ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

অস্ফুট রণনে ছবিযাপন || কামালুদ্দিন

কামালুদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২৭ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অস্ফুট রণনে ছবিযাপন || কামালুদ্দিন

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া একটি চিত্রকর্ম

শিল্প হচ্ছে জীবন পর্যালোচনা, জীবনের নানা রূপ, নানা রঙের গল্প সঞ্চালন। শিল্পের উৎকর্ষ বা চরিতার্থতা নির্ভর করে শিল্পীর শিল্পের অনুরণনের ওপর। জীবনযাপন আর ছবিযাপন এক নয়। ছবি, ছবি হয়ে না উঠলে ইচ্ছেমতো কেটে ছেঁটে দিই। কোনটি শিল্প সেই রায় কে দেবেন, কোন বিচারক? লালনের একটি কথা আছে- ‘এই দেশে যা পাপ গণ্য অন্যদেশে পূণ্য তাই’। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ছবি সম্পর্কে তাঁর অত্যন্ত আধুনিক মত ঘোষণা করেছেন; তিনি বলেছেন, ‘ছবিটা ছবিই, তার বেশী কিছু নয়, তার কমও নয়’।

‘সময়ের বর্ণনা’ মঞ্জুর দ্বিতীয় একক প্রদর্শনীর মূল প্রতিবেদন। সময়ের আবর্তে তিনি নিজেকে পুঁজি করেছেন শিল্পালোকে। ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে পঁয়ত্রিশটি ছবি নিয়ে গত ২৬ জুন থেকে শুরু হয়েছে এই প্রদর্শনী। চলবে আগামী ৩ জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত।

সময় নির্মম হয়, সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়ে সামনে ছুটতে থাকে, কারো মান অভিমানের তোয়াক্কা করে না। সময়ের বর্ণগুলো সহজে বিবর্ণ হয়ে যায়, তবু শিল্পী সেই পেছনে ফেলে দেওয়া বিবর্ণ গল্পগুলো কুড়িয়ে ধুলোবালি ঝেড়ে সামনে নিয়ে আসেন নিজ দায়িত্বে- এখানেই শিল্পীর দায়বদ্ধতা। মঞ্জুর শিল্পী হিসেবে সংযত, সংহত, স্থিতধী এবং আত্মপ্রত্যয়ী। তিনি ছবিযাপনের অভিজ্ঞতা বা আবেগের তীব্রতা চিত্র পরিসর উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল বর্ণশিখার আশ্রম করে তুলেছেন। যে আশ্রমে কোন বিশ্রাম নেই, যেখানে সব রঙ ও রঞ্জকের নিরবচ্ছিন্ন বিচরণ।

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া একটি চিত্রকর্ম

 

উপরন্তু প্রদর্শনীতে চিত্র পরিসরের বেশীরভাগ জায়গা দখলের দায়ভার শিল্পী জলরঙকে দিয়েছেন। তাতে মনে হয় শিল্পীর সাথে জলরঙের সার্থক সহযোগ আছে। এছাড়া  জলরঙ ছাড়াও অবশিষ্ট কিছু পরিসর তিনি রাঙিয়েছেন এক্রেলিক ও কালি কলম দিয়ে। এমনিতে প্রকরণের প্রজ্ঞা না থাকলে শিল্পী পারঙ্গম হয়ে ওঠেন না। সেই জলরঙের শুদ্ধ আচরণ ফুল আর অস্ত্র। ফুল আর অস্ত্র পরস্পরের বিপ্রতীপ। তাছাড়া অস্ত্র দিয়ে কোন প্রকার যুদ্ধ নেভানো যায় না। অস্ত্রের সাথে অস্ত্রের লড়াই সে তো আগ্নেয়গিরিকে উদ্দীপ্ত  করা। যুদ্ধ নেভাতে গেলে অপর পক্ষের ফুল হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে, অন্যথায় শান্তিচুক্তি আসবে না। আক্ষরিক অর্থে কেউ যুদ্ধে জিতলেও আসলে সবাই হারে। শিল্পী এখানে দোষের তীর ছুড়েছেন সেই চিরচেনা আমেরিকার দিকে, কেন জানি দোষের তীর সবার অজান্তে আমেরিকার দিকে লক্ষ্যবস্তু হয়ে যায়। চিত্রে নিষ্প্রভ এই শিশুটির কান্না ঝর্ণা; আগামীদিনের ভবিষ্যৎকে প্লাবিত করবে, পৃথিবীর সব শিশুর স্বপ্ন ভেসে বেড়াবে অনিশ্চিত কচুরিপানারর মতো। তাই সময় থাকতে শিশুদের স্বপ্নগুলোকে নোঙর দিতে হবে। না হলে ফুলের মতো শিশুরাও সহজে শুভ্রতা হারাবে আগামীতে। এমনিতেও আগামী দিনগুলো শিশুদের জন্য বরাদ্দ।

শিল্পকৃতির মহত্ত্ব ও প্রগাঢ়তায় দিকভ্রান্ত সমাজকে মূর্ত করে তোলে- যেমন নিশ্চল এই দানবীয় সমাজ একটি  ক্ষুদ্রতম হামিংবার্ড এর সাথেও পাঞ্জা লড়ে কব্জির জোর প্রদর্শন করে। অন্যদিকে চিত্রের পটভূমির মানুষগুলো দেখা যাচ্ছে নির্বিকার এবং অনিশ্চয়তার কোল ঘেঁষে যাদের একমাত্র জীবনীকার। ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, সন্ত্রাস, মানব পাচার, হত্যা, লুণ্ঠন, হিংসা এবং জমিদখল এসব বিশেষণের মায়াজাল মোহজাল সভ্য সমাজের টুঁটি চেপে ধরছে। সমাজের মুখোশধারী অমানুষগুলো মানবিকতাকে ছুঁতে পারেনি, তারা পশুত্বকে অনুসরণ করেছে, সেক্ষেত্রে পশু মানবিকতা অনুসরণ করেনি। পশু নিখাঁদ পশু, মানুষ নিখাঁদ মানুষ নয়, এটা মানুষের ব্যর্থতা।

বোতলের ভেতরের অবরুদ্ধ জীবন উপাখ্যানের গল্পকে নিচে ফেলে দিয়ে বোতলের দরজা খুলে জেগে উঠছে সাদা ও হলুদ রঙের দুটি ফুল, যেন মানবিকতার শুভেচ্ছা দূত। এই ফুল দুটির কিছু পাপড়ি দীর্ঘ পরিশ্রান্ত হয়ে নুয়ে আছে। চিত্রের পেছনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় একটি সাবলাইম বিউটি, সত্যিকারার্থে তা নয়- এটি  হচ্ছে সমকালীন সন্ত্রাসবাদের রক্তগর্জন বা ক্রিমসন রেডের আধিপত্য। উপরন্তু কালার চার্টে ক্রিমসন রেডটি উগ্র ও প্রতাপশালী রঙ হিসেবে স্বীকৃত অন্য রঙের সাথে লাগলেই দাঙ্গা লেগে নিজেই বিজেতা বনে যায়। এই চিত্রে শিল্পী চিত্রায়িত করেছেন দুটি জীবন, একটি মানবজীবন অন্যটি পুষ্পজীবন।

‘কালো সুন্দরী’ নামকরণ  নাকি রঙকরণ? কালো নেপথ্যের রঙ, নেপথ্য সব সময় নিঃস্বার্থ হয়। কালো অপ্রকাশিত গল্পের রঙ। কোনো রঙ সুন্দর অসুন্দরের পক্ষ অবলম্বন করে না। অজ্ঞাতসারে হয়ত বা শিল্পী রঙ-বেরঙের দীপ্র উপস্থিতি দেখিয়েছেন। অনুভূমিক একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি সদ্য বিবাহিতা সম্ভ্রম হারানো নারীমূর্তি। বিবাহ বিচ্ছেদের প্রতিরূপ যিনি  কিনা সংসার জীবনের দোরগোড়ায় থমকে গেছেন, অনেক অগোছালো বলিরেখা চিত্রের বাইরে কাঁটাতারের মতো অবদমন করে রেখেছে নববধূকে। অবসন্ন জীবনের দগ্ধ কপালের সিঁদুর লাইনচ্যুত হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে গিয়ে গঙ্গাজলে মিশে গেছে। গয়নাগুলো যেন অপেক্ষায় আছে কখন তাদের বাঁধন খুলে দেবে। সবই আমাদের সমাজ ব্যবস্থার রীতিনীতি।


 

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া একটি চিত্রকর্ম


মোনালিসা রহস্য- সংসক্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। ভিঞ্চি প্রতিকৃতি আঁকতে কখনো আগ্রহী ছিলেন না। ঐ সময় অনেক বিশিষ্টজনকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ ম্যাডোনা লিসার ছবি আঁকতে আগ্রহী হলেন এবং ভাসারির তথ্য মতে মোনালিসার মনকে প্রফুল্ল রাখতে ভিঞ্চি আঁকার সময় একদল বাদকও নিয়োগ দিয়েছিলেন। সেই জগতখ্যাত মোনালিসার ছবিটি উডেন প্যানেলে আঁকা আর মঞ্জুর মোনালিসাও উডেন প্যানেলে আঁকা, তবে বর্ণ প্রয়োগে তিনি তেলরঙের পরিবর্তে কালি কলম ও এক্রেলিক রঙের সংশ্রয় নিয়েছেন। তবু অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আছে। চিত্রে আছে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রিকশা পেইন্টিংয়ের মোটিফ; যেসব এই বাংলার প্রতিচ্ছবি আর কিছু কালি কলমের সারি সারি কয়েকটি দলে বিভক্ত, যেন মনে হচ্ছে ভিঞ্চির বাদক দলের ঐকতান। উষ্ণ হলুদ পটভূমিতে ডানপাশের নিচে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ‘মা’ লেখাটি। কাহ্‌লিল    জিবরানের কথায় মানবজাতির মুখে সবচাইতে সুন্দর শব্দ হচ্ছে ‘মা’ শব্দটি, আর সব চাইতে সুন্দর ডাক হচ্ছে ‘আমার মা’ ডাকটি। চিত্রে শিল্পী নানা ইঙ্গিতের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।

শিল্পী কিসের গল্প শোনাতে চেয়েছেন-  রূপকথার গল্প নাকি জীবনকথার গল্প? গল্পের কথক শিল্পী নিজেই হয়েছেন। তবে এতটুকু প্রতীয়মান যে শিল্পী নিজের যাপিত জীবনের রঙ ও রেখার গল্প শোনাবেন, কারণ রঙ ও রেখার সমন্বয়ে পৃথিবীর সব গল্প প্রকাশ করা যায়। চিত্রের অপ্রসন্ন চাহনি বা অস্ফুট রণন নিজের সব গল্পকে অনেক রেখা দিয়ে রেখাপাত করেছেন। একটু অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে কথা বললে- দৃশ্যত তাঁর চিত্রে রঙের ভারসাম্য রক্ষার তাগিদ বেশি অনুভব করা যায়, তাতে শিল্প সচেতন হয়ে যায়, বেশি সচেতনতা শিল্প কৃত্রিমতার আশ্রয় নেয়।

‘সময়ের বর্ণনা’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে নিজস্ব শৈলীর রচনা বিন্যাস, রেখাঙ্কন, বাস্তবানুগ রঙ লেপন, তুলির খোঁচাখুঁচি ছবিকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাছাড়া বিষয় বিবেচনায় যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ এলেও সবচেয়ে বেশি ফুলের আধিক্য। কারণ শিল্পী নিজের চিত্রভূমি কর্ষণ করে ফুলগাছের বীজ বপন করেছেন, তিনি চেয়েছিলেন আজকের কদর্য সমাজ, নোংরা সমাজ, পুঁজিবাদের সমাজ যেন ফুলগাছের পরিচর্যা করে। তাতে মানুষ নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে দূরে   থাকবে। তাই প্রতিটি ছবি  সাজিয়েছেন পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে, প্রতিটি ছবিতে ফুলের গন্ধ মেখে দিয়েছেন। মঞ্জুর শিল্পরুচির অস্ফুট রণন যেন আমদেরকেও অনুভব করতে শেখায়। তিনি চেয়েছিলেন শিল্পিত সমাজ ব্যবস্থা যেখানে ফুলের বাগিচার বিশ্বায়ন হবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়