ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

জন্মদিন স্মরণে

কাফকা আমাদের কেন দরকার?

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫১, ৩ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাফকা আমাদের কেন দরকার?

|| মুম রহমান ||

A book should serve as the ax for the froyen sea within us- Franz Kafka

আমাদের ভেতরে একটা বরফ জমাট সমুদ্র আছে। সেই সমুদ্রের জমাট বরফ কাটতে হলে কুঠার হিসেবে দরকার বইয়ের। এমন কথা কাফকা বলেছিলেন। আর যে লেখক বইকে আমাদের ভেতরে জমে থাকা বরফের সমুদ্র কাটার কুঠার ভাবে নিঃসন্দেহে বলা যায় তার লেখার একটা গভীরতর উদ্দেশ্য আছে। গভীরতর উদ্দেশ্য নিয়ে কাফকা লেখালেখি করেছেন। পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্যে লেখেননি তিনি। আজ বিশ্বব্যাপী কাফকা অন্যতম সেরা লেখক হিসেবে আলোচিত তা শুধু তার গল্প বলার বাহাদুরি বা ভাষার গুণাগুণের জন্য নয়। বরং ভাবনায়, দর্শনে আর আঙ্গিকে বিশ্ব দরবারে নতুনতর উপাদান দিয়েই তিনি আলোচ্য। আধুনিক কালের সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক হিসেবে কাফকাকে গণ্য করা হয়।

সমকালের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করি, কাফকা পাঠ তাই জরুরি। কিন্তু পুনরায় মনে রাখা প্রয়োজন, গড়গড় করে পড়ে ফেলার মতো লেখক কাফকা নন। কাফকার গল্প অনুধাবন করা ততোটা সহজ নয়। কেননা, প্রচলিত রীতির গল্প বলাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার বাক্য গঠন, চরিত্র নির্মাণ, গল্পের বিষয়- সব কিছুই যেমন তীব্র প্রথাবিরোধী, তেমনি প্রতিবাদী এবং অবশ্যই দুরহ। কিন্ত এই দুরহময়তা কেবল সাহিত্যের বাহাদুরির অস্ত্র নয়। যে সংকটময়, জটিল সময় আর জীবন তিনি যাপন করেছেন তারই প্রতিফলন ঘটেছে তার লেখালেখিতে।

আপতভাবে তার গল্পগলো দুর্বোধ্য, কোথাও বা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। কাফকার গল্প চকিত দর্শনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ধর্ম, চরিত্র, আচরণ নিয়ে ঘোট পাকায়। সরল করে মিষ্টি গল্প লেখেননি তিনি। কাজেই তার গল্পের ভেতরে ঢুকতে হলে বেশ সাধনা করতে হয়। তার গল্প বুঝতে গেলে কিয়েকার্ডের দর্শন যেমন বুঝতে হয়, তেমনি বুঝতে হয় বাইবেলিয় ভাষা, পুরাণ, লোকগাঁথা, ধর্ম-দর্শন। তিনি ধাঁধার মতোই কঠিন করে রেখেছেন নিজের গল্প ভুবন। কিন্তু এই কঠিনেরও রয়েছে মায়া। কাফকা যেন দূর্গম অচেনা দ্বীপ, দূর্গম কিন্তু মায়াবি আকর্ষণে টানে। সেই টানেই পাঠক এগিয়ে যান কাফকার রহস্য জগতে।

যথাবিহিত ভিন্ন পথে হাঁটার কারণে কাফকাকেও কম অবহেলা সইতে হয়নি। তবে নিজের ধর্মমতের কারণেই তাকে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে। কাফকার অন্যতম অপরাধ ইহুদি হওয়া। ইহুদি হওয়ার কারণেই জীবিতকালে এবং মৃত্যুর পরও কাফকা ও তার লেখাকে বহু বাধা পার হতে হয়েছে। অনেক সাহিত্য সমালোচকও কাফকাকে ইহুদি লেখক হিসেবেই দেখতে পছন্দ করেন। আমি বলবো, এটা ছিলো একটা আন্তর্জাতিক মৌলবাদ। লেখক, সে কাফকা বা অন্য যে কেউ, সে সদাই বৈশ্বিক। কোনো জাত, পাত, গোষ্ঠীর জন্য নয়, বড় লেখক তার লেখার গভীরে সদাই মানব জাতি আর মহাবিশ্বের কথা বলেন। নিঃসন্দেহে কাফকা তার ব্যতিক্রম নন। যে কাফকা নাৎসী তাড়িত, যে কাফকা একদা নিজের লেখা পুড়িয়ে ফেলার অনুরোধ করেছিলেন, যে কাফকা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন, সে কাফকা আজ অমর। বিষয়, ভঙ্গি আর ভাষার সুসমন্বয়ে কাফকা বিশ্বে আজ অনুকরণীয় লেখক। সার্ত্র, ক্যামু, বেকেট, বোর্হেস- কম বেশি আধুনিককালের সব দিকপালরাই কাফকা দ্বারা প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত।এই পৃথিবীতে বহু গুরুত্বপূর্ণ লেখক আছেন, অনেক লেখকই বিশ্বকে নতুন নতুন মতবাদ দিয়েছেন। কিন্তু কাফকা সম্ভবত একমাত্র লেখক যিনি নিজেই একটি মতবাদ। ‘কাফকায়েস্ক’ বলে যে মতবাদ আজ বিশ্ব সাহিত্যে স্বীকৃত তা কাফকার রচনার শৈলী ও গঠন থেকেই নেয়া। আর কোনো লেখকের নামে একটি মতবাদ গড়ে ওঠেনি।

স্বভাবতই কাফকায়েস্ক বুঝতে পারলে আমরা কাফকা ও তার লেখা সহজেই অনুধাবন করতে পারবো। ম্যারিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশনারি মতে কাফকায়েস্ক হলো কাফকার লেখার গুণ বা বৈশিষ্ট্য, বিশেষত দুঃস্বপ্নের মতো জটিল, উদ্ভট কিংবা যুক্তিহীন এক জগত। কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে কাফকায়েস্কের ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এ উপন্যাসে দেখি, কেউ হয়তো জোসেফ কে-এর সম্পর্কে মিথ্যাচার করেছে বা কোনো ষড়যন্ত্র করেছে। সে জানে সে কখনোই কোনো অন্যায় করেনি, কিন্তু এক সকালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কোনো কারণ ছাড়াই বন্দী হওয়া নায়ক জোসেফ কে সে অর্থে কোনো বিচারও পায় না। অদ্ভুত অচেনা এক আদালত, সেটা আদালত কিনা তাতেও সন্দেহ আছে সেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এক অহেতুক জটিল, দীর্ঘ ও হতাশাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে যায় জোসেফ কে। অথচ এই জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতা ও বিষাদ এসেছে নেহাতই অর্থহীন, উদ্ভট উপায়ে। কাফকায়েস্ক আসলে এই সীমাহীন উদ্ভট, জটিল ও হতাশাজনক পরিস্থিতির নাম। তথাকথিত আধুনিক আমলাতন্ত্রের অর্থহীন দীর্ঘসূত্রিতার সঙ্গে এর মিল আছে। ধরুন আপনি হাসপাতালে গেলেন, সেখানে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া, ভুল চিকিৎসা এবং জীবন-মৃত্যুর এক জটিল চক্রে আপনি ও আপনার পরিবার আটকে গেলেন উদ্ভটভাবে- এটিই হতে পারে কাফকায়েস্ক ভঙ্গির একটি গল্প। প্রচলিত আইন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফাঁদে ব্যক্তি যেমন আটকে যায়, তেমনি ব্যক্তি নিজেও তার নিজের তৈরি নিয়মের নিগঢ়ে বন্দী হয়ে পড়ে। সর্বোপরি ব্যক্তির সঙ্গে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা ও তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে শুরু হয় অসীম সংঘাত। যেই সংঘাত ক্রমশ উদ্ভট, দীর্ঘতর আর হতাশাজনক পরিবেশের সৃষ্টি করে।

পুরাণকে বারবার নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন কাফকা। প্রমিথিউস গল্পে প্রমিথিউসের বন্দীত্বের চারটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ‘নয়া উকিল’ গল্পে দেখি আলেক্সেন্ডার দ্য গ্রেটের বিশ্ব জয়ের সঙ্গী ঘোড়া বিউসেফ্যালাস বর্তমান যুগে এসে ড. বিউসেফ্যালাস হয়ে গেছে। সে নেহাতই একজন উকিল যে ‘যুদ্ধের কলরব থেকে মুক্ত ও দূরে, সে কেবল বই পড়ে আর প্রাচীন মোটা মোটা পূঁথির পাতা উল্টে যায়।’ ‘প্রহরী’ গল্পে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রহরীকে পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটাই অবিরল। এই পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা তার বহু গল্পেই দেখা যায়। ‘প্রস্থান’ গল্পের ভৃত্য যেন প্রভুর আদেশ বুঝতে পারছে না। প্রভু বেরুতে চাইলে ভৃত্য জানতে চায় সে কোথায় যাবে। প্রভু জানায়, সে এর বাইরে যেতে চায়, এটাই তার একমাত্র গন্তব্য। কাফকার প্রায় সকল গল্পের সকল নায়কেরাই কোনো একটা চক্র থেকে বের হতে চায়। কোথায় যাবে, কেন যাবে, তারচেয়েও বড় কথা এখান থেকে যেতে হবে। ‘ইসাবেলা’ গল্পেও দেখা যায় সুন্দরী নারী ঘোড়া ইসাবেলা জগতটাকে দেখতে চায়। প্রভুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে সে বেরিয়ে আসে। সে বলে, ‘আস্তাবলে কারো কোনো কাজে না-লেগে খামাখা দাঁড়িয়ে না-থেকে আমি বরং এখন দুনিয়াটাও দেখতে চাই, মানে যতক্ষণ পারি, যতক্ষণ এটা করার মতো শক্তি আমার আছে’। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে গন্তব্যে পৌঁছা হয়ে ওঠে না। ‘একটি সাধারণ বিভ্রান্তি’ গল্পে দেখা যাচ্ছে জনৈক ক দেখা করতে চায় খ-এর সঙ্গে। সে চ স্থানে গেলে খ চলে আসে তার এখানে। ক আর খ-এর দেখা হয় না। একদম কাছে আসলেও দেখা হয় না। ‘সম্রাটের কাছ থেকে একটি বার্তা’ গল্পেও দেখি সম্রাট অতি দক্ষ একজন বার্তাবাহককে বিশেষ একজনের কাছে একটি বার্তা দিয়ে পাঠান। কিন্তু বার্তাবাহক অসীম বাধা ঠেলে আসতে থাকে, আসতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।

এটা জানাই, কাফকার অনেক গল্পে মানুষ পশুর মতো আবার পশু মানুষের মতো। ‘ইসাবেলা’ নামের ঘোড়াকে সুন্দরী নারীই মনে হয়। ‘শঙ্কর’ গল্পের কথক পারিবারিক সূত্রে একটি উদ্ভট শঙ্কর প্রাণী পেয়েছে। এই প্রাণীটি আংশিক ভেড়া ও আংশিক বেড়াল, সে আবার কখনোবা কুকুরও হতে চায়। ‘একজন পারিবারিক মানুষের যত্নআত্তি’ গল্পে ওড্রাডেক নামের একটি কাল্পনিক প্রাণীর দেখা পাই। উদ্ভট আকৃতির উদ্দেশ্যবিহীন এই প্রাণীটিও টিকে থাকবে দীর্ঘকাল সেই ভাবনাই গল্পকারকে পীড়িত করে ভীষণভাবে।

কাফকা আইনের ছাত্রই শুধু ছিলেন না, কর্মজীবনের শুরুতে আইনের একজন করণিক হিসেবে আদালতে কাজও করেছেন। কিন্তু প্রচলিত আইনের উপর তার যে খুব আস্থা ছিলো তা বলা যায় না। তার একাধিক গল্পেই আইনের জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতা উঠে এসেছে। ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাস ছাড়াও ‘নয়া উকিল’ ‘উকিলগণ’, ‘আমাদের আইন-কানুনের সমস্যা’ ইত্যাদি গল্পে আইনের এইসব দিক তিনি তুলে ধরেছেন।

কাফকা স্বয়ং ভীষণভাবে ফ্রয়েড দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার গল্পে যে ধাঁধাময় জগত সেটা বুঝতে গেলে ফ্রয়েডিয় মনোবীক্ষণ বোঝা জরুরি। তিনি তার প্রতীকগুলো ফ্রয়েডিয় দৃষ্টিভঙ্গিতেই তুলে ধরেছেন। আমরা কাফকার জীবনী থেকেই জানি তিনি তার বাবাকে ভীষণ ভয় পেতেন, এক ধরণের রহস্যময় ভীতি থেকেই পিতার সঙ্গে তার শত্রুতা ছিলো। বাবা তার সাহিত্য চর্চাকেও গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে মাকেও কাফকা একদা অভিযোগ করেছিলেন যে, তারা তার ভালো চায় না। কাফকার বিশ্বাস ছিলো, অভিভাবকরা তার প্রতি আরেকটু সদয় ও সংবেদনশীল হলে সে হয়তো অন্য রকম হতে পারতো। বাবা-মা’র সাথে তার এই সম্পর্কের টানাপোড়েনের চিহ্ন মেটামরফোসিস সহ একাধিক রচনাতেই দেখতে পাই। বাবাকে লেখা এক চিঠিতে কাফকা বলেছিলেন, ‘আমার লেখা আপনাকে নিয়েই। সেই সব লেখায় আমি কেবল আমার বেদনাকেই তুলে ধরেছি যা দীর্ঘশ্বাস হয়ে আপনার বুকে বাজেনি।’

অন্যদিকে কাফকার সাহিত্য মার্ক্সীয় দৃষ্টিতেও বিবেচনা করা যায়। তিনি নিজেও ব্যক্তি জীবনে বুর্জোয়া শাসন দ্বারা নিপিড়িত বোধ করেছেন। তার একাধিক গল্পের নায়কেরা লড়াই করেছেন বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না কাফকা’র মতো সংবেদনশীল ও সচেতন লেখক নিশ্চয়ই ক্রম-বর্ধনশীল নাৎসীবাদকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাসে জোসেফ কে’র লড়াইটা নাৎসীবাদের বিরুদ্ধেও ব্যাখ্যা করা যায়। এই তথ্যও মনে রাখা দরকার যে, কাফকার তিন বোন নাৎসীদের নির্যাতন ক্যাম্পেই মারা গেছেন। সব কিছু মিলিয়ে যে তীব্র দোলাচল, টানাপোড়েনের ডিজিটাল জীবন আমরা বেছে নিয়েছি সেখানে আমরাও ক্রমশ গ্রিগর সামশার মতো পোকার জীবনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা ক্রমশ জীব-জন্তুর মতোই আচরণ করতে শুরু করেছি। এই সব বিবেচনায় কাফকা একটি আয়নার নাম। যে আয়নায় আমরা নিজেদের জটিল জীবন দেখতে পাবো হয়তোবা। সেই আশাতেই কাফকা পাঠ আমাদের জন্য জরুরি বিবেচ্য।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়