ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য: বাংলাদেশ পর্ব

মোজাফ্‌ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ২৫ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য: বাংলাদেশ পর্ব

|| মোজাফ্‌ফর হোসেন ||

সাতচল্লিশের দেশভাগ কেবল ভূখণ্ডকে বিভক্ত করেনি, বিভক্ত করেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভূগোলকেও। ফলে নিজভূমেই ডায়াসপোরা অভিজ্ঞতার লাভ করেছেন দুই বাংলার লেখক। দেশভাগ-উত্তর বাংলা সাহিত্যে দেশভাগের পীড়া ও স্মৃতিচারণ ব্যাপক একটা অংশজুড়ে আছে। ভৌগলিকভাবে কাছাকাছি এবং অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে হয়ত বাংলার মানুষের দেশবদলের ইতিহাসে ডায়াসপোরা সাহিত্যের ভেতর আলোচনায় তোলা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গেলে শুরুটা এখান থেকেই হয়।

যে কারণে আমরা যদি মনিকা আলীকে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখক বলি বা নাইপলকে ভারতীয় ডায়াসপোরা লেখক তাহলে নিশ্চয় ঋত্বিক ঘটককেও বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা বলতে পারি। (সাক্ষাৎকার, বইয়ের দেশ, জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যা) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে হর্ষ দত্ত যখন প্রশ্ন করেন- ‘নিজের দেশ, নিজের মাটি থেকে ছিন্নমূল হওয়ার ব্যথার ছোঁয়া রয়ে গেছে আপনার সৃষ্টিতে। কেন এ বিষয়টা ঘুরেফিরে এসেছে?’
সুনীল তখন উত্তর দেন, ‘দেশভাগ নিয়ে আমার বাবার একটি উক্তি আমার সব সময় মনে পড়ে। ’৪৭-এর ১৫ আগস্ট সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হলো, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই হারানোর বেদনা এতো বছর পরও বুকের মধ্যে টনটন করে।’ এই বেদনার কারণ তিনি নির্ণয় করেছেন এভাবে, ‘ফরিদপুরের বদলে আমাদের বাড়ি যদি হতো বীরভূমের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে, তাহলে কলকাতায় এসে পড়াশোনা ও চাকরি-বাকরি করে শহরবাসী হয়ে যেতাম। গ্রামের সেই বাড়িতে যেতাম কালেভদ্রে, শেষের দিকে হয়তো আর যেতামই না। মাটির বাড়িটা ধসে পড়লে কিংবা অন্য কেউ জবরদখল করলেও মাথা ঘামাতাম না। এ রকম তো হয়ই। কিন্তু ফরিদপুরের সেই গ্রাম থেকে আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই যখন চলে এলেন, তখন বোঝা গেল, ইচ্ছা থাকলেও আমাদের আর সেখানে কখনো ফেরা হবে না। এটাই বেদনার উৎস।’
এই বেদনাবোধ থেকেই সুনীলের লেখায় ঘুরেফিরে আসে বাংলাদেশ ও দেশভাগের প্রসঙ্গ। অনুরূপভাবে হাসান আজিজুল হক তাঁর সাহিত্যে বারবার ফিরে যান বর্ধমানের যবগ্রামে।

‘স্মৃতি’ এবং ‘নতুন অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন’ যেমন ডায়াসপোরা সাহিত্যের বিষয়, তেমনি আমাদের দেশভাগের সাহিত্যের। দেশবিভাগের শিকার যারা তারা মাইগ্রেটেড নন; বলপূর্বক স্থানান্তরিত অর্থাৎ ফোর্সড ডায়াসপোরা। দেশভাগের পর যারা ওপার বাংলায় গেছেন তাদের ইউরোপ-আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের মতোই নতুন করে আত্মপরিচয় নির্মাণ করতে হয়েছে। ফলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘সাঁকোটা দুলছে’ কবিতায় যখন বলেন-

‘মনে পড়ে সেই সুপুরি গাছের সারি

তার পাশে মৃদু জ্যোৎস্না মাখানো গ্রাম

মাটির দেয়ালে গাঁথা আমাদের বাড়ি

ছোট ছোট সুখে স্নিগ্ধ মনস্কাম।

সাঁকোটির কথা মনে আছে, আনোয়ার?

এত কিছু গেল ,সাঁকোটি এখনো আছে

এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার

সাঁকোটা দুলছে, এই আমি তোর কাছে।’

-তখন সেই কবিতার মধ্যে আমরা বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সাহিত্যের সন্ধান পাই।



দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ পড়াশোনার জন্য কিংবা শিক্ষিত মানুষ কাজের জন্য ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গেছেন। পাকাপাকিভাবে সেখানে থেকেও গেছেন অনেকে। স্বাধীনতার পর থেকে শ্রমিক হিসেবে অসংখ্য অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত বাংলাদেশি আরব দেশগুলোতে গেছেন। এখন বাংলাদেশের প্রবাসী নাগরিক কতজন তার সঠিক পরিসংখ্যান কোনো উৎস থেকে জানা যায় না। কারণ যারা গেছেন তাদের অনেকে আবার অবৈধ পথ অবলম্বন করেছেন, কেউ চলে এসেছেন, কেউ কেউ মারা গেছেন যাত্রাপথে, ফলে তাদের হিসাবে আনা মুশকিল। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, এ পর্যন্ত ৯৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন। পূর্বেই বলেছি, শ্রমিক ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক নাগরিক ইউরোপ-অ্যামেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে উচ্চপদে কাজ করছেন, ব্যবসা করছেন, করছেন গবেষণা এবং পড়াশোনা। সেই হিসেবে এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি এখন প্রবাস জীবনযাপন করছেন বলে একটা আপাত ধারণা পাওয়া যায়।

বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত ইউরোপীয় বা আমেরিকান সাহিত্যিকেরা ভারতীয় ডায়াসপোরা লেখকদের মতো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সফল না হলেও মেধার উজ্জ্বল ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বৈশ্বিক পর্যায়ে তেমন আলোচনায় না আসার কারণ ব্যাপকভাবে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা না করা। বাংলাদেশের ভেতরে যেমন ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করার প্রবণতা কম, তেমনি অধিকাংশ বাংলাদেশি লেখক বিদেশে বসে বাংলা ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা করেছেন। বইও প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। তবে তাঁদের লেখায় ডায়াসপোরা বা অভিবাসী জীবনের সংকট উঠে এসেছে। অধিকাংশ বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখক বাংলা ভাষাতে লেখেন বলে আমরা তাঁদের ‘প্রবাসী লেখক’ বলে থাকি। কিন্তু তাত্ত্বিক পরিসরে আলোচনা করতে গেলে তাঁদের ডায়াসপোরা লেখক বলা ভালো। অন্যান্য দেশের ডায়াসপোরা লেখকদের মতো বাংলাদেশের কথিত প্রবাসী লেখকদের লেখার বিষয়বস্তুও থাকে গৃহহীন থাকার বেদনা। ভিনদেশে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার আখ্যান। বাংলা ভাষায় লেখার কারণে কথিত বাংলাদেশি প্রবাসী লেখকরা ডায়াসপোরা লেখক হিসেবে বৈশ্বিক পর্যায়ে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। যতটুকু হয়েছে সেটি সম্ভব হয়েছে ইংরেজি ভাষায় লেখা বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখকদের হাত ধরে। তারাই আজ মূল ধারায় ডায়াসপোরা লেখক হিসেবে গণ্য।

গ.
আলোচনার সুবিধার্থে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সাহিত্যকে আমরা দুভাগে ভাগ করে নিতে পারি:

১. বাংলা ভাষায় রচিত ডায়াসপোরা সাহিত্য/ বা কথিত প্রবাসী সাহিত্য

২. ইংরেজি ভাষায় রচিত ডায়াসপোরা সাহিত্য

বাংলা ভাষায় রচিত ডায়াসপোরা সাহিত্য: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে দিয়ে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। দেশভাগের পর তিনি কর্মসূত্রে পাকিস্তান, নয়াদিল্লি, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, লন্ডন প্রভৃতি স্থানে থেকেছেন। ফরাসি মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘লাল সালু’ উপন্যাসটি ১৯৬৩ সালে প্রথম ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়। L’arbre sans racines শিরোনামে অনুবাদ করেছিলেন লেখকের স্ত্রী আন-মারি ওয়ালীউল্লাহ। ১৯৬৭ সালে লেখক নিজেই সেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘ট্রি উইদাউট রুটস’ শিরোনামে প্রকাশ করেন। প্যারিসে বসে ওয়ালীউল্লাহ লেখেন ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাস দুটি। তবে এর কোনোটিই ডায়াসপোরা সংকট নিয়ে নয়। ষাটের দশকের শেষদিকে লেখক ‘দ্য আগলি এশিয়ান (কদর্য এশীয়)’ নামে ইংরেজি ভাষায় একটি উপন্যাস লেখেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডব্লু. জে. লেদেরে এবং ই.বার্ডিক (১৯৫৮) রচিত ‘দ্য আগলি আমেরিকান (কদর্য মার্কিনী)’ উপন্যাসের প্রত্যুত্তর হিসেবে এটি রচনা করেন। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। তিনি বিদেশে বসে ইংরেজিতে কিছু ছোটগল্পও লিখেছেন। ওয়ালীউল্লাহ দীর্ঘ প্রবাসজীবনের কারণে তাঁর নামে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখকদের জন্য একটি সম্মাননার প্রবর্তন করেছে বাংলা একাডেমি। যদিও সেখানে ডায়াসপোরা শব্দটি ব্যবহার না করে প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক বলা হয়।

৭ বছরের জন্য সৈয়দ শামসুল হকও প্রবাসজীবনে ছিলেন। বিবিসি রেডিওতে বাংলা বিভাগে কর্মরতকালীন তিনি লন্ডনে ছিলেন। অবস্থানকালে তিনি উপন্যাস-কবিতা-নাটক ও গল্প লিখেছেন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ লন্ডনে বসে লেখা। এ সময় তিনি নিজের লেখা উপন্যাস ‘জনক ও কালো কফিন’ ইংরেজিতে অনুবাদও করেন। ‘দ্য ড্রিমইটার’ শিরোনামে ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে সেটা প্রকাশিত হয়েছে। তবে তাঁর লেখায় ডায়াসপোরা জীবনের সংকট সেভাবে আসেনি। তিনি লন্ডনে বসে দেশ নিয়ে লিখেছেন, প্রবাস জীবন নিয়ে নয়।
জীবনের মাঝামাঝি এসে প্রবাস জীবন বেছে নেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরী। প্রায় চার দশক তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। তাঁর সকল স্মৃতি ও নির্মাণের প্রায় অনিবার্য লক্ষ্য ও পরিণতি হয়ে ওঠে ফেলে আসা স্বদেশ। খুব বেশি লেখেননি। বিদেশে প্রবাসী লেখকদের নিয়ে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছেন। প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধানে যখন তিনি কলম তুলে নেন, তখন তাঁর কবিতায় দেশে না থাকার আক্ষেপ বড় হয়ে ওঠে। ডায়াসপোরা লেখক হিসেবে একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ তিনি নিউইয়র্কে বসে লিখেছেন।

একইভাবে স্মৃতির অন্বেষণ দেখি বাংলাদেশের আরেক প্রধান লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের রচনায়। ‘দূরদেশ স্বদেশ’ গদ্যগ্রন্থে সে মনস্তাপের অসংকোচ উচ্চারণ রয়েছে। এক ডজনের মতো গল্পগ্রন্থ ও কয়েকটি ক্ষুদে উপন্যাস লিখেছেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। এসব রচনার তিনি ফিরে গেছেন তাঁর স্মৃতিতাড়িত স্বদেশে। সাড়ে চার দশক স্থায়ী তাঁর প্রবাস জীবন।
কথাসাহিত্যিক দিলারা হাশেম প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতাকে তাঁর সাহিত্যের একটি কেন্দ্রীয় পটভূমি হিসেবে সচেতনভাবে নির্বাচন করেছেন। যেমন তাঁর ‘সদর অন্দর’ উপন্যাসটি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখকদের ভেতর সবচেয়ে বেশি সক্রিয় লন্ডনপ্রবাসী লেখক সালেহা চৌধুরী। তিনি একাধারে অনুবাদক, ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক। সত্তর দশকের শুরুতে তিনি লন্ডনে যান। সেখানে বসে তিনি ২০টির মতো উপন্যাস, ২২টির মতো অনুবাদ ও ১২টি করে শিশুসাহিত্য ও গল্পের বই লিখেছেন। সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে। প্রবাসজীবন তাঁর লেখালেখির অন্যতম প্রধান বিষয়। তাঁর একটা নমুনা দিই- সালেহা চৌধুরীর ‘শতগল্প’ সংকলনে আমরা দেখি ব্রিটেনের পটভূমিকায় ৩২টি, ইতালি-আমেরিকা-ভারত ও আফ্রিকার পটভূমিকায় ৩টি করে এবং মেদিরা ও চীনের পটভূমিকায় একটি করে গল্প স্থান পেয়েছে। এ বছর ‘লন্ডন রূপকথা নয়’ শিরোনামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে পরিবার পাবলিকেশন্স থেকে। এই উপন্যাসে লন্ডনে বসবাসরত নারীদের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও সংকটের কথা উঠে এসেছে।

কবি দাউদ হায়দার স্বেচ্ছায় বা জীবিকার জন্য দেশত্যাগ করেননি। তিনি নির্বাসিত লেখক। অর্থাৎ ফোর্সড ডায়াসপোরা। তাঁর অধিকাংশ উল্লেখযোগ্য কবিতাতেই রয়েছে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নিরন্তর অপেক্ষা ও রক্তক্ষরণ। কবি দাউদ হায়দারের মতো নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন। আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত ও পঠিত লেখক তিনি। স্বদেশে ফিরে আসার বাসনা ও আবেগ তাঁর বিভিন্ন লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে।
কবি শামীম আজাদ প্রায় তিন দশক বিলেতে আছেন। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, অনুবাদ, শিশুতোষগ্রন্থ মিলিয়ে বিলেত ও বাংলাদেশে তাঁর বইয়ের সংখ্যা ত্রিশের বেশি। ১৯৯৭ সালে আমেরিকার বিখ্যাত সাময়িকী ‘দি নিউইয়র্কার’-এর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার অনুবাদ। শামীম আজাদের কবিতার মতো পূরবী বসুর ছোটগল্প-উপন্যাসেও আমরা লেখকের স্বদেশ থেকে দূরে থাকার পীড়া ও নস্টালজিয়া অনুভব করি। পূরবীর গল্পগ্রন্থ ‘জোছনা করেছে আড়ি’ বা ‘নিরুদ্ধ সমীরণে’ সে-কথার সাক্ষ্যভাষ্য রয়েছে। 'যে রবে পরবাসে' শিরোনামে তাঁর একটি গল্প সংকলন আছে প্রবাসজীবন নিয়ে। আরেক কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামান আমস্টারডাম প্রবাস জীবন নিয়ে একটা বই লিখেছেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি ব্রিটেনে আছেন। এর আগে নব্বই দশকে বেশ কয়েক বছর আমস্টারডাম ছিলেন। আরেক কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী। ১৯৭৫ সাল থেকে লন্ডনের বাসিন্দা। জীবিকার পাশাপাশি লেখালেখিতেও সক্রিয় রয়েছেন। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসটির নাম ‘নীলার দ্বিতীয় অন্তর’। পটভূমি, লন্ডনবাসী বিবাহিত এক বাঙালি নারীর সঙ্গে লন্ডনেই তার প্রেমিকের দেখা হওয়ার পরবর্তী জীবন। মুক্তিযুদ্ধের একটি পর্যায় উপন্যাসটির উপজীব্য।

এছাড়াও কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ ও কবি-গল্পকার নাজনীন সীমন দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন ২৮ বছর ধরে। কবি ফেরদৌস নাহার ১৬ বছর ধরে কানাডা আছেন। আজফার হোসেন, ইকবাল হাসান, সৈয়দ ইকবাল, নাজমুন্নেসা পিয়ারী, মাসুদ খান, মুজিব ইরম, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, শামস আল-মমীন, শাহেদ কায়েস, ফকির ইলিয়াস, আবু মকসুদ, তুষার গায়েন, কুলদা রায়, নাহার মণিকা, ফেরদৌস সাজেদিন, এমদাদ রহমান, মিলটন হাসনাত, মৌসুমী কাদেরসহ আরও অনেকে আছেন। উল্লিখিত কথাশিল্পী, কবিদের লেখায় তাঁদের স্বদেশ থেকে দূরে থাকার পীড়া ও নতুন দেশে আত্মপরিচয় নির্মাণের কথা এবং দুই দেশের সাংস্কৃতিক ব্যবধানের প্রসঙ্গ নানাভাবে এসেছে। কয়েকটি কবিতা থেকে উদ্ধৃতি টেনে এ পর্বের প্রথম অংশের ইতি টানছি।

‘নগরী লন্ডনে

বায়ুর বাগানে

বসে আছি শিথিল

শৈত্যে লিমেরিকে অন্ত্যমিলে

দেহখানি ঝুলে আছে দেশে

পলি আর নুনে।’

[ফলোস্বরা/শামীম আজাদ]


‘অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে আকাশ ঢাকা

গায়ে তার জ্বলে কোটি-কোটি প্লাংক্টন

তারই মাঝে একা একটি শ্যামলা মেঘে

সহসা তোমার মুখের উদ্ভাসন।

দূর গ্রহে বসে ভাবছি তোমার কথা

এতটা দূরে যে, ভাবাও যায় না ভালো

ভাবনারা হিম-নিঃসীম ভ্যাকুয়ামে

শোধনে-শোষণে হয়ে যায় অগোছালো।’

[নির্বাসন/মাসুদ খান]


‘সকল প্রকারই ছিল তুচ্ছ, অবান্তর-

শুধুই প্রকৃতি, শুধু প্রকৃতির উচ্ছিষ্টেই তুষ্ট ছিনু বটে;

না মরে পাষাণ দেশ, দিলা দ্বীপান্তর!

তোমার- তোমারই জন্যে তবু আমি দিবা-বিভাবরী

পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি!’

[পুলিপোলাও/সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ]


‘হঠাৎ টুটেছে নিদ্রা রাত্রি কতো দূর, নিজেই পেঁতেছি ফাঁদ নিজেই বিভোর। যদি না কপাল ফাটা রেজারতি রয়, নিজ দেশ রাখি বুঝি পরদেশী হয়! পরবাসী পরবাসী কান্দে তনুমন, হেলায় ভুলেছো পথ কহে গুরুজন। এমত বংশের লোক ডেকে কয় ওরে, ‘যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে’! আমি কী ফিরিবো আর নাই কোনো পথ, উজাইয়ের মাছ আমি পুষেছি অপথ!

কুক্ষণে ধরেছি মায়া বিদেশ বিভ্রম, পয়ার প্রবন্ধ রচে মুজিব ইরম।’

[বৈদেশী/মুজিব ইরম]


‘আমার মৃত্যু হলে

ইংল্যান্ডের স্বপ্নময় মাটিতে

আমার কবর দিও,

ইংল্যান্ডের কিছু জায়গা

চিরকালের জন্যে বাংলাদেশ হয়ে যাবে।’

[দিনরাতরির তসবিদানা/মাজেদ বিশ্বাস]


‘আমি আমার পাঁচটি আঙুল লাটিমের সুতোর বৃত্তে পেছিয়ে

দ্রুত লাটিম দিয়ে মাটির বুকে আঁচড় দিয়েছি,

আর কলমের নিভ জিহ্বায় চেটে চেটে কাগজে

মানচিত্র এঁকেছি, শব্দের পর শব্দ দিয়ে লিখেছি একটি নাম

বাংলাদেশ।’

[মাটি ও মানুষের কাছাকাছি/ফারুক আহমদ রনি]


‘নদীরা সমুদ্রে যায়

নেই শুধু ঠিকানা আমার

আমি তো চৈত্রে ফাটা

কোন এক আকাল খামার। এখানে বৃষ্টি নেই

নেই ছায়া নেই চরাচর? এ যেন বিজন ভূমি

সাহারার ধু-ধু প্রান্তর।’

[আমি/দিলু নাসের]


‘শেষ বার বিয়ারিঙে চড়ে ঘুরে এসেছি গোকুল নগর

বাল্যবন্ধু সেই স্মৃতি সেলাই করে লেখে চিঠি [...] ফিরে আয়

আজো সেই বেতবন, নিসর্গ লুটিয়ে আছে মৃতপ্রায়

পালকের চিহ্ন নেই আর কোনো নাম সেই খামের উপর।’

[নৈশব্দবিলাপের চতুর্দশপদী: সুমন সুপান্ত]
 

 

বি.দ্র.: বাংলাদেশ পর্ব আগামী পর্বে সমাপ্য
 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়