন। সে সময় হয় এই আয়োজন। এর আগে গারো সমাজে কিছু আচার পালন করা হয়। যেমন জুম ক্ষেতের মাঝখানের কিছু অংশের ধান সবার শেষে কাটা হয়। মান্দি ভাষায় ওই স্থানটিকে বলা হয় আ’সিরকার স্থান। ধান কাটা হয় দেবতার উদ্দেশ্যে ধূপ উৎসর্গ করে। গাছের গোড়া থেকে কেটে আঁটি বেধে ধান বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় অনেকে মিলে একসঙ্গে আনন্দ ধ্বনি করেন। গারোদের বিশ্বাস, নতুন ফসলের সঙ্গে তারা শস্যের দেব-দেবীদেরও বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর ওই নতুন ধানের চাল দিয়ে উৎসবের জন্য চু (বিশেষ পানীয় বা মদ) তৈরি করেন। এভাবে প্রস্তুতি পর্ব শেষ হলে গারো সমাজের নেতা নকমা (মোড়ল) এবং খামাল (পুরোহিত) আখিংভূক্ত সকলের সঙ্গে আলোচনা করে উৎসবের দিন নির্ধারণ করেন। উৎসবের সাতদিন আগে খামাল একটি দড়িতে সাতটি গিট দেন। এরপর প্রতিদিন একটি করে গিট খুলে ফেলেন। এভাবে যে দিন শেষ গিট খোলা হয় সেদিনই উদ্যাপিত হয় ওয়ানগালা উৎসব। সাংসারেক গারো সমাজে ওয়ানগালা নানা পর্বে বিভক্ত ছিল। যেমন চু-রুগালা, থক্কা, সাসাৎসআ, জলওয়াত্তা প্রভৃতি।



চু-রুগালা মূলত উৎসর্গের পর্ব। এ পর্বে শস্যের দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে নতুন ধানের ভাত, ফলমূল, শাকসবজি, পশুপাখি প্রভৃতি উৎসর্গ করা হয়। পর্বটি শুরু হয় নকমার বাড়িতে। নকমার ঘরে কলাপাতা বিছিয়ে তার ওপর চালকুমড়া, আদা, পিঁয়াজ, আলু প্রভৃতি শস্য বা ফলমূল কেটে কিছু ভাত, চিড়া এবং অন্যান্য বস্তুসহ সাজিয়ে রাখা হয়। পাশেই রাখা হয় দা, কোদাল, নিড়ানি প্রভৃতি কৃষি যন্ত্রপাতি। খামাল সূর্য দেবতা মিসি সালজংয়ের প্রতি উৎসর্গকৃত নৈবেদ্যর ওপর কিছু পরিমাণ চু ঢেলে দেন। এ সময় গারো পুরুষরা দামা, দাদিক, রাং, খ্রাং, আদুরু, নাগড়া প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকেন। সমাজের প্রধান ব্যক্তিরা তখন ঢাল তলোয়ার নিয়ে নাচতে শুরু করেন। নারীরাও নেচে গেয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এক পর্যায়ে নকমা বা খামাল ঘরের বিভিন্ন স্থানে এবং নৃত্যরত নারীদের ওপর নতুন ধানের চাল ও ভাত ছিটিয়ে দেন। খামাল এ সময় সালজংকে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে মন্ত্র পাঠ করেন। এ দিন সন্ধ্যায় পর্যায়ক্রমে সবার বাড়িতে আমোয়া (পূজা) হয়। কেউ সেদিন পাগড়িতে মোরগের পালক যুক্ত করেন না। নতুন অলঙ্কার ও নতুন কাপড় পরেন না।

থক্কা মানে চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে তা দিয়ে কোনো কিছু রাঙিয়ে দেয়া বা চিহ্নিত করা। রুগালার পর ওয়ানগালা উৎসবের চিহ্ন হিসেবে ঘরবাড়ি রাঙিয়ে দেয়ার জন্য নারীরা ঘরে ঘরে চালের গুঁড়া তৈরি করেন। এরপর সেই গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে প্রথমে নকমার বাড়ির ঘরের খুঁটি ও কড়ি কাঠের ওপর টিপ দেয়। এরপর হাতের তালুর সাহায্যে ঘরের বিভিন্ন স্থানে ছাপ দেয়। এভাবে প্রত্যেকের বাড়িঘর রাঙানো হয়। নববর্ষের আগে, চৈত্রসংক্রান্তিতে হিন্দুদের বাড়িঘরেও এ কাজটি করা হয়ে থাকে। মান্দি ভাষায় ‘সাসাৎসআ’ হচ্ছে ধূপ। থক্কা পর্বে বাড়ি ঘর রাঙানোর পর সাসাৎসআ পর্ব শুরু হয়। এ পর্বে সূর্য দেবতা মিসি সালজংয়ের উদ্দেশ্যে ধূপ জ্বালিয়ে এবং বাদ্য-বাজিয়ে বিশেষ ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। পুরোহিত ধূপ পোড়ানোর সময় বাদক দল তালে তালে বাদ্য বাজাতে থাকেন। সাসাৎসআ’র সময় পানাহারের ব্যাপক আয়োজন থাকে। ওয়ানগালা উৎসবের সমাপনী পর্ব হলো জলওয়াত্তা। এই পর্বে মিসি সালজংকে বিদায় দেয়া হয়। আর এ বিদায় অনুষ্ঠান উদযাপিত হয় নকমার বাড়িতে। আয়োজকরা সবাই শোভাযাত্রা করে একস্থানে জড়ো হয়ে সালজংকে বিদায় জানান। এ সময় সবাই দুই সারিতে বসেন। সারির সামনের দিকে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে খামাল চু’র হাড়ি ও ফং (লাউয়ের খোলস দিয়ে তৈরি পাত্র) নিয়ে বসেন এবং মিসি সালজংয়ের উদ্দেশ্যে মন্ত্র পাঠ করেন। এক পর্যায়ে কলাপাতার ওপর চালের গুঁড়া ছিটিয়ে দেন। এরপর ফং থেকে চালের গুঁড়ার ওপর চু ঢেলে দেন। অন্যরা এ সময় খামালের কাছে থাকা খ্রাং (বিশেষ ধরনের ঢোলক) বাজাতে বাজাতে নাচতে শুরু করেন।



ওয়ানগালা উৎসবে খ্রিস্টিয় রীতির প্রচলনের কারণে সাংসারেক রীতির অনেক কিছুই এখন আর দেখা যায় না। রুগালা, থক্কা, সাসাৎসআ, জলওয়াত্তা প্রভৃতি পর্বগুলো দেখলেই তা ধরা পড়ে। বিশেষ করে এ সময়ের ওয়ানগালা উৎসব অনেকটাই নাচ, গান আর সামান্য কিছু আচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে গারোদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে তাদের মিথগুলো আজও জীবন্ত হয়ে আছে। উল্লেখ্য যে, গারোরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তাদের গোত্রভিত্তিক কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন দুয়াল গোত্রভূক্ত গারোরা ওয়ানগালা উদযাপন করেন না। তাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব ‘চুগান’। অন্যদিকে ‘ব্রাক’ গোত্রভূক্তরা ওয়ানগালা করেন ‘হানছি থাক্কা’র মধ্য দিয়ে। এতে তারা সালজং মিদ্দির উদ্দেশ্যে মোরগের রক্ত উৎসর্গ করেন।

নেত্রকোনার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, শেরপুরের ঝিনাইগাতি, জামালপুরের শ্রীবর্দী, বকশিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা প্রভৃতি সীমান্ত এলাকার পাশাপাশি টাঙ্গাইলের মধুপুরের গারো অধ্যূষিত এলাকায় প্রতিবছর ঘটা করে ওয়ানগালা অনুষ্ঠিত হয়। আদিবাসী ও বাঙালির চমৎকার এক মেলবন্ধন সূচিত হয় এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবের মধ্য দিয়ে। আর এ কারণেই আশা করা যায় ওয়ানগালা হারিয়ে যাবে না। বরং এটি একদিন ‘আমাদের উৎসব’ হয়ে টিকে থাকবে যুগ-যুগান্তর।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়