ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফুটবলই জীবন || মুম রহমান

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১১, ২৪ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফুটবলই জীবন || মুম রহমান

ছবি : সংগৃহীত

কোথায়, কবে শুনেছিলাম, খেয়াল নেই। কিন্তু গানটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। সম্ভবত এমন ছিলো, ‘কুদ্দুইস্যারে তওবা করাই বল খেলাটা ছাড়’। ফুটবল খেলার তীব্র নেশা থেকে ছাড়ানোর কথা বলা হয়েছে এ গানে। এই গানেরই ভেতরে কোনো একটা লাইন ছিলো এমন যে, ‘তোমার আমার জীবনটারে ফুটবলের লাহান’। ফুটবলের মতো যে যাকে পায় লাত্থি দিতে থাকে, গোল হওয়াটাই মূখ্য।

এখন ফুটবলের ভরা মৌসুমে এসে মনে পড়ছে, মাঠে আমরা ফুটবল খেলি না, তবে আমাদের হালের জীবনযাত্রার মধ্যে ফুটবল খেলার আচরণ ঢুকে গেছে সুচারুভাবেই। অর্থ, খ্যাতি, প্রেম কিংবা অন্য যে কোন কিছু ফুটবলের মতো করে ভাবলে ব্যাপারটা বোধগম্য হয় সহজেই। সবাই মিলে ছুটছি একটা ফুটবল কিংবা টাকা কিংবা খ্যাতি কিংবা সাফল্য কিংবা ফেসবুকের পেছনে। সবার লক্ষ্য একটাই- গোল দেয়া। গোল দেয়াটা কী? সফল হওয়া। দৌড়াদৌড়ি সবাই করে, জালের মধ্যে বলটা নিয়ে ফেলতে পারে না সবাই। কিন্তু চেষ্টাটা সবাই করে। কিন্তু সেই চেষ্টা গণনায় পড়ে না। যতো বলি খেলার হারজিৎ আছে, ভালো খেলতে পারাই বড় কথা; আদতে তা আমরা মানি না। কে ভালো খেললো, কে খারাপ খেললো, সেটা ইতিহাসে লেখা থাকে না। ইতিহাসে লেখা থাকে কে কাকে কয় গোল দিয়েছে। সাধারণ মানুষ তখনই ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে যখন সে ফুটবলের মাঠে কিংবা নিজের জীবনের অন্য কাজেও লক্ষ্যে পৌঁছায় অর্থাৎ কিনা গোলপোস্টে পৌঁছায়।

স্কুলে পড়ার কালে সেবা প্রকাশনীর কল্যাণে স্যার ওয়াল্টার স্কটের ‘তালিসমান’ আর ‘আইভানহো’ পড়ে মজা পেয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে স্কটিশ এই ঔপন্যাসিকের সঙ্গে পরিচয় আরো গাঢ় হয়ে। জানতে পারি, তিনি শুধু উপন্যাসই নয়, ছোটগল্প, নাটক আর কবিতাও লিখেছেন। স্কটল্যান্ডের এই লেখক ইংরেজি ভাষাতেই আজ ধ্রুপদী বলে স্বীকৃত। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি আইন পেশার সাথে জড়িত ছিলেন, ছিলেন রাষ্ট্রীয় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে আবার রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু খুবই বিস্মিত হয়েছি, গুরুত্বপূর্ণ এবং গম্ভীর এই মানুষটার একটা উদ্ধৃতিতে। তিনি বলেছেন, ‘জীবন নিজেই একটা ফুটবল।’ ১৮৩২ সালে মারা গেছেন স্যার ওয়াল্টার স্কট। ধারণা করা যায়, কতো আগে তিনি এ কথাটা বলেছিলেন। জীবনকে ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করা যথার্থ একটা প্রাজ্ঞতার ব্যাপার।

প্রতীক ব্যবহারের ক্ষেত্রে জর্জ অরওয়েল বিশ্বখ্যাত হয়ে আছেন তার ‘এনিমেল ফার্ম’ উপন্যাসের মাধ্যমে। পশু খামারের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রাশিয়ার গল্প বলেছিলেন। মাত্র ৪৭ বছরে যক্ষা রোগে মারা যান অরওয়েল। কিন্তু তার জীবন ছিলো কর্মময় আর বিচিত্র। সেই জর্জ অরওয়েলও ফুটবল নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। তার ভাষ্যমতে, ‘ফুটবল এমন এক খেলা যেখানে সবাই আহত হয় আর প্রত্যেক জাতিরই খেলার নিজস্ব শৈলী আছে যা আবার অন্য দেশিদের কাছে অনৈতিক মনে হয়।’ এই কথাটাকেও আমরা জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি। এর সঙ্গে প্রতীকিভাবে শিশুদের ব্যাঙ নিয়ে খেলার কথাও বলতে পারি। জীবনে শুধু ফুটবল খেলাতেই নয়, আমরা অনেক ক্ষেত্রেই আহত হই, পরাজিত হই। আবার আমাদের নিজেদের জীবন যাপনের শৈলী কিংবা ধরন অন্যদের কাছে নৈতিক না-ও হতে পারে। মুসলমানের গরু খাওয়া, হিন্দুর সিঁদুর দেয়া- ভিন্নধর্মীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, এমনকি নৈতিকও নয়।

জর্জ অরওলের মতোই আলবেয়ার কামুও বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৭ বছর। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগে সবচেয়ে কম বয়সী লেখক হিসেবে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ‘আউটসাইডার’, ‘দ্য প্লেগ’-এর মতো উপন্যাসের রচয়িতা কামু তো সরাসরি ফুটবলের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। তিনি নিজে আলজেরিয়ার জাতীয় টিমের গোলকিপার ছিলেন। পরবর্তীকালে এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বহু বছরে বহু কিছু দেখার পর, আমি সুনিশ্চিতভাবেই মানুষের নৈতিকতা আর কর্তব্য সম্পর্কে যা শিখেছি তা এই খেলা থেকে আর এই আরইউএ থেকেই।’ আরইউএ ছিলো তার যৌবনের ফুটবল দল র‌্যাসিং ইউনিভার্সিটি আলজেরিয়া। অরওয়েল আর কামুর ফুটবল বিষয়ক নৈতিকতার চিন্তা নিয়ে মনে হয় ভিন্ন প্রবন্ধই লেখা সম্ভব।

কামু আর সার্ত্রে বন্ধুতা ও শত্রুতা- দুটোই আলোচিত। সাহিত্য ও দর্শন ভাবনায় তাদের মিল ও ফারাক বহু আলোচিত। সার্ত্রে কোন প্রাতিষ্ঠানিকতায় বিশ্বাস রাখতেন না। অস্তিত্ত্ববাদী দার্শনিক, লেখক জ্যাঁ পল সার্ত্রে পৃথিবীর একমাত্র লেখক যিনি নোবেল পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেই সার্ত্রে বলেছিলেন, ‘একটা ফুটবল ম্যাচে সবকিছুই জটিল হয়ে ওঠে অন্য দলের উপস্থিতির কারণে।’ আমাদের জীবনটাও কি তাই নয়! প্রতিপক্ষের উপস্থিতিই কি আমাদের সকল পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে না! একা একা দ্বীপে বসবাসের যতোগুলো উপন্যাস পড়েছি বা চলচ্চিত্র দেখেছি সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জটিলতা কম। জীবন যুদ্ধ সেখানে একরৈখিক। ‘ব্লু লেগুন’, ‘রবিনসন ক্রুসো’, ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’র কথা মনে করেই বলা যায়, একাকী দ্বীপবাসী জীবনে তারা খাদ্য, অন্ন, বস্ত্র এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সরল সংকটে ভুগছে। এই সংকটকালে তারা লড়াই করে প্রাণপণ। কিন্তু এখানে জটিলতা কম। কেননা, প্রকৃতি এখানে প্রতিকূল আবার প্রকৃতিই সহায়। অনত্র সভ্য জগতে ফিরে এলেই তাদের জটিলতা বেড়ে যায়। সভ্য জগত এক তীব্র প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বীতার জগত, যে জগত নিয়ত আমাদেরকে দৌড়াতে ব্যস্ত রাখে এবং গোল করাটাই এখানে মূখ্য। পরীক্ষার খাতা, চাকরির বাজার, সংসারের দিনলিপি- সবখানেই আমরা ছুটছি। এক অদৃশ্য ফুটবলের পেছনে ছুটে চলছে জীবন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়