ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ঈদুল ফিতর ও আমাদের সামাজিক জীবন

রওশন জাহিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩২, ১৬ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদুল ফিতর ও আমাদের সামাজিক জীবন

রওশন জাহিদ : ঈদ আরবী শব্দ। মূল শব্দ ‘আউদ’। এর শাব্দিক অর্থ হলো আনন্দ-খুশি, প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা। এর বাংলা প্রতিশব্দ না থাকায় এটি এখন বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ হয়েছে। আর ‘ফিতর’ শব্দটি এসেছে ফিতরা ধাতু থেকে। ফিতর শব্দের অর্থ হলো ভেঙে ফেলা, সাদকা, ফিতরা। ঈদুল ফিতরের সমষ্টিগত অর্থ হচ্ছে রোজা ভঙ্গের ঈদ। তাইতো কবির কণ্ঠে শুনতে পাই- ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। আবার ‘ঈদগাহ’ বলতে নামাযের জায়গা বোঝানো হয়েছে। যে স্থানে ঈদের নামায আদায় করা হয়ে থাকে সেই স্থানকে ঈদগাহ বলা হয়। অর্থাৎ ঈদগাহ শব্দের অর্থ ফিরে আসার স্থান। মুসলমানগণ ঈদের নামাজের জন্য বছরে দুইবার যে স্থানে ফিরে আসে তাকেই ঈদগাহ বলা হয়ে থাকে।


ঈদ মহা আনন্দের আয়োজন। এদিন সকলেই কেবল হাসতে চাই, আনন্দে অবগাহন করতে চাই। সবাই একে অপরের সঙ্গে নিজেদের জমানো ভাবের বিনিময় করতে চাই, চাই একে অপরের সুখে সুখী হতে। এতে ভালোবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হতে থাকে যা চলে সারা বছর। এই ভালোবাসা মানুষকে এক অপরের কাছে নিয়ে আসে, ভেদাভেদের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে প্রেমের রাজত্ব কায়েম করে। ভালোবাসাই একমাত্র শক্তি যা অমঙ্গল দূর করতে পারে। প্রেমই পারে মানুষকে বাঁচাতে, অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে কেবলই হাসাতে।


বাংলাদেশে বসবাসরত বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে ঈদুল ফিতর একটি আনন্দঘন ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তবে কালক্রম এটি সামাজিক উৎসবের চরিত্র গ্রহণ করেছে। যে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন ঈদের দিন সকলেই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে আগ্রহী হয়। বিশেষ প্রতিবন্ধকতা ছাড়া সকলেই নাড়ির টানে নিজের শিকড়ের কাছে ফিরতে চায়। সকল আত্মীয়-স্বজনের দেখা হওয়ার এ যেন এক মোক্ষম সুযোগ। যদিও ঈদ ধর্মীয় অনুষ্ঠান; তারপরও প্রথমত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি আর দ্বিতীয়ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণে এই উৎসবের আনন্দ সকল জনগোষ্ঠীর লোকজন উপভোগ করে। শারদীয় পূজায় যেমন ইসলাম ধর্মাবলম্বীগণ দাওয়াত পেয়ে থাকে, তেমনি ঈদের দিনেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ তাদের প্রতিবেশীর বাসায় দাওয়াতে যায়। শুধু সামাজিক সম্প্রীতিই নয়, সম্পদের অসম বন্টনের কারণে যেন কারও ঈদেও খুশি বিলীন না হয় তাই ধনীর জন্য নির্ধনকে সাহায্য করার রীতিও প্রচলিত। কবি নজরুল ইসলামের কবিতায় আমরা দেখি,

‘ঈদ-উল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান,

ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ব যা করিবে দান,

ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!

ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,

তৃষ্ণাতুরের হিস্যা আছে ও পেয়ালাতে,

দিয়া ভোগ কর বীর, দেদার,

বুক খালি করে আপনারে আজ দাও জাকাত,

করো না হিসাবী আজি হিসাবের অঙ্কপাত!’


এই সাম্য ও সমতার বন্ধনে মানুষ নিজেকে যুক্ত করতে চায়, মানুষ তার পরিবারের সকলের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে চায়। পরিবারের সকলে মিলে নতুন কাপড় পরে মিষ্টান্ন খায়। সকলের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। ঈদের দিন সকলেই খুশি থাকে, হাসিতে হাসিতে ভরে ওঠে পাড়া-মহল্লা। ঈদের দিন নামায পড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। সকলে মিলে ঈদগাহে মিলিত হয়ে একসঙ্গে নামাজ আদায়ের ফলে সকলের দেখা হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। নামায পড়ে খুতবা শোনার শেষে সকলে কোলাকুলি করে যা সৌহার্দে্যর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আজও গ্রামের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন ব্যবস্থার ভিতরে ঈদগাহের সকলে কোলাকুলি করে থাকে। তবে নগর জীবনের ঘেরাটোপে পরিচয়হীনতার কারণে কোলাকুলির হার খুব বেশি নয়। তারপরও এ রীতি পালন করে সকলেই আনন্দ পেয়ে থাকেন। বিশেষ করে ছোট বাচ্চারা কোলাকুলি করে অনেক আনন্দ পায় কারণ তারা যেমন ছোটদের সঙ্গে কোলাকুলি করে তেমনি বড়দের সঙ্গেও করতে পারে যা বছরের অন্য কোনো সময় হয়ে ওঠে না। ঈদের আনন্দ ছোটোরাই বেশি উপভোগ করে। বিশেষ ব্যবস্থায় ঈদের জামাতে নারীরাও অংশগ্রহণ করে।


রমযান মাসজুড়ে সিয়াম সাধনার পরে আসে ঈদ। রমযানে মুসলিমগণ সৃষ্টিকর্তার দেয়া বিধান মেনে সারাদিন পানাহার ও সকল রকম খারাপ কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখে। ইফতারের সময়ে সকলে মিলে একই পাতে ইফতার গ্রহণ করে। এক অপরের প্রতি ভাইয়ের মতো আচরণ করে। তবে যে কোনোভাবেই লোক দেখানো কোনো কিছুর ব্যাপারে ধর্মীয় বিধি নিষেধ আছে। বর্তমানে নাগরিক সমাজে ইফতার মাহফিলের সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায় যেখানে শ্রেণিভেদে ইফতারের দাওয়াত দেয়া হয়ে থাকে। ঈদুল ফিতরের সঙ্গে ফিতরা প্রদানের একটি বড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ঈদের জামাতে যাওয়ার আগেই ফিতরার টাকা বন্টন করে দেওয়ার নিয়ম আছে। অভাবগ্রস্ত লোকজনের মধ্যে ফিতরার টাকা বন্টন করে দিতে হয় যাতে তারা ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে। ইফতারের মতো জাকাতের সংস্কৃতিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ঈদের দিনে মিষ্টান্ন ভক্ষণ ও নতুন কাপড় পরার রেওয়াজ চালু আছে। তাই ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় জাকাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে যাতে সমাজের সকলে ঐ নির্দিষ্ট দিনে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে। এবং এটি সমাজের বিত্তবানদের কর্তব্য বলে স্বীকৃত। কারণ সকলের খুশিতেই সামাজিকভাবে ঈদের দিন খুশির দিন হয়ে ওঠে।


বাঙালির সামাজিক জীবনে ঈদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ধর্মঘনিষ্ঠ মানসিকতার কারণে বাঙালি ঈদের দিন যেমন ধর্মপালন করে তেমনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে নিজেদের খশিতে অন্যকেও খুশি করে থাকে। সৌহার্দে্যর যে বন্ধন মানুষের  মধ্যে গড়ে ওঠে ঈদের কারণে তা যেন সারা বছর থাকে। এটি সকলেই চায়। শুধু সামজিক জীবন নয়, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক সহাবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠতে পারে ঈদের কারণে। কারণ, বাঙালি সামাজিক জীবনে ধর্মের অর্গল ছিন্ন করে মানবিকতাকে আলিঙ্গন করেছে অকুণ্ঠ চিত্তে যা বাঙালির নৃতাত্তিক বৈশিষ্ট্যও বটে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়